যিলক্বদ ১৪৩৮   ||   আগস্ট ২০১৭

সন্তান : আমার হাতে আল্লাহর আমানত

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমদাদুল হক

মাতা পিতার কাছে সন্তান কত প্রিয় তা বোঝানোর যোগ্যতা সম্ভবত কোনো মানুষের নেই। ভালোবাসার চূড়ান্ত পরিসীমা বুঝাতেই মানুষ সন্তানের ভালোবাসার উপমা দিয়ে থাকে। এক আরব বেদুঈন কতইনা চমৎকার বলেছে, ‘আমার সন্তান তো আমার নিজের কলিজাটিই, যা বক্ষ থেকে বের হয়ে যমিনে চলাফেরা করছে।’ কিয়ামত দিবসের বিভীষিকা বুঝাতে আল্লাহ তাআলা সন্তানের ভালোবাসার কথা দিয়েই বুঝিয়েছেন যে, সন্তান এত প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও সেদিন পিতা মাতার সন্তানেরও খোঁজ রাখার সুযোগ হবে না। মা তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসার সীমা বুঝাতেও কুরআন-হাদীসে সন্তানের এ ভালোবাসা দিয়েই বুঝানো হয়েছে যে, স্বীয় সন্তান থেকেও এঁদেরকে বেশি ভালোবাসতে হবে। জোড়াবদ্ধ হওয়ার পর প্রতিটি জোড়ার এটাই আকাক্সক্ষা থাকে যে তাদের কোল জুড়ে নতুন কেউ আসবে। ফুটফুটে চেহারায় স্বচ্ছ কোমল অন্তর নিয়ে হাসবে। একটু বিলম্ব হলে প্রতীক্ষার প্রহর যে আর শেষ হয় না। অস্থির হয়ে যায়, কখন নতুন মুখটি আসবে। আর যখন সে দুনিয়াতে আসে ঘরের সবাই তো খুশিই, তবে মাতা-পিতার যে কী পরিমাণ খুশি তা বলে বুঝানো সম্ভব নয়। সন্তানটি তাদের কলিজার টুকরা, গর্বের ধন। একে আমাদের মতো করে গড়ে তুলব। তাকে আমরা এটা বানাব ওটা বানাব ইত্যাদি ইত্যাদি। এ হল সন্তান নিয়ে ভাবনার এক পিঠ এবং সাধারণত এটিই দৃশ্যমান। তবে এক্ষেত্রে আরেকটি দিক আছে, এবং সেটিই হল আসল ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা সাধারণত আমাদের ভাবনার বাইরে থেকে যায়। এক সময় মানুষ ছিল না, দুনিয়াও ছিল না। জান্নাত-জাহান্নামও ছিল না। আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলেন মানুষ সৃষ্টি করবেন, উদ্দেশ্য- তারা তাঁর ইবাদত-আনুগত্য করবে, নেক কাজ করবে, মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকবে, অতপর তাঁর ইচ্ছা ও দয়ায় চিরস্থায়ী জান্নাতে বসবাস করবে। তাই তিনি দুনিয়া সৃষ্টি করলেন, জান্নাত-জাহান্নাম তৈরি করলেন। তো এ মানুষ কীভাবে সৃষ্টি করবেন, তিনি চাইলে তো প্রথম মানুষ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষকে একবারেই একসাথে সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেভাবে না করে প্রথমে একজন (আদম আ.) সৃষ্টি করলেন। এরপর তাঁর থেকে তার স্ত্রীকে। অতপর এঁদের থেকে মানুষ সৃষ্টি হবে। এদের থেকে যারা সৃষ্টি হবে তাদের থেকেও একইভাবে মানুষ সৃষ্টি হবে। এভাবে মানুষ সৃষ্টির ধারা অব্যাহত থাকবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা চলতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে একসাথে সৃষ্টি না করে এভাবে মা-বাবার মধ্যমে সৃষ্টি করার রহস্য তো অনেক আছে। তবে সাদামাটাভাবে যে হেকমতটি সহজে বোঝা যায় এবং যার ফলাফল সবার সামনে, তা হল এভাবে সৃষ্টিতে মানুষ একে অপরের সাথে সৃষ্টিগতভাবে সম্পৃক্ত হয়, ফলে তাদের মাঝে আত্মীয়তা, হৃদ্যতা, অন্তরঙ্গতা, একে অপরের সহযোগিতার সম্পর্ক ও টান তৈরি হয়। তাই কেউ কারো পিতা-মাতা হয়, কেউ সন্তান হয়, কেউ ভাই-বোন হয় ইত্যাদি। আজ পুরো মানবজগৎ এভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত। কিয়ামত পর্যন্ত পিতা-মাতার মাধ্যমে যে সন্তানটি দুনিয়াতে আসবে সে আল্লাহ্রই সৃষ্টি- মানব। মানব তাঁরই সে সৃষ্টি, যাকে ইবাদাত-আনুগত্য ও জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এ সৃষ্টি আল্লাহর, আমার হাতে সে আল্লাহর দেয়া আমানত; সে তো আল্লাহরই খলীফা, যার কথা তিনি ফেরেশতাদেরও বলেছেন। ফেরেশতাগণ নেতিবাচক কথা বললেও তিনি তাদেরকে এমন সৃষ্টির ফয়সালার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। وَ اِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلٰٓىِٕكَةِ اِنِّیْ جَاعِلٌ فِی الْاَرْضِ خَلِیْفَةً قَالُوْۤا اَتَجْعَلُ فِیْهَا مَنْ یُّفْسِدُ فِیْهَا وَ یَسْفِكُ الدِّمَآءَ وَ نَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَ نُقَدِّسُ لَكَ قَالَ اِنِّیْۤ اَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ. স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি। তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার সপ্রসংস স্তুতিগান ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, আমি জানি, যা তোমরা জান না। -সূরা বাকারা (২) : ৩০ আল্লাহ তাআলা যখন প্রথম মানবদ্বয়কে দুনিয়াতে অবতরণ করান তখন এ বলে অবতরণ করান- اهْبِطُوْا مِنْهَا جَمِیْعًا فَاِمَّا یَاْتِیَنَّكُمْ مِّنِّیْ هُدًی فَمَنْ تَبِعَ هُدَایَ فَلَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَ لَا هُمْ یَحْزَنُوْنَ وَالَّذِیْنَ كَفَرُوْا وَ كَذَّبُوْا بِاٰیٰتِنَاۤ اُولٰٓىِٕكَ اَصْحٰبُ النَّارِ هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ. তোমরা সকলে এখান (জান্নাত) থেকে নেমে যাও। অতপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোনো হেদায়েত আসবে তখন যারা আমার হেদায়েতের অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। আর যারা কুফরী করবে এবং আমার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করবে তারা জাহান্নামবাসী, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। -সূরা বাকারা (২) : ৩৮-৩৯ প্রেরিত মানুষ তো এখন শুধু দুজন, কিন্তু বলা হয়েছে, তোমরা সকলে নেমে যাও, উদ্দেশ্য এ দুজনসহ এদের সকল বংশধর। আল্লামা সুয়ূতী রাহ. এ আয়াতের পূর্বের আয়াতে- وَ قُلْنَا اهْبِطُوْا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ -এর ব্যখ্যায় বলেন, أنتما بما اشتملتما عليه من ذريتكما অর্থাৎ তোমরা দুজন এবং তোমাদের ঔরসে যত সন্তান আছে সকলে অবতরণ করো। আর এ দুজনসহ আগত সকল সন্তান বা মানবকেই আল্লাহ তাআলা এ কথা বলে পাঠিয়েছেন যে, দেখ দুনিয়াতে যাওয়ার পর তোমাদের নিকট আমার হেদায়েত আসবে, আর তোমরা তা গ্রহণ করে নিবে। প্রতিদানে আমি জান্নাত দেব, অন্যথা করলে তোমাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। তাহলে প্রতিটি সন্তান দুনিয়াতে আসার সাথে সাথে তার প্রতি এ ঘোষণা চলে আসে- সে আল্লাহর খলীফা। আর এজন্যই তিনি প্রতিটি বনী আদমের মাঝে তাঁর ইবাদত-আনুগত্যের, সর্বোপরি হেদায়েত ও জান্নাতের পথে চলার সহজাত যোগ্যতা ও শক্তি দিয়েই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন; কারণ সে তাঁরই খলীফা, তাঁরই প্রিয় সৃষ্টি। প্রসিদ্ধ হাদীসটি প্রায় সকলেরই জানা, নবীজী বলেন- كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ. প্রতিটি সন্তানই ‘ফিতরাত’-এর উপর (হেদায়েত ও সত্যপথ গ্রহণের সহজাত যোগ্যতা নিয়েই) জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু তার মাতা-পিতা তাকে ইহুদী বানায়, খ্রিস্টান বানায় বা অগ্নিপূজারী বানায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৮৫ শুধু তাই নয় সহজাতভাবে হেদায়েতের উপর থাকতে যে বিষয়গুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায় আল্লাহ তাআলা সেগুলো কোনো শিশুকেই (স্বভাবগতভাবে) দেননি, বাকি শিশু যদি পরবর্তীতে পরিবেশ থেকে শিখে নেয় তা ভিন্ন কথা। তো আমার সন্তান, কলিজার টুকরা, যাকে একমাত্র আমার মনে করছি, সে তো আমার হাতে আল্লাহর আমানত- আল্লাহর খলীফা, যাকে আল্লাহ ইবাদত-আখেরাত-জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর সে জন্যই আল্লাহ তার মাঝে সে যোগ্যতা দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যা দিয়ে সে আল্লাহর নিকট থেকে এসে পুনরায় আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে পারে। এ হল সন্তান নিয়ে ভাবনার আরেক দিক। আর জানা কথা এবং বাস্তবতাও এই যে, এ দিকটিই হল ভাবনার আসল দিক। সন্তানের আসল রূপ। কেননা আল্লাহ তাআলা এ মানুষের জন্যই দুনিয়ার সবকিছু সৃজন করেছেন, জান্নাত সাজিয়েছেন, জাহান্নাম বানিয়েছেন। এক সময় সমগ্র দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে একমাত্র মানুষই বাকি থাকবে। দুনিয়া তো নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী, আসল না। আসল তো আখেরাত। কিন্তু হয় কী! যে দিকটি মূল সে দিকে আমরা খুব কমই ভ্রুক্ষেপ করি। ভাবি না যে, সে আল্লাহরও, সে তো আল্লাহর খলীফা। আমরা সাধারণত ভাবি- এ আমার সন্তান সুতরাং তাকে আমি একান্ত আমার ইচ্ছা অনুসারে গড়ব। কে আছে বাধা দেয়ার, কার কী বলার আছে! তার উপর একমাত্র অধিকার আমার। কিন্তু যদি একটু ভেবে দেখি কে তাকে সৃষ্টি করেছেন। যাকে একমাত্র আমার মনে করছি তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, মেধা ও শক্তি-সামর্থ্যসহ তার পুরো অস্তিত্ব কে দান করেছেন? পৃথিবীতে আগমনের পর তার জীবনের জন্য আলো-বাতাস-ভূমিসহ যাবতীয় আবশ্যকীয় উপকরণ কে দান করেছেন? আমি না আল্লাহ? আমি শুধু তাকে বহন করেছি, লালন-পালন করেছি। তাহলে এখন সন্তানকে কার ইচ্ছা অনুযায়ী লালন-পালন করা হবে? আমার ইচ্ছা, না আল্লাহ্র ইচ্ছা? আমি সন্তানকে আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে লালন-পালন করছি; বিজাতীয় কালচারে তাকে গড়ে তুলছি। কাল আমার আদরের সন্তানই যদি আমার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে নালিশ করে আমাকে সম্বোধন করে বলে- আমি অবুঝ ছিলাম তোমরা কেন আমার পথ জান্নাত থেকে ঘুরিয়ে দিলে, দ্বীন কবুলের আমার সহজাত শক্তিকে কেন বিনষ্ট করে দিলে? আমাকে যদি ছোটবেলা থেকেই আমার সহজাত পথে রাখতে এবং আমাকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করতে, তাহলে আজ আমার এ অবস্থা হত না। তা না করে কেন তোমরা আমাকে বিপথগামী করলে? তখন আমরা কী জবাব দেব? ইমাম মালেক রাহ. কাসেম ইবনে মুহাম্মাদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমার স্ত্রী মারা গেলে মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরাযী আমাকে সান্ত¡না দিতে আসেন এবং বলেন, বনী ইসরাঈলে একজন বড় আলেম ছিলেন, খুব ইবাদত বন্দেগী করতেন, মানুষ তার নিকট মাসআলা-মাসায়েল জানতে আসত। তার একজন স্ত্রী ছিল, সে তাকে খুব ভালোবাসত, একদিন স্ত্রী মারা যায়। তখন তিনি এমন ব্যথিত হলেন যে, মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা একটি ঘরে থাকতে লাগলেন এবং দরজা লাগিয়ে দিলেন, কাউকে তিনি সাক্ষাৎ দিচ্ছেন না, সবাই অনেক চেষ্টা করেও তাকে বুঝাতে পারছেন না। অবশেষে একজন মহিলা বিষয়টি জানলেন এবং ঐ আলেমের ঘরের সামনে গেলেন, আর লোকজনকে বললেন আমি একটি মাসআলা জানতে এসেছি, যা ঐ আলেম ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে হবে না। আমাকেই তার সাথে সরাসরি কথা বলতে হবে। এ বলে মহিলা দরজায় বসে থাকতে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন আমাকে তার সাথে সাক্ষাৎ করতেই হবে। তখন এক লোক আওয়াজ দিয়ে আলেমকে বললেন, একজন মহিলা এসেছে তার নাকি আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতেই হবে, সে আপনার দরজায় পড়ে রয়েছে, কোনোভাবেই সরছে না। তখন আলেম অনুমতি দিলে মহিলাটি বলল, আমি একটি মাসআলা জানতে এসেছি। আলেম বললেন, কী মাসআলা? মহিলাটি বললেন, আমি আমার প্রতিবেশী এক নারী থেকে অলংকার ধার নেই এবং অনেক দিন পর্যন্ত তা ব্যবহার করি। এরপর তারা আমার নিকট লোক প্রেরণ করে তা ফেরৎ নেয়ার জন্য, আমি কি এখন তা ফেরত দেব? আলেম বললেন, আল্লাহর শপথ, অবশ্যই। মহিলা বললেন, সেটি তো আমার কাছে অনেক দিন ছিল এবং আমি তা আমার নিজের মত করে ব্যবহার করেছি। আলেম বলেন, তারা তোমাকে সেগুলো অনেক দিন পর্যন্ত ধার দিলেও তারাই ওটার মালিক। তখন মহিলা বললেন, আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন। আল্লাহ আপনাকে যা ধার দিয়েছেন অতপর তা নিয়ে গেছেন, ঐ কারণে আপনি শোকার্ত হচ্ছেন। অথচ তিনিই সেটির মালিক! আলেম তখন নিজের বিষয়টি বুঝতে পারলেন। আল্লাহ ঐ নারীর মাধ্যমে তাকে অনেক উপকৃত করলেন। -মুয়াত্তা মালেক, জানাইয অধ্যায়, হাদীস ৫৫৯ কথা দীর্ঘ হয়ে গেল। মূল কথা হল, আমাদের ভাবা দরকার, আমাদের সন্তান কি একান্তই আমাদের নাকি আমাদের কাছে আল্লাহর আমানত? তারা কি শুধু আমারই সন্তান, না আল্লাহর খলীফা? তাই তাদের ক্ষেত্রে আমাদের কর্মপদ্ধতি কী এবং কী হওয়া দরকার; গুরুত্বের সাথে ভাবা উচিত। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন

 

advertisement