Rabiul Akhir 1439   ||   Januay 2018

পরিবারের সবার জন্য দ্বীনশিক্ষা : আসুন! দ্বীন শিখি দ্বীন শেখাই

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহমান

অনেকেই সন্তানকে মাদরাসায় পড়ানোর আগ্রহ পোষণ করেন। আলেম বানানোর স্বপ্ন লালন করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, দিনমজুর সম্ভবত কোনো শ্রেণিই বাদ নেই। এমন লোকও দেখেছি, যার একটিমাত্র ছেলে এবং কষ্টেসৃষ্টে তার জীবন কাটে। তারপরও ছেলেকে মাদরাসায় পড়াচ্ছেন। তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করছেন। একজন মুসলিমের এমনটিই হওয়া উচিত। সন্তানকে দ্বীনী মাদরাসায় পড়ানো, আলেম বানানো মুমিনের শ্রেষ্ঠ স্বপ্নগুলোর অন্যতম। এ স্বপ্ন সবার হৃদয়ে উদিত হোক। মাদরাসার উদ্যান ইলম পিপাসীদের পদচারণায় মুখরিত হোক। ইতিবাচক নানাদিকের পাশাপাশি একজন নগণ্য তালিবে ইলম হিসেবে বিভিন্ন তালিবে ইলম, তাদের অভিভাবক, পরিবার-পরিজনের সাথে কথা বলে, বিভিন্ন অবস্থা দেখে কিছু শূন্যতাও অনুভূত হয়েছে নিজেরও কিছু অভিজ্ঞতা আছে। ইচ্ছে হচ্ছে, এখানে এ বিষয়ে কিছু মুযাকারা করি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিন। কোনো কোনো পরিবারে কয়েক সন্তানের মধ্যে এক সন্তানকে মাদরাসায় পড়ানো হয়। পড়ানো তো দরকার সবাইকেই, কিন্তু কোনো কারণে তা সম্ভব না হরে করণীয় হচ্ছে, প্রয়োজনীয় দ্বীন শিক্ষা সবাইকে দেওয়া। এটা মুসলিম মাত্রেরই জরুরি। সে যে পেশাই অবলম্বন করুক। যেমন ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, কুরআন তিলাওয়াত, অযু, নামায, যাকাত, রোযা, হজ্বের প্রয়োজনীয় মাসায়েল, হালাল-হারামের বুনিয়াদী বিষয়সমূহ, ইসলামী আদব-আখলাক, দ্বীনের বোধ ও চেতনা, দ্বীনের প্রতি দরদ ও মহব্বত প্রভৃতি বিষয়। এ শিক্ষা এজন্য জরুরি যে, এতে সে ধীরে ধীরে দ্বীনমনষ্ক ও ইসলামীবোধসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারবে। ঈমান ও তাকওয়ার চেতনায় উজ্জীবিত হবে। জীবনাচরণে ন্যায় ও সততার পরিচয় দিতে সক্ষম হবে। দায়িত্ববান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে। এই শিক্ষা সাধারণ শিক্ষায় শক্তি সঞ্চার করবে, আলো ছড়াবে। এর সুফল বয়ে আনতে সহায়তা করবে। প্রয়োজনীয় দ্বীনী ইলম ও বোধ সবসময় জরুরি। বর্তমানে অনেক বেশি জরুরি। এখন বিপথগামিতার উপায়-উপকরণ ও হাতছানি অতীতের চেয়ে বেশি। ওসব উপকরণ এখন বাইরের জগৎ পেরিয়ে চার দেয়ালের ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। এজন্য অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন অভিভাবকগণ যেন সন্তানদের চোখের উপর রাখেন। আসলে চোখের উপর কতক্ষণ রাখবেন। এটা তাদের বিরক্তিরও কারণ হতে পারে। তাই গোড়া থেকে পরিশীলিত করতে হবে। অন্তরে ঈমান ও তাকওয়া বপন করতে হবে। আর এটা সম্ভব কেবল দ্বীনী শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমেই। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এটি বাস্তব উদাহরণ এবং তা অনেকেরই জানা। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. জনগণের খোঁজ-খবর রাখতেন। কে কী করে, কার কী সমস্যা পর্যবেক্ষণ করতেন। একবার রাতের বেলায় সে উদ্দেশ্যে বের হলেন। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি এসে গেল। তখন মধ্যরাত। একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে শুনতে পেলেন, এক বৃদ্ধা তার মেয়েকে দুধে পানি মিশাতে বলছে। মেয়েটি মাকে বলল, আপনি কি শুনেননি, খলীফা আজ কী আদেশ জারি করেছেন? তিনি ঘোষণা করিয়েছেন, কেউ যেন দুধে পানি না মেশায়। বৃদ্ধা বলল, এখন মেশালে না খলীফা দেখবেন, না তার ঘোষণাকারী। মেয়েটি বলল, তারা না দেখলেও আল্লাহ তো দেখবেন। আমার পক্ষে এটা সম্ভব নয় যে, মানুষের সামনে আল্লাহর আনুগত্য করব আর নির্জনে নাফরমানি করব। কত গভীর বোধ ও উপলব্ধি! কী জ্বলন্ত চেতনা ও বিশ্বাস!! নির্জনেও অনৈতিকতাকে অকপটে প্রত্যাখ্যান। এটাই হচ্ছে সত্যিকার ঈমান ও তাকওয়ার ফল, যা অনন্য, অতুলনীয়। এই শিক্ষা পিতা-মাতার উপর সন্তানের হক। এর আওতায় সকল সন্তানকে নিয়ে আসা চাই এবং তা আগে থেকে শুরু করা উত্তম। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে এ ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার উপর নির্ভর করে একটি শিশুর ভবিষ্যৎ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার ভিত্তি শক্ত না হলে পরবর্তীতে তা শোধরানো কঠিন। শৈশবের শিক্ষা পাথরে অঙ্কিত নকশার মতই অন্তরে গেঁথে যায় এবং জীবনাচরণে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। এ শিক্ষার জন্য প্রভাতী মকতব বা স্কুলের ধর্ম শিক্ষা যথেষ্ট নয়; মকতবে তো একেবারে প্রাথমিক কিছু বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়। আর স্কুলের ধর্ম শিক্ষা দ্বারা ইসলাম সম্পর্কে হয়ত কিছু তথ্য ও জ্ঞান অর্জিত হবে, কিন্তু দ্বীনের বোধ ও চেতনা, জযবা ও প্রেরণা জাগ্রত হওয়া কঠিন। তাই এগুলোর পাশাপাশি বয়স অনুপাতে আরো উদ্যোগ-ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সাথে দরকার পিতা-মাতার সন্তানদের নিয়ে এসব বিষয়ে মুযাকারা করা। কিন্তু আমাদের পরিবারগুলোতে দ্বীনী বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনার অনেক অভাব। প্রতিটি পরিবারে দ্বীনী আলোচনার অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। এ ক্ষেত্রে ‘তালীম’ একটি উপলক্ষ বা সহায়ক হতে পারে। প্রতিদিন সুবিধামত সময়ে দ্বীনী কোনো কিতাব থেকে তালীম হবে, যেখানে পরিবারের সকল সদস্য উপস্থিত থাকবেন। একজন পাঠ করবেন, বাকিরা শুনবেন। এটা ঘরের মধ্যে, পরিবারের লোকদের মাঝে দ্বীনী আবহ বিস্তারে সহায়ক হবে। ইসলাম মুসলমানদেরকে আল্লাহর কাছে নেক সন্তান প্রার্থনা করতে বলে। আদি পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বার্ধক্যে উপনীত হয়ে যান; কিন্তু তাঁর কোনো সন্তান জন্মায়নি। জীবনসন্ধ্যায় দাঁড়িয়েও তিনি সন্তানের অভাব বোধ করেছেন। দুআ-কাতর হয়েছেন মহান আল্লাহর দুয়ারে। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন- নেক সন্তান। কুরআনের ভাষায়- رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ হে প্রভু! আমাকে নেক সন্তান দান করুন। -সূরা সাফফাত (৩৭) : ১০০ হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালামেরও চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর কোনো সন্তান জন্মায়নি। জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে তিনি দয়াময় আল্লাহর দরবারে সন্তান প্রার্থনা করেছেন। তবে যেনতেন সন্তান নয়। কাতর-মিনতি করেছেন সেই সন্তান যেন দুটি গুণে গুণান্বিত হয়। ১. আমার ও ইয়াকুব আলাইহিস সালামের (ইলমের) ওয়ারিশ হবে। ২. সেই সন্তান যেন আপনার সন্তুষ্টিধন্য হয়। কুরআনের ভাষায়- قَالَ رَبِّ اِنِّیْ وَهَنَ الْعَظْمُ مِنِّیْ وَ اشْتَعَلَ الرَّاْسُ شَیْبًا وَّ لَمْ اَكُنْۢ بِدُعَآىِٕكَ رَبِّ شَقِیًّا وَ اِنِّیْ خِفْتُ الْمَوَالِیَ مِنْ وَّرَآءِیْ وَ كَانَتِ امْرَاَتِیْ عَاقِرًا فَهَبْ لِیْ مِنْ لَّدُنْكَ وَلِیًّا یَّرِثُنِیْ وَ یَرِثُ مِنْ اٰلِ یَعْقُوْبَ وَ اجْعَلْهُ رَبِّ رَضِیًّا. সে বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! আমার অস্থিরাজি পর্যন্ত জীর্ণ হয়ে গেছে, মাথা বার্ধক্যজনিত শুভ্রতায় উজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছে এবং হে আমার প্রতিপালক! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করে কখনও ব্যর্থকাম হইনি। আমি আমার পর আমার চাচাত ভাইদের ব্যাপারে শঙ্কা বোধ করছি এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। সুতরাং আপনি আপনার নিকট থেকে আমাকে এমন এক উত্তারাধিকারী দান করুন- যে আমারও উত্তরাধিকারী হবে এবং ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম)-এর উত্তরাধিকারও লাভ করবে এবং হে আমার প্রতিপালক! তাকে এমন বানান, যে (আপনার নিজেরও) সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হবে। -সূরা মারইয়াম (১৯) : ৪-৬ সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী আমাদের প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র যবানেও একই কথা উচ্চারিত হয়েছে। তিনিও নেক সন্তানকেই মুমিন-জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ আখ্যা দিয়েছেন- ‘মৃত্যুর পর তিনটি আমল ছাড়া সব আমলের যোগাযোগ রহিত হয়ে যায়। ১. সদকায়ে জারিয়া ২. উপকারী ইলম ৩. নেক সন্তান।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৩১০ এই মহান নবীগণ শুধু নেক সন্তানের কথা বলেছেন কেন? কারণ নেক সন্তানই মা-বাবা ও জাতির ভবিষ্যৎ। শিশুর ভবিষ্যৎ আর জাতির ভবিষ্যৎ একই সুতোয় গাঁথা। নেক সন্তান পরিবার, সমাজ, দেশ সবার জন্য গৌরব ও কল্যাণকর। আর অসৎ সন্তান সবার জন্য কলঙ্ক ও ক্ষতিকর। তাই তাঁরা আল্লাহর কাছে নেক সন্তানের জন্য মুনাজাত-কাতর হয়েছেন এবং এক্ষেত্রে তাঁদের চেষ্টারও কোনো কমতি ছিল না। সুতরাং ছেলেমেয়েকে দ্বীন শিক্ষা দিয়ে নেক, সৎ ও যোগ্য মানুষরূপে গড়ে তুলতে পিতা-মাতার সচেষ্ট হতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমাজে যথেষ্ট শূন্যতা বিরাজমান। যে সন্তানকে দ্বীনী মাদরাসায় পড়ানো হয় তো হয়ই আর যাকে পড়ানো হয় না তাকে অনেক সময় প্রয়োজনীয় দ্বীন শিক্ষা পর্যন্ত দেওয়া হয় না। অথচ দ্বীনী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কোথাও কোথাও দেখা যায় যে, পরিবারের যে ব্যক্তি আলেম তিনি পরিবারের অন্য লোকদের দ্বীন শিক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক নন এবং তাদেরও তার কাছ থেকে শেখার আগ্রহ নেই। আলেম হওয়ার আগে পরিবারের যে দ্বীনী অবস্থা ছিল আলেম হওয়ার পরও সেই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগে যে তিমিরে নিমজ্জিত ছিল এখনো সেখানেই পড়ে রয়েছে। যার পরিণতি হয় অনেকটা ‘বাতির নিচে অন্ধকার’ এ প্রবচনটির মত। অথচ নিজের কল্যাণের পর আলেম হওয়া বা বানানোর প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে পরিবারের কল্যাণ। ইলম দ্বারা প্রথমত উপকৃত হবেন আলেম নিজেই। ইলম অনুযায়ী আমল করে নিজ জীবনকে জ্যোতির্ময় করবেন। দ্বিতীয়ত উপকৃত হবে তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন। তিনি তাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিবেন। তারাও তার কাছ থেকে শিক্ষা করবে। তার আলো থেকে আলো নিয়ে নিজেদের জীবন আলোকিত করবে। এ রকম সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একজন আলেমের মাধ্যমে উৎকৃষ্ট পরিবার নির্মিত হতে পারে। পবিত্র কুরআনের ইরশাদ- وَ مَا كَانَ الْمُؤْمِنُوْنَ لِیَنْفِرُوْا كَآفَّةً فَلَوْ لَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآىِٕفَةٌ لِّیَتَفَقَّهُوْا فِی الدِّیْنِ وَ لِیُنْذِرُوْا قَوْمَهُمْ اِذَا رَجَعُوْۤا اِلَیْهِمْ لَعَلَّهُمْ یَحْذَرُوْنَ. তাদের প্রতিটি (বড়) দল থেকে একটি (ছোট) অংশ বের হয় না কেন, যাতে তারা দ্বীনের বুঝ অর্জন করতে পারে এবং তাদের কওমকে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসবে। ফলে তারা সতর্ক হবে। -সূরা তাওবা (৯) : ১২২ এখানে যিনি দ্বীনের বুঝ অর্জন করেছেন তাকে বলা হয়েছে, তিনি যেন নিজ কওমকে তা শিক্ষা দেন। আর কওমকে বলা হয়েছে তারা যেন সে অনুযায়ী নিজেদের পরিচালিত করেন। আর কওমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ তো পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনই। আসলে আলেমের দায়িত্ব এখানেই শেষ নয়; পরিবার ও সমাজের গণ্ডি পেরিয়ে দেশব্যাপী তাঁর দায়িত্ব। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আদর্শ সমাজ ও দেশ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আলেম হলেন কুরআন-সুন্নাহর ধারক ও বাহক। দ্বীনের দাঈ ও প্রহরী; যিনি নিজে কুরআন-সুন্নাহর গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জন করবেন। তা অপরাপর মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে দিবেন। মানুষকে ন্যায়, শান্তি ও কল্যাণের দিকে ডাকবেন। অন্যায়, অকল্যাণ ও অনৈতিকতা থেকে নিষেধ করবেন। অর্জিত ইলম অনুযায়ী আমল করে মানুষের সামনে এর প্রায়োগিক রূপও তুলে ধরবেন। মানুষের আমল সঠিকভাবে হচ্ছে কি না তাও পর্যবেক্ষণ করবেন। এসকল বৈশিষ্ট্যের কারণেই হাদীসে তাদেরকে নবীগণের ওয়ারিশ আখ্যা দেওয়া হয়েছে- ‘আলউলামা-উ ওয়ারাছাতুল আম্বিয়া।’ নবীজীর এই ইরশাদ থেকে তাদের দায়িত্বের বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা যেমন অনুমান করা যায়, তেমনি অনুভব করা যায় মানবজীবনে তাদের কী প্রয়োজন। আমরা সবাই অনুভব করি, একজন ডাক্তারের কী প্রয়োজন। মানুষের জন্য আলেমের প্রয়োজনীয়তা ডাক্তারের মতই। শারীরিক সুস্থতার জন্য যেমন ডাক্তার দরকার, তেমনি আত্মিক, চারিত্রিক ও নৈতিক সুস্থতা ও উন্নতির জন্যও আলেম দরকার। ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর নাম হয়ত অনেকেই শুনেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর একটি চমৎকার উপদেশ আছে। তিনি বলেছেন, যে শহরে দ্বীনী সমস্যার সমাধানের জন্য আলেম নেই এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যার সমাধানের জন্য ডাক্তার নেই, সেখানে বসবাস করো না। তো তাঁর দৃষ্টিতে ডাক্তার ও আলেমের প্রয়োজনীয়তা সমান। ডাক্তার ও আলেম না থাকলে মানুষ সর্বাঙ্গীণ সুস্থ জীবন যাপন করবে কীভাবে? ইমাম সুফিয়ান সাওরী রাহ. তো স্পষ্টই বলে দিয়েছেন যে, আলেমগণ হলেন ডাক্তার। যারা মানুষের (আত্মিক) রোগ-ব্যাধি নির্ণয় করবেন এবং এর সঠিক ঔষধ বলে দিবেন। এই উক্তিতে আলেমের প্রয়োজনীয়তার দিকটি মূর্ত হওয়ার পাশাপাশি আরেকটি সত্যের দিকেও ইঙ্গিত রয়েছে। তা হল আলেমের কাছে যেতে হবে। সাধারণত ডাক্তার রোগীর কাছে আসেন না; রোগীই তার কাছে যায়। যদিও ইসলামে আলেমের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি নিজে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবেন। তাদের দ্বীন শিক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাবেন। যার শুরুতেই রয়েছে তার পরিবার-পরিজন। সেই সাথে পরিবারের লোকদেরও কর্তব্য তার কাছ থেকে দ্বীন শিক্ষা করা। এক্ষেত্রে লজ্জা-শরম বাধা হওয়া মোটেই উচিত নয়। শিক্ষার ব্যাপারে লজ্জার কিছু নেই। ছোট বড়র কাছ থেকে শিক্ষা করবে। বড়ও প্রয়োজনে ছোটর কাছ থেকে জানবেন। ছেলেমেয়েরা মা-বাবার কাছ থেকে শিখবে। মা-বাবাও প্রয়োজনে তাদের কাছ থেকে জানবেন। ভাই-বোনেরা একে অপরের কাছ থেকে শিক্ষা করবে। ইসলামী ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায় হচ্ছে উস্তায শাগরেদের কাছ থেকে এবং পিতা-মাতা সন্তানের কাছ থেকে অজানা বিষয় জেনে নিতেন। এক্ষেত্রে তারা মোটেই সংকোচ বোধ করতেন না। ইলম শিক্ষার জন্য আমাদের পূর্বসূরিগণ কত দূরদূরান্ত সফর করেছেন। কত দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন। ছোট-বড় নানা বিষয়ের জন্যই তা হয়েছে। এটি আমাদের ইতিহাসের আরেকটি প্রোজ্জ্বল দিক। একটি উদাহরণ দেখুন- আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহ.-এর নাম হয়ত অনেকেই শুনেছেন। তিনি হাদীস, ফিকহ, যুহদ, তাকওয়া সর্বক্ষেত্রে শীর্ষব্যক্তিত্ব ছিলেন। হাসান বসরী রাহ.-এর একটি নসীহত শোনার জন্য তিনি ‘মারব’ থেকে ‘রায়’ অঞ্চলে সফর করেছেন। ‘মারব’ থেকে ‘রায়ে’র দূরত্ব এক হাজার কিলোমিটারেরও বেশি। সেখানে গিয়ে হারূন ইবনে মুগীরার সাথে সাক্ষাৎ করেন। হারূন ইবনে মুগীরা বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক সওয়ারির উপর আরোহণ করে আমার কাছে এলেন এবং হাসান বসরী রাহ.-এর একটি নসীহত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, আমি ইসমাঈল ইবনে মুসলিম থেকে শুনেছি, তিনি হাসান বসরী থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘একজনকে শত্রু বানিয়ে হাজার মানুষকে খুশি করো না।’ আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক বললেন, আমি তো এটার জন্যই এসেছি। লক্ষ করুন, এটি দ্বীনের মৌলিক কোনো বিষয় নয়; একটি নসীহতমাত্র। তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতির এই যামানায়ও এক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া সহজ নয়। আজ থেকে এগারো-বারো শ বছর আগে ঘোড়া, গাধা ও উটের যামানায় তা কত কষ্টের ছিল, সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এই কঠিন কাজটিই তাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছিল, যার মূলে ছিল দ্বীন-তৃষ্ণা। এই গৌরবময় ধারা মিটিমিটি হলেও এখনো কতক জায়গায় জ্বলছে। তাই আমাদের দ্বীন শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী হতে হবে। আর যখন নিজেরাই পরিবারের একজনকে সাগ্রহে মাদরাসায় পাঠিয়েছেন, আলেম বানিয়েছেন, তো তার কাছ থেকে শেখার উৎসাহ থাকবেনা কেন? আর তারই বা কেন থাকবে না নিজের প্রিয়জনদের শেখানোর আগ্রহ?

 

advertisement