Rabiul Akhir 1439   ||   Januay 2018

জ্যোতির্বিজ্ঞানে মধ্যযুগের মুসলমানদের অবদান

ড. গোলাম কাদির লূন

প্রবন্ধটির প্রথম কিস্তি যিলহজ্ব ১৪৩৮ হিজরী/সেপ্টেম্বর ২০১৭ ঈসায়ী সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। ২য় কিস্তি ছাপা হয়েছে গত সংখ্যায়-রবিউল আউয়াল ১৪৩৯ হিজরী/ডিসেম্বর ২০১৭ ঈসায়ী। এ সংখ্যায় এর সর্বশেষ কিস্তি ছাপা হল। এ বিষয়টি সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একাধিক শাস্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যদি কোনো শাস্ত্রজ্ঞের নজরে মূলে বা অনুবাদে কোনো ত্রুটি ধরা পড়ে তাহলে মেহেরবানী করে আমাদের অবহিত করার বিনীত অনুরোধ রইল। -সম্পাদক [মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন এমন ব্যক্তিমাত্রই অবগত আছেন যে, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে মুসলমান পণ্ডিতগণ অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। অনেক কিছুর তো আবিষ্কারও তাঁরা করেছেন। এসব কাজে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তৎকালীন মুসলিম শাসকগণ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণায় অকাতরে অর্থ বিলিয়েছেন তাঁরা। এসব গবেষণাকর্ম পরবর্তী যুগে বিজ্ঞানের উন্নতিতে ব্যাপকভাবে সহায়ক হয়েছে। খোদ পশ্চিমের অমুসলিম বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকগণও এ বাস্তবতা বর্ণনা করেছেন এবং এই সত্যের সাক্ষ্য দিয়েছেন। যদিও একতরফা পড়াশোনা ও হীনম্মন্যতার কারণে অনেক মুসলমান আজ নিজেদের এই ঐতিহ্যের খবর রাখেন না বা স্বীকার করেন না। বিশিষ্ট গবেষক ড. গোলাম কাদির লূন-এর এ সংক্রান্ত একটি প্রামাণ্য নিবন্ধের (কিছু পরিমার্জনের পর) অনুবাদ করেছেন আমাদের স্নেহভাজন মাওলানা ওয়ালিউল্লাহ আবদুল জলীল। তরজমাটি বেশ প্রাঞ্জল হয়েছে। আশা করি পাঠক এতে চিন্তার ও আনন্দের খোরাক পাবেন। -তত্ত্বাবধায়ক] (পূর্ব প্রকাশিতের পর) ৫. জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের আরেকটি অবদান হল, তারা সৌর বছরের এমন একটি ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করেন, যা বর্তমানে প্রচলিত গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের চেয়েও ভালো। মুসলমানরা সৌর বছরের সঠিক দৈর্ঘ্য জানার প্রথম চেষ্টা করেন খলীফা মামুনুর রশীদের আমলে। হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে আলবাত্তানী বছরের দৈর্ঘ্য আবিষ্কার করেন, তা গ্রিকদের বর্ণিত সময়ের বিপরীতে আজকের গ্রহণযোগ্য সময়ের অধিক নিকটবর্তি। জালালুদ্দীন মলিক শাহ-এর যুগে মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতশাস্ত্রবিদ উমর খৈয়াম ‘তারীখে জালালী’ নামে একটি ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করেন। তিনি গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের পর সৌর বছরের দৈর্ঘ্যকাল আবিষ্কার করেন, যা আধুনিক বর্ণনারীতি অনুযায়ী ৩৬৫.২৪২৪ দিন। প্রচলিত গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার, যাকে আমরা খ্রিস্টীয় বছর বলে থাকি- এর দৈর্ঘ্য হল, ৩৬৫.২৪২৫ দিন আর প্রকৃত সৌর বছর হল ৩৬৫.২৪২২ দিন। এখনকার প্রচলিত ক্যালেন্ডারে মূল ক্যালেন্ডার বা সৌর বছর থেকে ০.০০০৩ দিন বাড়তি। যা শুধু ৩৩৩০ বছরে একত্রিত হয়ে একদিন হবে। তখন তারিখে একদিনের ব্যবধান হবে। এর বিপরীতে উমর খৈয়াম যে ক্যালেন্ডার তৈরি করেন তা আজকের ক্যালেন্ডারের চেয়ে এদিক দিয়ে উত্তম-এর মধ্যে মূল সৌর বছর থেকে শুধু ০.০০০২ দিন বাড়তি, যা পাঁচ হাজার বছরে একদিন বাড়তি হবে। প্রচলিত গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারে একদিনের ব্যবধান হবে মাত্র ৩৩৩০ বছরে। আর উমর খৈয়ামের ক্যালেন্ডারে তারিখে একদিন পরিবর্তন করতে হবে ৫০০০ বছর পর। (اردو دائرہ معارف اسلامیہ : ২৭১: ১৪/১) আধুনিক ক্যালেন্ডার বিশেষজ্ঞ ঈঅখঠওটঝ-এর বক্তব্য হল, কোপারনিকাস প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি বছরের একেবারে সঠিক পরিমাণ আবিষ্কার করেন। কিন্তু তার এ বক্তব্য সঠিক নয়। কোপারনিকাস রোমের প্রধান পাদরির ইঙ্গিতে ক্যালেন্ডারে কয়েকটি সংশোধন আনেন এবং বছরের সঠিক দৈর্ঘ্য জানার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার সে সফলতা লাভ হয়নি, যা লাভ হয়েছিল চারশ বছর পূর্বে উমর খৈয়ামের। পরবর্তী বিজ্ঞানীরা সুস্পষ্ট করে দেন বছরের দৈর্ঘ্যে কোপারনিকাসের আটাশ সেকেন্ড ভুল হয়। উমর খৈয়ামের আবিষ্কৃত দৈর্ঘ্য বছরের প্রকৃত দৈর্ঘ্য থেকে শুধু ১১.৩ সেকেন্ড বেশি। উমর খৈয়ামের এ অসাধারণ প্রজ্ঞার স্বীকারোক্তি খ্রিস্টান ঐতিহাসিক ও প্রাচ্যবিদরাও করেছেন। ফিলিপ কে. হিট্টি উমর খৈয়ামের ক্যালেন্ডারের ব্যাপারে লিখেন- This calendar, in the Judgment of a modern scholar, is "somewhat more accurate than ours". (History of the Arabs P. 477) আধুনিক কালের এক বিশেষজ্ঞের মতে এ ক্যালেন্ডার আমাদের ক্যালেন্ডারের চেয়েও বেশি সঠিক। উমর খৈয়াম একজন কবি হিসেবে প্রসিদ্ধ। তার চৌপদী দুনিয়াজোড়া খ্যাত। কিন্তু অনেক কম মানুষই জানে, তিনি উঁচু মাপের গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তিনি মানমন্দিরগুলোতে বছরের পর বছর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দিকনির্দেশনা দেন, যার ফলে التاريخ الجلالي -এর মতো ক্যালেন্ডার প্রস্তুত হয়। ফিলিপ কে. হিট্টি লেখেন- Umar is known to the world primarily as a persian poet and free-thinker; very few realize that he was a frist- class mathematician and astronomer as well. The researches of Al-khayyam and his collaborators resulted in the production of the calendar named after his patron al-Tarikh al-Jalali, which is even more accurate than the Gregorian calendar. The latter leads to an error of one day in 3330 years, where- as al-khayyam's apparently leads to an error of one day in about 5000 years. (History of the Arabs P. 377) পৃথিবী উমর খৈয়ামকে একজন ফারসী কবি ও মুক্তমনা হিসেবে জানে। অনেক কম মানুষই জানে, তিনি উঁচু মাপের গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। তিনি এবং তার সহকর্মী বিজ্ঞানীদের গবেষণায় একটি ক্যালেন্ডার প্রস্তুত হয়, যাকে পৃষ্ঠপোষকের নামে التاريخ الجلالي বলা হয়। যা আজকের প্রচলিত গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের চেয়েও বেশি সঠিক। এতে ৩৩৩০ বছরে একদিনের ব্যবধান হয় আর খৈয়ামের ক্যালেন্ডারের ৫০০০ বছরে একদিনের ব্যবধান হবে। ৬. জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের আরেকটি সোনালী অবদান হল, তারা ইউরোপীয়দের দৃষ্টি মাটির বিছানা থেকে তারাভরা আকাশে নিয়ে যান। তাদের রচিত আরবী কিতাবগুলোর গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু, স্পেনিশ, পর্তুগিজ, ক্যাস্টিলিয়, ফ্রেঞ্চ, জার্মানি ও ইংরেজি অনুবাদগুলোর মাধ্যমে পশ্চিমাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। স্পেনে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা সমাপন করে ইহুদী-খ্রিস্টান পণ্ডিতরা আরবীর জ্ঞানভা-ার ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্য স্মারক স্থাপন করে। তাদের পঞ্জিকার সহায়তায় ১১৪০ খ্রিস্টাব্দে মার্সেইল-এর অধিবাসী রেমন্ড নিজ রচনা এবং আলফোনসো দশম তেরো খ্রিস্টিয় শতাব্দীতে নিজ তত্ত্বাবধানে পঞ্জিকা প্রস্তুত করেন। ফিলিপ কে. হিট্টি পশ্চিমের ওপর মুসলমানদের প্রভাব আলোচনা করতে গিয়ে লিখেন- Finally it was through spanish channels that the Latin west found its Oriental inspiration in astronomy and astrology. The leading Muslim astronomical works were translated in Spain into Latin, and the Alfonsine tables compiled under the aegis of Alfonso X in the thirteenth century were but a development of Arab astronomy. (History of the Arabs P.570) শেষ পর্যন্ত প্রাচ্যের জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষবিদ্যা স্পেনের মাধ্যমেই ল্যাটিনভাষী পশ্চিম দুনিয়াকে প্রভাবিত করেছিল। স্পেনে মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলো ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ হয়। তেরো শতাব্দীতে আলফোনসো দশমের তত্ত্বাবধানে যে আলফোনসাইন সারণী রচিত হয় তা আরবী জ্যোতির্বিজ্ঞানেরই পরিমার্জিত রূপ। তিনি আরো বলেন, মার্সেইল-এর অধিবাসী রেমন্ডের রচনাও অধিকাংশ আযযারকালীর পঞ্জিকা থেকে গৃহিত। আরবদের জ্যোতির্বিজ্ঞান তখন ইউরোপের অন্যান্য অংশে প্রবেশ করতে শুরু করে। খ্রিস্টান শিক্ষক গার্বার্ট (Gerbert) পরবর্তীতে Pope sylvester II নামে প্রসিদ্ধ হন, স্পেনে পড়াশোনার পর জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়গুলো সঙ্গে করে নিয়ে যান। Rheims-এ অবস্থিত নিজ বিদ্যালয়ে শিক্ষা দিতে থাকেন। এগারো শতাব্দীতে আফ্রিকার পাদরী কন্সটান্টিন (মৃত্যু : ১০৮৭) স্পেনে পড়াশোনা শেষ করে রোমে যান। মাউন্ট ক্যাসিনোর উপাসনালয়ে বেনিডিক্ট পাদরিদের সঙ্গে থেকে আরবী গ্রন্থগুলোর অনুবাদ শুরু করেন। তারপর বাথ-এর পাদরি অ্যাডেলার্ড কর্ডোভা থেকে নিজের সঙ্গে করে আরবী কিতাবের বড় একটি অংশ নিয়ে যান এবং নিজ ভাতিজার সহায়তায় অনুবাদ করে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে দেন। বারো শতকে তরজমার কাজ বেশ গতি লাভ করে। এ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ অনুবাদকদের মধ্যে বাথ-এর অ্যাডেলার্ড ছাড়াও ক্রেমোনার অধিবাসী জেরার্ড ও জন ইশবিলী প্রসিদ্ধ। আরবী গ্রন্থের অনুবাদের কাজ পরের শতাব্দীতেও অব্যাহত থাকে। আধুনিক কালে অনুবাদের কাজ ইউরোপের অন্যান্য ভাষা- স্পেনিশ, জার্মানি, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি ও রুশ ভাষায় হয়। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানের তরজমা ও গবেষণার ধারা ইউরোপ ও আমেরিকায় আজও আগ্রহের সঙ্গে হচ্ছে। মধ্যযুগে আরবী থেকে যে তরজমা ল্যাটিন ও অন্যান্য ভাষায় হয়েছিল তার কিছু প্রসিদ্ধ তরজমার বিবরণ নিম্নরূপ : ১. বারো শতাব্দীর শুরুতে বাথ-এর অ্যাডেলার্ড খুওয়ারিযমী পঞ্জিকা ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। ২. বারো শতকের শেষার্ধে ক্রেমোনার জেরার্ড جداول الطليطلي-এর ল্যাটিন তরজমা করেন। এ সংকলনে খুওয়ারিযমী, আলবাত্তানী ও আযযারকালীর পঞ্জিকাগুলোও ছিল। ৩. ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দে জন ইশবিলী আলফারগানী রচিত جوامع علم النجوم الحركات السماوية -এর ল্যাটিন অনুবাদ করেন, যা ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে ফেরেরা থেকে, ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে নুরেমবার্গ থেকে, ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয়। বারো শতাব্দীর শেষার্ধে ক্রেমোনার অধিবাসী জেরার্ডও এর ল্যাটিন অনুবাদ করেন, যা ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বেশ সুসজ্জিত আঙ্গিকে প্রকাশিত হয়। ইয়াকুব আনাতুলী (jacob Anatoli) এ গ্রন্থের হিব্রু অনুবাদ করেছিলেন। এ হিব্রু অনুবাদটিকে ইয়াকুব ক্রিস্টম্যান (Jacob christmann) ল্যাটিন পোশাক পরায়, যা ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ইয়াকুব জুলিয়াস গ্রন্থের মূল আরবী পাঠ ল্যাটিন তরজমা ও ব্যাখ্যাসহ ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে এ্যামস্টারডাম Amsterdam থেকে প্রকাশ করেন। ৪. আবূ মা‘শার বলখী রচিত المدخل الكبير على علم أحكام النجوم -এর অনুবাদ ১১৩৩ খ্রিস্টাব্দে ল্যাটিন ভাষায় করা হয়। এ অনুবাদ খুব সম্ভব জন ইশবিলী করেছিলেন। ১১৪০ খ্রিস্টাব্দে সামান্য সংক্ষেপিত হয়ে জনসম্মুখে আসে। ১৪৮৯/১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে (অঁমংনঁৎম) আউগ্সবুর্র্গ থেকে, ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দে ভেনিস থেকে প্রকাশিত হয়। ল্যাটিন অনুবাদকে তেরো শতাব্দীর শেষের দিকে হিব্রু পোশাক পরানো হয়। আবূ মা‘শারের আরেক গ্রন্থ المدخل الصغير অ্যাডেলার্ড বারো শতকে ল্যাটিন ভাষায় রূপান্তর করে। তার রচিত كتاب القرانات জন ইশবিলী ল্যাটিন অনুবাদ করেন। ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে অঁমংনঁৎম আউগ্সবুর্র্গ থেকে, ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে ভেনিস থেকে প্রকাশিত হয়। এ অনুবাদক আবূ মা‘শারের আরেকটি কিতাব كتاب تحاويل سني العالم ল্যাটিন ভাষায় রূপান্তরিত করেন, যার তিনটি এডিশন ১৪৮৮, ১৪৮৯ ও ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে) অঁমংনঁৎম ( আউগ্সবুর্গ থেকে প্রকাশিত হয়। দুইটি মুদ্রণ ১৪৮৮ ও ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দে ভেনিস থেকে প্রকাশিত হয়। তার রচিত كتاب الصور والحكم عليها -এর অনুবাদ গ্রিক ভাষায় হয়। গ্রিক থেকে ল্যাটিন ভাষায় হয়। ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে এইচ উলফ বাজেল (Augsburg) থেকে প্রকাশ করেন। আবূ মা‘শারের অন্য আরও গ্রন্থের পূর্ণ অথবা আংশিক অনুবাদ হয়েছে। ৫. আলবাত্তানীর زيج الصابي -এর ল্যাটিন তরজমা এক ইংরেজ বারো শতকে করেছিল। পান্ডুলিপিটি দুষ্প্রাপ্য। দ্বিতীয় ল্যাটিন তরজমা আফলাতুন তিফুলী Plato Tiburtinus বারো শতকের শুরুর দিকে করেন। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে নুরেমবার্গ থেকে, ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে Bologna থেকে প্রকাশিত হয়। এর স্পেনিশ তরজমা আলফোনসো দশমের নির্দেশে তেরো শতকে করা হয়। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে এক ইতালীয় প্রাচ্যবিদ زيج الصابي -এর দৃষ্টিনন্দন আরবী সংস্করণ প্রকাশ করেন। এরপর এটি ল্যাটিন তরজমা ও ব্যাখ্যাসহ প্রকাশিত হয়। ৬. হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে, খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে আব্দুল আযীয ইবনে উসমান আলকাবীসী المدخل إلى علم النجوم রচনা করেছিলেন। ১১৪৪ খ্রিস্টাব্দে জন ইশবিলী ল্যাটিন ভাষায় এর অনুবাদ করেন। ১৩৩১ সালে প্যারিস থেকে এর ওপর পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়। ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি পর্যালোচনা জনসম্মুখে আসে। ১৩৬২ খ্রিস্টাব্দে আলকাবীসীর এই কিতাবের ফ্রেঞ্চ তরজমা হয়। ল্যাটিন তরজমা ঈসাগুজি (Isagogi) নামে পনেরো অথবা ষোলো শতকে কমপক্ষে দশবার প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন জন এ গ্রন্থটি একাধিকবার ব্যাখ্যা ও টীকাসহ ১৪৮২, ১৪৮৫, ১৫১২ (দুই বার) ১৫২১ (দুই বার) ভেনিস থেকে প্রকাশ করে। ১৫১২ ও ১৫২১ সালে প্রকাশিত দুইটি মুদ্রণ পৃথক পৃথক প্রকাশক প্রকাশ করেন। ১৫৭৩ সালে এই তরজমা বুনিয়া এবং ১৫২০ সালে লাইডেন থেকে প্রকাশিত হয়। ১৫২১ সালে প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয়। ১৫৬০ সালে এর ব্যাখ্যা কোলোন koln থেকে ছাপা হয়। ১৯০৫ সালে আরেকটি ভাষ্য ফ্লোরেন্স থেকে প্রকাশিত হয়। ১৪৭৩ থেকে নিয়ে ১৫২১ পর্যন্ত ইউরোপে ওই গ্রন্থের আটটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ৭. জাবের ইবনে আফলাহের কিতাব إصلاح المجسطي -এর ল্যাটিন তরজমা বারো শতকে ক্রেমোনার জেরার্ড করেন। এরপর মূসা ইবনে তাব্বুন ১২৭৪ খ্রিস্টাব্দে হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করেন। এরপর ইয়াকুব ইবনে মাজের মূসার ভাতিজা এর আরেকটি হিব্রু অনুবাদ করেন। স্যামুয়েল ইবনে ইয়াহুদ ১৩৩৫ সালে এর পুনঃসম্পাদনা করেন। জেরার্ডের ল্যাটিন অনুবাদ ১৫৩৪ সালে নুরেমবার্গ থেকে প্রকাশিত হয়। ৮. ১১২৬ খ্রিস্টাব্দে বাথ-এর অ্যাডেলার্ড মাসলামা আলমাজরিতীর পঞ্জিকার ল্যাটিন অনুবাদ করেন। ৯. আলবাতরুজী রচিত كتاب الهيئة -এর অনুবাদ মাইকেল স্কট তেরো শতকে করেন। এফজে কারমোডি ১৯৫২ সালে Berkeley থেকে প্রকাশ করেন। ক্লানিমুস Calonymos ইবনে দাউদ كتاب الهيئة -এর আরেকটি তরজমা ল্যাটিন ভাষায় করেন, যা ভেনিস থেকে ১৫৩১ সালে প্রকাশিত হয়। মূসা ইবনে তাব্বুন একে হিব্রু ভাষায় রুপান্তর করেন। বার্নার্ড আর গোল্ডস্টেইন এ তরজমাটির আরবী মূল পাঠ ও ইংরেজিসহ ১৯৭১ সালে দুই খণ্ডে লন্ডন থেকে প্রকাশ করেন। ১০. ১৯৬৭ সালে ইহুদী পণ্ডিত ইবরাহীম ইবনে অযরা ‘মাশাআল্লাহ’র পঞ্জিকা ক্যাস্টলিও ভাষায় এবং তার বন্ধু ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন। ১১. আযযারকালীর পঞ্জিকা الزيج الطليطلي -এর দুটি অনুবাদ হয় ল্যাটিন ভাষায়। একটি তরজমা করেন জেরার্ড, আরেকটি করেন জন ইশবিলী। তার ক্যালেন্ডারের তরজমা ল্যাটিন, হিব্রু, পর্তুগিজ, ক্যাস্টলীয় ভাষায় হয়। ১২. ১১৬০ সালে ইবরাহীম ইবনে আযরা খুওয়ারিযমী পঞ্জিকা অবলম্বনে আলবেরুনী কৃত ভাষ্যগ্রন্থের তরজমা করেন। ১৩. ১১৪৩ সালে টলেমি বিষয়ক মাজরিতীর রচনার তরজমা করেন Hermann The Dalmation। ১৪. ১২৩৬ সালে মাইকেল স্কট বাতরুজীর গ্রন্থের তরজমা করেন। ১৫. নাসীরুদ্দীন তূসী রচিত زيچ ايلخانی -এর তরজমা (অংশিক) হয়েছে ল্যাটিন ভাষায়, যা ১৬৫০ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। (History of the Arabs P. 588-589) আরবী ভাষায় রচিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের গ্রন্থ অনুবাদের এ হল সামান্য ঝলক। এখানে শুধু সেসব কিতাব অনুবাদের আলোচনা করা হয়েছে যেগুলোর নাম সাধারণত ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থে পাওয়া যায়। বাস্তবে তা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর রচিত গ্রন্থরাজির শতভাগের এক ভাগও নয়। অনেক অনুবাদ ল্যাটিন ভাষা ছাড়া অন্যান্য পশ্চিমা ভাষায় হয়েছে, যেগুলো এখনো গবেষণার বাইরে অথবা যেগুলোর লেখক ও অনুবাদকদের নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। শুধু ল্যাটিন তরজমাগুলোর ওপর গবেষণা করে এফ জে কারমোডি একটি গ্রন্থ রচনা করেন।১ অধিকন্তু কোনো কোনো গবেষক বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকীতে জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখেন। যেগুলোর মাধ্যমে অনেক গ্রন্থ ও পঞ্জিকার পরিচয় পর্যালোচনা, আলোচনা ও আলোকপাত জনসম্মুখে আসে। এ পর্যন্ত এমন অনেক প্রবন্ধ ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। ইউরোপের কিছু সাম্প্রদায়িকমনা বিশেষজ্ঞ মুসলমানদের অবদান এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাদের ব্যক্তব্য হল, মুসলমানদের মাঝে কোনো কোপারনিকাস ও নিউটন জন্ম হয়নি। কিন্তু তারা রবার্ট ব্রেফাল্টের এ কথা ভুলে যায়, মুসলমানরা যে অবদান রেখেছে তা ছাড়া কোপারনিকাস ও নিউটনের জন্মই হতো না। এরপর এটাও এক তিক্ত বাস্তবতা- কোপারনিকাস বা ক্যাপলার, গ্যালিলিও কিংবা ট্যুকোব্রাহে সবাই মুসলমানদের গবেষণাজাত আবিষ্কার ও সৃষ্টিগুলোকে অবলীলায় নিজের নামে চালিয়ে দেন। যেমন রাতের চুরি করা সম্পদ দিনের বেলা নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। কোপারনিকাসের কথাই ধরুন, তিনি Bologna ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতার সময় আরব গণিতশাস্ত্রবিদদের গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করেছিলেন। তার গ্রিক ভাষা শেখার একটি কারণ এও ছিল, যেন মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের রচনার গ্রিক অনুবাদগুলো পড়তে পারেন, তার সব খ্যাতির কারণ হল, তিনি তার রচনা উব revolutionibus orbium coelestium গ্রন্থে ‘গ্রহ নক্ষত্রের ঘূর্ণন পৃথিবী কেন্দ্র করে’ এ দর্শন প্রত্যাখ্যান করেন। টলেমির এ দর্শনের বিপরীত মত পোষণ করেন কোপারনিকাস। তিনি বলেন, সমস্ত গ্রহ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে না; বরং সমস্ত গ্রহ সূর্যের পাশে বৃত্তাকারে ঘুরে। সব গ্রহের একই অবস্থা। কোপারনিকাসের এ দর্শনে সূর্য কেন্দ্র হওয়ার ধারণা দেওয়া হয়। কিন্তু এ দর্শন তার নিজস্ব ছিল না। তার আগে গ্রিক গণীতবিদ পিথাগোরাস ও Aristarchus -এরও মতামত ছিল যে, সব সৃষ্টির কেন্দ্র পৃথিবী নয়, সূর্য। কিন্তু এ্যারিস্টটল এ বলে তাদের বিরোধিতা করেন, পৃথিবী যেহেতু সৃষ্টির সেরা জীবের বাসস্থান তাই সমস্ত সৃষ্টিজগতের কেন্দ্রও পৃথিবী হওয়া চাই। এ্যারিস্টটলের বিরোধিতার কারণে পিথাগোরাস ও Aristarchus-এর মত গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। গ্রিক ভাষা থেকে অনূদিত গ্রন্থাবলির মাধ্যমে মুসলমানরা উভয় মত সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তারা একটি যন্ত্রও আবিষ্কার করেন, যা তৈরি করার সময় পৃথিবী ঘূর্ণায়মান হওয়ার দর্শনগুলো সামনে ছিল। এ ছাড়াও মুসলমানরা জ্যোতির্বিজ্ঞানে টলেমির নিয়ম-কানুনগুলোর ত্রুটি চিহ্নিত করে কোপারনিকাসের জন্য পথ সহজ করে দেয়। টলেমির ওপর যারা আপত্তি তুলেছেন তাদের মধ্যে আলবাত্তানী, জাবের ইবনে আফলাহ ও আলবাতরুজী প্রসিদ্ধ। কোপারনিকাসের অধ্যয়নে গ্রিক ও মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পাণ্ডুলিপি থাকত। টলেমির ওপর মুসলমানদের কৃত আপত্তিগুলো তার জানা ছিল। তিনি নিজ গ্রন্থে আলবাত্তানীর অনেক উদ্ধৃতি এনেছেন। জাবের ইবনে আফলাহের Spherical Trigonometry সম্পর্কেও জানতেন। Spherical Trigonometry সম্পর্কেও জাবেরের মতো তার সাধারণ ধারণা ছিল। তিনি এও জানতেন জাবের টলেমির ওপর আপত্তি তুলেছিলেন। তিনি আলবাতরুজীর দর্শন সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। নাসীরুদ্দীন তূসীর বেশ কিছু দর্শন এই ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীর ওখানে পাওয়া যায় এবং তাকে এর স্রষ্টা মনে করা হয়। গত চল্লিশ বছরের গবেষণায় এ মজার বিষয়টি আবিষ্কার হয়েছে যে, কোপারনিকাস নিজ রচনায় চাঁদ ও বুধের যে মডেল উপস্থাপন করেছেন তা মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে শাতেরের কিতাবে হুবহু ছিল। যিনি কোপারনিকাসের জন্মের শত বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছেন। ক্যাপলারের অবস্থা এর চেয়ে ভিন্ন নয়। তিনিও কদমে কদমে মুসলমানদের থেকে সুবিধা নিয়েছেন। মুসলমানদের না জানি কত সৃষ্টি ও আবিষ্কার আছে, যেগুলোকে আজ ক্যাপলারের সম্পদ বলা হয়। ফিলিপ কে. হিট্টি ও J.M Millas -এর বর্ণনা মোতাবেক জোয়ার-ভাটায় চাঁদের যে প্রভাব তার নিয়ম-কানন সম্পর্কে ইউরোপীয়দের আবূ মা‘শার বলখী অবগত করেছেন। কিন্তু এখন এটাকে ক্যাপলারের আবিস্কার গণ্য করা হয়, যিনি আবু মা‘শারের মৃত্যুর ৬৮৫ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। (History of the Arabs P. 378) ওয়েল ডোরান ও ফিলিপ কে. হিট্টির মতানুসারে চশমা ইবনে ফিরনাস আবিষ্কার করেন। (The Age of Faith P. 298) কিন্তু এখন ইউরোপীয়রা বলছে, দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতার কারণে ক্যাপলার চোখের বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। তখন তিনি চশমা আবিষ্কার করেন। অথচ ইবনে ফিরনাস ক্যাপলার জন্মের ৬৮৪ বছর আগের মানুষ ছিলেন। চক্ষু বিষয়েও ক্যাপলারের ওপর ইবনুল হায়সামের অনেক অবদান আছে। তার চিন্তা-চেতনার মধ্যে এই মহান চক্ষু বিশেষজ্ঞের গভীর প্রভাব রয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেলায়ও ক্যাপলার মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার দ্বারা উপকৃত হন। আলবাত্তানীর زيج الصابي এবং ইবনে ইউনুসের الزيج الكبير الحاكمي -এর তরজমা তার সামনে ছিল। এর চেয়ে বড় কথা হল গ্রহের উপবৃত্তাকার ঘূর্ণন যে তিন প্রসিদ্ধ নিয়মে সীমাবদ্ধ তার প্রথম নিয়মটিই আযযারকালী থেকে নেওয়া, যিনি তার জন্মের চারশ বছর আগের মানুষ। একই অবস্থা গ্যালিলিওর, তিনি ইবনে বাজ্জাহর গতিসম্পর্কিত তত্ত্ব থেকে পুঁজি পেয়ে এ্যারিস্ট্যটলের ‘পতনশীল বস্তুর গতি তার ওযন অনুপাতে হয়’- এই মতামতের রদ করেন। ইবনে বাজ্জাহ ছাড়াও অন্যান্য মুসলিম বিজ্ঞানীদেরও এ মতামত ছিল। ‘পতনশীল বস্তুর গতির সম্পর্ক তার পরিমাণের সঙ্গে নয়’। গ্যালিলিও এ দর্শন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এ গল্প তৈরি হয়, তিনি পিসার মিনার থেকে এক পাউন্ড ও দশ পাউন্ডের শিশার বল এক সঙ্গে ছুড়ে দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ঢালুতে পতিত হওয়ার সময় বস্তুর গতি সংক্রান্ত দর্শন সর্বপ্রথম ইবনে বাজ্জাহ উপস্থাপন করেন। ইবনে রুশদের লেখার মাধ্যমে পশ্চিম ল্যাটিনরা তার অবগতি লাভ করে। গ্যালিলিওও সে সম্পর্কে জানতেন। সময় গনার জন্য সর্বপ্রথম প্যান্ডুলামের ব্যবহার ইবনে ইউনুস করেন, যা ইউরোপীয়রাও স্বীকার করেছেন। কিন্তু ইউরোপীয়রা এটাকে গ্যালিলিওর আবিষ্কার বলে থাকে। অথচ ইবনে ইউনূসের মৃত্যুর পাঁচশ বছর পর গ্যালিলিওর জন্ম। আবূ মা‘শার বলখী ২৭ মুহাররম ২১৭ হিজরীতে দূরবীন আবিষ্কার করেন। কিন্তু এখন এটাকে গ্যালিলিওর আবিষ্কার মনে করা হয়। সূর্যপৃষ্ঠে দাগ সর্বপ্রথম ইবনে রুশদ চিহ্নিত করেন। ইউরোপের বইপত্রে লেখা আছে, এ দাগ প্রথম গ্যালিলিওর দূরবীনে ধরা পড়ে, যিনি ইবনে রুশদের ৩৬৬ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। একই অবস্থা ডেনমার্কের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ট্যুকোব্রাহের। তিনি মুসলমানদের গ্রন্থাবলি থেকে প্রভূত সুবিধা নেন। তিনি আলবাত্তানীর প্রচুর উদ্ধৃতি আনেন। তার দুটি মানমন্দিরই মারাগার মুসলিম মানমন্দিরের নমুনায় বানানো হয়েছিল। ইউরোপের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও লেখকরাও স্বীকার করেন, এ ব্যবস্থাপনা, যন্ত্র স্থাপন ও পর্যবেক্ষণ মারাগার মানমন্দিরের নকল ছিল এবং তিনি নিজেও মারাগার মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অনুকরণ করতেন। জ্ঞানগত বিষয়ের ঘৃণিত চৌর্যবৃত্তি দুনিয়ার অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে ইউরোপে ব্যাপক। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানও তাদের হাত থেকে নিরাপদ থাকেনি। পশ্চিমের বড় বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ কাজ করেন। তেরো শতাব্দীতে Robert Grosseteste (মৃত্যু : ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দ) যিনি কিছুদিনের জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। তিনি টলেমির দর্শন রদ করেন। নিজের বইয়ের সব বিষয়বস্তু আলবাতরুজীর গ্রন্থ থেকে চুরি করেন। তিনি টলেমির দর্শন রদ করে সারা ইউরোপে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। স্মর্তব্য, মধ্যযুগের নামকরা বিজ্ঞানীদের একজন হলেন এই রবার্ট। এরচেয়ে হতাশাজনক আচরণ করেন মধ্যযুগের প্রসিদ্ধ গণিতশাস্ত্রবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী Regiomontanus, যিনি মহাবিশ্ব বিষয়ে রচিত De Triangulis-এর চতুর্থ অধ্যায় জাবের ইবনে আফলাহ থেকে চুরি করেন। তার চুরির এ রহস্য কার্ডানো (Cardano) উন্মোচিত করেন। ইউরোপের খ্রিস্টান পাদরীদের আঁচলও এ কারণে কলঙ্কিত। এগারো শতকের খ্রিস্টান পাদরী কুস্তুনতীন আফ্রীকী Constantine The African (মৃত্যু : ১০৮৭) তাদের মধ্যে গণ্য, যারা ল্যাটিন দুনিয়ায় আরবী জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসার করে ইউরোপের ওপর বড় অনুগ্রহ করেছেন। কিন্তু চৌর্যবৃত্তির বেলায় এ দুনিয়াত্যাগী পাদরী দুনিয়া পূজারীদেরও হার মানান। ম্যাক্স মিরহাফ লিখেন- Constantine was a shameless plagiarist claiming for him self many works which he had translated from Arabic into Latin. (The Legacy of Islam P. 346) কনস্ট্যানটাইন একজন নির্লজ্জ চোর। তিনি অনেক কিতাবের লেখক হওয়ার দাবি করেন, যেগুলো তিনি আরবী থেকে ল্যাটিন অনুবাদ করেছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের প্রকৃত অবস্থান নির্ণয় করা এখন কঠিন মনে হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না পশ্চিমা ভাষায় অনূদিত আরবী গ্রন্থাবলির কমপক্ষে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জনসম্মুখে আনা হয়। এখন পর্যন্ত যে গবেষণা হয়েছে তার মাধ্যমে জানা গেছে, ইউরোপে জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞান উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। ফিলিপ কে. হিট্টিও একথা স্বীকার করেছেন- Several of the Moslem works on astronomy were translated in course of time into Latin, especially in Spain, and exercised a determining influence on the development of The science in Christian Europe. (History of the Arabs P. 378) জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে মুসলিমদের অনেক রচনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে স্পেনে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। এ অনুবাদগুলো খ্রিস্টান ইউরোপে বিজ্ঞানের উন্নয়নে মিমাংসাপূর্ণ অবদান রাখে। মুসলমানরা ইউরোপকে শুধু মেধার আলোয় আলোকিত করেননি বরং তাদের দেশে নিজেদের স্মৃতিও অঙ্কিত করে আসেন। ড্রেপারের বক্তব্য অনুযায়ী ইউরোপে সর্বপ্রথম মানমন্দির মুসলমানরাই স্থাপন করেন। ইশবিলিয়ার জিরাল্ডা মিনার এ উদ্দেশ্যেই ১১৯৬ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট গণিত বিশারদ জাবের ইবনে আফলাহের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা হয়। (History of the Intellectual Development of Europe. Vol. II, P. 42) অন্যত্র তিনি লেখেন- The first medical college established in Europe was that founded by Saracens at Salerno, in Italy. The first astronomical observatory was that erected by them at Seville, in Spain. (History of the Conflict Between Religion and Science. p.115) ইউরোপের সর্বপ্রথম মেডিকেল কলেজ, যা আরবরা ইটালির সালারনোতে স্থাপন করে এবং প্রথম মানমন্দির, যা আরবরা স্পেনের ইশবিলিয়াতে স্থাপন করে। স্পেন থেকে যখন মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়া হল তখন খ্রিস্টানরা অজ্ঞতার দরুণ বুঝতেই পারেনি- মিনার দিয়ে কী কাজ হতো। জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে ছিল অন্ধ, তাই মানমন্দিরের বিষয়টি কল্পনাও করতে পারত না। অবশেষে মিনারকে গির্জার ঘণ্টাঘর বানায়। ড্রেপারও এ দুঃখজনক ঘটনা উল্লেখ করেছেন- After the expulsion of the Moors, it was turned into a belfry, the Spaniards not knowing what else to do with it. (History of the Intellectual Development of Europe Vol. II, P. 42) মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়ার পর মিনার গির্জার ঘণ্টাঘরে পরিণত করা হয়। কারণ, স্পেনিশরা জানত না, এটা অন্য কাজেও ব্যবহার করা যায়। যারা এ মিনার নির্মাণ করেছিলেন তারা পৃথিবীবাসীর সঙ্কীর্ণতা জানতেন। পৃথিবী থেকে তাদের স্মৃতিচি‎হ্ন মোছা যাবে। এজন্য তারা নিজেদের অমোছনীয় স্মৃতি আসমানে রেখে যান, মহাকাশে গ্রহের নাম পড়–য়া পাঠক আজও তাদের অক্ষয় স্মৃতি দেখতে পায়। (History of the Intellectual Development of Europe Vol. II, P. 42) ফিলিপ কে. হিট্টি লেখেন- Arab astronomers have left on the sky immortal traces of their industry which every one who reads the names of the stars on an ordinary Celestial sphere can readily discern. Not only are most of the star names in European languages of Arabic origin, such as Acrab (aqrab, scorpion), Algedi (al-Jadi, the kid) Altair (al-tair, the flyer) Deneb (dhanab, tail), Pherkad (farqad, calf) but a number of technical terms, including “azimuth” (al-sumut) “nadir” (nazir) “zenith” (al-samt), are likewise of Arabic etymology and testify to the rich legacy of Islam to Christian Europe. (History of the Arabs P. 572-573) আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের অমর স্মৃতি আকাশের বুকে রেখে যান। মহাকাশে গ্রহের নাম যে পড়ে সেই সহজে তা চিহ্নিত করতে পারবে। শুধু এটুকুই নয় যে, ইউরোপীয় ভাষায় অধিকাংশ গ্রহের নাম আরবী-মূলের। যেমন, Acrab (عقرب) Algedi (الجدي) Altair (الطائر) Deneb (ذنب) Pherkad (فرقد) এ সবগুলোর মূল আরবী, বরং অনেক শাস্ত্রীয় পরিভাষা azimuth (السموات) nadir (نظير) zenith (السمت) ইত্যাদিও আরবী থেকে নিঃসৃত। যেগুলো ইসলামের মূল্যবান উত্তরাধিকারের সাক্ষী, যেগুলো খ্রিস্টান ইউরোপ লাভ করেছে।

 

advertisement