মুমিন প্রতারণা করে না প্রতারিতও হয় না
Mufti Abul Hasan Muhammad Abdullah
ঈমানদার অন্যের সাথেও প্রতারণা করে না, নিজেও প্রতারিত হয় না। অন্যের সাথে প্রতারণা না করা সাধুতা ও দিয়ানতদারির পরিচয় আর প্রতারিত না হওয়া সচেতনতা ও দূরদর্শিতার পরিচয়। মুমিনকে যেমন দিয়ানতদার হতে হয় তেমনি বুদ্ধিমান ও দূরদর্শীও হতে হয়। চারপাশের ঘটনাবলীর যথার্থ বিশ্লেষণে ও সঠিক করণীয় নির্ধারণে বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার বিকল্প নেই।
শিরোনাম থেকেই আজকের আলোচনা শুরু করছি। সাম্প্রতিক কয়েকটি বিষয় নিয়ে পাঠকের সাথে একটু আলোচনা করতে চাই। মনে হচ্ছে সবগুলো বিষয়েই কথাটি প্রযোজ্য।
প্রথমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বায়তুল মুকাদ্দাস (জেরুজালেম)-কে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করা নিয়েই একটু বলি। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল রাষ্ট্রটি যে একটি অবৈধ ও চাপিয়ে দেয়া রাষ্ট্র এটা একটা স্বীকৃত বিষয়। যুগযুগ ধরে যারা এই ভূখণ্ডের অধিবাসী তাদেরকে চরম জুলুম-অত্যাচারের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত করে সেই জায়গায় ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা আছে। সেই দিকে যাব না। শুধু এইটুকু বলি, ১০৯৯ সালে ক্রুসেডারদের ফিলিস্তীন অঞ্চল জবরদখল করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে হাজার হাজার মুসলমানকে কতল করার পর মাত্র ৮৮ বছরের মাথায় ১১৮৭ সালে হিততীন যুদ্ধের পরপরই সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী এই ভূখণ্ডকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এরপর ১৯১৭ সালের ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির ছত্রছায়ায় পুনরায় এই অঞ্চল অধিকৃত হওয়ার পর ১০০ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে মুসলিমবিশে^ আরেকজন সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর আবির্ভাব এখনো ঘটেনি। আর একারণেই ট্রাম্পের মত লোকেরা তাদের কাজগুলো নির্বিঘ্নে করে যেতে সক্ষম হচ্ছেন। খোলা চোখে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প এই কাজটি সম্পন্ন করেছে; কিন্তু সচেতন লোকেরা জানেন যে, এটা ১৯৯৬ সালেই পাশ হওয়া বিল। তবে এইটুকু কথা ঐ বিলে ছিল যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট চাইলে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি রাখতে পারবেন। এই বিল পাশ হওয়ার পর থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা তা ছ’মাস ছ’মাস করে মুলতবি করে আসছিলেন আর নির্বাচনের সময় ঘোষিত কথা অনুযায়ী ট্রাম্প তা কার্যকর করলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প তা কার্যকর করার জন্য বর্তমান সময়টিকে উপযুক্ত সময় কেন মনে করলেন? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে মুসলিম বিশে^র নেতৃবৃন্দের অবস্থা একটু দেখতে হবে। সৌদি আরব, আমিরাত, মিসর প্রভৃতি আরব দেশগুলোর অবস্থা লক্ষ্য করলেই উত্তর বের হয়ে আসবে। বিশেষত সৌদি আরবের অবস্থা থেকে স্পষ্ট যে, সৌদি এখন আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এতে দোষের কিছু ছিল না, যদি আমেরিকার হাতিয়ার হিসেবে না হয়ে স্বতন্ত্র পরাশক্তি হিসেবে গড়ে উঠত। বিশ্ব শান্তির নামে আমেরিকার সাথে সখ্য, প্রথম দিন থেকেই প্রকাশ্যে মুসলিম-বিদ্বেষী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সবার আগে সংবর্ধনা প্রদান এবং তাকে পাশে নিয়ে সৌদি বাদশাহর তলোয়ার হাতে নাচগান- সবই গোটা মুসলিম বিশ্বকে লজ্জায় ফেলেছে। এরই সাথে বাতাসে ভাসছে ট্রাম্পের জামাতা কুশনারের সাথে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমানের সখ্যের সংবাদও। মূলত এই সব বিষয়ই ট্রাম্পকে সুযোগ করে দিয়েছে- আলকুদসকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা দেওয়ার। শাহ ফয়সাল থাকলে কি এমনটা সম্ভব হত!
আরো লজ্জার ব্যাপার হচ্ছে, এ সম্পর্কে ওআইসির বৈঠক হয়েছে ইস্তাম্বুলে। বৈঠকটি জেদ্দায় হতে পারল না কেন? খাদিমে হারামাইন কি তৃতীয় হারামের খাদিম ও মুহাফিয নন? ওআইসির ঐ বৈঠকে দূরের দেশের রাষ্ট্রপতি- প্রধানমন্ত্রীরা যেতে পারলেন, কিন্তু সৌদি, আরব আমিরাত ও মিসর থেকে গেলেন সাধারণ মন্ত্রীগণ।
কাজেই আমাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে; অন্যদের আগ্রাসনের সাথে খবরদার হতে হবে মুসলমানদের বর্তমান নেতৃত্বের ব্যাপারেও। কারণ মুমিন যেমন অন্যের সাথে প্রতারণা করে না, তেমনি প্রতারিতও হয় না।
। দুই।
সম্প্রতি ৬ ডিসেম্বর আইসিটি বিষয়ক মেলা ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১৭-এর উদ্বোধন হয়। এতে অন্যতম ‘প্রধান আকর্ষণ’ বানানো হয়েছিল সোফিয়া নামক একটি রোবটকে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেমে ‘টেক টক উইথ সোফিয়া’ নামে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে তাকে ভাড়া করে আনা হয়েছিল। সাংবাদিকদের তথ্য অনুযায়ী এর জন্য রাষ্ট্রকে ব্যয় করতে হয়েছে ১২ কোটি টাকা। এই রোবটের তথ্য অনলাইনে দেখার পর যে অনুভূতি জেগেছে, দরসে ছেলেদের সাথে সেগুলো আলোচনা করেছি। সে কথাগুলোই পাঠকের সাথেও ভাগাভাগি করছি।
সংবাদে দেখা যাচ্ছে, হল ভর্তি অতিথি-দর্শক একটি রোবটের কিছু যান্ত্রিক কথাবার্তা নিয়ে ব্যাপক মাতামাতি করেছেন। মিডিয়াতেও দেখা গেছে, ব্যাপারটিকে ব্যাপকভাবে আকর্ষণীয় করে তোলার প্রচেষ্টা। ফলে মানুষকেও উল্লসিত দেখা গেল। একটি রোবট নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলছে, প্রধানমন্ত্রীর নাতনীর নামে তার নাম- সে কথাও বলেছে। সবাই খুব উল্লসিত। একই রোবট সৌদি আরবও ঘুরে এসেছে। পাঠক জেনেছেন, সৌদি আরব প্রথমবারের মতো এই রোবটকে নাগরিকত্বও দিয়েছে। তা নিয়ে অনেকে হাসাহাসিও করেছেন। এদিকে যুবরাজ বিন সালমানের ঘোষিত ভিশন ২০৩০-এ যে সিটির কথা বলা হয়েছে তাতেও নাকি থাকবে হাজার হাজার রোবট। সেটি হবে একটি রোবট-সিটি! এই যে রোবট নিয়ে মাতামাতি, এ নিয়ে যে কথাগুলো বলতে চাই তার আগে বলে নিচ্ছি, মানব-উন্নয়ন ও মানুষের সেবায় প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহারের আমরা বিরোধী নই। প্রযুক্তি আল্লাহ তাআলার নিআমত। মানুষ আল্লাহ-প্রদত্ত বিদ্যা-বুদ্ধি ব্যবহার করে কিছু নতুন উপায় উদ্ভাবন করবে- এ তো আল্লাহর অসংখ্য দানেরই এক ক্ষুদ্র অংশ। আল্লাহ তাআলা তো এই গোটা বিশ^ জগৎকে মানুষের জন্যই সৃষ্টি করেছেন-
خَلَقَ لَكُمْ مَّا فِی الْاَرْضِ جَمِیْعًا
পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।
মানুষ যদি নিজের দিকে তাকায় এবং তার চারপাশের প্রকৃতি, উদ্ভিদজগৎ, প্রাণীজগৎ ও আল্লাহর বিচিত্র সৃষ্টির দিকে তাকায় তাহলে যেমন নিজের ক্ষুদ্রতা বুঝতে পারবে তেমনি বুঝতে পারবে যাকে সে নিজের কর্ম মনে করছে তারও ক্ষুদ্রতা।
অন্যদিকে মুসলমান যদি নিজের সমৃদ্ধ অতীতের দিকে তাকায় তাহলেও দেখতে পাবে আবিষ্কারে ও উদ্ভাবনে তারাই ছিল বিশ্বের পথিকৃত। কাজেই নিত্য-নতুন আবিষ্কার এবং এর যথার্থ ব্যবহার কখনোই মুসলমানের কাছে অনভিপ্রেত নয়। এই ভূমিকাটুকুর পর আলোচ্য বিষয়ে যে কথা বলতে চাই তা হচ্ছে :
এক. এটি কি এত মাতামাতির মতো ব্যাপার? রোবট তো অনেক আগে থেকেই আছে এবং বিশে^র বিভিন্ন দেশে রোবট অনেক কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। কে না জানে এখনকার পুঁজিবাদী বিশ্বে প্রত্যেক পণ্য-নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নানাভাবে তার পণ্যের প্রচার করে থাকে। পুঁজিবাদী স্বার্থেই তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা মাতামাতির পরিবেশ তৈরি করে। হংকংয়ের যে কোম্পানিটি এই রোবট উৎপাদন করছে তারা আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য এর নাম দিচ্ছে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’। এটাও তো নতুন কিছু নয়। প্রশ্ন হচ্ছে সফটওয়্যারগুলো আসলে কী? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই তো। তো বিশেষভাবে এটাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে প্রচার-প্রচারণার উদ্দেশ্য যে কী তা বোধ হয় এতক্ষণে পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।
দুই. দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, রোবটটি মেয়ের সাজে কেন? তাহলে এখানে উদ্দেশ্য কি প্রযুক্তি, না মানুষকে আকর্ষণ করা। শুধু প্রযুক্তির দিক থেকে দেখলে এটি কি খুব আকর্ষণীয়? নেতা, সাংবাদিকদের সাথে মাপা মাপা কথা- এতে আশ্চর্যের কী আছে? সম্ভবত ৭১ টেলিভিশনের এক সাংবাদিক বেখেয়ালে পূর্ব নির্ধারিত প্রশ্নের বাইরে কিছু প্রশ্ন করতেই রোবটের ‘বুদ্ধিমত্তা’র পরিচয় প্রকাশিত হয়ে গেল। দেখা গেল সে আর উত্তর দিতে পারছে না। কাজেই হুজুগে না মেতে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা উচিত। মানুষ তো প্রাচীন কাল থেকেই মূর্তি বানিয়ে আসছে। আর এখন ইমেজ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে যে কোনো নেতা-নেত্রীরও অবয়ব তৈরি করা সম্ভব। আর রোবটের কথা বলা, তো কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, যখন ... প্রযুক্তির এইসব আয়োজন-অনুষ্ঠান চলছে তখন রাজধানীতে আরেকটি মেলা চলছিল, পাখি মেলা। একেক পাখির একেক বুলি- ‘অতিথি এসেছে, পিড়ি দাও’ এমন কত বুলি! পয়সাওয়ালারা অনেক দাম দিয়ে কথা বলা পাখি কিনে বাড়ি ফিরেছে। যাইহোক, রেডিও, টেপরেকর্ডারের পর সিডি, ভিসিডি, অডিও, ভিডিওর এত সহজলভ্য প্রযুক্তি-উপকরণের যুগে এই রোবট নিয়ে এত মাতামাতি, রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচের কী অর্থ থাকতে পারে? ওই যে বহু বছর আগে থেকে কল সেন্টারের যন্ত্রগুলো শুধু একটি নম্বর পেয়েই গ্রাহকের একাউন্টের হরেকরকম তথ্য শুনিয়ে আসছে- তা কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নয়?
মুসলিম দেশগুলোর বাস্তব সমস্যা ও প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে দেশে দেশে বিন সালমানেরা হুজুগ সৃষ্টির জন্য এবং ক্ষমতার মসনদকে নির্বিঘ্ন রাখতে যা কিছুই করুক এতে প্রতারিত হওয়া মোটেই উচিত নয়। উম্মাহর যুবসমাজের কর্তব্য নিজেদের পরিচয় ও উম্মাহর বাস্তব সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করা।
তিন. তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশটি একটি শ্রমঘন দেশ। এদেশে শ্রমিক সহজলভ্য বলেই শিল্পপতিরা সাশ্রয়ী মূল্যে শ্রম কিনতে পারছেন। ভবিষ্যতে যদি শ্রমের বাজার রোবট দখল করে তাহলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জীবন-জীবিকার কী উপায় হবে? আর যদি বলেন, শিক্ষিত লোকদের কাজগুলোও রোবট করবে তবে ভবিষ্যত-শিক্ষিত সমাজ এবং বর্তমানে লক্ষ শিক্ষিত বেকারদের কী হবে? একশ্রেণির প্রযুক্তি ব্যবসায়ী মানব জাতিকে কোন্ পথে নিয়ে চলছে?
আরেকটি আশঙ্কাও কেউ কেউ ব্যক্ত করেছেন। আর তা হচ্ছে মানবহত্যাকারী রোবট! আমরা এ নিয়ে বিশদে যেতে চাই না। প্রযুক্তিবিদেরাই বিষয়টি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারবেন। ক্ষমতাবানেরা নিজেদের স্বার্থ-হাসিলের জন্য প্রযুক্তির এই অপব্যবহারের পথে অগ্রসর হলে মানবজীবনের শান্তি-স্বস্তি-নিরাপত্তার কী হাশর হবে তা কি কেউ বলতে পারে? আর প্রযুক্তি কি সবসময় নিয়ন্ত্রণে থাকে? ব্যাপকভাবে বিশ্ব জুড়ে হ্যাকিংয়ের ব্যাপারটি শোনা যায়। কাজেই আমাদের কর্তব্য, প্রতারিত না হওয়া।
। তিন।
ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস এদেশে আসার আগে থেকেই মিডিয়া ও পত্রপত্রিকায় প্রচার-প্রচারণা আরম্ভ হয়েছিল। প্রথমে আবহটা ছিল, রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে পোপ ফ্রান্সিসের আগমন; কিন্তু পরে বাস্তবে যা দেখা গেল তা হচ্ছে, তিনি টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে গেলেনই না; ঢাকায় কিছু রোহিঙ্গাকে নিয়ে আসা হল ‘সমবেদনা গ্রহণ’-এর জন্য। বাংলাদেশে এসে তাকে দেখা গেল প্রধানত খ্রিস্টধর্মীয় যাজকের অভিষেক-অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। বাংলাদেশে যেহেতু আইনগতভাবে যে কোনো ধর্মের লোকেরাই বসবাস করতে পারেন তাই কোনো ধর্মের প্রধান ব্যক্তি অতিথি হয়ে আসতেই পারেন, কিন্তু বিষয়টি গণমাধ্যমে যেভাবে প্রচারিত ও উপস্থাপিত হয়েছে, বিশেষত সরকারি টেলিভিশন যেভাবে লাইভ প্রচার করেছে তাকে বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কী বলা যায়? নিজস্ব ধর্মীয় কাজে যিনি এসেছেন তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে ‘মানবদরদী’ হিসেবে! এইসব প্রচার-প্রচারণায় মেতে ব্যাপকভাবে মুসলিমেরাও খ্রিস্টধর্মের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। এটা যে ধর্মীয় ও সাধারণ বোধ-বুদ্ধি- কোনো বিচারেই বৈধ ও সমীচীন হয়নি তা কি দলীল-প্রমাণ দিয়ে বলার প্রয়োজন আছে?
যারা অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে অতি উৎসাহের সাথে সব ধর্মের লোকদের অংশগ্রহণের কথা বলেন তারা কি মসজিদে হারামের ইমামদের আগমনে, মুসলমানদের ঈদ, কুরবানী ও অন্যান্য ধর্মীয় বিষয়ে সম্পূর্ণ নিষ্প্রভ থাকেন না? আচ্ছা, ওইসব অনুষ্ঠানে কি কোনো ভিনধর্মীকে মুসলমানদের ইবাদতে যোগ দিতে দেখা যায়?
আমরা অন্যান্য ধর্মের লোকদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিরোধী নই, তবে একেতো সেটাও হতে হবে ইসলামের বিধি বিধান অনুসারে, দ্বিতীয়ত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নামে অন্য ধর্মের ধর্মীয় পর্ব-উৎসবে অংশগ্রহণের সুযোগ মুসলমানের নেই। একজন ঈমানদার মুসলমান কীভাবে কুফর ও শিরক সম্পর্কে উদাসীন হতে পারে? কুফর-শিরক এবং এর সকল লক্ষণ ও নিদর্শনের প্রতি অবশ্যই ঈমানদারের অন্তরে ঘৃণা থাকতে হবে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নামে কুফর-শিরক সম্পর্কেও উদাসীনতা ও নিজ আদর্শ বিসর্জনের কোনো সুযোগ নেই।
হযরত ওমর রা.-এর ঐ হাদীস তো আমাদের অনেকেরই জানা আছে। তিনি তাওরাতের একটি কপি পেয়ে তা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে এসেছিলেন এবং পড়তে আরম্ভ করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মোবারকে চরম অসন্তুষ্টির ছাপ ফুটে উঠল। হঠাৎ তা লক্ষ করে ওমর রা. সঙ্গে সঙ্গে তা পড়া বন্ধ করে দিলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন-
أَمُتَهَوِّكُونَ فِيهَا يَا ابْنَ الْخَطّابِ، وَالّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَقَدْ جِئْتُكُمْ بِهَا بَيْضَاءَ نَقِيّةً، لَا تَسْأَلُوهُمْ عَنْ شَيْءٍ فَيُخْبِرُوكُمْ بِحَقٍّ فَتُكَذِّبُوا بِهِ،أَوْ بِبَاطِلٍ فَتُصَدِّقُوا بِهِ، وَالّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ أَنّ مُوسَى كَانَ حَيّا، مَا وَسِعَهُ إِلّا أَنْ يَتّبِعَنِي.
হে খাত্তাবের বেটা! তোমরা কি এ বিষয়ে সংশয়ী?! ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ! আমি তো তোমাদের কাছে আল্লাহর দ্বীন নিয়ে এসেছি শুভ্র-সমুজ্জ্বলরূপে। ওদেরকে কোনো বিষয় জিজ্ঞেস করো না। হতে পারে ওরা কোনো হক কথা বলবে কিন্তু তোমরা তা অস্বীকার করবে অথবা কোনো নাহক কথা বলবে আর তোমরা তা কবুল করবে। ঐ সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ! মূসা যদি জীবিত হতেন তাহলে তাঁরও আমার অনুসরণ ছাড়া অন্য কোনো অবকাশ থাকত না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫১৫৬
মুসলমানকে নিজের দ্বীন ও ঈমান সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন ও সংবেদনশীল থাকতে হবে। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ জাতীয় কথায় বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হওয়া মুমিনের শান নয়।
এজাতীয় দর্শনে সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার নানা নজির আমাদের সামনে আছে। মনে পড়ছে আজানগাছি নামক পশ্চিমবঙ্গের এক ভদ্রলোকের কথা। তার ভক্তরা বছরে একবার প্রেসক্লাবে জমা হয়ে আন্তধর্মীয় অনুষ্ঠান করত। ওখানে সাধারণত দেখা যেত বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকে। বিভিন্ন ধর্মের লোকেরাও হয়ত কিছু থাকত। অতি সম্প্রতি ভারতেও তোলপাড় হয়ে গেল তথাকথিত সর্বধর্মীয় চেতনাবাদী গুরমিত সিংয়ের নানা কর্মকা- নিয়ে।
একই কা- এবার দেখা গেল ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় নেতা পোপের আগমনকে কেন্দ্র করে। শুধু খ্রিস্টানের একান্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে সাধারণ অবুঝ মুসলমানদের সে মুখীই করা হয়নি বরং একটি তথাকথিত সর্বধর্মীয় প্রার্থনা-সভাও করে ফেলা হয়েছে, যাতে অংশগ্রহণ করেছেন কোনো কোনো মুসলিম ধর্মীয় ব্যক্তিরাও। আমাদের মনে হয় না এটা পোপের কাজ; বরং এ দেশীয় কিছু অতি উৎসাহী লোক, যারা নিজেদেরকে ‘অতি উদার’ ‘অতি অসাম্প্রদায়িক’ বলে দেশে-বিদেশে যাহির করতে ইচ্ছুক, সম্ভবত তথাকথিত আন্তধর্মীয় প্রার্থনার পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন। যার যা উদ্দেশ্যই থাকুক, মুসলমানদের অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।
মিডিয়ার কল্যাণে এহেন ঈমান পরিপন্থী ঘটনা গোটা বিশ্বে প্রচারিত হয়েছে, যার দ্বারা দেশে-বিদেশে সরল ও স্বল্পশিক্ষিত মুসলিমদের বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবৈধ এই কর্মটিকে আদর্শ ও অনুসরণীয় মনে করে নিজের দ্বীন-ঈমানকে হুমকির মুখেও ফেলতে পারে। কাজেই এখানেও সেই কথা বলেই শেষ করছি, যা শিরোনামে বলেছি; মুমিন যেমন অন্যের সাথে প্রতারণা করতে পারে না, তেমনি প্রতারিতও হতে পারে না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে দ্বীন ও ঈমান রক্ষা করে চলার তাওফীক দান করুন- আমীন।