দু’জন মেয়রের পরলোকগমন : চাই ঈমানী দৃষ্টি, ঈমানী মূল্যায়ন
সম্প্রতি অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’জন মেয়রের ইন্তিকাল হয়েছে। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। দুই মেয়রের মৃত্যুই জনমনে বেশ নাড়া দিয়ে গেছে। দু’জনই ছিলেন দুনিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অর্থ-বিত্ত, নাম-যশ ক্ষমতা-প্রতিপত্তি, যা কিছু আজকালের মানুষের আরাধ্য তার অনেক কিছুই তাদের ছিল। এবিএম মহিউদ্দিন প্রৌঢ়ত্বে পদার্পণ করলেও আনিসুল হক অভিহিত হতেন তরুণ ও স্মার্ট মেয়র হিসেবে। সম্ভবত একারণে তার মৃত্যু আরেকটু বেশি নাড়া দিয়েছে।
তাদের মৃত্যুর পর যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। মিডিয়ায় এসেছে প্রবন্ধ-নিবন্ধ-স্মৃতিচারণ। এসব আয়োজনে বিষাদ আছে, স্মৃতিকাতরতা আছে এবং সর্বোপরি আনুষ্ঠানিকতা আছে। কিন্তু একজন ঈমানদারের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে জিনিসটির তা নেই।
মেয়র মহিউদ্দিন কিংবা মেয়র আনিসুল হক তাদের মৃত্যু এক অমোঘ বাস্তবতারই দৃষ্টান্ত। দু’জনই ছিলেন পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সময় যখন ফুরিয়েছে কিংবা বলুন সময় যখন এসেছে দু’জনকেই চলে যেতে হয়েছে। তাদের পদ-পদবী, সহায়-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন, ভক্ত-অনুরক্ত, সেবক-সমর্থক সব রয়েছে আপন জায়গায়, কিন্তু তাদেরকে চলে যেতে হয়েছে মাটির নীচে। এটিই এই পৃথিবীর অনিবার্য সত্য, যা বিস্মৃত হওয়া যায়, কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া যায় না। প্রয়াত দুই মেয়র এই সত্যেরই নাড়া দিয়ে যাওয়া দুই দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টান্ত থেকে নিজের জন্য কিছু শিক্ষা ও সচেতনতা অর্জন করা কাম্য এবং এটিই বুদ্ধিমানের পরিচয়।
কুরআন মাজীদের এক শিক্ষা হচ্ছে, اعتبار অর্থাৎ দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নেওয়া। কুরআন মানুষকে যে চিন্তা-নৈতিক উচ্চতায় উন্নীত করতে এসেছে তার এক স্পষ্ট দৃষ্টান্ত হচ্ছে ‘ই‘তিবার’। এটি সৌভাগ্যের সোপান এবং সৌভাগ্যবানের আলামত।
বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন-
الشّقِيّ مَنْ شَقِيَ فِي بَطْنِ أُمِّهِ وَالسّعِيدُ مَنْ وُعِظَ بِغَيْرِه.
অর্থাৎ মন্দভাগ্য সে, যে মাতৃগর্ভেই মন্দভাগ্য (ফলে সে অন্যের অবস্থা থেকে শিক্ষা নেয় না) আর সৌভাগ্যবান সে (যে মাতৃগর্ভেই সৌভাগ্যবান এবং) যে অন্যের দ্বারা শিক্ষা গ্রহণ করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৪৫
তাহলে অন্যের অবস্থা ও পরিণাম থেকে নিজের জন্য শিক্ষা নেওয়া বা না নেওয়া হচ্ছে সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ। এর দ্বারা প্রত্যেকে নিজের অবস্থা বিচার করতে পারে।
অন্যের অবস্থা লক্ষ্য করে নিজের দিকে তাকাবার প্রেরণা যদি জাগে তাহলে তা সৌভাগ্যের লক্ষণ। এই প্রেরণা ও উপলব্ধিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ এগিয়ে যেতে পারে উন্নতি ও আত্মোৎকর্ষের পথে। কাজেই সৌভাগ্যের উপায় মনে করে এর সঠিক ব্যবহার কাম্য। পক্ষান্তরে অন্যের অবস্থা দেখেও যদি নিজের দিকে তাকাবার ফুরসত না ঘটে তাহলে এটা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ। এই বিস্মৃতি ও অবহেলা পরিণামে দুর্ভাগ্যগ্রস্ত করতে পারে। কাজেই সাবধান হওয়া উচিত এবং দুর্ভাগ্যের পথ ছেড়ে সৌভাগ্যের পথে আসা উচিত।
এই যে চেতনা, নিজেকে ও নিজের জীবনকে উন্নতি ও সৌভাগ্যের পথে এগিয়ে নেওয়ার প্রেরণা; এটাই তো সত্যিকারের জ্ঞান। নিজেকে জানার চেয়ে এবং আপন কর্মের পরিণাম সম্পর্কে সচেতন হওয়ার চেয়ে বড় উপকারী জ্ঞান আর কী হতে পারে? এই বাস্তব জ্ঞানেরই এক উপায় হচ্ছে ‘ই‘তিবার’- শিক্ষণীয় বিষয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। বিখ্যাত মনীষী হাতিমে আসাম রাহ. বলেছেন-
من العبرة يزيد العلم ومن الذكر يزيد الحب ومن التفكر يزيد الخوف
শিক্ষাগ্রহণ জ্ঞান বৃদ্ধি করে, স্মরণ বৃদ্ধি করে ভালবাসা আর চিন্তা-ভাবনা বৃদ্ধি করে ভয়।
জীবনকে সঠিক গন্তব্যের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যেমন প্রয়োজন সঠিক জ্ঞানের তেমনি প্রয়োজন ভয় ও ভালবাসার। ‘ইলম’ যেমন ঈমানের এক শাখা তেমনি আল্লাহ ভয় ও ভালবাসাও ঈমানের শাখা। আল্লাহর প্রতি ভালবাসাই তাঁর আনুগত্যকে সহজ করে দেয় আর আল্লাহর ভয় সহায়তা করে তাঁর নাফরমানী থেকে বেঁচে থাকতে। আর সঠিক জ্ঞান নির্দেশ করে সত্য-ন্যায়ের পথ। এই জ্ঞান ও উপলব্ধি এবং এই ভয় ও ভালবাসা, এককথায় মানুষের অভ্যন্তরীণ এই প্রেরণাসমূহ কীভাবে জাগ্রত হয়? এই প্রেরণাসমূহ জাগ্রত হয় চিন্তা-ভাবনা, স্মরণ ও শিক্ষাগ্রহণ দ্বারা। নিজের সম্পর্কে ভাবুন, আল্লাহর নিআমতসমূহ স্মরণ করুন আর চারপাশের সব কিছু থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন, আপনার ভেতরের ঐ সুপ্ত শক্তি জাগ্রত হবে, যা আল্লাহর হুকুমে আপনাকে পরিচালিত করবে সঠিক পথে।
কিন্তু আমাদের চারপাশে আলোচনার যে ধারা, জীবন ও জগতের ঘটনারাজিকে মূল্যায়নের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা কি আমাদেরকে আমাদের নিজেদের সম্পর্কে সতর্ক-সচেতন করছে, না আরো বেশি করে বিস্মৃতি ও উদাসীনতার দিলে ঠেলে দিচ্ছে?
মৃত্যুর মতো একটি ব্যাপার, যা মানব-মনকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেওয়ার কথা এবং মানবের মনে আখিরাতের ফিকির জাগ্রত করার কথা তা-ই কি আমাদেরকে আরো বেশি আয়োজন ও অনুষ্ঠানমুখী করছে না? করে তুলছে না স্মরণ ও স্মৃতিচারণের শিরোনামে আরো বেশি আলাপচারিতামুখী? যা নিঃশেষ করে দিচ্ছে নিজের দিকে তাকাবার এবং একান্তে নিজের পরিণাম নিয়ে ভাববার প্রেরণাকে? যিনি বলেছেন সত্য বলেছেন-
من نظر إلى الدنيا بغير العبرة انطمس من بصر قلبه بقدر تلك الغفلة .
যে দুনিয়াকে দেখে শিক্ষাগ্রহণের আলোহীন চোখে সে পৃথিবীকে (যতটুকু) দেখে তার অন্তর্দৃষ্টি ততটুকু নিষ্প্রভ হয়ে যায়।’
তখন অবস্থা এই হয় যে, মানুষ দেখে, কিন্তু এই দেখা তার কর্ম ও বিশ^াসকে সংশোধন করে না; মানুষ শোনে, কিন্তু সেটা তার জীবন ও কর্ম গঠনে কোনো প্রভাব ফেলে না। এ যেন তাদের অবস্থা, যাদের সম্পর্কে কুরআন বলছে-
لَهُمْ قُلُوْبٌ لَّا یَفْقَهُوْنَ بِهَا وَ لَهُمْ اَعْیُنٌ لَّا یُبْصِرُوْنَ بِهَا وَ لَهُمْ اٰذَانٌ لَّا یَسْمَعُوْنَ بِهَا اُولٰٓىِٕكَ كَالْاَنْعَامِ بَلْ هُمْ اَضَلُّ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْغٰفِلُوْنَ.
তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দ্বারা দেখে না এবং তাদের কান আছে, কিন্তু তা দ্বারা শোনে না। এরা পশুর ন্যায়; বরং আরো বিভ্রান্ত। এরাই গাফেল। -সূরা আ‘রাফ (৭) : ১৭৯
অন্য আয়াতে-
فَاِنَّهَا لَا تَعْمَی الْاَبْصَارُ وَ لٰكِنْ تَعْمَی الْقُلُوْبُ الَّتِیْ فِی الصُّدُوْرِ .
বস্তুত চক্ষু তো অন্ধ নয়, অন্ধ হচ্ছে বক্ষস্থিত হৃদয়। -সূরা হজ¦ (২২) : ৪৬
আমাদের পূর্বসূরি সাহাবা-তাবেয়ীন, যাঁরা ছিলেন উন্নত কর্ম ও নির্মল জীবনের আদর্শ নমুনা তাঁদের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।
তাঁদের চোখ ও হৃদয় দুই-ই ছিল সজাগ, তাই যা তাঁরা দেখতেন তা হৃদয় দ্বারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হতেন। তাঁরা শুধু বাইরের পরিপাটিতায় ব্যস্ত থাকতেন না, কলব ও হৃদয়েরও যত্ন নিতেন।
বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর অন্তরের পরিচর্যার জন্য কোনো বিরাণ ঘরের সম্মুখে চলে যেতেন এবং বেদনা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলতেন-
أين اهلك
কোথায় তোমার অধিবাসী?
এরপর নিজেকে সম্বোধন করে বলতেন-
كل نفس هالك إلا وجهه
অর্থাৎ এক আল্লাহ ছাড়া আর সবাই মরণশীল।
-তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৪৩৯
খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর এই বাণী তো সুপ্রসিদ্ধ-
كل يوم يقال : مات فلان وفلان ولا بد من يوم يقال : مات عمر
প্রতিদিন ঘোষণা হয়, অমুকের মৃত্যু হয়েছে, অমুকের মৃত্যু হয়েছে। একটি দিন তো অবশ্যই এমন আসবে যেদিন বলা হবে, ওমরের মৃত্যু হয়েছে।
এ হচ্ছে অন্যের অবস্থা থেকে নিজের সম্পর্কে সচেতন হওয়ার দৃষ্টান্ত।
কাজেই যে চলে গেল শুধু তার স্মৃতিচারণেই বাধা পড়ে থাকা নয়, নিজের কথাও একটু ভাবুন, আপন বিশ^াস ও কর্মের হিসাবও একটু মিলিয়ে দেখুন। যে গেছে সে তো চলেই গেছে, আপনার হাতে যে ক’টি মুহূর্ত এখনো অবশিষ্ট আছে সেগুলোর প্রতি একটু সদয় হোন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসে কবর যিয়ারতের যে তারগীব, তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই তো নিজের সম্পর্কে সচেতন হওয়া-
إِنِّي كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا؛ فَإِنّهَا تُذَكِّرُ الْآخِرَةَ
আমি তোমাদের কবর-যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। তো এখন যিয়ারত কর। কারণ তা আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩০০৫
গোরস্তানে মাটির ঢিবিগুলোর নীচে যারা শায়িত, এ কি শুধু তাদেরই নিয়তি, না এ আমাদেরও ললাট-লিখন? কেউ কি পারবে নিয়তির এই লিখন খণ্ডাতে?
অবশ্যই সকল প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া, একমাত্র তিনিই চিরজীবী। ষ