Safar 14439   ||   November 2017

কুরআনে কারীম ও সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম : কিছু দিক কিছু দৃষ্টান্ত

মাওলানা সাঈদ আহমাদ বিন গিয়াসুদ্দীন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কুরআনের অনুসরণ ও এর বিধি-বিধানের বাস্তবায়ন

 

হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পড়বে, কুরআনের বিধি-বিধান অনুযায়ী আমল করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে গোমরাহি থেকে রক্ষা করবেন এবং আখেরাতের আযাব থেকে মুক্তি দেবেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَى

যে আমার  পথনির্দেশক কিতাবের অনুসরণ করবে, সে পথভ্রষ্ট কিংবা হতভাগা হবে না। -সূরা ত্বহা (২০) : ১২৩

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্বয়ং কুরআনঅনুসারীদের ব্যাপারে ঘোষণা দিচ্ছেন যে, তারা দুনিয়াতে পথভ্রষ্ট এবং আখেরাতে বিফল হবে না। (বরং উভয় জাহানে সৌভাগ্য ও সফলতা লাভ করবে)। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৬০৩৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৩০৫৭৫

আবু হাসীন রাহ. বলেন, এক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর কাছে এসে বলল, আমাকে কিছু নসীহত করুন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, ঠিক আছে শোনো। প্রথম নসীহত হল, এক আল্লাহর ইবাদত করবে। তাঁর সাথে কখনো কাউকে শরীক করবে না। দ্বিতীয় নসীহত হল, কুরআনকে নিজের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করবে (এবং যে অবস্থায় কুরআনের যে হুকুম), তা চোখ বুজে মাথা পেতে নিবে। তৃতীয় নসীহত হল, তোমার কাছে যখন কোনো কল্যাণকর ও সত্য কথা পৌঁছবে, তখন বার্তাবাহক ছোট কিংবা বড় যেমনই হোক না কেন তা গ্রহণ করে নিবে। আর কেউ যদি ভুল কিংবা মিথ্যা কথা পৌঁছায়, তাহলে সে তোমার বন্ধু কিংবা আত্মীয় হলেও সাথে সাথে তা প্রত্যাখ্যান করে দিবে। -ফাজায়েলে কুরআন, আবু উবায়দ ১/২৫৯

লক্ষ্য করুন, এ দুইটি রেওয়ায়েতে একটি বিষয়ই যৌথভাবে বিবৃত হয়েছে। তা হল, এই মহান দুই সাহাবীর প্রত্যেকেই নসীহত করার সময় কুরআনকে নিজের জীবনের পথনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলেছেন। কুরআনের আলোয় আলোকিত হওয়ার এবং তারই রঙে জীবনকে রঙিন করার জোর তাকিদ দিয়েছেন। যার দ্বারা বোঝা যায়, সাহাবায়ে কেরামের নিকট পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনের প্রকৃত সাফল্যের একমাত্র পথ হল, কুরআনকে আঁকড়ে ধরা এবং তার পূর্ণ আনুগত্য।

হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন, কুরআন তিলাওয়াতকারী ব্যক্তি যেন তোমাদের ধোঁকায় না ফেলে দেয় (অর্থাৎ শুধু তার তিলাওয়াত শুনে প্রশংসা শুরু করে দিও না) বরং দেখো, সে কুরআন অনুযায়ী আমল করে কি না। -ছহীহুত তারগীব ওয়াততারহীব, পৃ. ৫৮

মোটকথা, কুরআনে কারীমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হক হল, কুরআন অনুযায়ী আমল করা। কুরআনের আদর্শে জীবন গড়া। সাহাবায়ে কেরাম কুরআনের এ হক আদায়ে এবং এ দাবি পূরণে স্থাপন করেছেন অতুলনীয় দৃষ্টান্ত । যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রয়েছে আত্মার খোরাক ও উত্তম আদর্শ।

বস্তুত সাহাবায়ে কেরামের কুরআনী জীবনের দিকে তাকালে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, কুরআনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁদের উপমা হল এমন রোগীর মত, যে চিকিৎসার জন্য কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছে। ডাক্তার তাকে রোগ অনুযায়ী একটি প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। যাতে কিছু ওষুধ ব্যবহার করতে এবং কিছু জিনিস থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। প্রশ্ন হল, এ প্রেসক্রিপশনের সাথে রোগীর আচরণ কেমন হবে? উত্তর একেবারেই স্পষ্ট। এ রোগী ব্যক্তিটি যেহেতু সুস্থতা লাভ করতে চাচ্ছে এবং ডাক্তারের উপর তার আস্থাও আছে, তাই ডাক্তার যে প্রেসক্রিপশন লেখে দিয়েছে, যে বিধিনিষেধ বেধে দিয়েছে সে তা পরিপূর্ণরূপে মেনে চলবে। কারণ এ ব্যাপারে তার পূর্ণ আস্থা আছে যে, ডাক্তারের দিকনির্দেশনা মেনে চলার মাঝেই তার সুস্থতা নিহিত।

এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রকৃত মুমিনদের গুণ এভাবে বর্ণনা করেছেন-

اِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِیْنَ اِذَا دُعُوْۤا اِلَی اللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖ لِیَحْكُمَ بَیْنَهُمْ اَنْ یَّقُوْلُوْا سَمِعْنَا وَ اَطَعْنَا ؕ وَ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ

ঈমানদারদের যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ডাকা হয়, যাতে রাসূল তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেন, তখন তাদের কথা এ-ই হয় যে, আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম। -সূরা নূর (২৪) : ৫১

অর্থাৎ একজন প্রকৃত মুসলমানের গুণ হল, যখন কোনো ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে ডাক আসে, তখন সে এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে سَمْعًا وطَاعَةً (‘শ্রুত আদেশ শিরোধার্য’) বলে সাথে সাথে সেই ডাকে সাড়া দিতে এবং হুকুম মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। এতেই রয়েছে তার মঙ্গল, কল্যাণ ও প্রকৃত সাফল্য। (ফাওয়ায়েদে ওসমানী পৃ. ৪৭৬, উপরোল্লিখিত আয়াত সংশ্লিষ্ট তাফসীরী হাশিয়া)

কুরআনের সাথে সাহাবায়ে কেরামের কেমন সম্পর্ক ছিল, বিশেষত কুরআনের অনুসরণ ও তার হুকুম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাঁদের আদর্শ কী ছিল- এককথায় আমরা যদি তা প্রকাশ করতে চাই, তাহলে বলতে হবে, সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন سَمِعْنا وأَطعْنَا (নির্দেশ শুনেছি ও শিরোধার্য করে নিয়েছি)- এ আয়াতের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। নি¤েœ তাঁদের আদর্শ জীবন থেকে এমন কিছু ঈমান-উদ্দীপক ঘটনা উল্লেখ করা হল, যার প্রতিটিতেই শোনা যায় (سمْعًا وطَاعَةً)-এর সেই মধুর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি!

 

কিবলা পরিবর্তনের সংবাদ পেয়ে নামাযের মধ্যেই বাইতুল্লাহর দিকে ঘুরে যাওয়া

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে যখন মদীনায় গেলেন, তখন আল্লাহ তাআলার হুকুমে প্রথম ষোলো-সতের মাস বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরেই নামায আদায় করেন। তবে নবীজীর দিলের তামান্না ছিল, বাইতুল্লাহ যেন হয় কেবলা। অবশেষে আল্লাহ তাআলা নবীজীর দিলের তামান্না পূরণ করে বাইতুল্লাহকে কেবলা হিসেবে গ্রহণ করার হুকুম নাযিল করেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-

قَدْ نَرَى تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ

নিশ্চয় আমি আপনার মুখ বার বার আকাশের দিকে উঠতে দেখছি। সুতরাং আমি অবশ্যই আপনাকে  সেই কেবলার দিকে ফিরিয়ে দেব, যা আপনি পছন্দ করেন। অতএব, এখন আপনি স্বীয় মুখ মসজিদুল হারামের দিকে ফেরান। -সূরা বাকারা (২) : ১৪৪

হযরত বারা ইবনে আযেব রা. এ সংক্রান্ত একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, কেবলা পরিবর্তনের হুকুম নাযিল হওয়ার পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আছরের নামায বাইতুল্লাহর দিকে ফিরে আদায় করেন। নামাযের পর এক ছাহাবী বাইরে বেরিয়ে দেখেন, এক মসজিদে লোকজন আগের মতো বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকেই মুখ করে নামায আদায় করছে। তিনি তখন আওয়াজ দিয়ে বললেন, বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করে নামায পড়ার হুকুম নাযিল হয়েছে। আমি এখনই নবীজীর সাথে বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করে নামায পড়ে এসেছি। মুছল্লিরা তখন রুকু অবস্থায় ছিল। ঘোষণা শোনামাত্র সে অবস্থায়ই তাঁরা বাইতুল্লাহর দিকে ঘুরে যান। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৪৮৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৫; তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/১০৭-১০৮

হযরত ইবনে ওমর রা. বলেন, কুফাবাসীদের কাছে পরের দিন ফজরের নামাযের সময় এ সংবাদ পৌঁছে। তাঁরাও তখন নামাযরত অবস্থায় বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করে নেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪০৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৬; তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/১০৯-১১০

কুরআন মাজীদে কেবলা পরিবর্তনের হুকুমের একটি হেকমত এটাও বলা হয়েছে-

لِنَعْلَمَ مَنْ يَتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّنْ يَنْقَلِبُ عَلَى عَقِبَيْهِ

যাতে আমি জানতে পারি যে, কে রাসূলের অনুসরণ করে, আর কে পেছনের দিকে ফিরে যায় (অর্থাৎ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে)। -সূরা বাকারা (২) : ১৪৩

এটা তো জানা কথা, এ ধরনের পরীক্ষায় সাহাবায়ে কেরাম সবসময়ই উত্তীর্ণ হয়েছেন। তবে এ ঘটনায় যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হল, সাহাবায়ে কেরাম নামাযের মধ্যে যে অবস্থায় ছিলেন, হুকুম শোনামাত্র সে অবস্থায়ই বাইতুল্লাহর দিকে ঘুরে যান। তাদের এ কথা ভাবারও তো সম্ভাবনা ছিল যে, এ নামাযটি বাইতুল মাকদিসের দিকে ফিরেই শেষ করি। পরবর্তী নামায থেকে বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করব। কিন্তু কুরআনের আদেশ পালনে নিবেদিতপ্রাণ সেসব মনীষীদের এতটুকু বিলম্ব কীভাবে সহ্য হতে পারে! তাঁদের জীবনে এমনই ছিল "سَمِعْنَا وَ أَطَعْنَا"-এর বাস্তবায়ন।

 

মদ হারাম হওয়ার বিধান নাযিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরামের আনুগত্যের অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

কুরআন মাজীদে মদের ব্যাপারে একাধিক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। সর্বশেষে অবতীর্ণ হয়েছে সূরা মায়েদার এ আয়াতগুলো-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنَّمَا الْخَمْرُ وَ الْمَیْسِرُ وَ الْاَنْصَابُ وَ الْاَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّیْطٰنِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ اِنَّمَا یُرِیْدُ الشَّیْطٰنُ اَنْ یُّوْقِعَ بَیْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَ الْبَغْضَآءَ فِی الْخَمْرِ وَ الْمَیْسِرِ وَ یَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَ عَنِ الصَّلٰوةِ  فَهَلْ اَنْتُمْ مُّنْتَهُوْنَ .

হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয় মদ, জুয়া, পূজার বস্তু ও জুয়ার তীর- (সবই) অপবিত্র, শয়তানের কাজ। অতএব এসব থেকে বেঁচে থাকো, যাতে তোমরা সফলকাম হও। শয়তান এ-ই চায় যে, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে বিরত রাখবে। অতএব তোমরা কি (তা থেকে) বিরত হবে? -সূরা মায়িদা (৫) : ৯০-৯১

এ আয়াতে স্পষ্টভাবে মদ হারাম হওয়ার ঘোষণা করে মদ থেকে বিরত থাকার আদেশ করা হয়েছে। আরবে তখন মদের ব্যাপক প্রচলন ছিল। যুগ যুগ ধরে মদ তাদের সমাজ-সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু মদ হারাম হওয়ার হুকুম নাযিল হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরাম এ বিধানের প্রতি আনুগত্যের যে বিরল দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন, ইতিহাসে এর কোনো নজির পাওয়া যাবে না।

ওপরের আয়াতগুলোর শেষে বলা হয়েছে- فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ (তোমরা কি মদপান থেকে বিরত হবে?) হযরত ওমর রা. আয়াতটি শোনামাত্রই বলে উঠলেন, اِنْتَهَيْنَا اِنْتَهَيْنَا ‘হাঁ, হাঁ, আমরা বিরত হলাম। আমরা বিরত হলাম।’ -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৭৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৬৭০

হযরত বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, এক মজলিসে কিছু সাহাবী মদের পেয়ালায় ঠোঁট লাগিয়েছেন, ঠিক এমন সময় তাদের কাছে মদ হারাম হওয়ার সংবাদ পৌঁছল। সাথে সাথে তাঁরা মদের পেয়ালা দূরে নিক্ষেপ করলেন, আর فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ-এর জবাবে বলে উঠলেন,   اِنتَهَيْنَا رَبَّنَا (অর্থাৎ আমরা বিরত হয়ে গেছি হে আমাদের প্রতিপালক।) -তাফসীরে তাবারী ১০/৫৭২; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৫/৩৪৫

হাদীস ও তাফসীর গ্রন্থসমূহে এ ধরনের আরো অসংখ্য ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

 

خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ

আয়াতটি শোনামাত্র ওমর রা.-এর মাথা নত করে দেয়া

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, হযরত ওমর রা.-এর খেলাফতের সময় একবার উয়াইনা ইবনে হিস্ন মদিনায় এসে তার ভতিজা হুর ইবনে কায়েসের নিকট অবস্থান করল। হুর ইবনে কায়েস ছিলেন ওমর রা.-এর মজলিসে শুরার একজন সদস্য। সাধারণত কুরআনের হাফেজ-আলেমগণই ওমর রা.-এর মজলিসে শুরার সদস্য হতেন। একদিন উয়াইনা হুর ইবনে কায়েসকে বলল, তুমি তো আমিরুল মুমিনের কাছের মানুষ। তাঁর সাথে একটু সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দাও! হুর ইবনে কায়স তখন ওমর রা.-কে অনুরোধ করলে তিনি উয়াইনাকে সাক্ষাতের অনুমতি দেন।

ওমর রা.-এর সাথে সাক্ষাৎ করা মাত্রই উয়াইনা বলে উঠল, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি না আমাদেরকে প্রাপ্য অধিকার দেন আর না আমাদের সাথে ইনসাফ ও ন্যায়সম্মত আচরণ করেন। এ কথা শুনে ওমর রা. অত্যন্ত রাগান্বিত হন। তখন হুর ইবনে কায়স বলল, আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ

ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর, সৎকাজের আদেশ কর এবং অজ্ঞ লোকদের এড়িয়ে চল। -সূরা সাজদা (৩২) : ১৬

আর এ ব্যক্তিও মুর্খদের অন্তর্ভুক্ত। তাই আল্লাহ তাআলার হুকুম অনুযায়ী এর কথা উপেক্ষা করুন। এ আয়াত শোনামাত্র ওমর রা. একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন। উয়াইনাকে কিছুই বললেন না। কারণ তিনি যে ছিলেন وَقّافٌ عِنْدَ كِتَابِ اللهِ (আল্লাহ তাআলার হুকুমের সামনে পূর্ণ সমর্পিত একজন মানুষ।) -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৪২

 

কুরআন মাজীদ সম্পর্কে সাহাবীগণের কিছু অনুভূতি

কুরআনের সাথে সম্পর্ক ও ভালোবাসা, কুরআনের তিলাওয়াত ও তাদাব্বুর, কুরআন পড়ে পুলকিত ও শিহরিত হওয়া, কুরআন হিফ্য করা, সর্বোপরি কুরআনের অনুসরণ-অনুকরণ এবং তার বিধি-বিধান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা ও আদর্শ কেমন ছিল, বিভিন্ন ঘটনার আলোকে তার অতি সংক্ষিপ্ত কিছু নমুনা ও চিত্র (আলকাউসারের কুরআনুল কারীম সংখ্যায় আমার দীর্ঘ লেখায়) তুলে ধরা হয়েছে।

এ প্রবন্ধে কুরআন মাজীদ সম্পর্কে তাঁদের কিছু মূল্যবান বাণী ও বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছে। এগুলোর মাধ্যমে কুরআনের ব্যাপারে তাঁদের অনুভব-অনুভূতি, ভালোবাসা ও হৃদয়ের আকুতি কেমন ছিল, তা যেমন বোঝা যাবে, পাশাপাশি কুরআনের সঠিক মূল্য, অপরিসীম গুরুত্ব, কুরআনের বাহকগণের মর্যাদা, তাঁদের আখলাক ও গুণাবলী কেমন হওয়া চাই, মানুষের উপর কুরআনের হক ও দাবি কী কী, সে দাবি পূরণকারীদের ব্যাপারে ঐশী সুসংবাদ এবং এ ব্যাপারে অবহেলাকারীদের পরিণতি ইত্যাদি বিষয়গুলোও স্পষ্ট হয়ে যাবে।

মুররা ইবনে শারাহীল রাহ. বলেন, ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, তোমরা যদি উপকারী ও কল্যাণকর জ্ঞান অর্জন করতে চাও, তাহলে কুরআন মাজীদে তা সন্ধান কর। কারণ, তা পূর্বাপর সকল জ্ঞানের ভা-ার। -ফাযায়েলে কুরআন, আবী উবায়দ ১/২৭৬; মুখতাসারু কিয়ামিল লাইল, পৃ. ১৭৪; ফাযায়েলে কুরআন, ইবনে কাসীর ১৬২ তাবারানীর সূত্রে

আম্র ইবনে কায়েস সাকুনী রাহ. বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা.-কে বলতে শুনেছি, তোমরা কুরআনের সাথে সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলো। নিজেও কুরআন শিক্ষা কর এবং সন্তানদেরকেও তা শিক্ষা দাও। মনে রেখো, কুরআন সম্পর্কে তোমরা অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে। এটি তোমাদের জন্য হয় সওয়াব কিংবা আযাবের কারণ হবে। আর জ্ঞানী লোকদের জন্য কুরআন হচ্ছে শ্রেষ্ঠ উপদেশবার্তা। -ফাযায়েলে কুরআন, আবী উবায়দ ১/২৪২-২৪৩

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, কুরআন হল আল্লাহর দস্তরখান। তাই প্রত্যেকের উচিত, সামর্থ্য অনুযায়ী কুরআন শিক্ষা করা (এবং এর দ্বারা নিজের ঘর আবাদ করা)। ঐ ঘর কল্যাণ ও বরকত থেকে সবচে’ বেশি বঞ্চিত, যেখানে কুরআনের কোনো অংশ নেই (অর্থাৎ যে ঘরে কুরআন তিলাওয়াত করা হয় না। কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ করা হয় না। সর্বোপরি কুরআনী বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করা হয় না)। এমন ঘরের উপমা হল বিরাণ ঘরের মতো, যা আবাদ করার কেউ নেই। -মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৭/১৬৪

 

কুরআনের মাহাত্ম্য ও বৈশিষ্ট্য

আবুল আহওয়াস রাহ. বর্ণনা করেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, কুরআন মাজীদ আল্লাহ তাআলার দস্তরখান। তাই যথাসম্ভব তা শিক্ষা কর এবং তার দ্বারা উপকৃত হও। নিঃসন্দেহে কুরআন হল আল্লাহর রজ্জু (অর্থাৎ তাঁর সাথে সম্পর্ক গড়ার সুদৃঢ় মাধ্যম), উজ্জ্বল আলো, (অন্তরের) রোগ-ব্যাধি নিরাময়কারী। যে তাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে, তা তার জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হবে এবং তা আপন অনুসারীদেরকে দেখাবে মুক্তির পথ। এতে কোনো বক্রতা নেই, যা সোজা করার প্রয়োজন আছে।

কুরআনের রহস্য কখনো শেষ হবে না। আর তা কখনো পুরাতনও হবে না। তাই এমন মহান গ্রন্থ অধিকহারে তিলাওয়াত কর। কারণ, এর তিলাওয়াতের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা প্রতিটি অক্ষরে দশটি করে নেকী দান করবেন। আমি এ কথা বলছি না যে, الم একটি হরফ। বরং ا একটি হরফ, ل একটি হরফ, م একটি হরফ। (এভাবে الم পাঠকারী অন্তত ত্রিশটি নেকী লাভ করবে।) -সুনানে দারেমী, হাদীস ৩৩০৭; ফাযায়েলে কুরআন, ইবনে কাসীর, পৃ. ১৮

 

কুরআন মাজীদ : জান্নাত লাভের মাধ্যম কিংবা জাহান্নাম!

মু‘য়াল্লা কিন্দী রাহ. বলেন, ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, জেনে রাখো, কুরআন (আপন অনুসারীর পক্ষে, আর বিরুদ্ধাচরণকারীর বিপক্ষে) এমন সুপারিশকারী, যার সুপারিশ কবুল করা হবে। অতএব যে কুরআনের অনুসরণ করবে, সে জান্নাতে যাবে। আর যে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। -ফাযায়েলে কুরআন, ইবনে কাসীর, পৃ. ১৫১ বাযযারের সূত্রে

 

কুরআনের অনুসরণই কুরআনের সবচে’ বড় দাবি

যিয়াদ ইবনে মিখরাক রাহ. বর্ণনা করেন, ইবনে মাসউদ রা. ইরশাদ করেছেন, কুরআন মুখস্থ করা আমাদের জন্য (তুলনামূলক) কিছুটা কষ্টকর হলেও কুরআন অনুযায়ী আমল করার সৌভাগ্য আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। আর পরবর্তী লোকদের অবস্থা এই হবে যে, তারা সহজে কুরআন মুখস্থ করে ফেলবে বটে, তবে তার অনুসরণ ও তার বিধান অনুযায়ী আমল কমই করবে! -তাফসীরে কুরতুবী ১/৬৯, আবু বকর ইবনুল আনবারীর সূত্রে

 

কুরআনের বাহকগণের উদ্দেশে

ছা‘লাবা ইবনে আবুল কনুদ রাহ. বর্ণনা করেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কুরআন হিফ্জ করেছে, সে নিজের কাঁধে একটি ভারী বোঝা তুলে নিয়েছে। এবং তার হৃদয়ে নবুওতে মুহাম্মাদীর সবচেয়ে বড় দান সংরক্ষিত করে দেয়া হয়েছে। তাই (তার আখলাক ও চরিত্রে স্বাতন্ত্র থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ) কেউ খারাপ আচরণ করলে তার সাথেও খারাপ আচরণ করা কিংবা কেউ মুর্খতাপূর্ণ কাজ করলে তার সাথেও মুর্খদের মতো আচরণ করা কুরআন-বাহকের জন্য শোভা পায় না। (বরং তার উচিত, ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শন করা)। কারণ, তার হৃদয়ে যে রয়েছে খোদার কালাম! (যা মানুষকে উত্তম আখলাক শিক্ষা দেয়)। -ফাযায়েলে কুরআন, আবী উবায়দ ১/২৮৯; আখলাকু হামালাতিল কুরআন ২৬

হযরত ওমর ফারুক রা. একবার কারীদের (কুরআনের হাফেজ ও আলেমদের) সম্বোধন করে বললেন, হে কারী সম্প্রদায়! আপন দৃষ্টি উঁচু এবং শির বুলন্দ করো। (কারণ, কুরআনের আলোয় সত্য-সরল পথ ও হেদায়েতের) রাস্তা তোমাদের সামনে স্পষ্ট। অতএব তোমরা নেকী ও কল্যাণকর কাজে অন্যদের চেয়ে অগ্রসর হতে চেষ্টা করো। আর (হাত পেতে) অন্যের উপর বোঝা হয়ো না। -আততিবয়ান, পৃ. ৪১

 

কুরআনের সত্যিকার পতাকাবাহী

হযরত সালেম মাওলা আবী হোযায়ফা রা. একজন প্রথম সারির মুহাজির সাহাবী। তিনি ছিলেন কুরআন ধারণকারী ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী বিশিষ্ট সাহাবীদের একজন। তাঁর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে চারজন সাহাবীর নাম উল্লেখ করে তাঁদের থেকে কুরআন শিক্ষা করার আদেশ দিয়েছেন, তিনি তাঁদেরই একজন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৯৯৯

হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর খেলাফতকালে ইয়ামামার প্রসিদ্ধ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং মুহাজিরদের ঝা-াবাহী ছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে কেউ তাঁকে বলল, আপনার ব্যাপারে আমাদের আশঙ্কা হয়। তাই ঝা-া অন্য কারো কাছে দিয়ে দিন। তিনি তখন বললেন, (যুদ্ধক্ষেত্রে আমি যদি দুর্বলতা প্রদর্শন করি), তাহলে তো আমি অতি নিকৃষ্ট কুরআন ধারণকারী। এ কথা বলেই তিনি সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলেন। যুদ্ধ করতে করতে তাঁর ডান হাত কেটে গেলে বাম হাতে ঝা-া তুলে নেন। বাম হাতও কেটে গেলে ঝা-া ঘাড় দিয়ে আঁকড়ে ধরেন, তবুও তা মাটিতে পড়তে দেননি। আর এ অবস্থায় তার মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল কুরআনের এ আয়াত-

وَكَأَيِّنْ مِنْ نَبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ

আর কত নবী রয়েছেন, যাদের সঙ্গী হয়ে বহু আল্লাহওয়ালা যুদ্ধ করেছেন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৪৬

অবশেষে তিনি এ যুদ্ধেই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। -উসদুল গাবাহ ২/২৬১; আলইসাবাহ ফি তাময়িযিস সাহাবা ৩/১৬

আরো দেখুন : ফাযায়েলে কুরআন, আবী উবায়দ ১/২৯১; তারিখে তাবারী ৫১৬; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৬/৩২৯

 

কুরআন মর্যাদা সমুন্নত করে

আমের ইবনে ওয়াসেলা রাহ. বর্ণনা করেন, নাফে ইবনে আবদুল হারেস রাহ. ছিলেন ওমর রা.-এর নিযুক্ত মক্কার গভর্নর। একবার তিনি ‘উসফানে’ (মক্কার নিকটে একটি স্থানের নাম) হযরত ওমর রা.-এর সাথে দেখা করলেন। খলীফাতুল মুসলিমীন তাকে তখন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি উপত্যকার অধিবাসীদের জন্য (অর্থাৎ মক্কাবাসীদের জন্য) কাকে নায়েব (ভারপ্রাপ্ত গভর্নর) বানিয়ে এসেছ? নাফে রাহ. বললেন, (আবদুর রহমান) ইবনে আবযাকে।

ওমর রা. : ইবনে আবযা কে?

নাফে রাহ.            : সে আমাদের আযাদকৃত একজন গোলাম।

ওমর রা. : একজন গোলামকে নিজের নায়েব ও লোকদের আমীর বানিয়েছ?

নাফে রাহ.            : সে কিতাবুল্লাহর মাহির এবং আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তি।

ওমর রা. : তাহলে ঠিক আছে। শোনো, আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা আপন কিতাবের মাধ্যমে অনেককে সম্মানিত করবেন। আর অনেককে করবেন অপদস্থ! আমার মনে হয়, ইবনে আবযা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কালামে পাকের ওসিলায় সম্মানিত করেছেন। -ফাযায়েলে কুরআন, আবী উবায়দ ১/২৭৪-২৭৫

আল্লাহ পাক আমাদেরকে কুরআনের মূল্য বুঝার, এর হকসমূহ অনুধাবন করার এবং তা আদায়ে সচেষ্ট হওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন।

[আলকাউসারের কুরআনুল কারীম সংখ্যায় ‘কুরআনের সাথে সাহাবায়ে কেরামের সম্পর্ক : কিছু দিক কিছু দৃষ্টান্ত’ শিরোনামে লেখকের একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। মূল প্রবন্ধটির কলেবর বড় হয়ে যাওয়ায় কিছু অংশ তখন রেখে দেওয়া হয়েছিল, যাতে পাঠকের জন্য বেশ কিছু উপকারী তথ্য ছিল। গত সংখ্যায় তার একটি অংশ প্রয়োজনীয় কিছু সংযোজনসহ পাঠকদের জন্য পেশ করা হয়েছিল। এ সংখ্যায় বাকি অংশ ছাপা হল।]

 

advertisement