উম্মাহ : কাতার সংকট
স্মরণকালের ভয়াবহতম সংকটের মুখোমুখী মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার। বিশ্বের সর্বাধিক মাথাপিছু আয়ের এই মুসলিম দেশের ওপর শকুনের বিষদৃষ্টি আগেও পড়েছে। কিন্তু এবার স্বজাতি ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো যেভাবে তাকে বিপর্যয়ে ফেলেছে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। আরব অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি এবং ‘সন্ত্রাসবাদী’ দলগুলোকে আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন দেয়ার অভিযোগ তুলে কাতারের সাথে সবধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে সৈৗদিআরব এবং তার মিত্র আরব আমিরাত, মিশর, বাহরাইন, ইয়েমেন ও লিবিয়া। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কাতারের সাথে সবধরনের স্থল, নৌ ও আকাশ সীমান্ত। বিশেষত সৌদি সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে আমদানি নির্ভর এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বড় রকমের সংকট তৈরি হতে পারে। এনটিভির সংবাদ মতে কাতারের নাগরিকদের হারাম শরীফেও ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। কাতার এয়ারওয়েজের স্পন্সর করা বার্সেলোনার জার্সি পরাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কাতারের প্রতি কোনো ধরনের সহানুভূতি দেখালে আমিরাতে পনের বছর কারাদণ্ডের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অবরোধ আরোপকারী দেশসমূহ বিশেষত মিশরের দুই লাখ নাগরিক কাতারের ইঞ্জিনিয়ারিং, নির্মাণ শিল্প, আইন ও ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত। নিজ দেশের নির্দেশে এরা কাতার ত্যাগে বাধ্য হলে কাতারে ব্যাপক শূন্যতা তৈরি হবে।
হামাস ও ইখওয়ানের পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম আলজাযিরা দ্বারা আরব অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে কাতারকে। সৈৗদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আলজুবাইরের ঘোষণা মতে এই অবরোধ থেকে মুক্তি পেতে কাতারকে হামাস-ইখওয়ানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে এবং আলজাযিরার সংবাদ নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে।
এখানে একটি সাধারণ প্রশ্ন হচ্ছে, হামাস নেতাদের বহিষ্কারের দাবি সৌদির মুখে কেন? এটা তো ইসরাঈলের দাবি হওয়ার কথা! হামাস সহায়তা পেলে, শক্তিশালী হলে সৌদি-আমিরাত-মিশরের সমস্যা হওয়ার কথা না। কিংবা আলজাযিরা যদি মুসলমানদের কমবেশি স্বার্থ সংরক্ষণ করে সংবাদ প্রচার করে, তাহলে তো সবার খুশি হওয়ার কথা। নারায হওয়ার কথা কেবল ইহুদিবাদী ইসরাঈল ও তার দোসরদের। কারণ হামাস যে ইসরাঈলের গলার কাঁটা তা তো পরিষ্কার। ইখওয়ান ও আলজাযিরাও একই সূত্রে গাঁথা। কারণ হামাসকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করা সম্ভব মিশরের পক্ষে। গাজা-মিশর সীমান্ত ও সুড়ঙ্গ দিয়ে খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি অস্ত্র সরবরাহ করাও অসম্ভব নয়। অতএব ইখওয়ান মিশরের ক্ষমতায় বসার অর্থ হামাসের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া, যা ইসরাঈলের পক্ষে অস্বস্তিকর বৈকি। আর আলজাযিরা হচ্ছে ইহুদি নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া বলয়ের বাইরে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সংবাদ সংস্থা, যারা ফিলিস্তিনে, বিশেষত গাজায় ইসরাঈলের জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত হাইলাইট করে যাচ্ছে। অতএব আলজাযিরা যতদিন আছে ততদিন মুসলিম বিশ্বে চালিয়ে যাওয়া ইসরাঈল-আমেরিকার বর্বরতাগুলো ধামাচাপা দেয়ার সুযোগ নেই।
সুতরাং কার বা কাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই বয়কট তা অনুমান করে নেওয়া কঠিন নয়। সংবাদ মাধ্যমগুলোতে চলতি অবরোধের নেপথ্য কারণ হিসেবে আঞ্চলিক রাজনীতি, কাতারের ইরানপ্রীতি, আলজাযিরা কর্তৃক আরব বসন্তে উসকানি দেয়া এবং সৌদি শাসকদের নামে অপপ্রচার ইত্যাদি বিষয় উঠে এলেও হামাস, ইখওয়ান এবং আলজাযিরার ত্রিমুখী আক্রমণ থেকে ইসরাঈলকে রক্ষা করাই যে প্রধান উদ্দেশ্য তা একপ্রকার স্পষ্ট। সৌদি ও অন্য পাঁচ আরব রাষ্ট্র খেলার পুতুল মাত্র, পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে ইসরাঈল ও আমেরিকা।
সম্প্রতি ট্রাম্পের একটি টুইট বার্তা এবং আমিরাতের রাষ্ট্রদূতের ফাঁস হওয়া ইমেইল বিষয়টাকে আরো খোলাসা করেছে। আরব-আমেরিকান সম্মেলন শেষে ট্রাম্পের ফিরে যাওয়ার পরপরই এই আকস্মিক অবরোধ। এর পরই ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় যা বলেছেন তার মূলকথা হচ্ছে এই অবরোধ তারই কৃতিত্ব।
এদিকে আমেরিকায় নিযুক্ত আমিরাতের রাষ্ট্রদূতের ফাঁস হওয়া ইমেইলে দেখা গেছে, তিনি এফডিডি নামের এক ইসরাঈলী গোষ্ঠীর সাথে মিলে কাতারের ভাবমূর্তি ক্ষুণণ্ন করার পরিকল্পনা করছেন। উভয়ের মধ্যে জুনের ১১ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য একটি বৈঠকে কাতার নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়, যেখানে আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদেরও উপস্থিত থাকার কথা। ইন্টারসেপ্টের খবরে বলা হয়, বৈঠকে সম্ভাব্য আলোচ্য বিষয়গুলোর একটি ছিল কাতারভিত্তিক সংবাদ-সংস্থা আলজাযিরা। আলজাযিরাকে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার কারণ হিসেবে বিবেচনা করে তা নিয়ে আলোচনার কথা ছিল।
মোদ্দাকথা ইসরাঈল-আমেরিকার সাথে আরব শাসকদের পূর্ব আঁতাতের ফল হল সাম্প্রতিক কাতার অবরোধ। এর মাধ্যমে যদি দেশটাকে পঙ্গু করে দেয়া যায় তাহলে আলজাযিরার মুখে লাগাম আঁটবে, হামাস-ইখওয়ান অভিভাবকশূন্য হবে এবং বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত মুসলিমদের কাতার যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থসহায়তা দিত তাও বন্ধ হয়ে যাবে। বলাবাহুল্য, এটা আরব বাদশাহদের দিলের কামনা কখনো হতে পারে না। এই আকাঙ্খা ইসরাঈলের, আরব শাসকেরা ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র।
আমেরিকার সাথে কাতারের দহরম মহরম কোনো অংশে কম ছিল না। কাতারের ঘাঁটি থেকে উড়ে গিয়েই মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলো সাদ্দামের ইরাকে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের নামে একদিকে ট্রিলিয়ন ট্রিলয়ন ডলার অপচয় করছে, অপরদিকে এই ক্রীড়াযজ্ঞ চলাকালীন যেসব নোংরা কাজ চলে থাকে তার মাধ্যমে জাযিরাতুল আরবের পবিত্র ভূমিকে নাপাক করার সমস্ত আয়োজন চূড়ান্ত করেছে। এই সকল বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর জন্য গভীর চিন্তার খোরাক রয়েছে।
এখন কাতারের সামনে দু’টো রাস্তা- হয় সৌদি শক্তির কাছে নমনীয় হয়ে আপসের আয়োজন করা। এক্ষেত্রে তাকে হামাস-ইখওয়ানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পাশাপাশি আলজাযিরার সংবাদ প্রকাশের নীতিমালায় ব্যাপক রদবদল করতে হবে। তবে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন “আমরা বশ্যতা স্বীকার করতে প্রস্তুত নই। আমরা কখনোই আমাদের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিকে লুটাতে দেয়ার জন্য প্রস্তুত নই।” অবশ্য এই লেখা যখন লিখছি তখন কুয়েতের মধ্যস্থতায় কাতার, সৌদি ও আমিরাতের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এতে যদি সমাধান না হয় তাহলে কাতারের সামনে দ্বিতীয় যে রাস্তা খোলা তা হচ্ছে আত্নরক্ষার্থে এবং অতীব প্রয়োজনীয় আমদানি পণ্যের চাহিদা মেটাতে আরো বেশি করে সমুদ্রের ওপারের ইরানের দিকে ঝুঁকে পড়া। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের হস্তক্ষেপের সুযোগ আরো বাড়বে, যা অঞ্চলটির স্থিতিশীলতার জন্য অতিরিক্ত হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
আফসোসের ব্যাপার হল যেখানে উচিত ছিল আরব রাষ্ট্রগুলো একজোট হয়ে একদিকে ইসরাঈল-আমেরিকা অপরদিকে ইরান-রাশিয়ার মোকাবেলা করবে, সেখানে তারা নিজেরা ইঙ্গমার্কিন শক্তির ক্রীড়নক হয়ে কাতারকে ঠেলে দিয়েছে ইরানের দিকে। নিজেরাই যখন নিজেদেরকে দুশমনের খাদ্যবস্তুতে পরিণত করে তখন আর কিছু বলার থাকে না।
এই সংকট মোকাবেলার কথা ভাবলে মূলে ফিরে যেতে হয়। সমস্যার মূলে রয়েছে ধনসম্পদ ও ক্ষমতার প্রতি আমাদের শাসকদের নির্লজ্জ লোভ। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, লোকেরা যেভাবে একে অন্যকে ডেকে খাবারের পাত্রে একত্র হয় ঠিক সেভাবে তোমাদের ওপর ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীগুলো হামলে পড়বে। একজন বললেন, সেটা কি আমাদের সংখ্যাস্বল্পতার দরুণ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, সেদিন সংখ্যায় তোমরা থাকবে অনেক, কিন্তু তোমরা হবে বানের জলে ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মত। আল্লাহ শত্রুদের মন থেকে তোমাদের ভীতি তুলে দিবেন। আর তোমাদের অন্তরে ঢেলে দিবেন ওয়াহ্ন (অক্ষমতা)। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, ওয়াহ্ন কী? রাসূল ইরশাদ করলেন, দুনিয়ার লোভ ও মৃত্যুকে অপছন্দ করা। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২৯৭
অতএব যতদিন সম্পদ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার রোগ শাসকদের মধ্যে থাকবে ততদিন এ জাতীয় সংকট বিভিন্নরূপে মুসলিম উম্মাহর ওপর সওয়ার হতেই থাকবে। গদি টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমাদের পদলেহন থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই যা তারা করবে না। এক্ষেত্রে প্রথমত মুসলিম দায়ীদের কর্তব্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বার্তা জনসাধারণ, শাসকশ্রেণী, বিশেষত ভবিষ্যত প্রজন্মের কানে পৌঁছে দেয়া।
দ্বিতীয়ত সংকট সমাধানের তড়িৎ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণও গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উচিত সমস্যা সমাধানকল্পে এগিয়ে আসা এবং যত দ্রুত সম্ভব আলোচনার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। তবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই সফলতার মুখ দেখবে না যতক্ষণ সৌদি শাসক পরিবারের বেধোদয় না হবে। ইহুদীদের হাতের পুতুল হয়ে কাতারের ওপর এমন অবিচার করে এবং কাতারের নিরপরাধ নাগরিকদের হারাম শরীফে প্রবেশে বাধা দিয়ে যেভাবে তারা বিশ্ব মুসলিমের ধিক্কারের পাত্রে পরিণত হচ্ছে তা কখনোই তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। ক্ষমতার মোহ আর গদিলিপ্সার ওপর মুসলিম উম্মাহর স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া ছাড়া টালমাটাল মধ্যপ্রাচ্যে কখনো শান্তি ফিরবে না। এই বাস্তবতা তারা যত দ্রুত উপলব্ধি করবে ততই মুসলমানদের মঙ্গল।