কুরআনের মাসে কুরআন তিলাওয়াত
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা রমাযান মাসের পরিচয় দিয়েছেন-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ
রমযান মাস, যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। [সূরা বাকারা (২) ১৮৫]
রমযান মাস হল কুরআনের মাস। কুরআনের সাথে এ মাসের সম্পর্ক অনেক গভীর। রমযানের প্রতি রাতেই জিবরীল আলাইহিস সালাম রাসূলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁরা একে অপরকে কুরআন শোনাতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬
কুরআন তিলাওয়াত সকল ঈমানদারের সব সময়ের আমল। তবে রমযান মাসে এর গুরুত্ব আরো বেশি। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন এবং বুযুর্গানে দ্বীন সকলেই রমযান মাসে তিলাওয়াতের বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই রমযানের অধিকাংশ সময় কুরআন তিলাওয়াতে কাটাতেন। দিনে মুসহাফ থেকে তিলাওয়াত করতেন। আর রাতে তারাবীহ ও নফলের তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। তাদের অনেকে দৈনিক এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। অনেকে তো দৈনিক দুই খতমও পড়তেন। কেউবা বিশ রাকাতে, কেউ দুই রাকাতেই পূর্ণ কুরআন খতম করতেন। এভাবে কুরআন তিলাওয়াতের মধ্যেই কাটতো তাদের রমযানের দিনরাত।
এক্ষেত্রে নারীগণও পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। নারীদের অনেকে ছিলেন, যারা দৈনিক এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। কুরআন তিলাওয়াতের ব্যাপারে তাদের মধ্যে ছিল প্রতিযোগিতা। আল্লাহ তাআলা তাদের সময় ও সক্ষমতায় বরকত দান করেছিলেন।
এমন একজন বুযুর্গ নারী ছিলেন হযরত ইয়াহইয়া কান্ধলভী ও মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর আম্মাজান। তিনি হাফেযা ছিলেন। রমাযানের বাইরে তাঁর নিয়মিত আমল ছিল, দৈনিক এক মঞ্জিল তিলাওয়াত করা। আর রমযানে তার দৈনিক আমল ছিল চল্লিশ পারা তিলাওয়াত করা। অর্থাৎ এক খতম করেও আরো দশ পারা তিলাওয়াত করতেন। এ তিলাওয়াতের পাশাপাশি কয়েকশ করে বিভিন্ন তাসবীহ আদায় করতেন। যা প্রায় সতের হাজারের কাছাকাছি হয়ে যেত। (আকাবির কা রমযান, যাকারিয়া রাহ., পৃষ্ঠা ৬৩; বারাকাতে রমাযান, মাওলানা মনযুর নোমানী রাহ., পৃষ্ঠা ৩৪)
বলাবাহুল্য, এটা একমাত্র আল্লাহর বিশেষ তাওফীকেই সম্ভব হত, যা আল্লাহর বিশেষ দান ও পুরস্কার।
মাওলানা ইয়াহইয়া ও মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর নানীজান হযরত মাওলানা মুজাফফর হুসাইন রাহ.-এর মেয়ে আমাতুর রহমান রাহ. যিনি ‘উম্মিবী’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি রমযানে তার কোনো (মাহরাম) আত্মীয়ের পেছনে তারাবীহ ও নফলে কুরআন তিলাওয়াত শুনতেন। কখনো মাওলানা ইয়াহইয়া রাহ.ও মাওলানা ইলিয়াস রাহ. তাকে তারাবীতে তিলাওয়াত শোনাতেন। তারা মসজিদে ফরয পড়ে ঘরে চলে আসতেন। এরপর সারা রাত সাহরী পর্যন্ত তারাবীতে তিলাওয়াত করতেন আর তাদের নানীজান উম্মিবী সারা রাত নামাযে দাঁড়িয়ে তিলাওয়াত শুনতেন। সাহরী পর্যন্ত তিলাওয়াত চলত। তাতে চৌদ্দ বা পনের পারা তিলাওয়াত হত।
একবারের ঘটনা। উম্মিবীকে এ বছর তিলাওয়াত শোনাচ্ছিলেন তাঁর ছেলে, মাওলানা ইলিয়াস ও মাওলানা ইয়াহইয়া রাহ.-এর মামা মাওলানা রউফুল হাসান ছাহেব। তিনি ঊনত্রিশ রমযান দিবাগত রাতের তারাবীতে দুই রাকাতের প্রথম রাকাতে আলিফ লাম থেকে সূরা ফালাক পর্যন্ত পড়েন। আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা নাস পড়ে দু’রাকাতেই পুরো কুরআন খতম করেন। উম্মিবীও নামাযে দাঁড়িয়ে পুরো খতম শোনেন। তিনি দুই রাকাতে খতম করে উম্মিবীকে বললেন আমি দুরাকাত পড়িয়ে দিলাম। বাকি আঠারো রাকাত আপনি পড়ে নিন। এ ছিল বৃদ্ধ বয়েসে নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআনের তিলাওয়াত শোনার ঘটনা। কুরআনের কেমন আশেক ছিলেন তারা! (আকাবির কা রমাযান, পৃ. ২২)
এই ধরণের ঘটনা থেকে শিক্ষার বিষয় হচ্ছে, আমরা যে যে অবস্থায় আছি তা থেকে উন্নতির চেষ্টা করা। হুবহু এই ঘটনার অনুসরণ সবার পক্ষে সম্ভবত নয়, অনেক ক্ষেত্রে তা মুনাসিবও নয়। কিন্তু নিজ অবস্থা থেকে উন্নতি ও তরক্কির চেষ্টা তো সর্বাবস্থায় ও সবার জন্যই কাম্য।
শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রাহ. তাঁর মেয়েদের ব্যাপারে লিখেছেন, “আল্লাহ তাদের হিম্মত আরো বাড়িয়ে দিন। আমার মেয়েদের অবস্থা এই যে, তাদেরকে খাবার-দাবারের ইন্তেজাম করতে হয়, প্রত্যেকেরই কয়েকজন করে সন্তান আছে, তাদের লালন-পালন করতে হয়, এত ব্যস্ততার পরও তারা মাশাআল্লাহ রমযানের রাতগুলো কয়েকজন হাফেজের পেছনে তিলাওয়াত শোনায় কাটিয়ে দেয়। তাছাড়া রমযানে দৈনিক কমপক্ষে চৌদ্দ থেকে পনের পারা তিলাওয়াত করে। তারা পরস্পরে প্রতিযোগিতা করে যে, কার তিলাওয়াত কত বেশি হয়। আল্লাহ পাকের দয়া, রমযানে মেয়েদের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াতের আগ্রহ-উদ্দীপনা এখনো বাকি আছে। আল্লাহ তাদের কবুল করুন। রাত-দিনে তারা একটু বিশ্রামের জন্যও তেমন সময় পায় না। রাতের অংশ তো কুরআনে কারীমের তিলওয়াত শোনার মধ্যেই কেটে যায়। ঐ সময় বাচ্চারা থাকে ঘুমে। দিনে যখন তারা একটু বিশ্রাম করতে যায় তখন বাচ্চারা জ্বালাতন করে। কখনো কখনো বেচারীদের প্রতি আমার খুব মায়া হয়। আল্লাহ তাদের কবুল করুন। (আকাবির কা রমাযান, পৃ. ৬৩)
কুরআনের মাসে আমাদের পরিবারগুলোও যেন জীবন্ত থাকে কুরআনে কারীমের তিলাওয়াতে। আমাদের দিনরাত যেন কাটে তিলাওয়াত-নিমগ্নতায়। যেন গড়ে উঠে তিলাওয়াতের মাঝে প্রতিযোগিতার পরিবেশ। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।