শা‘বান-রমযান : রহমত ও মাগফিরাতের মওসুম
সময় বয়ে চলেছে। আমরাও এগিয়ে চলেছি। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি আমাদের গন্তব্যের দিকে, যা নির্ধারিত হয় বিশ্বাস ও কর্মের দ্বারা। কর্ম ও বিশ্বাসই হচ্ছে চূড়ান্ত গন্তব্যের পথ। তাই কর্ম যদি ভালো হয় তাহলে আশা করা যায় গন্তব্যও ভালো হবে। আমরা নিশ্চয়ই ভালোর প্রত্যাশী।
আমাদের মানযিল যেন হয় শান্তির, পরিণাম যেন হয় মুক্তির এজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের দিয়েছেন সত্যপথের দিশা। আর দান করেছেন পেছনের ক্ষতি পূরণ করে ঈমান ও আমলে এগিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন উপায়। এই শুদ্ধি ও উন্নতির বার্তা নিয়ে আবারো আমাদের মাঝে আসছে মাহে রমযান। রহমত ও মাগফিরাতের মাহে রমযান। এর আগের মাসটি শা‘বান, যে মাসের পনেরর রাত, অর্থাৎ চৌদ্দ শা‘বান দিবাগত রাতটি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। তাই রমযানের আলোচনা শুরু করতে চাই এই পবিত্র রজনীর আলোচনার মাধ্যমে।
হাদীস শরীফে এ রাতকে নির্দেশ করা হয়েছে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা‘বান’ বলে। আমাদের সাধারণ পরিভাষায় বলি শবে বরাত। ক্ষমা ও মাগফিরাতের জন্য, গুনাহের কালিমা থেকে পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্য এ রাত বিশেষ মহিমাপূর্ণ।
হাদীস শরীফে শবে বরাত
শবে বরাত সম্পর্কেও আছে চিন্তাগত ও কর্মগত প্রান্তিকতা। সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ কথা হচ্ছে, এ রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। রাতটি উদযাপনের বিশেষ কোনো পন্থা নির্ধারণ করা বা সম্মিলিত উৎসবের রূপ দান করা সমীচীন নয়; বরং এ রাতের প্রমাণিত ফযীলতকে সামনে রেখে যথাসাধ্য ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকা কাম্য এবং তা নির্ভযোগ্য রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব রাতের মতোই মনে করা এবং এ রাতের ফযীলত সংক্রান্ত সকল হাদীসকে ‘মওজু’ বা ‘জয়ীফ’ বলে আখ্যায়িত করা যেমন ভুল তেমনি এ রাতকে শবে কদরের মতো বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করাও একটি ভিত্তিহীন ধারণা।
শবে বরাতের ফযীলত বিষয়ক একটি হাদীস এই- হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শা‘বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং শিরককারী ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া অন্য সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ -সহীহ ইবনে হিব্বান ১৩/৪৮১ হাদীস ৫৬৬৫
ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, নূরুদ্দীন হাইছামী, কাসতাল্লানী, যুরকানী প্রমুখ হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলে রায় দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন, মাসিক আলকাউসার শা‘বান ’২৬ সেপ্টেম্বর ’০৫ সংখ্যা।
মাহে রমাযান : ফযীলত ও করণীয়
মাহে রমাযানের ফযীলত ও বিশিষ্টতা সম্পর্কে কুরআন মাজীদের এই আয়াত সকলেরই জানা-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِیْۤ اُنْزِلَ فِیْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰی وَ الْفُرْقَانِ ۚ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْیَصُمْهُ ؕ
রমযান মাস, যাতে অবতীর্ণ হয়েছে কুরআন, মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাস পাবে সে যেন এই মাস রোযা রাখে। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৫
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে, ‘যখন রমাযান এল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
قَدْ جَاءَكُمْ رَمَضَانُ، شَهْرٌ مُبَارَكٌ، افْتَرَضَ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ، تُفْتَحُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَنّةِ، وَتُغْلَقُ فِيهِ أَبْوَابُ الْجَحِيمِ، وَتُغَلّ فِيهِ الشّيَاطينُ، فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا، فَقَدْ حُرِمَ
মাহে রমাযান তোমাদের মাঝে এসে গেছে, এ এক বরকতময় মাহিনা, আল্লাহ তোমাদের উপর এ মাসের সিয়াম ফরয করেছেন। এই মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয় আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয়। আর শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। এতে আছে এমন এক রজনী, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকে সে তো প্রকৃতই বঞ্চিত। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭১৪৮
কাজেই মুমিনের কর্তব্য, এ মাসের কদর করা। আর তা এভাবে যে, প্রতিটি ফরয রোযা যতেœর সাথে রাখা হবে, অন্যান্য ফরয বিধানও যতেœর সাথে পালন করা হবে, গুনাহ ও পাপাচার থেকে দূরে থাকা হবে আর রাতের তারাবির সালাত গুরুত্বের সাথে আদায় করা হবে।
তারাবি বিশ রাকাত
মাহে রমযানের মোবারক সময়েও একশ্রেণির মানুষকে দেখা যায় নানা বিষয়ে বির্তক ছড়াতে। এর মধ্যে তারাবীর রাকাআত-সংখ্যা অন্যতম। আমাদের কর্তব্য এই সকল অপপ্রচারে প্রভাবিত না হওয়া এবং বিতর্কে না জড়িয়ে ও ভিন্ন পথে না গিয়ে এই মাসের খাইর ও বরকত লাভে সচেষ্ট থাকা।
তারাবীর রাকাআত-সংখ্যার বিষয়টি অতিশক্তিশালী দলীল দ্বারা প্রমাণিত। খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ, মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কেরামের ইজমা, মারফূ হুকমী, সুন্নাতে মুতাওয়ারাছাহ এবং ফকীহ মুজতাহিদগণের ইজমা- এই সকল শক্তিশালী দলীলে প্রমাণিত যে, তারাবীর নামাযকে আট রাকাতে সীমাবদ্ধ মনে করা এবং বিশ রাকাত মাসনূন হওয়াকে অস্বীকার করা মারাত্মক ভুল। কাজেই মাহে রমাযানের বরকতময় রজনীতে সর্বপ্রকার বিতর্ক ও বিভ্রান্তি থেকে দূরে থাকুন এবং নিষ্ঠার সাথে বিশ রাকাত তারাবী আদায় করুন। এ বিষয়ে বিস্তারিত দলীল-প্রমাণের জন্য দেখুন মাসিক আলকাউসার অক্টোবর-নভেম্বর’০৫ সংখ্যা।
রমাযানের শুরু ও ঈদের তারিখ নিয়েও আজকাল বিতর্ক ছড়ানো হচ্ছে। এ বিষয়েও উলামায়ে কেরামের সাঙ্গে থাকুন এবং সর্বপ্রকারের বিচ্যুতি ও বিচ্ছিন্নতা পরিহার করে চলুন।
চাঁদ বিষয়ে দালীলিক ও বরাতসমূহ এবং বিশ্লেষণ ও উন্মোচনে অনন্য এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধ আলকাউসারে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান সংখ্যাতেও এ প্রসঙ্গে একটি প্রামাণিক প্রবন্ধ রয়েছে।
এ সময়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সদাকাতুল ফিতর বা ফিৎরা। ইখলাসের সাথে নিজের রোযার ভুল-ত্রুটির ক্ষতিপূরণের এক উপায় মনে করে এই আমলটি পালন করা উচিত। এটি ইসলামের মানবিক শিক্ষারও একটি অনন্য উদাহরণ।
এ প্রসঙ্গে সচেতন হওয়ার মতো একটি বিষয় হচ্ছে, সদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ ও পরিমাপ। এ ক্ষেত্রে একাধিক পরিমাণ আছে। প্রত্যেকের কর্তব্য নিজ সামর্থ্য ও সচ্ছলতা অনুপাতে উচ্চ পরিমাণটি গ্রহণ করা।
এ সময়ের আরেক ইবাদত ই‘তিকাফ। এরপর আসে ঈদুল ফিতর। এই সকল আমল ও ইবাদত যেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট আদাব ও মাসায়েল সম্পর্কে জ্ঞান ও সচেতনতা। যে কোনো আমল ও ইবাদতের ক্ষেত্রেই পূর্বাহ্নে মাসায়েল জেনে নেওয়া অতি প্রয়োজন। অন্যথায় নানা ভুল ত্রুটির আশঙ্কা থাকে। আলকাউসারের বিভিন্ন সংখ্যায় এ সকল প্রয়োজনীয় বিষয়ে কিছু কিছু আলোচনা করা হয়েছে। এখানে কিছু শিরোনাম সংখ্যাসহ উল্লেখ করে দেওয়া হল।
* ইসলামের নিদের্শনা= রোযা ও যাকাত : জরুরি কয়েকটি মাসআলা, এক নজরে রমযান ও রোযার প্রয়োজনীয় মাসায়েল- রমযান-শাওয়াল ’২৬ অক্টো-নভে. ’০৫
* ইসলামী ঈদ : তাৎপর্য ও শিক্ষা- রমযান-শাওয়াল ’২৭ অক্টো.-নভে. ’০৬
* রমযান ও ঈদের চাঁদ : কার দায়িত্ব কী- শাবান-রমযান ’২৮ সেপ্টে.-অক্টো. ’০৭
* হাদীস ও আছারের আলোকে রোযার মাসায়েল- শাবান-রমযান ’৩৩ জুন-জুলাই ’১৩