শিশুর মন
ইবতিদায়ী মাদরাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। পথে শিশুশ্রেণীর ক’জন তালিবে ইলমের সাথে দেখা। সকলেরই বয়স পাঁচের কিছু বেশি। আমাকে দেখে সবাই সালাম দিল। ‘আসসালামু আলাইকুম’। আমিও উচ্চস্বরে উত্তর দিলাম- ‘ওয়াআলাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ’। ওদের একজন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল- ‘অনেকে সালামের উত্তর চুপে চুপে দেন’। হাসিমুখে এ কথা বলে শিশুছেলেটি হাটতে শুরু করল।
কিছুদিন আগে এক তালিবে ইলমকে দেখলাম মাদরাসার দরসের সময় বাসার সামনে খেলা করছে। সে শিশুশ্রেণীতে নতুন ভর্তি হয়েছে। তাকে খেলতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মাদরাসায় যাওনি তুমি? কেন যাওনি?’ শিশুটির আনমনা উত্তর, ‘মাদরাসায় গেলে আমাকে শুধু মারে’। পাশ থেকে একজন বলল, ‘হুযুররা তোমাকে মারে?’ ছোট্ট শিশুটি রাগত স্বরে তাড়াতাড়ি উত্তর দিল, ‘না, হুযুররা মারে না। আমার ক্লাসের ছেলেরা মারে’। ... ছেলেটির উত্তরে আমি অবাক হলাম।
***
উভয় দৃশ্যে যে বিষয়টি ফুটে উঠে তা হচ্ছে, শিশুরাও বুঝে। ওদেরও রয়েছে বোধ ও অনুভূতি। আছে ভাল-মন্দের মাঝে তফাৎ করার সাহস। তাই তাদের অনুভূতিগুলোর মূল্যায়ন করা দরকার। তাদের কথা ও কাজের গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমরা অনেকেই মনে করি শিশুকালটা তরবিয়তের সময় নয়। এটা তো ‘ছেলেবেলা’। আসলে শিশুকালটাই হচ্ছে তারবিয়াতের শ্রেষ্ঠ সময়। কারণ, জীবনের এ সময়টা হচ্ছে শূন্য ক্যানভাসের মত, নির্মল ও পবিত্র। এখন তার সামনে যা কিছুই দেখানো হবে, তাকে যা শিখানো হবে তা-ই সে গ্রহণ করবে এবং স্মরণশক্তি যতদিন আছে ততদিন তা লালন করবে।
ইমাম গাজালী রাহ. বলেন, ‘শিশু বাবা-মা’র কাছে আমানত। তার অন্তর মূল্যবান মণিমুক্তার মত নির্মল ও নিষ্কলংক। শূন্য ক্যানভাসের মত পবিত্র ও নির্মল। তা যে কোনো চিত্রের জন্যই উপযোগী এবং তাকে যে দিকে ইচ্ছে ফেরানো যায়। তাকে যদি ভালো কাজে অভ্যস্ত কর তাহলে সে এর উপরই গড়ে উঠবে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সৌভাগ্যবান হবে। ... আর যদি তাকে মন্দ কাজে অভ্যস্ত কর, পশুর মত অবজ্ঞা ও উপেক্ষা কর তবে সে হতভাগ্য ও ধ্বংস হবে।’ ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, ৩/১০৪-১০৫
জীবনের প্রথম কয়েকটি বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশুর বয়স যখন দেড় থেকে দুই বছর তখন থেকেই সে বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্যদের অনুসরণ করতে শুরু করে। তখন থেকেই সে শিখতে শুরু করে। এ সময়ের শিক্ষা-দীক্ষা অন্য যে কোনো সময়ের শিক্ষা-দীক্ষার চেয়ে কম গুরুত্বের নয়।
আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি যে, দুই বছরের একটি শিশু মাঝে মাঝে তার বাবা-মাকে নাম ধরে ডাকে। এটা আর কিছু নয় শুধুমাত্র অনুসরণ। সে যখন দেখে দাদা-দাদি তার আব্বুকে নাম ধরে ডাকে, সেও আব্বুকে ‘আব্বু’ না বলে দাদা-দাদির মত নাম ধরে ডাকতে শুরু করে। এই যে শিশুর অনুসরণপ্রিয়তা, তা শুধু ভালোর ক্ষেত্রেই হবে তা নয়। ভালো-মন্দ সব ক্ষেত্রেই তা হতে পারে। ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝার যোগ্যতা তার নেই। সে এখন শুধু অনুসরণ-অনুকরণ করতে পারে। মানুষের স্বভাবজাত যোগ্যতা এটি। তাই এ সময় থেকেই যদি আমরা শিশুকে ভালো কাজে অভ্যস্ত করতে পারি তাহলে সন্তানের তরবিয়াতের পথে অনেকটাই অগ্রসর হতে পারব।
এর পরের বয়সটাতে সে ভালো-মন্দের তফাৎ করতে পারে ঠিকই কিন্তু অনুসরণপ্রিয়তাকে ছাড়তে পারে না। তাই মন্দ কাজেও সে অন্যের অনুসরণ করে। আর যেহেতু বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেই তার শেখা ও বুঝা শুরু হয়, তাই তাদের আচার-আচরণই সন্তানকে সবচে’ বেশি প্রভাবিত করে। বাবা-মা’র চিন্তাচেতনা, কথাবার্তা, চালচলন, পোশাক-আশাক এমনকি খাদ্যাভ্যাস পর্যন্ত সন্তানের মন ও মননে গভীর রেখাপাত করে। তাই শিশুকাল থেকেই সন্তানের যত্ন, প্রতিপালন ও তারবিয়াতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া।