পাপ-পুণ্যের ধারা
দুনিয়া হচ্ছে আখেরাতের কর্মক্ষেত্র। এই কর্ম যাতে সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে আঞ্জাম দেওয়া যায়, সেজন্য মানুষকে প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ, শক্তি-সামর্থ্য ও দিকনির্দেশনা দান করা হয়েছে। এসব কাজে লাগিয়ে একজন মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি-ধন্য হতে পারে। দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানকে জ্যোতির্ময় করতে পারে। গড়ে তুলতে পারে নেক ও সওয়াবের প্রভূত সঞ্চয়।
এ প্রচেষ্টার সর্বশেষ সীমা হল মৃত্যু। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সমাপ্তি ঘটে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সকল সম্পর্ক। নিঃশেষ হয়ে যায় যাবতীয় কর্মক্ষমতা। না ভালো কাজের শক্তি থাকে, না মন্দ কাজের। না সওয়াব উপার্জনের সক্ষমতা থাকে, না গোনাহ কামানোর।
মৃত্যুর পর শুরু হওয়া জীবনের প্রথম মনযিল হল কবর। কবরের জীবনের পর সকলকে আল্লাহ তাআলার কাছে সমবেত হতে হবে। তিনি পার্থিব জীবনের হিসাব-নিকাশ নিবেন এবং ভালো-মন্দ যাবতীয় কর্মের প্রতিদান দিবেন। তখন কারো ঠিকানা হবে জান্নাত, কারো জাহান্নাম।
সেদিন নেককার ও গোনাহগার উভয়েরই নিজ নিজ কৃতকর্ম স্মরণ হবে। নেককার আফসোস করবে কেন আরো বেশি নেক অর্জন করেনি। আর গোনাহগারের অনুতাপ তো হবে অন্তহীন- কেন গোনাহ থেকে বেঁচে থাকেনি। কেউ কেউ তাদেরকে আবার দুনিয়াতে পাঠানোর আবেদন করবে। কিন্তু এ কি সম্ভব?
বুদ্ধিমানের কর্তব্য গোনাহ থেকে যথাসম্ভব বেঁচে থাকা। আখেরাতের চিরস্থায়ী সুখ ও শান্তির পথে অগ্রগামী হওয়া এবং মৃত্যুর আগেই মৃত্যু ও তার পরের জীবনের যথোচিত প্রস্তুতি নেওয়া।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে তাঁর প্রিয় মুমিনদেরকে এ কথাই স্মরণ করিয়েছেন-
وَ اَنْفِقُوْا مِنْ مَّا رَزَقْنٰكُمْ مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَ اَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَیَقُوْلَ رَبِّ لَوْ لَاۤ اَخَّرْتَنِیْۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیْبٍ فَاَصَّدَّقَ وَ اَكُنْ مِّنَ الصّٰلِحِیْنَ وَ لَنْ یُّؤَخِّرَ اللهُ نَفْسًا اِذَا جَآءَ اَجَلُهَا وَ اللهُ خَبِیْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَ .
আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় কর, এর আগে যে, তোমাদের কারো মৃত্যু এসে যাবে আর তখন সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাকে কিছু কালের জন্য সুযোগ দিলে না কেন, তাহলে আমি দান-সদকা করতাম এবং নেক লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম। যখন কারো নির্ধারিত কাল এসে যাবে তখন আল্লাহ তাকে কিছুতেই অবকাশ দিবেন না। আর তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবহিত। -সূরা মুনাফিকূন (৬৩) : ১০-১১
হাদীসে বুদ্ধিমানের পরিচয় এভাবে ব্যক্ত হয়েছে-
الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ، وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا، وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.
বুদ্ধিমান সে-ই যে নিজের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য আমল করে। আর অক্ষম সে-ই যে নিজের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী চলে এবং আল্লাহর কাছে (বৃথা) আশা পোষণ করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৯
চতুর্থ খলীফা আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর একটি বক্তব্যে দুনিয়া-আখেরাতের স্বরূপ ও আমাদের করণীয় এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
إِنَّ الدُّنْيَا قَدْ تَرَحَّلَتْ مُدْبِرَةً، وَإِنَّ الْآخِرَةَ مُقْبِلَةٌ وَلِكُلِّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا بَنُونَ، فَكُونُوا مِنْ أَبْنَاءِ الْآخِرَةِ، فَإِنَّ الْيَوْمَ عَمَلٌ وَلَا حِسَابَ، وَغَدًا حِسَابٌ وَلَا عَمَلَ.
দুনিয়া ফিরে যাচ্ছে আর আখেরাত এগিয়ে আসছে। আর এ দুটির প্রত্যেকটিরই আছে সন্তানাদি। তোমরা আখেরাতের সন্তান হও। কারণ আজ শুধু আমল, হিসাব নেই। আর আগামীকাল শুধু হিসাব, আমল নেই। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৩৫৬৩৬
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এক বিশেষ নিআমত হল, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমলের ধারা বন্ধ হয়ে গেলেও জীবদ্দশায় নির্দিষ্ট কিছু আমল করে গেলে মৃত্যুর পরও সওয়াব জারি থাকে। অর্থাৎ মানুষ নিজেই নিজের জন্য সওয়াব পৌঁছার ব্যবস্থা করে যেতে পারে এবং চাইলে অন্য কেউও তাকে সওয়াব পৌঁছাতে পারে। এ উভয় পদ্ধতিই আল্লাহ তাআলার একান্তই দয়া ও অনুগ্রহ। নতুবা বান্দার কি সাধ্য ছিল কর্মক্ষমতা হারানোর পরও প্রতিদান লাভের? প্রথম পদ্ধতিটির নির্দিষ্ট কোনো নাম নেই। আলোচনার সহজতার জন্য একে ‘সওয়াব লাভের উপায়’ বলা যেতে পারে। আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটি ‘ঈসালে সওয়াব’ নামে অধিক পরিচিত। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে প্রথম পদ্ধতিটি (সওয়াব লাভের উপায়) সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা উপকারী বলে মনে হচ্ছে।
সওয়াব লাভের উপায়
সঠিক পদ্ধতি ও সহীহ নিয়তে করা মুমিনের কোনো নেক আমলই বৃথা যায় না। আল্লাহ তাআলার কাছে এর বিনিময় সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু মৃত্যুর পর যেহেতু কোনো আমল করা সম্ভব নয় তাই সওয়াব ‘কামাই করা’ও অসম্ভব। তবে এমন কিছু আমল আছে, যা জীবদ্দশায় করে গেলে মৃত্যুর পরও সওয়াব ও উপকারিতার ধারা অব্যাহত থাকে । যথা-
এক. সদকায়ে জারিয়া
সদকামাত্রই উপকারী ও বিরাট সওয়াবের কাজ। এর বহু প্রকার ও ধরন রয়েছে। কিছু সদকা আছে অস্থায়ী। যেমন কাউকে খাদ্যদ্রব্য দান করা। আর কিছু সদকা আছে স্থায়ী। যেমন মসজিদ নির্মাণ করা। এই প্রকার সদকাকে ‘সদকায়ে জারিয়া’ বলা হয়। সদকায়ে জারিয়া করলে মৃত্যুর পরও দানকারীর ‘সওয়াব-সঞ্চয়’ সমৃদ্ধ হতে থাকবে। এর ¯্রােতধারা তার ‘পুণ্য-তরি’কে চলমান রাখবে।
এখানে সদকায়ে জারিয়ার কিছু উদাহরণ উল্লেখ করছি :
১. মসজিদ নির্মাণ।
২. মকতব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা।
৩. দ্বীনী পাঠাগার ও দ্বীনী কিতাবের ব্যবস্থা করা।
৪. ঈদগাহ বানানো।
৫. কবরস্থান করা।
৬. যে কোনো দ্বীনী কাজের জন্য জমি ওয়াফ্ক করা।
৭. এতীম ও অসহায় লোকদের বাসস্থান ও উপার্জনের ব্যবস্থা করা।
৮. রাস্তা ও পুল নির্মাণ করা।
৯. পানির ব্যবস্থা করা।
১০. ফলদার বৃক্ষ রোপণ করা।
১১. সরাইখানা তৈরি করা।
১২. সীমান্ত পাহারা দেওয়া ইত্যাদি।
দুই. উপকারী ইলম
উপকারী ইলম অর্জনের গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। এর উপকারিতা হাসিল করতে পারে প্রথমত ব্যক্তি নিজেই। সেই সাথে যদি এর প্রচার-প্রসার করা হয়, মানুষকে শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়া হয়, যা দ্বারা তারা যুগ-যুগ ধরে উপকৃত হতে থাকবে, কল্যাণ ও শান্তির পথে এগুতে থাকবে এবং যার ধারাবাহিকতা ব্যক্তির মৃত্যুর পরও চলমান থাকবে, তবে তা আরো বেশি মহিমময়। যতদিন এই ইলম দুনিয়াতে আলো ছড়াতে থাকবে ততদিন তার সওয়াবের ভুবনও আলোকিত হতে থাকবে।
তিন. নেক সন্তান
সন্তান-সন্ততি আল্লাহ তাআলার এক মহা মূল্যবান নিআমত। এ শুধু পার্থিব অবলম্বনই নয়; আখেরাতের সম্বলও বটে। নিজের দুনিয়া ও আখেরাতকে সুন্দর করার পক্ষে বড় সহায়ক। সততা-যোগ্যতা ও তাকওয়া-তহারাতের উপর তাকে প্রতিষ্ঠিত করলে মা-বাবা দুনিয়া-আখেরাত সবখানে উপকৃত হবেন এবং মৃত্যুর পরও এই বৃক্ষের সুফল ভোগ করতে থাকবেন।
উপরোক্ত তিনটি বিষয় হাদীসে এভাবে ব্যক্ত হয়েছে-
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ: إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ.
মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার তিনটি আমল ছাড়া সমস্ত আমল তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমল তিনটি হচ্ছে- সদকায়ে জারিয়া, এমন ইলম, যা থেকে উপকৃত হওয়া যায় এবং নেক সন্তান, যে তার জন্য দুআ করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৩১০
আরেকটি হাদীসে এসেছে, ‘মানুষ যা কিছু রেখে যায় তার মধ্যে তিনটি জিনিস উত্তম- নেক সন্তান, যে তার জন্য দুআ করে। এমন সদকা যা অব্যাহত থাকে। এর সওয়াব সে লাভ করে। এবং এমন ইলম, যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়।’ -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ২৪৯৫
এ তিনটি কাজ পৃথক পৃথকভাবেও বর্ণিত হয়েছে। উপকারী ইলম সম্পর্কে ‘সুনানে ইবনে মাজাহ’র (২৪০) একটি বর্ণনা এ রকম-
مَنْ عَلَّمَ عِلْمًا فَلَهُ أَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِه، لَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الْعَامِلِ.
যে কাউকে ইলম শিক্ষা দেয়, সে এ অনুযায়ী আমলকারীর অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে। আমলকারীর সওয়াব থেকে কমানো হবে না।
অন্য এক হাদীসে এসেছে-
أَفْضَلُ الصَّدَقَةِ أَنْ يَتَعَلَّمَ الْمَرْءُ الْمُسْلِمُ عِلْمًا ثُمَّ يُعَلِّمَهُ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ.
উত্তম সদকা হল নিজে ইলম শিক্ষা করা এবং অপর মুসলিম ভাইকে তা শিক্ষা দেওয়া। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪৩
নেক সন্তান সম্বন্ধে এক হাদীসের ইরশাদ-
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَيَرْفَعُ الدَّرَجَةَ لِلْعَبْدِ الصَّالِحِ فِي الْجَنَّةِ، فَيَقُولُ: يَا رَبِّ، أَنَّى لِي هَذِهِ؟ فَيَقُولُ: بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ.
আল্লাহ তাআলা জান্নাতে নেককারের মর্যাদা উঁচু করলে সে জিজ্ঞেস করবে, হে আমার প্রতিপালক! এটা আমার জন্য কোথা থেকে এল? তিনি বলবেন, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ইস্তিগফারের কারণে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১০৬১০
চার. নেক কাজের সূচনা
নেক কাজের সূচনা করা যথেষ্ট কঠিন। সূচনাকারীকে কত বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিতে হয়! কত ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করতে হয়! এসব কিছু পেছনে ফেলে একটি নেক কাজের ভিত্তি স্থাপন করলে পরবর্তী সময়ে যারা ঐ কাজ করবে তাদের সকলের সমপরিমাণ সওয়াব সে পাবে।
জারীর ইবনে আবদুল্লাহ আলবাজালী রা. থেকে বর্ণিত, একবার কিছু বেদুঈন কম্বল পরিহিত অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এল। তিনি তাদের দুরবস্থা দেখলেন। তারা ভীষণ অভাবগ্রস্ত ছিল। উপস্থিত লোকদেরকে তিনি তাদের জন্য দান করার প্রতি উৎসাহিত করলেন। কিন্তু এ কাজে তারা কিছুটা দেরি করল। এতে নবীজীর চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ পর এক আনসারী একটি রূপার থলি নিয়ে এল। কিছুক্ষণ পর আরেকজন এল। এভাবে একে একে সকলেই দান করলেন। তখন নবীজীর চেহারায় প্রসন্নতা ফুটে উঠল। তিনি ইরশাদ করলেন-
مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً، فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ، كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا، وَلَا يَنْقُصُ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْءٌ، وَمَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً، فَعُمِلَ بِهَا بَعْدَهُ، كُتِبَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا، وَلَا يَنْقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْءٌ.
যে ইসলামে কোনো উত্তম নিয়ম চালু করে, যে অনুযায়ী পরবর্তীতে আমল করা হয়, তার জন্য আমলকারীদের অনুরূপ সওয়াব লেখা হবে। তাদের সওয়াব সামান্য পরিমাণও কমানো হবে না। আর যে ইসলামে কোনো মন্দ নিয়ম চালু করে, যে অনুযায়ী পরবর্তীতে আমল করা হয়, তার জন্য আমলকারীদের অনুরূপ গোনাহ লেখা হবে। তাদের গোনাহ কিছুমাত্রও কমানো হবে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০১৭
পাঁচ. মৃত সুন্নাহ জীবিত করা
যে কোনো সুন্নাহ মানুষের কর্ম থেকে বিলুপ্ত হতে থাকলে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর চিন্তা ও বিশ্বাস থেকে হারাতে শুরু করলে তো কথাই নেই। আরো কঠিন হয় যখন সেটার জায়গায় কোনো বিদআত এসে ঢুকে পড়ে। এ জাতীয় মৃত সুন্নাহ পুনরুজ্জীবিত করলে পরবর্তীতে যারা ঐ সুন্নাহর অনুসরণ করবে তাদের সকলের অনুরূপ সওয়াব তার আমলনামায় জমা হবে।
নবীজীর ইরশাদ-
مَنْ أَحْيَا سُنَّةً مِنْ سُنَّتِي قَدْ أُمِيتَتْ بَعْدِي، فَإِنَّ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلَ مَنْ عَمِلَ بِهَا...
যে আমার পরে একটি মৃত সুন্নাহ জীবিত করবে সে পরবর্তীতে যারা এ অনুযায়ী আমল করে, তাদের সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। তাদের সওয়াব সামান্য পরিমাণও কমবে না। আর যে এমন কোনো নবআবিষ্কৃত বিষয় উদ্ভাবন করবে, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পছন্দ নয়, পরবর্তীতে যারা এ অনুযায়ী আমল করে, তাদের সমপরিমাণ গোনাহ তার উপর বর্তাবে। তবে তাদের গোনাহ বিন্দুপরিমাণও কমবে না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৭৭
ছয়. হেদায়েতের দিকে ডাকা
ইসলামে ব্যক্তিগত সংশোধনে আত্মতৃপ্তি পছন্দনীয় নয়; আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী ও অন্যান্যদের হেদায়েতের ব্যাপারেও আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নিজের দ্বীনের সহীহ বুঝ ও সমঝ অর্জন এবং নিজের জীবনে তা বাস্তবায়নের পাশাপাশি মুসলিমের এক দায়িত্ব হল অপরকে এর দিকে ডাকা, তার কাছে ইসলামের কল্যাণকর শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া। বস্তুত দাওয়াত হচ্ছে হেদায়েতের নূর সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার এক মূল্যবান উপায়। যারা এই দাওয়াতে সাড়া দেবে তাদের অনুরূপ সওয়াব আহ্বানকারীর সংগৃহীত হবে। তাদের আমলের ধারা যদি তার মৃত্যুর পর পর্যন্ত বহাল থাকে, তাহলে ততদিন পর্যন্তই সে এর সওয়াব পেতে থাকবে।
হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-
مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى، كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ...
যে মানুষকে হেদায়েতের দিকে ডাকে পরবর্তীতে যারা তা অনুসরণ করে তাদের অনুরূপ সওয়াব তাকে দান করা হবে। তবে ওদের সওয়াব বিন্দুপরিমাণও কমবে না। আর যে গোমরাহীর দিকে ডাকে পরবর্তীতে যারা তা অনুসরণ করে তাদের সমপরিমাণ গোনাহ তাকে বহন করতে হবে। এতে ওদের গোনাহ সামান্য পরিমাণও কমবে না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৭৪
সারকথা হল, এ ছয়টি কাজ (সদকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম, নেক সন্তান, নেক কাজের সূচনা, মৃত সুন্নাহের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও হেদায়েতের দিকে ডাকা) করে গেলে মৃত্যুর পরও সওয়াব লাভ করা যাবে।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে দুটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন মনে হচ্ছে-
(ক) উপরোক্ত ছয়টি কাজ মৌলিক শিরোনাম মাত্র। প্রত্যেকটির বিস্তর শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এক সদকায়ে জারিয়ারই তো কত প্রকার! উপকারী ইলমের কত অঙ্গন ও অনুষঙ্গ! নেক কাজ ও সুন্নাহ্র কত বৈচিত্র্য ও বিস্তৃতি এবং হেদায়েতের দিকে ডাকার কত পথ ও পন্থা!
এ ছয়টি কাজের মধ্যে শেষ তিনটি মূলত উপকারী ইলমেরই শাখা। আরও খুলে বললে কুরআন-সুন্নাহ্য় ‘সদকা’ শব্দ যে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সেই হিসেবে নেক সন্তান ও উপকারী ইলমকেও ‘সদকায়ে জারিয়া’ বলা যায়। ‘সহীহ ইবনে খুযায়মা’ গ্রন্থে নি¤েœাক্ত শব্দে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে-
إِنَّ مِمَّا يَلْحَقُ الْمُؤْمِن مِنْ عَمَلِه وَحَسَنَاتِه بَعْدَ مَوْتِهِ عِلْمًا عَلِمَهُ وَنَشَرَهُ، أَوْ وَلَدًا صَالِحًا تَرَكَهُ، أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ، أَوْ بَيْتًا لِابْنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ، أَوْ نَهَرًا كَرَاهُ، أَوْ صَدَقَةً أَخْرَجَهَا مِنْ مَالِهِ فِي صِحَّتِهِ وَحَيَاتِهِ، تَلْحَقُهُ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهِ.
মুমিনের মৃত্যুর পর তার যেসব আমল তার সাথে যুক্ত হয় তা হল- তার শেখানো ও প্রচারিত ইলম। তার রেখে যাওয়া নেক সন্তান। মসজিদ নির্মাণ করা। সরাইখানা তৈরি করা। পানির নহর খনন করা। জীবদ্দশায় সুস্থ অবস্থায় দান-খায়রাত করা। এগুলোর সওয়াব সে মৃত্যুর পরও পায়। -সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ২৪৯০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪২
ইমাম বায়হাকী রাহ. (৪৫৮হি.) এ হাদীসটির সাথে এধরনের আরেকটি হাদীস বর্ণনা করে বলেন-
‘এ দুটি বর্ণনার সহীহ হাদীসের (যাতে আছে যে, তিনটি ছাড়া সমস্ত আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়) সাথে বিরোধ নেই। কারণ এতে ‘সদকায়ে জারিয়া’ বলা হয়েছে, যা এখানের অতিরিক্ত আমলগুলোকে শামিল করে।’ -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী ৩/২৪৮
(খ) এগুলো শুধু সওয়াবের জন্য বিশেষ নয়; গোনাহের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ কেউ যদি গোনাহের কাজে ‘গোনাহে জারিয়া’র সূচনা করে, ক্ষতিকর জ্ঞানের প্রচার-প্রসার করে, ছেলে-মেয়েকে অসৎরূপে গড়ে তুলে, খারাপ কাজের সূচনা বা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, মানুষকে গোমরাহীর দিকে ডাকে, তাহলে যতদিন তা বাকি থাকবে ততদিন তার গোনাহের বোঝা ভারি হতে থাকবে। এই অন্ধকার ছড়ানোর ধারা তার মৃত্যুর পরও চলমান থাকলে মৃত্যুর পরও তার আমলনামা অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে থাকবে।
এ সংক্রান্ত কিছু হাদীস তো পাঠক ইতোমধ্যেই লক্ষ করেছেন। নিম্নে আরও কিছু আয়াত ও হাদীস পেশ করছি।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
لِیَحْمِلُوْۤا اَوْزَارَهُمْ كَامِلَةً یَّوْمَ الْقِیٰمَةِ وَ مِنْ اَوْزَارِ الَّذِیْنَ یُضِلُّوْنَهُمْ بِغَیْرِ عِلْمٍ اَلَا سَآءَ مَا یَزِرُوْنَ.
কিয়ামতের দিন তারা নিজেদের (কৃত গোনাহের) পরিপূর্ণ ভারও বহন করবে এবং তাদেরও ভারের একটা অংশ, যাদেরকে তারা অজ্ঞতার কারণে বিপথগামী করছে। -সূরা নাহল (১৬) : ২৫
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
وَلَيَحْمِلُنَّ أَثْقَالَهُمْ وَأَثْقَالًا مَعَ أَثْقَالِهِمْ.
তারা নিজেদের গোনাহের বোঝা বহন করবে এবং নিজেদের বোঝার সাথে আরো কিছু বোঝা। -সূরা আনকাবুত (২৯) : ১৩
নবীজীর ইরশাদ-
لاَ تُقْتَلُ نَفْسٌ ظُلْمًا، إِلَّا كَانَ عَلَى ابْنِ آدَمَ الأَوَّلِ كِفْلٌ مِنْ دَمِهَا، لِأَنَّهُ أَوَّلُ مَنْ سَنَّ القَتْلَ.
যে কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হবে এর গোনাহের একটা অংশ প্রথম আদম সন্তানের উপর বর্তাবে। কারণ সেই প্রথম হত্যার প্রবর্তন করেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৭৭
আর এগুলো গোনাহের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া শরীয়তের বিধান ‘একজনের গোনাহের বোঝা আরেকজনের উপর বর্তাবে না’- এর সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ, একজনের গোনাহের ভার আরেকজনের উপর বর্তাবে না; যদি এর সাথে তার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা না থাকে। অন্যথায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা থাকলে তার উপরও এর একাংশ গোনাহ বর্তাবে। বলাই বাহুল্য, এটা অন্যের বোঝা নয়, নিজেরই সংশ্লিষ্টতার বোঝা।
সূরা নাহলের ২৫ নং আয়াতের তাফসীরে শাইখুল ইসলাম যাকারিয়া আনসারী রাহ. (৯২৬ হি.) বলেন,
তারা নিজেদের কুফ্র অবলম্বনের বোঝা বহন করবে। সেই সাথে তাদের কারণে যারা বিপথগামী হয়েছে তাদেরও পুরোপুরি বা আংশিক গোনাহ। আর আল্লাহর ইরশাদ- وَ لَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ اُخْرٰی
এর অর্থ হল, যেখানে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই- না কারণগত না অন্য কোনোভাবে। -ফাতহুর রহমান পৃ. ৩০৪
খলীল আহমদ সাহারানপুরী রাহ. (১৩৪৬হি.) من دعا إلى هدى হাদীসটির ব্যাখ্যায় বলেছেন,
‘তুমি যদি প্রশ্ন কর, এ তো বাহ্যিকভাবে আল্লাহর ইরশাদ, وَ لَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ اُخْرٰی -এর সাথে সাংঘর্ষিক?
আমি বলব, উভয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কারণ গোমরাহীর দিকে আহ্বানকারী অনুসরণকারীদের গোনাহ বহন করেনি; বরং তারা যে তার কারণে পথভ্রষ্ট হয়েছে সেটার গোনাহ বহন করেছে।’ -বাযলুল মাজহুদ ১৩/৩৭
এজন্য গোনাহের ধারা চলমান থাকে এমন কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।