সাধারণ শিক্ষিত ও আলেম উলামা পরস্পর কাছাকাছি আসা উচিত
মুসলমানদের হাজার বছরের যে ইতিহাস সেই ধারা যদি আজ পর্যন্ত অব্যাহত থাকত তাহলে এই কাজটি এখন আলাদা করে শুরু করার দরকার হত না। বিভিন্ন খেলাফতের সময় মুসলমানদের যে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল তাতেও ভাগাভাগি ছিল না। শিক্ষার একটা স্তর পর্যন্ত সকল মুসলমানের শিক্ষা এক। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাতে ভাগাভাগি ছিল না। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত যতগুলো জাগতিক শিক্ষা দরকার তা সকল শিক্ষার্থী জানবে এবং ফরযে আইন ইলম ও মুসলমান হিসেবে যা যা জানা দরকার তা সকলে জানবে। কোনো শিক্ষার্থী মুসলমান হিসেবে চলার জন্য আবশ্যকীয় যেসব বিষয় রয়েছে তা জানা থেকে পিছে থাকবে না। আবার জাগতিক বিষয়ের যেগুলো অপরিহার্য সেগুলো জানাও বাকি থাকবে না। এরকম শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ছিল। এক দুই বছর নয়, হাজার বছর ধরে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে ঈমানী দুর্বলতা ও ইসলাম থেকে দূরে সরার কারণে অন্যরা আমাদের ওপর আগ্রাসন চালিয়েছে। অন্যদের আগ্রাসনে ধীরে ধীরে আমাদের ক্ষমতা গেছে, শিক্ষা গেছে, অর্থব্যবস্থা গেছে। সবকিছুই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। নিজেদেরটা হারিয়ে অন্যদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ফেলেছি। যা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এমন এক শিক্ষা-ব্যবস্থা,যা এক অংশ শেখায় আরেক অংশ শেখায় না। যে শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়ন শেখায় কিন্তু সে উন্নয়ন সত্যিকারের উন্নয়ন কীভাবে হবে এবং ইনসাফপর্ণ উন্নয়ন কীভাবে হবে তা শেখায় না। এ কথাগুলো এখানকার জেনারেল শিক্ষিত বন্ধুদের সামনে ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই।
ধরুন,আমাদের দেশসহ গোটা পথিবীই অর্থনীতিতে খুব এগিয়ে গেল। মানুষের ধন-দৌলত বাড়ল। কিন্তু এতে কী হবে? এতে আসলে বৈষম্যও বাড়বে?
ক’দিন আগেও আপনারা দেখেছেন যে,পথিবীর অর্ধেক মানুষের হাতে যা সম্পদ আছে আটজন লোকের হাতে এ পরিমাণ সম্পদ আছে। যদি এ আটজন লোকের সম্পদের দশ ভাগের একভাগ ওই বাকী অর্ধেক গরীব লোকদের কাছে যেত তাহলে এরা হতদরিদ্র থাকত না। এরা একটা মাঝামাঝি পর্যায়ে উঠে আসত। বিশ্বের একেবারে বড় ধনীদের বাদ দিয়ে আমাদের দেশের কথা বলি। আমরা যে শহরে বাস করি, দেখতে পাই একদিকে বিল্ডিংয়ের সাড়ি অন্যদিকে ঘিঞ্জি বস্তি। আমরা যে গাড়ি ব্যবহার করি তাতেও খুব দৃশ্যমান প্রকাশ্য বৈষম্য। শিক্ষার তো উন্নতি হয়েছে,কিন্তু এ বৈষম্য দূর হচ্ছে না কেন?
পার্থক্য থাকবে,সম্পদের ব্যবধান থাকবে,কাজের ফরক থাকবে,কাজ কেউ উঁচু করবে,কেউ নিচু। কেউ কর্মচারী থাকবে,কেউ কর্মকর্তা। কিন্তু মানুষ হিসেবে চলার জন্য ন্যূনতম যা দরকার সেটা সকলকেই পেতে হবে। এই শিক্ষাটা সে কথা বলে না। এটা রয়েছে ইসলামী শিক্ষায়।
একটি উদাহরণ দিয়েছি, আরেকটি উদাহরণ দেই। দুর্নীতি দূর করার জন্য হালালভাবে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু এই যে আরেকটা শ্রেণী, এই শ্রেণীটা এত বেশি লাগামহীন কীভাবে হয়ে উঠল। মুসলমান হয়ে তো এত লাগামহীন হতে পারে না। বোঝা গেল,তার শিক্ষার মধ্যে মুসলমানিত্ব ঢোকেনি,খোদাভীতি ঢোকেনি। যখন থেকে সে পড়ছে সে শুধু পড়াই পড়ছে। যদি এর মধ্যে তাকওয়া ঢুকত, মুসলমানিত্ব ঢুকত তাহলে এরকম লাগামহীন হত না।
মোটকথা,মুসলমান হিসেবে আমার বৈশিষ্ট্য কী,মুসলমান হিসেবে একটি সুন্দর পথিবী প্রতিষ্ঠার অংশ হওয়ার জন্য এবং একটি সুন্দর পথিবী পরিচালনার জন্য আমাকে কীভাবে চলতে হবেÑ এ জিনিসগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অনুপস্থিত।
অন্যদিকে আমাদের মাদরাসা শিক্ষা। যখন ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর পরে উপমহাদেশে ইংরেজদের শাসন আসল তখন তারা শিক্ষাব্যবস্থার আমল পরিবর্তন করেছিল। সেটারই ধারাবাহিকতা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। তখন মুসলমানদের সন্তানদের ন্যূনতম দ্বীনী শিক্ষা দেয়াটা জটিল হয়ে দাঁড়াল। তখন ভারতবর্ষের বুযুর্গ আলেম যারা,তাঁরা চিন্তা করলেন,এ অবস্থা যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে তাহলে শুধু নামের মুসলমান থাকবে;মুসলমানের সন্তানেরা কালিমা জানবে না, দ্বীন জানবে না,নামায পড়ার লোকও থাকবে না। তখন তারা নিছক ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরী করলেন। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তখন জাগতিক শিক্ষা রাখা হয়নি। প্রথমে ওভাবে শুরু করলেন। তাঁরা বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন এবং জেনারেল শিক্ষিতদের সাথে তাদেরও যোগাযোগ ছিল। তাদেরকে জিজ্ঞাসাও করা হয়েছে যে, আপনারা জাগতিক শিক্ষা বাদ দিয়ে ওটা করলেন কেন? তারা বলেছেন, সব তো সয়লাব হয়ে গেছে। এখনকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্বীন বলতে কিছু নেই। সতরাং বিকল্প হিসেবে এখন শুধুই ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা অগ্রসর হলে আস্তে আস্তে আবার সমন্বয় ঘটবে।
ধীরে ধীরে সে শিক্ষাব্যবস্থা এখন উন্নতি করেছে। এখন যে দ্বীনী মাদরাসাগুলোতে দ্বীন শিক্ষা দেয়া হয় ওখানে প্রাথমিক পর্যায়ে জাগতিক শিক্ষারও ব্যবস্থা আছে। উপমহাদেশের মাদরাসাগুলোতে আছে। আমাদের দেশের মাদরাসাগুলোতেও আছে। কিন্তু যে জেনারেল শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে আছে, সেখানে এমন একটা মানসিকতায় আমরা পৌঁছেছি যে, শিক্ষার বইয়ের মধ্যে মনে হচ্ছে আল্লাহ শব্দ থাকাটা অপরাধ। ওড়না শব্দ থাকাটা দোষণীয়। সেটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, বিক্ষোভ হচ্ছে। তাহলে আমরা কোন্ জায়গায় পৌঁছেছি,যেখানে এ শব্দগুলোই সহ্য করানো হচ্ছে না। এজন্য আমরা চাই এবং অনেক ওলামায়ে কেরাম চান যে,জেনারেল শিক্ষা ও দ্বীনী শিক্ষা দটোই কাছাকাছি আসা উচিত। জেনারেল শিক্ষিত শ্রেণী এবং আলেম-ওলামা পরস্পর কাছাকাছি আসা উচিত। উন্নত সমাজব্যবস্থার জন্য পরস্পরের সহযোগিতা দরকার এবং প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছ থেকে কিছু কিছু অর্জন করা দরকার। এ প্রয়োজনকে চিন্তা করেই এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান ছোট পরিসরে হলেও শুরু হতে যাচ্ছে। মাশুক ভাইয়ের (খ্যাতিমান চার্টার্ড একাউন্টেন্ট) মেহনতে। তিনি কুমিল্লারই সন্তান। তাঁর দ্বীনী জযবাÑ কিছু দ্বীনী খেদমত করার। এ বাড়ি তিনি ভাড়া নিয়েছেন এবং সংস্কার করেছেন। তিনি বলেছেন দ্বীনী কাজ করার কথা। কী কাজ করা হবে সেটা বলেননি। তাঁর কথা, আপনাদের যা ইচ্ছা হয় করুন। আমরা চিন্তা করেছি যে, এ ধরনের একটা কাজ এখান থেকে শুরু হোক।
আমরা এখানে যেটা শুরু করতে চাই তা নিছক একটি প্রতিষ্ঠান নয়; বরং এর মাধ্যমে আমরা একটা পথ দেখাতে চাই। এটা মহল্লায় মহল্লায় হবে। এবং ইনশাআল্লাহ পুরো দেশে হবে। আমরা চাই যে, আমাদের কচিকাঁচারা যারা এখন স্কলে পড়ছে, এরা স্কুল থেকে কলেজে যাবে,স্কুল থেকে কলেজে যাবে, ইউনিভার্সিটিতে যাবে,এরপর কর্মজীবনে কোনো সরকারী চাকুরী নিবে কেউ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে যোগ দিবে, কেউ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলবে,যেখানেই সে থাকুক,একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে থাকুক। আদর্শ মানুষ হওয়ার জন্য যে যে গুণ অর্জনের কথা আল্লাহ তাআলা বলেছেন,সেগুলো সে অর্জন করবে। যতটুকু তার স্কলের সিলেবাসে আছে ততটুকু সেখান থেকে শিখবে। অতিরিক্ত আরো প্রয়োজনীয় যে দ্বীনী বিষয়গুলো আছে,তা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে শিখবে। এভাবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ পাবে আদর্শ মুসলমান ডাক্তার,মুসলমান ইঞ্জিনিয়ার,মুসলমান ডিসি, এসপি, সচিব ইত্যাদি। তখন দূদকের মত বিভিন্ন সংস্থার পিছনে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে না।
আমরা ছেলেদের উপর বোঝা চাপাতে চাইনা,বরং আমরা চাই,কয়েক বছর লাগিয়ে শিখবে এবং অল্প অল্প সময় করে শিখবে। এক ঘণ্টা বা দুঘণ্টার প্রোগ্রাম। এর ভেতরে তাকে কুরআনে কারীম সহীহ-শুদ্ধ করে শিক্ষা দেওয়া এবং দ্বীনের অন্যান্য জরুরি বিষয়াদি, জরুরি মাসআলা-মাসায়েল এবং সে কর্মজীবনে গেলে কীভাবে দ্বীনী বিষয়গুলো সমাধা করবে এর দিক-নির্দেশনা দেওয়া হবে। সে যেন পরিবারের একজন আদর্শ সদস্য হতে পারে। আদর্শ সন্তান,আদর্শ ভাই,আদর্শ ভাতিজা,আদর্শ পিতা,আদর্শ দাদা হতে পারে এর নির্দেশনাগুলো এ প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়ার চেষ্টা করা হবে। ইনশাআল্লাহ হবে। যাদের স্কুল সকাল শিফটে তারা বিকেলে সময় দিবে এবং যাদের স্কুল বিকেলে তারা সকালে সময় দিবে। আর যারা বয়স্ক,তাদের জন্য বাদ মাগরিব সান্ধ্যকালীন ব্যবস্থা থাকবে। প্রথম যেদিন মশওয়ারা হয়েছিল সেদিন অনেকে প্রস্তাব রেখেছিলেন যে,কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের জন্যও প্রোগ্রাম রাখা হোক।
কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রামে যুক্ত হতে পারবেন। তারপরও আমরা কিছু চিন্তা করেছি যে, উচ্চ পর্যায়ের ছাত্ররা দ্বীনী বিভিন্ন বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হয় এবং বিভিন্ন মতাদর্শ সামনে আসার কারণে অনেক বিষয়ে সংশয়গ্রস্ত হয়। সে ধরনের বিষয় নিয়েও মাঝে মাঝে এখানে দিনব্যাপী বা খ-কালীন আলোচনা সভা,সেমিনারের ইচ্ছা আছে। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন ও কবুল করুন।