তালীমুদ্দীন একাডেমী কুমিল্লা : সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের দ্বীন শিক্ষার একটি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ
সর্বস্তরের মানুষের মাঝে প্রয়োজনীয় দ্বীনী শিক্ষার বিস্তার অতি জরুরি। দ্বীনী জ্ঞানের অভাবে আকীদা-ইবাদত থেকে শুরু করে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই বড় বড় ত্রুটি থেকে যায়,যা একজন মুসলিমের জীবনে থাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ কারণে দ্বীনী মাদরাসার তালিবানে ইলমের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, সাধারণ শিক্ষিত ও নানা পেশায় নিয়োজিত মুসলিমেরাও কীভাবে প্রয়োজনীয় দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করতে পারেন এ বিষয়ে দরদী উলামায়ে কেরামের ফিকির ও মেহনত অব্যাহত ছিল,এখনো আছে। এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবানিতে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছে ‘তালীমুদ্দীন একাডেমী’ নামে একটি নতুন ধারার দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আলহামদু লিল্লাহ।
গত ২০ জুমাদাল উলা ১৪৩৮ হিজরী,মোতাবেক ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ঈসায়ী,রোজ শনিবার নগরীর বাগিচাগাঁও বড় মসজিদের অদূরে অবস্থিত কে. বি. হাউসে এই প্রতিষ্ঠানটির পথচলা শুরু হয়। এ উপলক্ষে এক উদ্বোধনী সভার আয়োজন করা হয়েছিল।
ঢাকা ও কুমিল্লার শীর্ষস্থানীয় ও বুযুর্গ ওলামায়ে কেরাম এই মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রিত ওলামায়ে কেরামের মধ্যে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র জামিআ কাসিমুল উলূমের শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আশরাফ আলী দামাত বারাকাতুহুম,জামিআ ইসলামিয়া কওমিয়া হামীদিয়া বটগ্রামের মুহতামিম হযরত মাওলানা নূরুল হক দামাত বারাকাতুহুম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আরো ছিলেন হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর খলীফা,হযরত হামীদুর রহমান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম।
কুমিল্লার বর্ষীয়ান ও বুযুর্গ আলেম,ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া বটগ্রামের মুহতামিম হযরত মাওলানা নূরুল হক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম ইলমে দ্বীনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে হৃদয়গ্রাহী আলোচনা করেন। চমৎকার উপমার মাধ্যমে তুলে ধরেন সুশিক্ষা,অশিক্ষা ও কুশিক্ষার পার্থক্য। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বলেন,‘মুসলমানদের ঐক্য নির্ভর করে ইলমের উপর। ইলম না থাকা সমস্ত অনৈক্যের মূল কারণ। সকলে ইলম শিখলে এত অনৈক্য থাকত না। এজন্য রাসূল সকলের উপর ইল্ম শিক্ষা করাকে ফরয করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন,‘মারকাযুদ দাওয়াহ এখানে যে উদ্যোগ নিয়েছে,আমি একে ষোল আনা সমর্থন করি। আমি আপনাদের নিকট অনুরোধ করি,শুধু ছেলেরা নয়,বয়স্করাও সময় দিবেন।’
সভার প্রধান অতিথি শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আশরাফ আলী ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম মূল্যবান দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বলেন,‘ইংরেজরা এ দেশে ধর্মহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা,ধর্মহীন বিচারব্যবস্থা,ধর্মহীন অর্থব্যবস্থা এবং ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে। এই শিক্ষা-ব্যবস্থার ব্যাপারে লর্ড ম্যাকলের বক্তব্য ছিল, আমরা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে গেলাম,যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এই উপমহাদেশের অধিবাসীরা দেখতে শুনতে এ দেশীয় মনে হলেও মানসিকতায় ইউরোপিয়ান হয়ে যাবে। বাস্তবে তাই হল।
‘দ্বীনী শিক্ষা না থাকলে চরিত্রবান নাগরিক হতে পারে না। বলা হয় শিক্ষা জাতির মেরুদ-,আর ধর্মহীন শিক্ষা জাতির মেরুদ- ভাঙ্গার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। প্রয়োজন ছিল সরকারিভাবেই সর্বস্তরে দ্বীনী শিক্ষা রাখার। কারণ আমি প্রথমে মুসলমান তারপর দার্শনিক,প্রথমে মুসলমান তারপর বিজ্ঞানী,প্রথমে মুসলমান তারপর প্রকৌশলী। আমার প্রথম পরিচয় হল আমি মুসলমান।’
‘ইসলামী শিক্ষাই মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে। অসভ্যকে সুসভ্য বানায়। চরিত্রহীনকে চরিত্রবান বানায়। কিন্তু যেহেতু এখন চলছে ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা তাই এ অবস্থায় জেনারেল শিক্ষিতদের জন্য দ্বীন শেখার ব্যবস্থা করা খুবই প্রয়োজন।’
বিষয়টি তিনি সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও উত্থাপন করেছেন বলে সভাকে জানান।
তিনি বলেন,‘মারকাযুদ দাওয়াহ-এর তত্ত্বাবধানে এখানে যে কাজ শুরু হয়েছে অতি গুরুত্বপর্ণ কাজ এটা। অতি মূল্যবান কাজ এটা।’
‘আমার অনুরোধ, আমরা যেন এ উদ্যোগটাকে সাদরে গ্রহণ করি। সবাই সহযোগিতা করি। বয়স্ক যারা আছি তারাও যেন এখানে সময় দেই। ছেলেদেরকেও এখানে পড়ানোর ব্যবস্থা করি।’
হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম গুরুত্বপর্ণ নসীহত পেশ করেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর পরামর্শে তৎকালীন বুয়েটে প্রতিষ্ঠিত দ্বীনী প্রতিষ্ঠান ও তার নানা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি উদ্যোগটিকে একটি চ্যালেঞ্জিং উদ্যোগ বলে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন এবং তালীমুদ্দীন একাডেমীর জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। পরিশেষে আন্তরিক দুআ দিয়ে তাঁর মূল্যবান নসীহত সমাপ্ত করেন।
মাওলানা শামছুল ইসলাম জিলানী সাহেব বলেন,‘দ্বীনী শিক্ষা থেকে আমরা অনেক দূরে। যেহেতু সকলের মাদরাসায় গিয়ে দ্বীন শেখার সুযোগ নেই বা অনেকের মধ্যে এই মানসিকতাও সৃষ্টি হয় না,এজন্য এজাতীয় প্রতিষ্ঠান হলে আমাদের জন্য দ্বীন শেখাটা সহজ হবে।’
‘এ প্রতিষ্ঠানকে পেয়ে আমরা অনেক আনন্দিত। এর শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারব না। আমি এ কথাই বলব,আমরা এর দাওয়াতটা ঘরে ঘরে পৌঁছানোর চেষ্টা করি এবং যত ব্যস্ততাই থাকুক দ্বীন শেখার জন্য নিয়মিত কিছু সময় বের করি। অন্তত কিছুদিন বসে দেখুন তাহলে প্রয়োজন অনুভব হবে। তখন নিজেই বলবেন যে,আরো আগে এখানে কেন আসলাম না।’
তালীমুদ্দীন একাডেমী কুমিল্লার প্রধান শিক্ষক ও মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়াহ ঢাকা-এর উস্তায মাওলানা মুহাম্মাদ আনওয়ার হুসাইন ছাহেব তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন,এখানে যে মেহনত শুরু হতে যাচ্ছে এটা নতুন কোনো মেহনত নয়;বরং পুরাতনকে ফিরিয়ে আনা। আগে মুসলমানের সন্তানেরা যেমন কুরআন শিখত, কুরআন জানত এখানেও সেই মেহনতকেই যিন্দা করা হচ্ছে এবং এ চেষ্টাই করা হচ্ছে যে,আমাদের সন্তান যেন আমাদেরই থাকে। আমরা আপনাদের নিকট কিছুই চাই না। শুধু আপনাদের একটু সময় চাই এবং আপনাদের সন্তানদের একটু সময় চাই।
তালীমুদ্দিন একাডেমীর বর্তমান কার্যক্রম
সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত,দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসাইলসহ পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও ঈমানী চেতনার উজ্জীবনের লক্ষ্যে বর্তমানে তিন শিফটে পাঠদান কর্মসূচি।
বৈকালিক স্কুলের ছাত্রদের জন্য সকাল ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত। প্রভাতী স্কুলের ছাত্রদের জন্য বিকাল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত। কলেজ,ইউনিভার্সিটির ছাত্র,চাকরিজীবী,ব্যবসায়ী,বিভিন্ন পেশাজীবী ও বয়স্কদের জন্য বাদ মাগরিব থেকে ইশা পর্যন্ত। দূর থেকে আগত ও দূরে কর্মস্থল-এমন লোকদের জন্য বাদ ইশা ১ ঘণ্টাব্যাপী পাঠদান কর্মসূচিও চালু হয়েছে। এ ছাড়া সমসাময়িক বিষয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মাসআলা-মাসাইল নিয়ে নিয়মিত সেমিনার এবং জেএসসি,এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা পরবর্তী ছুটি ও বিভিন্ন ছুটিতে শিক্ষার্থীকে হাতে-কলমে দ্বীনী বিষয়গুলো শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করবে ইনশাআল্লাহ। এছাড়া আশপাশের মাদরাসার তালিবুল ইলমদের জন্যও পৃথক মুহাযারার আয়োজন,তাদের ভবিষ্যত দ্বীনী ও দাওয়াতী কার্যক্রম সহজ ও ব্যাপক করার লক্ষ্যে নানামুখী প্রশিক্ষণ এবং স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি বিভিন্ন কর্মশালাও আয়োজন করবে ইনশাআল্লাহ। এই মজলিসে তালীমুদ্দীন একাডেমী কুমিল্লার তত্ত্বাবধান ও পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান মারকাযুদদাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর সম্মানিত মুদীর হযরত মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম ও আমীনুত তালীম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রাখেন। তাঁদের মূল্যবান আলোচনা এখানে উপস্থাপন করা হল। মুসাজ্জিলাহ থেকে আলোচনা দুটি পত্রস্থ করেছেন মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ কুমিল্লায়ী। আল্লাহ তাআলা তাকে ও সংশ্লিষ্ট সকলকে জাযায়ে খাইর দান করুন এবং আমাদের সকলকে উপকৃত করুন- আমীন।