প্রযুক্তি : সেলফি
বর্তমান সময়ে সেলফি-আসক্তি অনেকটা মনোরোগের পর্যায়ে চলে গেছে। মনস্তত্ববিদগণ এভাবেই তা ব্যাখ্যা করছেন। সেলফির বিচিত্র রূপ ও ব্যাপক বিস্তার সামনে রাখলে তাদের ব্যাখ্যার যথার্থতা বেশ বুঝে আসে।
কিছু কিছু সেলফি আছে যা সরাসরি নিজের প্রাণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা। হিংস্র প্রাণীর সাথে সেলফি, চলন্ত ট্রেনের সামনে সেলফি, পাহাড়ের চূড়ার প্রান্তে পা ঝুলিয়ে সেলফি, আরো কত রকমের সেলফি যে মানুষ তুলছে এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আহত-নিহত হচ্ছে তা একজন সাধারণ পত্রিকা-পাঠকেরও অজানা নয়। এখন তো সেলফির দৌরাত্ম্য ইবাদত-বন্দেগী পর্যন্তও পৌঁছে গেছে। মুসলমানের বহু কাঙ্ক্ষিত ইবাদত হজ্বে ও তাওয়াফেও সেলফির ছড়াছড়ি!
সেলফির মূল কথাটি হচ্ছে নিজেকে বা নিজের বিশেষ কোনো মুহূর্তকে নিজে ধারণ করা। এই ধারণের প্রেরণা কী, উদ্দেশ্য কী? সাধারণত তা হয় মনের ইচ্ছা পূরণ, ক্ষণিকের আনন্দ এবং অন্যের কাছে নিজেকে উপস্থাপন ।
মনের সকল ইচ্ছা পূরণ কি মানুষের জন্য কল্যাণকর? আর মানুষের কাছে সবকিছু উপস্থাপন করে কী লাভ? নিজেকে ও নিজের সকল মুহূর্তকে উপস্থাপন করতে হবে একমাত্র আল্লাহর কাছে। কুরআন মাজীদ আমাদের শেখাচ্ছে, ‘আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার জীবন, আমার মরণ আল্লাহর জন্য, যিনি রাব্বুল আলামীন।’
আমার হজ্ব, আমার তাওয়াফ তো মানুষের জন্য নয়, আমার নিজের ইচ্ছা পূরণ বা বিনোদনের জন্যও নয়, এ তো আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবার জন্য। আমি কি চিন্তা করেছি, সেলফির মতো সামান্য একটি ইচ্ছাপূরণের দ্বারা আমার ইবাদতটিই মাটি হয়ে যাচ্ছে? সেলফির দ্বারা তো ইবাদতের স্বরূপই বদলে যায়। বলুন তো ইবাদতের মধ্যে যে আল্লাহর বান্দা সেলফিগ্রস্ত হয় তার উদ্দেশ্য কি ইবাদত থাকে, না ইবাদতের অঙ্গ-ভঙ্গি? সে তো ইবাদত করছে না, ছবি তোলার জন্য ইবাদতের অঙ্গ-ভঙ্গি করছে। কিংবা অন্তত আল্লাহকে ভুলে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই প্রাণহীন অঙ্গ-ভঙ্গির কী মূল্য তাহলে আল্লাহর কাছে হতে পারে? কুরআন মাজীদের এক জায়গায় আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
لَیْسَ الْبِرَّ اَنْ تُوَلُّوْا وُجُوْهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَ الْمَغْرِبِ وَ لٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ اٰمَنَ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَ الْمَلٰٓىِٕكَةِ وَ الْكِتٰبِ وَ النَّبِیّٖنَ وَ اٰتَی الْمَالَ عَلٰی حُبِّهٖ ذَوِی الْقُرْبٰی وَ الْیَتٰمٰی وَ الْمَسٰكِیْنَ وَ ابْنَ السَّبِیْلِ وَ السَّآىِٕلِیْنَ وَ فِی الرِّقَابِ وَ اَقَامَ الصَّلٰوةَ وَ اٰتَی الزَّكٰوةَ وَ الْمُوْفُوْنَ بِعَهْدِهِمْ اِذَا عٰهَدُوْا وَ الصّٰبِرِیْنَ فِی الْبَاْسَآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ حِیْنَ الْبَاْسِ اُولٰٓىِٕكَ الَّذِیْنَ صَدَقُوْا وَ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُتَّقُوْنَ.
পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোনো পুণ্য নেই; পুণ্য (বান তো সে) যে, ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, শেষ দিবসের উপর, সমস্ত ফেরেশতা, কিতাবসমূহ ও নবীগণের উপর... -সূরা বাকারা (২) : ১৭৭
ঈমানদারের জন্যও এ আয়াতে এই গভীর শিক্ষা আছে যে, তার ইবাদত-বন্দেগীও যেন শুধু অঙ্গভঙ্গিতে পর্যবসিত না হয়।
আরেক জায়গায় মুমিনদের লক্ষ্য করে ইরশাদ হয়েছে-
لَنْ یَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰكِنْ یَّنَالُهُ التَّقْوٰی مِنْكُمْ كَذٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰی مَا هَدٰىكُمْ وَ بَشِّرِ الْمُحْسِنِیْنَ.
আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তার (কুরবানীর প্রাণীর) গোশত ও রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া...। -সূরা হজ্ব (২২) : ৩৭
অথচ কুরবানীর মতো ইবাদতও যারা ভিডিও করে থাকেন তারা কি কুরবানীর পশুর রক্ত-মাংসের মধ্যেই বাধা পড়ে গেলেন না?
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ইবাদতের প্রাণ হচ্ছে ‘যিকরুল্লাহ’ আল্লাহর স্মরণ। একারণেই সালাত ও কুরবানী, হজ্ব ও তাওয়াফ সব ক্ষেত্রেই কুরআন-সুন্নাহয় ‘আল্লাহর স্মরণ’ কথাটি উল্লেখিত হয়েছে। ছবি তোলা, ভিডিও করা ইত্যাদির মাধ্যমে ইবাদতের এই বড় অনুষঙ্গটি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা তো বলাই বাহুল্য।
দ্বিতীয়ত, সেলফি যদি হয় বিনোদন তাহলে ইবাদত-বন্দেগীতে সেলফিগ্রস্ততার দ্বারা কি ইবাদতকে বিনোদনে পরিণত করা হয় না?
দ্বীন-ধর্মকে ক্রীড়া ও বিনোদনে পর্যবসিত করা তো অনেক বড় অপরাধ।
তৃতীয়ত, সেলফিতে যখন যোগ হয় লোকের বাহবা পাওয়ার চিন্তা তখন এর মাধ্যমে ইবাদত রিয়াগ্রস্ত হয়, যাকে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে ‘শিরকে আসগর’।
চিন্তা করলে দেখা যায়, উপরের যে কোনো একটি বিষয়ই ইবাদতকে বিনষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। কাজেই সামান্য ইচ্ছা পূরণের জন্য হজ্ব-কুরবানীর মতো বাঞ্ছিত ও প্রতীক্ষিত ইবাদতকে নষ্ট করে ফেলা কত বড় নির্বুদ্ধিতা! দেখুন, শয়তান কত সহজে আমাদের বহু আকাক্সিক্ষত ইবাদতগুলো মাটি করে দেয়!
এরপর আসুন ঝুঁকিপূর্ণ সেলফি প্রসঙ্গে। যে সেলফির জন্য তরুণ-যুবকেরা জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিয়ে ফেলছেন তারা হয়তো সচেতন নন যে, এভাবে তারা একটি গর্হিত কাজে লিপ্ত হচ্ছেন। শরীয়তের বিধানে এটা বৈধ নয়। এ তো উপযুক্ত কারণ ছাড়া নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করা, যা পরিষ্কার নিষেধ। হাদীস শরীফে তো মৃত্যুর কামনা করতেও নিষেধ করা হয়েছে তাহলে নিজেকে মৃত্যু-ঝুঁকির মুখোমুখি করার তো প্রশ্নই আসে না।
মানুষের জীবন অতি মূল্যবান। এই একটিমাত্র জীবনকে কাজে লাগিয়ে যেমন মানুষকে আখিরাতের চিরস্থায়ী মুক্তি ও সাফল্য অন্বেষণ করতে হয় তেমনি পৃথিবীর অনেক এবং অনেকের দায়-দায়িত্বও পালন করতে হয়। তাহলে অর্থহীন কাজে এই জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলা মর্মান্তিক অবিবেচনা নয় কি? হায়! মানুষের প্রকাশ্য দুশমন শয়তান যে মানুষকে কতভাবে প্ররোচিত ও ক্ষতিগ্রস্ত করে!
প্রিয় বন্ধু! আপনি কি একজন সাহসী যুবক? আপনি কি আনন্দ পান অন্যের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া বা আলাদা হওয়ার মধ্যেই? তাহলে আপনাকে স্বাগতম! ইসলাম আপনাকে স্বাগত জানায় অর্থহীন কাজে নয়, অর্থপূর্ণ কর্মের বিস্তৃত অঙ্গনে-মানবসেবায়, জাতিগঠনে, ন্যায়ের বিস্তারে, অন্যায়ের প্রতিরোধে। দেখুন, একজন বহু সাধ্য-সাধনা করে তেলতেলে মুলিবাঁশ বেয়ে উঠে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করল। এই কর্মে সে এমনই অভাবিতপূর্ব সাফল্য অর্জন করল যে, শুধু মাটির মানুষ নয়, গাছের বানরও অভিভূত হয়ে গেল; বলুন তো এতে তার কী প্রাপ্তি ঘটল?
তাই আজেবাজে কাজ নয়, এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র হচ্ছে জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও কর্ম-কুশলতা। চলুন না, এই সব ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে যাই। আর এগিয়ে যাই একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে সন্তুষ্ট করবার জন্য, একমাত্র যাঁর কাছেই আমাদের সকল কর্ম ও মুহূর্ত থাকবে চির অক্ষয়।