শিক্ষা-দীক্ষা : জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থা
চলতি শিক্ষাবর্ষের (২০১৭ সালের) সরকারী পাঠ্যবইয়ে নানা ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। নানাজন নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথা বলেছেন। তবে সব মহলের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা একে মনে করছেন অনেক বড় একটি উপসর্গ। একটি দেশের জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থায় এই ধরনের ভুল-ভ্রান্তি একদিকে যেমন চূড়ান্ত অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার প্রমাণ অন্যদিকে দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্যও অশনি সংকেত।
পাঠ্য পুস্তকের ভুল-ভ্রান্তিকে কেন্দ্র করে আলোচনায় উঠে এসেছে এনসিটিবিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা অসংগতির খবরও। যোগ্য গবেষক ও বিশেষজ্ঞের অনুপস্থিতি, দলীয় বিবেচনায় তদবীর ভিত্তিক নিয়োগ, নীতিবহির্ভূতভাবে প্রেষণে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা ইত্যাদি নানা ত্রুটি ও অসংগতি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। যে শিক্ষা-ব্যবস্থার সাথে কোটি শিক্ষার্থীর জীবন ও ভবিষ্যত জড়িত সেই শিক্ষা-ব্যবস্থার এহেন দুরবস্থা সত্যিই দুশ্চিন্তার ব্যাপার। আমরা এই বিষয়টি মূল্যায়ন করতে চাই একজন মুমিনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
প্রথম কথা এই যে, জাগতিক শিক্ষা-দীক্ষার বিষয়টিকেও একান্তই ‘ইহজাগতিক’ মনে করা ভুল। এই ভুল ধারণা কোনো অমুসলিম সমাজে থাকলেও থাকতে পারে, মুসলিম সমাজে থাকতে পারে না। মুসলিম সমাজের জন্য তা যেমন আদর্শ-বিরোধী তেমনি চূড়ান্ত আত্মঘাতীও বটে। এই ভুল ধারণার কুফল নানাভাবে প্রকাশিত হয়। যেমন, এই শিক্ষার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা এক্ষেত্রে নিজেদের আখিরাতের জবাবদিহিতা-মুক্ত মনে করেন। যে মানুষটি আল্লাহর ভয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন, কষ্ট করে রমযান মাসের রোযাও রাখেন সেই মানুষটিও এই জাগতিক (!) বিষয়ে এসে পুরোদস্তুর ‘ইহবাদী’ হয়ে যান। অথচ ইবাদত-বন্দেগীর মতো এই ‘জাগতিক’ বিষয়েও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কারণ এখানেও আছে আল্লাহর বিধান, আছে আমানত ও বান্দার হকের ব্যাপার।
ইসলামী শিক্ষা ও বিধানে আমানত শুধু গচ্ছিত সম্পদকে বলে না; বরং যে বিষয়ে কারো উপর আস্থা রাখা হয়েছে এবং যে দায়িত্ব কারো উপর অর্পিত হয়েছে সেটিও আমানত। তা হতে পারে এক ব্যক্তির আমানত, হতে পারে লক্ষ জনের আমানত। তেমনি তা হতে পারে লঘু বা গুরু আমানত। শিক্ষা-দীক্ষা যদি আমানত হয় তাহলে যে শিক্ষার সাথে লক্ষ-কোটি শিক্ষার্থীর জীবন ও ভবিষ্যত জড়িত এবং যে শিক্ষার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব গোটা সমাজ ও জাতিকে প্রভাবিত করে, তা যে কত গুরু আমানত- এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণ ও বাস্তব প্রয়োগে যারাই যে পর্যায়ে জড়িত তাদের প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তাদের দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। সুতরাং এক্ষেত্রে ভ্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও কর্তব্যকর্মে অবহেলা দুটোই আমানতে খিয়ানত।
একইসাথে তা গোটা জাতির, বিশেষত কোটি শিক্ষার্থীর হক নষ্ট করা। কারণ, এই শিক্ষা-ব্যবস্থার সাথেই তো শিক্ষার্থীদের চিন্তা-ভাবনা, নীতি ও মূল্যবোধ এবং যোগ্যতা ও কর্মকুশলতা তৈরি হওয়ার বিষয়টি জড়িত। কাজেই ইসলামী বিধানের আলোকে তা অনেক বিস্তৃত হক। এই শিক্ষার্থী সমাজের বিশ্বাসগত ও কর্মগত সুপথগামিতা ও বিপথগামিতার দায়-দায়িত্ব তাদেরকেই বহন করতে হবে, যারা এই ব্যবস্থায় এর উপাদানসমূহ সৃষ্টি করেছেন।
ইসলামের ছওয়াব ও গুনাহের ধারণার সাথে যার ন্যূনতম পরিচয় আছে তিনিও জানেন ইসলামে আমানতে খিয়ানত করা এবং অন্যের হক নষ্ট করা কত বড় গুনাহ। এরপর সেই খিয়ানত ও হক নষ্ট করার সাথে যদি কুফ্র ও শুআবুল কুফ্রের বিস্তারও যুক্ত হয় তাহলে তা কত ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায় তা খুব সহজেই অনুমেয়। কাজেই জাগতিক শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রটিও সম্পূর্ণ ‘ইহজাগতিক’ ব্যাপার নয়, এখানেও রয়েছে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ এবং ছওয়াব-গুনাহের ব্যাপার।
দ্বিতীয়ত, জাগতিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ‘ইমারাতুল আরদ’ অর্থাৎ ভূমিকে আবাদ করা। কৃষি, শিল্প, নির্মাণ, গবেষণা ইত্যাদি নানা উপায়ে প্রকৃতিতে আল্লাহ তাআলার যে অবারিত দান তা আহরণের যোগ্যতা অর্জন করা। আর যেহেতু তা মুসলিমসমাজের শিক্ষা-ব্যবস্থা তাই এর অঙ্গিকার, এমন এক প্রজন্ম তৈরি করা, যারা আল্লাহর খলীফা হিসেবে তাঁর বিধান মোতাবেক পৃথিবীকে আবাদ করার চেতনা পোষণ করবে এবং নিজ মেধা ও কর্মের মাধ্যমে এই পৃথিবীকে বর্তমানের ও ভবিষ্যতের অধিবাসীদের জন্য বাসযোগ্য করে রেখে যাবে।
এই শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য জীবিকা উপার্জনও বটে। আর মুসলিম সমাজের শিক্ষা-ব্যবস্থার উদ্দেশ্য যে হবে হালাল জীবিকা উপার্জন তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। চাকুরি-বাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানাবিধ সেবা বিনিময়ের মাধ্যমে হালাল রিয্ক উপার্জনের যোগ্যতা ও পারদর্শিতা এই শিক্ষা-ব্যবস্থা থেকেই অর্জিত হতে হবে। সমাজের পার্থিব প্রয়োজনসমূহ পূরণের যোগ্যতাসম্পন্ন মানবশ্রেণি গড়ে তোলাও এ শিক্ষার উদ্দেশ্য।
এই শিক্ষার আরেক উদ্দেশ্য, সমসাময়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জনের মাধ্যমে বুদ্ধি, কৌশল, প্রযুক্তি ও অর্থ ইত্যাদি দিক থেকে সমাজকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শক্তিশালী করে তোলা। মুসলিম সমাজের জন্য এর রয়েছে আলাদা মাত্রা। কারণ মুসলিমসমাজ এক বিশ্বজনীন দাওয়াতের বাহক। এই দাওয়াতের প্রচার ও বিস্তারের জন্য এবং মিথ্যা ও অন্যায়কে প্রতিরোধ করবার জন্য উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলোতেও সাধ্যমত এগিয়ে যাওয়া দ্বীন ও শরীয়তেরই বিধান। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য মুসলিম সমাজের জাগতিক শিক্ষা-ব্যবস্থা কত উন্নতমানের হওয়া কাম্য তা খুব সহজেই অনুমেয়।
এখানে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উল্লেখ সম্ভবত অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বেশ কিছুদিন আগে একজন উচ্চশিক্ষিত সুধী ব্যক্তির সাথে কথা হচ্ছিল। একপর্যায়ে তিনি পকেট থেকে একটি কাগজ বের করলেন, যাতে পৃথিবীর নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের একটি তালিকা ছিল। তিনি বললেন, হুযুর! দেখুন এই তালিকায় কয়জন মুসলিম আর কয়জন অমুসলিম! বলাবাহুল্য, ঐ তালিকায় মুসলিম বিজ্ঞানীর নাম দু-তিনজনের বেশি ছিল না। এদের অন্তত একজন তো এমন, যিনি আসলে মুসলিম বিজ্ঞানীর তালিকায় আসেন না। তাহলে সংখ্যা আরো কমে গেল! যাই হোক, এরপর তিনি এর কারণ দর্শাতে গিয়ে যে কথাটা বললেন তা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তার কথার জবাবে নিবেদন করলাম, আপনি খুব কঠিন বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এর দায় কি আমাদের মুসলিম দেশগুলোর জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থার উপরই বর্তায় না? এখন আমাদের অধিকাংশ মুসলিম দেশেরই জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা জাগতিক শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত । এই শিক্ষা-ব্যবস্থারই তো অঙ্গিকার, সমাজকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, সমরবিদ সরবরাহ করা। আর যেহেতু এটি মুসলিম সমাজের শিক্ষা-ব্যবস্থা তাই এর দায়িত্ব, মুসলিম চিকিৎসক, মুসলিম প্রকৌশলী, মুসলিম বিজ্ঞানী ও মুসলিম সমরবিদ উপহার দেয়া। এখানে আমি মুসলিম শব্দটি তার যথাযথ অর্থেই ব্যবহার করেছি। অর্থাৎ আদর্শিক মুসলিম, জন্মসূত্রের মুসলিম নয়। এখন আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা প্রয়োজন, আমাদের জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থা কি এই লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রস্তুত?
‘মুসলিম’ বিজ্ঞানী তৈরি করার মতো নীতি, সদিচ্ছা, উপাদান ও উপযুক্ততা এই শিক্ষা-ব্যবস্থার আছে কি না সে আলোচনা অন্য অবসরের জন্য তোলা রইল, আন্তর্জাতিক মানের মনীষী ও বিজ্ঞানী তৈরির জন্যও কি এই শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রস্তুত?
চলতি শিক্ষা-বর্ষে এনসিটিবির পাঠ্য-পুস্তক কেলেঙ্কারি আমাদের কী জানাচ্ছে? আমরা তাহলে কোথায় যাব, কার কাছে যাব? এই দেশের অধিকাংশ সেক্যুলার শিক্ষাবিদের কাছে বড় কোনো প্রত্যাশার অবকাশ নেই। তাদের অনেকেরই চূড়ান্ত সংবেদন শিক্ষা-ব্যবস্থায় ‘হেফাযতের অনুপ্রবেশের মাত্রা’ নির্ণয়ে নিয়োজিত! তাই দেশের দ্বীনদার, ঈমানদার গবেষক, শিক্ষাবিদগণই একমাত্র ভরসা। তাদের কর্তব্য, জাগতিক শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং যতদূর সম্ভব এই শিক্ষা-ব্যবস্থাকে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা। ঈমানী চেতনার কারণে তাঁদের কাছেই তো এই উপলব্ধির প্রত্যাশা করা যায় যে, শিক্ষার এই সংস্কার-চেষ্টা তাদের দ্বীন ও ঈমানের দাবি এবং তাদের উপর গোটা জাতি ও শিক্ষার্থী সমাজের হক।