প্রাঙ্গণে দেবীমূর্তি : অতিসত্বর তা অপসারণ করা হোক
হঠাৎ করে হাইকোর্টের সামনের চত্বরে একটি মূর্তি এনে বসিয়ে দেয়া হল। শুধু বিতর্ক ও অস্থিরতা তৈরি হওয়া ছাড়া এই মূর্তি প্রতিষ্ঠায় দেশ ও জাতির কী উপকার হবে? সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন হতে পারে যে, বাংলাদেশের বিচার-ব্যবস্থায় এ যাবৎ কী কী দোষত্রুটি ছিল, যা এই মূর্তিপ্রতিষ্ঠা দ্বারা দূর হয়ে গেল? এ থেকে বোঝা যায়, আমাদের দায়িত্বশীলদের আরো পরিপক্কতার প্রয়োজন আছে।
যুগ যুগ ধরে ভুল ও খণ্ডিত শিক্ষা, অসত্য ও একপেশে প্রচারণা এবং ভোগবাদী চিন্তাচেতনার পরিবেশের বিস্তারের কারণে নানা ক্ষেত্রে নানা ভ্রান্ত চিন্তারও বিস্তার ঘটেছে। আমাদের দায়িত্বশীলেরাও যেহেতু এই সমাজেরই অংশ তাই তাদের অবস্থাও আলাদা নয়। কিন্তু তাদের তো ভুলে গেলে চলবে না যে, একজন সাধারণ নাগরিকের চিন্তার ভুল আর জাতির দায়িত্বশীল কারো চিন্তার ভুল এক কথা নয়। ঐ পর্যায়ের কারো চিন্তা ও সিদ্ধান্তের ভুল গোটা জাতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কাজেই সচেতনতা, সতর্কতা ও পরিপক্কতা খুব প্রয়োজন। এরপরও ভুল হতে পারে। ভুলটি ধরিয়ে দেয়ার পর তা সংশোধন করে ফেলা অতি জরুরি। এটা সৎ সাহসের পরিচায়ক। এর দ্বারা ভাবমূর্তির ক্ষতি হয় না; বরং উন্নতি হয়।
এখন তো এতসব অসত্য প্রচারণা ও ভ্রান্ত বিশ্লেষণ রয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্বচ্ছ ও দৃঢ় জ্ঞান ছাড়া ঐসব প্রচার-প্রচারণার ভ্রান্তি ধরতে পারা কঠিন। ফলে বিভ্রান্তির শিকার হওয়ায় সম্ভাবনা যে কারো থাকছে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, মূর্তির পক্ষেও কিছু লোক তর্ক-বিতর্কে নেমে পড়েছে। এদের মধ্যে দুটি ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে : একটি ধারা ঐসব লোকের, যারা এ ধরনের ক্ষেত্রগুলোতে সব সময় গৎবাঁধা কিছু শব্দ-বাক্য ব্যবহার করে থাকেন এবং পরোক্ষ হুমকি ধমকির দ্বারাই ময়দান দখলে নেয়ার চেষ্টা করেন। এদের গৎবাঁধা বুলির মধ্যে রয়েছে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ এবং একাত্তরের ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রভৃতি শব্দগুলো। এইসব শব্দের নির্বিচার প্রয়োগ এদের বৈশিষ্ট্য।
এদের পদ্ধতি খুব সরল-যে ব্যক্তি বা বিষয় তাদের চিন্তা বা স্বার্থের বিরোধী তারা তাকে জঙ্গি, মৌলবাদী কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী আখ্যা দেন আর যে ব্যক্তি বা বিষয় তাদের চিন্তা ও স্বার্থের অনুকূলে তাকেই তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা চেতনার পক্ষের বলে মত প্রকাশ করেন! এই শ্রেণিটিকে কী বলা যায়? চেতনা-ব্যবসায়ী? এদের অশালীন উচ্চারণ, অসার ও ভ্রান্ত যুক্তি এবং উস্কানিমূলক বক্তব্যের ব্যাপারে তো কিছু বলার নেই। শুধু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় যে, মুক্তিযুদ্ধের পর দশকের পর দশক ধরে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ দেবীমূর্তি থেকে মুক্ত ও পবিত্র থাকাটা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ছিল? জঙ্গিবাদী ও মৌলবাদী ব্যাপার ছিল? স্বাধীনতার পর যারা ক্ষমতায় এসেও মূর্তিস্থাপন করেননি তারা সবাই কি জঙ্গি-মৌলবাদী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী ছিলেন? আর এতবছর পর যারা ‘ন্যায়বিচারের প্রতীক’নামে গ্রিকদেবীর মূর্তি স্থাপন করলেন তারা কি তাদের ঐ সকল পূর্বসূরীর চেয়েও বড় চেতনাওয়ালা হয়ে গেলেন? তাহলে তো বিচার করতে হবে যে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনা আসলে কোনটা? আগের ওয়ালাদেরটা, না পরের ওয়ালাদেরটা?!
দ্বিতীয় ধারাটা ঐসব লোকের, যারা সম্ভবত উপলব্ধি করেন যে, সরাসরি ইসলামবিরোধী অবস্থান নিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামপ্রিয় মানুষকে দমানো যাবে না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। শুধু সাধারণ জনতাই তো নয় দেশের উচ্চ পর্যায় থেকে নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বস্তরেই কিছু নীতিবান ইসলামপ্রিয় মানুষ যে নেই তা নয়। কাজেই এরা সরাসরি বিরোধিতা না করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কিছু অসত্য তথ্য এবং কিছু ভ্রান্ত ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে একেবারে সুস্পষ্ট ধর্মবিরোধী ব্যাপারকেও ধর্মীয়ভাবে সিদ্ধ বলে প্রচার করে থাকেন। যাতে ইসলামপ্রিয় শিক্ষিতমহল ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিগণ এর বিরোধিতাকে নিতান্তই স্বল্প শিক্ষিত মানুষের আবেগের ব্যাপার মনে করেন। বলাবাহুল্য যে, এই ধারাটি পূর্বোক্ত ধারার চেয়েও ক্ষতিকর। এর দ্বারা একদিকে যেমন মুসলিম সমাজের জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত ইসলামপ্রিয় মানুষগুলোকে বিভ্রান্ত করা হয় অন্যদিকে ইসলামপ্রিয় গোষ্ঠীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এদের মাঝে দূরত্ব ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করা হয়। কিছু মুসলিম নামধারী মুনাফিক প্রকৃতির লোক যুগ যুগ ধরেই এ কাজটি করে আসছে। মুসলিম সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্বে এদের ‘অবদান’ই সবচেয়ে বেশি।
আলোচ্য বিষয়টিতে দেখা যাচ্ছে এবং এর আগেও বিভিন্ন সময় কিছু লোককে এই প্রচারণা করতে দেখা গেছে যে, ‘এটি ভাস্কর্য, এটি মূর্তি নয়। ইসলামে মূর্তি নিষিদ্ধ, ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়।’
আমাদের বুঝতে হবে যে, এটা উপরোক্ত ধারারই একটা কূট-কৌশল মাত্র। এ জাতীয় প্রচারণার গোড়ায় তো ইসলাম বিদ্বেষীরাই থাকে, তবে প্রচারণাটি বিস্তার পেয়ে গেলে অনেক অজ্ঞ মুসলিমও এর শিকার হয়ে যায়। তাই ইসলামের বিধানটি স্বচ্ছভাবে জানা থাকা খুবই প্রয়োজন। তাহলে অসত্য প্রচারণার স্বরূপ উপলব্ধি করা সহজ হয়।
খুব সহজ কথা যে, ইসলামে শুধু পূজার মূর্তিই নিষিদ্ধ নয়, প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণও নিষিদ্ধ। তাহলে এখানে দুটো বিষয় :
এক. পূজার মূর্তি বা উপকরণ। পূজা তো শুধু মূর্তির হয়নি। মূর্তি ছাড়া আরো নানা বস্তুর পূজা হয়েছে এবং হয়। তো যেসব বস্তুর পূজা হয়েছে বা হয় সেগুলোর ভাস্কর্য নির্মাণ নিষিদ্ধ পূজার অনুষঙ্গ হওয়ার কারণে। এরপর সেগুলো যদি হয় প্রাণীর প্রতিকৃতি তাহলে তা নিষিদ্ধ হয় পূজার কারণে এবং প্রাণীর প্রতিকৃতি হওয়ার কারণে।
দুই. প্রতিকৃতি নির্মাণ। ইসলামে কোনো প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণও স্পষ্টভাবে নিষেধ, এটা পূজার উদ্দেশ্যে না হলেও। পূজা ছাড়াও নানা উদ্দেশ্যে-যেমন সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে, জীবিকার উদ্দেশ্যে, কিংবা স্মরণীয় কারো স্মৃতি ও সম্মানের উদ্দেশ্যে প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হয়। যে উদ্দেশ্যেই হোক প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ ইসলামে পরিষ্কার নিষেধ। আর স্মরণীয় কারো স্মৃতি বা সম্মানের উদ্দেশ্যে প্রতিকৃতি নির্মাণ এবং সেই প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনও এক প্রকারের র্শিক। কাজেই শ্রদ্ধা-সম্মানের ব্যাপার জড়িত থাকে এমন কারো প্রতিকৃতি নির্মাণ আরো ভয়াবহ।
স্মৃতি ও সম্মানের জন্য প্রতিকৃতি নির্মাণ তো অজ্ঞানতা ও অপরিপক্কতার যুগের রীতি। ইসলামে স্মৃতি ও সম্মান রক্ষিত হয় কর্মের মাধ্যমে। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর খোলাফায়ে রাশেদীনের কোথাও কোনো ভাস্কর্য নেই। তাদের চেয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় মুসলিম জাহানে আর কে আছে? বিভিন্ন শিক্ষালয়, পাঠাগার ইত্যাদির নামকরণের মাধ্যমেও স্মৃতিরক্ষা হতে পারে। মূর্তি ও ভাস্কর্য তো শিরকের অনুষঙ্গ, যা জগতের সবচেয়ে বড় কুসংস্কার।
কাজেই একথা সম্পূর্ণ প্রতারণা যে, ইসলামে শুধু পূজার মূর্তি নিষিদ্ধ, ভাস্কর্য হিসেবে বা সৌন্দর্যের জন্য যে মূর্তি নির্মাণ করা হয় তা নিষিদ্ধ নয়। একজন সাধারণ মুসলিমেরও জানা আছে যে, ইসলামে যে কোনো প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ নিষিদ্ধ। এই জানা সঠিক এবং কুরআন-সুন্নাহর দলীলসম্মত।
দ্বিতীয়ত, ভাস্কর্য কি পূজার মূর্তির হয় না? অসংখ্য ভাস্কর্য আছে, যা মূলত দেব-দেবীর মূর্তি। কাজেই ভাস্কর্য হলেই তা আর পৌত্তলিকতার নিদর্শন থাকে না-এই ধারণা দেয়ার অপচেষ্টা কি সত্যকে গোপন করা হয়ে যায় না? কে না জানে যে, এই উপমহাদেশেরও অনেক ভাস্কর্যই বাস্তবে পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি। এর জন্য উদ্ধৃতির প্রয়োজন নেই। এরপরও একটি দুটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি : বাংলা পিডিয়ায় বলা হচ্ছে, ‘গুপ্ত শাসকগণ ছিলেন একনিষ্ঠ বৈষ্ণব। প্রাথমিক গুপ্ত মূর্তিগুলোর বেশিরভাগই বিষ্ণু অথবা বিষ্ণু সংশ্লিষ্ট অন্য যে কোনো মূর্তি। এ যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যটি বিহারের ভাগলপূরের শাহকু- থেকে আবিষ্কৃত নরসিংহ মূর্তি। (বাংলা পিডিয়া খ. ৭, পৃ. ৩৩৪, প্রকাশনায় : বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, প্রথম প্রকাশ : চৈত্র ১৪০৯/মার্চ ২০০৩)
অনেক ভাস্কর্য রয়েছে যেগুলোতে দেব-দেবীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বাংলা পিডিয়া বলছে, “বাংলার গুপ্ত ভাস্কর্যগুলোর বেশিরভাগই প্রতীকী এবং এগুলির আকৃতি নির্ধারিত হয়েছে মধ্যদেশ বা মধ্যভারতের পুরোহিত কর্তৃক বর্ণিত দেবতাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে।” (প্রাগুক্ত পৃ. ৩৩৫)
বরং বাংলা পিডিয়ার বর্ণনা অনুসারে ভাস্কর্য শিল্পের বিকাশই ঘটেছে মূর্তিকে কেন্দ্র করে। “এই শিল্পের কেন্দ্র ছিল মথুরা। এখানে সে সময় ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ ও জৈন মূলত এই প্রধান তিনটি কেন্দ্রের অনুসারীরা পূজার নিমিত্তে মূর্তি বানাতে গিয়ে এর সূচনা করেছিল।” (পৃষ্ঠা : ৩৩৩)
হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত লেডি জাস্টিসিয়া বা থেমিসের ভাস্কর্যটিও এ ধরনেরই একটি মূর্তি। The Encyclopaedia Britannica Micropaedia-এ বলা হয়েছে-
"Themis, in Greek religion, personification of justice, goddess of wisdom, and good counsel, and the interpreter of the gods' will. According to some sources, she was the daughter of Uranus (Heaven) and Gaea (Earth), although at times she was apparently identified with Gaea. She was Zeus's second consort ... . On Olympus, Themis maintained order and supervised the ceremonial. She was a giver of oracles, and one legend relates that she once owned the oracle at Delphi but later gave it to Apollo
The cult of Themis was widespread in Greece. She was often represented as a woman of Sober appearance carrying a pair of scales."
( The Encyclopaedia Britannica Micropaedia. vol,IX page.930, ©1979 by Encyclopaedia Britannica. lnc)
Dictionary of Greek and Roman Biography and Mythology-এ বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন অঞ্চলে তার পূজাও হত।
"The worship of Themis was established at Thebes, Olympia, Athens, at Tanagra and at Troezene..."
(Dictionary of Greek and Roman Biography and Mythology, edited by William Smith, LL.D. Vol. 3, page 1023. BOSTON: LITTLE, BROWN AND COMPANY. 1870)
মূর্তি ও ভাস্কর্যের বিস্তারের পেছনে ভোগবাদী স্বভাবও একটি বড় কারণ। আর এ কারণেই প্রগতিবাদী পুরুষেরা বেশি আকর্ষণ বোধ করে থাকেন দেবী মূর্তি বা নারী মূর্তির প্রতিই।
তো ভাস্কর্য বা সৌন্দর্যবর্ধনের নামে মূর্তি প্রতিষ্ঠা থেকে অবশ্যই নিবৃত্ত হতে হবে। স্বদেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের ন্যায়সঙ্গত আবেগ-অনুভূতিকে মূল্য দেয়া ছাড়াও এটা যে দায়িত্বশীলদের নিজেদেরও দ্বীন ও ঈমানের দাবি তা তারা উপলব্ধি করেন বলেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই। কাজেই যে কারণেই হোক যে ভুল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা অতি দ্রুত সংশোধন করা এবং হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে মূর্তি অপসারণ করাই এখন সময়ের দাবি।