Jumadal Ula 1438   ||   February 2017

দ্বীন শিক্ষায় জিজ্ঞাসার গুরুত্ব : শৈথিল্য ও সীমালংঘন

Mawlana Abul Bashar Md Saiful Islam

 

আজকাল বাংলাভাষায় ইসলাম সম্পর্কে প্রচুর  লেখাজোখা হচ্ছে। ইসলামী প্রকাশনা শিল্পের ক্রমবিস্তার আমাদের মনে বেশ আশার সঞ্চার করছে। অনেকেই দ্বীনী বই-পুস্তক কিনছে। দ্বীন সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ছে। নতুন-নতুন পাঠক সৃষ্টি হচ্ছে। অংকের হিসাবে বলা যায় একটা বড়-সড় পাঠকমহল গড়ে উঠেছে। সেই সংগে নানা-আংগিকে দ্বীনের আলোচনাও চলছে। ওয়াজ-মাহফিলের পরিমাণ বাড়ছে। তাবলীগ জামাতের মাধ্যমেও প্রচুর দ্বীনী আলোচনা হচ্ছে। মসজিদসমূহে জুমুআর দিন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। বস্ত্তনিষ্ঠ আলোচনার পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক বাড়ছে। জুমুআ ছাড়াও বিভিন্ন উপলক্ষে দ্বীনী আলোচনা হচ্ছে। ঘরোয়া পরিবেশেও আলোচনা অনুষ্ঠান হচ্ছে। হক্কানী পীর মাশায়েখের সংখ্যাও এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি। পীর-মুরীদির ধারায়ও দ্বীনের আলোচনা হচ্ছে এবং এভাবেও লোকজন দ্বীন শিখছে। নিঃসন্দেহে এসব যুগের এক লক্ষণীয় দিক। দ্বীনের প্রচার-প্রসার দ্বীনী শিক্ষার বিস্তারে সবগুলোরই ভূমিকা সাধুবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। এই বহুমাত্রিক প্রচেষ্টা অব্যাহত না থাকলে ভাবা যায় কি মানুষের ঈমান-আকীদা, ইবাদত-বন্দেগী, আখলাক-চরিত্র তথা দ্বীনের সর্বাঙ্গনে কী ভয়াবহ অবক্ষয় দেখা দিত? আল্লাহ তাআলা সেই পরিণতি  থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করুন এবং সে লক্ষ্যে এসব প্রচেষ্টাকে আরও বলিষ্ঠতার সাথে অব্যাহত রাখার তাওফীক দান করুন।

তবে এই একরৈখিক পরিসংখ্যান নিয়ে তুষ্ট হয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এর বিপরীত চিত্রেও নজর দেওয়া দরকার। এসব মাধ্যমে যারা দ্বীন শিখছে তারা সমাজের কত শতাংশ? যারা এখনও পর্যন্ত এর আওতায় আসেনি, তারা কত শতাংশ? নিশ্চয়ই পার্থক্যটা অনেক বড়। সমাজের সিংহভাগ মানুষই এমন, যারা এসব মাধ্যমের কোনও একটির ধরা ছোঁয়াকে কবুল করেনি। তারাও মুসলিম। অন্ততপক্ষে নিজেদের সেই পরিচয়ই দিয়ে থাকে। সেই পরিচয়ের তাগিদেই হয়ত বা জুমুআর নামায পড়ে। ঈদের মাঠে আসে। জানাযায় শামিল হয়। এবং এরকম আরও কিছু ইসলামী লক্ষণ-আলামত আলগোছে ধরে রেখেছে। তারা ইসলাম সম্পর্কে বলা যায় কিছুই জানে না। আকীদা-বিশ্বাসের কোনও খবর নেই।  মুমিন হতে হলে কী বিশ্বাস রাখতে হয় সে নিয়ে তাদের চিন্তা নেই। কি-কি কারণে ঈমান নষ্ট হয়ে যায় তা তাদের ভাবনায়ই আসে না। ওযূ-গোসল, হালাল-হারাম প্রভৃতি বিষয়ে তাদের অজ্ঞতার কোনও সীমা নেই। গোটা ইসলাম সম্পর্কেই তারা বেখবর। বাপ-দাদা মুসলিম, ব্যস সেই সুবাদে নিজে মুসলিম। এর বাইরে ইসলাম সম্পর্কে জানার কোনও গরজ তারা বোধ করে না। সুতরাং পরিতুষ্টির সুযোগ কোথায়?

কথা আছে অন্যখানেও। যারা কোনও না কোনওভাবে দ্বীনের সাথে জড়িত, দেখতে-শুনতে দ্বীনদার, নামায-রোযা করে, মসজিদে আসে, হয়ত বা কোনও পীরের মুরীদও কিংবা কোনও দ্বীনী খেদমত দাওয়াতী কর্মকাণ্ড সাথে জড়িত- দ্বীন শরীআত সম্পর্কে তাদের জানা শোনার অবস্থা কী? অবস্থা যে সন্তোষজনক নয় একটু দৃষ্টিপাত করলেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

এদের আকছারেরই সুন্নত-বিদআতের কোনও ধারণা নেই। বরং তাওহীদ শিরকের প্রভেদ সম্পর্কেও তারা সচেতন নয়। শাহজালাল রাহ.-এর দরগাহ আজমীরে মানত কেবল কবর পূজারীই নয়, কবরপূজা হারাম জানা লোককেও করতে দেখা যায়। বেঈমানী কথা বলে বা শিরকী কাজ করে ঈমানহারা হয়ে গেছে, অথচ সে নিয়ে কোনও ভাবনা-চিন্তা নেই, এমন লোক কথিত দ্বীনদারদের মধ্যেও ঢের আছে। নিয়মিত তাসবীহ আদায় করে অথচ সহীহ-শুদ্ধভাবে নামায পড়তে জানে না- এমন লোকের কি কোনও অভাব আছে? এমন বহু লোক আছে, যে দাওয়াতী কর্মে সদা তৎপর, অথচ সে জানে না, তার উপর হজ্ব ফরয হয়ে আছে। রকম অজ্ঞতার ফিরিস্তি দিতে থাকলে খতিয়ান অনেক লম্বা হয়ে যাবে। সারকথা এটাই যে, আজ দ্বীনদারদেরও বড় অংশ দ্বীন সম্পর্কে জানে বড় কম। সর্বগ্রাসী জাহালাতের গরাস হয়ে আছে সমাজের প্রতিটি স্তর। অতি নগণ্য সংখ্যাই তা থেকে মুক্ত আছে।

এই সর্ববিস্তৃত অজ্ঞতার কারণ কী? কারণ তো এই যে, অজ্ঞতা এক কঠিন ব্যাধি। ব্যাধি নিরাময়েরও ওষুধ আছে। কিন্তু যারা এতে আক্রান্ত তারা নিজেদের রোগী মনে করছে না। তারা যে রোগী সেই বোধ তাদের নেই। আর বোধ নেই বলে নিরাময়ের কথা ভাবছে না এবং ওষুধ সেবনের চিন্তা করছে না।

ওষুধ সেবনের চিন্তা করত, যদি নিজেদের রোগী ভাবতে পারত। তাই এখন বড় দরকার তাদের মধ্যে রোগ-সচেতনতা সৃষ্টি করার। অজ্ঞতা যে তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, তাদের ঈমান-আমল বরবাদ করছে, তাদের মানবিকতা ধ্বংস করছে এবং মানুষ হিসেবে তাদের জন্মগ্রহণ ব্যর্থ করে দিচ্ছে- সেই চেতনা অনুভূতি তাদের মধ্যে জাগ্রত করা ছাড়া এই মহাব্যধির চিকিৎসা সম্ভব নয়।

এর পাশাপাশি দরাকার ওষুধ সরবরাহ করা এবং তা সেবনে তাদের উদ্বুদ্ধ করা।

তা অজ্ঞতা নামক ব্যাধি নিরাময়ের কী উপায়? উপায় মূলত তিনটি-

এক. উলামায়ে কিরামের কাছে দ্বীন শরীআত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা;

দুই. দ্বীনী রচনাবলী পাঠ করা।

তিন. উলামা-মাশায়েখের সাহচর্য গ্রহণ করা।

লেখার উদ্দেশ্য মূলত দ্বীনী জ্ঞান আহরণের এই তিন মাধ্যম সম্পর্কে সামাজিক শৈথিল্য সীমালংঘনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সর্বপ্রথম আলোচনা করা যাক উলামায়ে কিরামের কাছে জিজ্ঞাস করা সম্পর্কে। বিষয়ে কুরআন মাজীদে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে-

فَسْـَٔلُوْۤا اَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ

তোমাদের জানা না থাকলে জ্ঞানীজনকে জিজ্ঞেস কর। -সূরা নাহ্ল (১৬) : ৪৩; সূরা আম্বিয়া (২১) :

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنَّمَا شِفَاءُ الْعِيِّ السُّؤَالُ

অজ্ঞতার দাওয়াই তো জিজ্ঞেস করা। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩০৫৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৩৬; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১০৭৫

কিন্তু দাওয়াই আজ চরমভাবে আবহেলিত। অধিকাংশ মানুষই এটি ব্যবহার করে না আবার যারা ব্যবহার করে তাদেরও অধিকাংশ ভুল ব্যবহার করে। অর্থাৎ ব্যাপারে দুরকম প্রান্তিকতাই বিদ্যমান। হয় এর প্রতি শৈথিল্য করা হয়, নয়ত করা হয় সীমালংঘন।

 

জিজ্ঞেস করতে শৈথিল্য অবহেলা

আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগী, অর্থ-সম্পদ সংক্রান্ত লেনদেন, পারস্পরিক আচার-ব্যবহার আখলাক-চরিত্র- এই যাবতীয় বিষয়েই রয়েছে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা, কিন্তু তা জানে জন? যারা জানে না তাদেরই বা জন সম্পর্কে জ্ঞানীজনদের জিজ্ঞেস করে? অধিকাংশেই করে না। হয়ত একটা ভুল বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করছে, সেই বিশ্বাসের উপর তার বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে, তাও কাউকে জিজ্ঞেস করে না বিশ্বাসটি সঠিক কি না। সেই বিশ্বাসটি শিরক কুফর পর্যায়েরও হতে পারে। একটু বিবেক-বুদ্ধি খাটালে সে সম্পর্কে অন্তরে খটকা লাগারই কথা। তা সত্ত্বেও দেখা যায় সেই বিশ্বাস নিয়ে কবরে যাচ্ছে, জীবনে একটিবারও কারও কাছে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার গরজ বোধ করে না। একজন নামাযী মানুষ যদি শাহজালালের দরগায় মানত করে তাকে আমরা কী হিসেবে নেব? দরগায় মানত করা যে শিরকী কাজ- নামাযীর মনে সে প্রশ্ন কেন জাগবে না? এমন বহু নামাযীকেই জাতীয় মানত করে তা পূরণ করতে দেখা যায়। একবারও জিজ্ঞেস করে না, তার কাজটি জায়েয হচ্ছে কি না! জাতীয় মানত তো বিশ্বাসের বিভ্রান্তি থেকেই করা হয়ে থাকে। দরগার পীর-ফকীর মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে পারে বলে যে নামাযী বিশ্বাস করে সে ঠিক কতটুকু নামাযী এবং তার ঈমানের কী অবস্থা, মুমিন হয়ে থাকলে প্রশ্ন তার মনে কেন জাগবে না? ইসলাম যে ঈমানের শিক্ষা  দেয় তার কণামাত্রও যদি অবশিষ্ট থাকে, তবে প্রশ্ন জাগা উচিত বৈকি। কিছু কিছু লোককে প্রশ্ন করতে দেখাও যায়। কিন্তু অধিকাংশেই তা করে না। আকীদা বিষয়ে এটা একটা উদাহরণ। রকম উদাহরণ বিস্তর আছে। ভুলের উপর মানুষ জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেই বিশ্বাস শুদ্ধ করে ফেলা যায়। তাও জিজ্ঞেস করবে না। তাদের কাছে জিজ্ঞেসনামক দাওয়াইয়ের কোনও মূল্য নেই।

এই যে নামাযীদের কথা বললাম, তারা নামায কতটুকু সহীহ-শুদ্ধ পড়ছে তাও কখনও খতিয়ে দেখে না। মসজিদে এসে দেখে ইমাম সাহেব রুকূ থেকে উঠে সিজদায় যেতে উদ্যত। এক নামাযী নিজে-নিজে রুকূ দিয়ে জামাতে শামিল হয়ে গেল এবং ইমামের সাথে একত্রে সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করল। আপনি তার পাশেই নামায পড়েছেন। রুকূ আপনিও পাননি। ফলে সালামের পর আপনি আরেক রাকআত নিজে-নিজে পড়ে নিলেন। ওই লোক পাশেই তা দেখছে। কিন্তু একটি বার জিজ্ঞেস করছে না, তার নামায হল কি না।

এমন বহু মালদার আছে, যারা নিজেরাই ফয়সালা নিয়ে নেয় তার উপর যাকাত ফরয হয়নি। কাউকে তার সম্পদের হিসেব দিয়ে জিজ্ঞেস করে না যে, তার উপর যাকাত ফরয কি না।

বাবা কি মায়ের ইন্তিকাল হয়ে গেল, এখন মীরাছ কিভাবে বণ্টন করতে হবে, বহু  নিয়মিত মুসল্লী আছে, যারা কোনও আলেমকে তা জিজ্ঞেস করে না। এরকম রাশি-রাশি উদাহরণ দেওয়া যাবে। এরা নিজ ইচ্ছামত চলে। কিংবা সমাজের প্রচলনই তাদের কাছে শেষ কথা। তাই কোনও আলেমকে জিজ্ঞেস করে না তাদের চলাটা ঠিক হচ্ছে কি না। ফলে অজ্ঞানতার গভীর অন্ধকারেই তারা পড়ে থাকে। ভুল-ভ্রান্তি কুসংস্কারের ভেতর  দিনাতিপাত করে আর মনে করে বেশ ধর্মজীবন যাপন করছে। এরাও তো কুরআন মাজীদের এই ইরশাদের মধ্যে পড়ে যায়-

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْاَخْسَرِیْنَ اَعْمَالًا اَلَّذِیْنَ ضَلَّ سَعْیُهُمْ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ هُمْ یَحْسَبُوْنَ اَنَّهُمْ یُحْسِنُوْنَ صُنْعًا.

বল, আমি কি তোমাদের সংবাদ দেব কর্মে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্তদের? তারা সেই সব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা নষ্ট হয়ে যায়, অথচ তারা মনে করে যে, তারা উত্তম কাজ করছে। -সূরা কাহ্ফ (১৮) : ১০৩-১০৪

ক্ষতি থেকে তাদের উদ্ধারের উপায় দ্বীন শরীআত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান আহরণ করা আর সে লক্ষ্যে দ্বীন শিক্ষার এই অন্যতম প্রধান মাধ্যম (উলামায়ে কিরামের কাছে জিজ্ঞেস করা’-কে) অবলম্বন করা।

ব্যাপারে উলামায়ে কিরামও স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা আপন-আপন স্থান থেকে মানুষের ভেতর এই বোধ চাপিয়ে দিতে পারেন যে, দ্বীন শেখার জন্য আলেমদের কাছে প্রশ্ন তাদের করতেই হবে। ভুলের উপর থাকা চলবে না। প্রকৃত মুমিন মুসলিম হতে হলে দ্বীনের সহীহ-শুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতেই হবে আর তার এক প্রকৃষ্ট মাধ্যম হচ্ছে প্রশ্ন করা

 

জিজ্ঞেস করতে লজ্জা যেন বাধা না হয়

অনেকেই জিজ্ঞেস করতে লজ্জাবোধ করে। লজ্জা পরিত্যাজ্য। যে লজ্জা মানুষকে দ্বীন শেখা হতে বঞ্চিত রাখে প্রকৃতপক্ষে তা লজ্জাই নয়। তা ভীরুতা, পলায়নপরতা জড়ত্ব। একে যে প্রশ্রয় দেয় সে চির জাহেল হয়েই থাকে। নিঃসন্দেহে লজ্জাশীলতা এক প্রশংসনীয় গুণ এবং তা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংগও বটে, কিন্তু যে লজ্জা মানুষকে অজ্ঞ করে রাখে, তা অতি নিন্দনীয়। তা ঘৃণাভরে ঝেড়ে ফেলা উচিত।

দেখুন লজ্জা নারীর ভূষণবলে একটা কথা আছে, যদিও প্রকৃতপক্ষে তা নর-নারী নির্বিশেষে প্রত্যেক মুমিনের ভূষণ, সেই লজ্জাকে দ্বীন শেখার ক্ষেত্রে প্রশ্রয় না দেওয়ার কারণে আনসারী নারীদের প্রশংসা করা হয়েছে। আমাদের বিদূষী মা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন,

نِعْمَ النِّسَاءُ نِسَاءُ الْأَنْصَارِ لَمْ يَكُنْ يَمْنَعُهُنَّ الْحَيَاءُ أَنْ يَتَفَقَّهْنَ فِي الدِّينِ.

আনসারী নারীগণ কতই না ভালো। দ্বীনের জ্ঞানার্জনে লজ্জা তাদের বাধা দিতে পারেনি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩২২, ৩৩২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস  ২৫১৪৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৬৪২

প্রশংসার কারণ তারা একান্ত নারী সংক্রান্ত বিষয়েও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে মাসাইল জিজ্ঞেস করতেন। তিনিও পরম মমত্বের সাথে তাদের তা বুঝিয়ে দিতেন। সাধারণভাবে সাহাবায়ে কিরামের নীতি এটাই ছিল যে, তারা দ্বীনী বিষয়ে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করতে লজ্জাবোধ করতেন না। তাঁর ওফাতের পর তারা পরস্পর একে অন্যকে জিজ্ঞেস করতেন। বহু মাসআলায় তারা উম্মাহাতুল-মুমিনীনের শরণাপন্ন হয়েছেন। উম্মুল-মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.-এর কাছে তো তারা অনেক বিষয়েই জিজ্ঞেস করেছেন, এমন কি যাকে লজ্জার মনে করা হয়ে থাকে এমন বিষয়েও। বস্ত্তত এটাই নিয়ম। আমার যে বিষয় জানা নেই তা যে ব্যক্তি জানে তার কাছে জিজ্ঞেস করতে সংকোচবোধ কেন করব? অজ্ঞতা তো কিছু গৌরবের বিষয় নয় যে, লজ্জাকে প্রশ্রয় দিয়ে তা ধরে রাখতে হবে! জ্ঞানস্পৃহা তো মানুষের স্বভাবগত। জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্বই হযরত আদম আলাইহিস সালামকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পরিয়েছিল। সেই শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার জন্য জ্ঞানাহরণ করতেই হবে। লজ্জা যদি তাতে বাধা হয়, তবে সেই অবাঞ্ছিত লজ্জাকেই পরিষ্কার করতে হবে, জ্ঞানাহরণ থেকে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি দ্বীন শরীআত সম্পর্কে ভালো জানে অসংকোচে তার কাছে নিজ অজানা বিষয়ে জিজ্ঞেস করা চাই।

 

জিজ্ঞেস করবে কাকে?

হাঁ, জিজ্ঞেস করতে হবে যথার্থ জ্ঞানীজনকেই। ব্যাপারেও মারাত্মক শিথিলতা লক্ষ করা যায়। ব্যস টুপি-দাড়ি থাকলেই তাকে মৌলভী সাহেব মনে করা হয়। এটা যেন মৌলভী হওয়ার নিদর্শন। ইসলামে মৌলভী সাহেবের জন্য তো আলাদা কোনও পোশাক পৃথক কোনো বেশ-ভূষা নেই। দাড়ি রাখা সুন্নত সকলেরই জন্য। সালিহীন নেক বান্দাদের পসন্দের পোশাক মুসলিম মাত্রেরই পছন্দনীয় হওয়া উচিত। উলামা-মাশায়েখ যে লেবাস ব্যবহার করেন, তা যদি কেউ ভালোবাসে সে ধন্যবাদার্হ। কিন্তু তাই বলে সে আলেম হয়ে যায় না। তাকে আলেম মনে করা উচিত না। কিন্তু সমাজ তাই মনে করছে। টুপি-দাড়ি থাকলেই তাকে হুজুর ডাকছে এবং তার কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করছে। একটু খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছে না যে, আসলেই সে আলেম কি না। আবার সেই লোকও কম যায় না। প্রশ্ন করা হচ্ছে দেখে নিজের প্রকৃত অবস্থান যেন ভুলে যায়। মনে মনে নিজেকে আলেমের মসনদে বসিয়ে উত্তর একটা দিয়ে দেয়। জাতীয় লোকদের অনেক উত্তর আমার সরাসরি নিজ কানেই শোনা আছে। তা রীতিমত ভয়ংকর, দুঃখজনক, হতবুদ্ধির কলঙ্কজনক। তার দুঃসাহসিক হরকতের জন্য  সাধারণের নির্বিচার জিজ্ঞাসাও কম দায়ী নয়।

আম-সাধারণ কেন জাতীয় শৈথিল্য দেখাবে? এটা তো হাতুড়ে ডাক্তার দ্বারা জটিল রোগের চিকিৎসা করানোর চেয়ে কম আত্মঘাতী নয়। ওই চিকিৎসায় যদি ভবলীলা সাঙ্গ হয় তো জিজ্ঞাসায় আখিরাত বরবাদ যায়। এরচেবড় ক্ষতি আর কী হতে পারে! ইদানীং অবশ্য হাতুড়ে ডাক্তার দেখানোর প্রবণতা অনেক কমে গেছে। কিন্তু বে-এলেম আবেদের কাছে জিজ্ঞাসার প্রবণতায় বিশেষ কমতি পরিলক্ষিত হয় না। সত্যিকারের আবেদ হলেও না হয় কথা ছিল। জিজ্ঞেস করা হয় কেবলই জাহিরী পোশাক দেখে। আকছার খাদেম মুআযযিনকেও মানুষ মুফতী মর্যাদা দিয়ে বসে। সন্দেহ নেই মসজিদের খেদমত অনেক বড় ফযীলতের কাজ। মুআযযিনের মর্যাদা তো অনেক উঁচুতে। কিন্তু আমাদের সমাজ তো মুআযযিনকে সেই মর্যাদা দেয় না এবং পদের জন্য কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতাও খোঁজে না। কেবল কণ্ঠস্বরই মানদ- তাই সুরেলা কণ্ঠের বে-এলেম মুআযযিন হয়ে যায়। ব্যতিক্রম হয়ত আছে, কিন্তু সাধারণ অবস্থা বড় দুঃখজনক। হাঁ যদি তাদেরকে আলেম গণ্য করা না হয়, এবং তারাও নিজ অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক থাকে এবং মহবক্ষত পরম শ্রদ্ধাবোধের সংগে পদের দায়িত্ব পালনে রত থাকে, তবে নিঃসন্দেহে হাশরের ময়দানে রকম মুআযযিনগণ বহু লোকের ঈর্ষার পাত্র হবে। সন্দেহ নেই রকম মুআযযিন দেশে অনেক আছে। আল্লাহ তাআলা তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করুন এবং দুনিয়ায়ও তাদেরকে ইজ্জতের জীবন দান করুন।

কথা হচ্ছিল- দ্বীনী বিষয় যারে-তারে জিজ্ঞেস করা উচিত নয়। কুরআন মাজীদ তো নির্দেশনা দিয়েছে- (তরজমা) তোমার জানা না থাকলে জ্ঞানীজনকে জিজ্ঞেস কর’ [সূরা নাহ্ল (১৬) : ৪৩] সুতরাং দ্বীন সম্পর্কে যার ভালো জানা আছে জিজ্ঞেস তাকেই করতে হবে। এক্ষেত্রে কেবল সনদ সার্টিফিকেট থাকাই যথেষ্ট নয়। চর্চায় নিয়োজিত আছে কি না তাও লক্ষ রাখা উচিত। সেই সংগে তাকওয়া-পরহেযগারীও। জিজ্ঞেস যখন দ্বীন সম্পর্কে তখন দ্বীনদার আলেমকেই সন্ধান করা উচিত। আমি যা জানতে চাই তার উপর আমার আখিরাতের নাজাত নির্ভর করে। আমি তার কাছে চাই নাজাতের পথ জানতে, কিন্তু অজ্ঞতাবশত সে যে পথ দেখাল তা নাজাতের নয়; বরং ধ্বংসের পথ। তাই সতর্কতা জরুরি। জিজ্ঞেসও অবশ্যই করতে হবে এবং সে জন্য উপযুক্ত লোকেরও সন্ধান করতে হবে। সন্ধান করলে পাওয়াও অবশ্যই যাবে। হয়ত খানিকটা সময় দিতে হবে। একটু পথ চলতে হবে, কিন্তু উদ্দেশ্য যখন নিজ দ্বীনের হিফাজত আখিরাতের নাজাত, তখন এতটুকু কষ্ট তো করতেই হবে। বড় চমৎকার বলেছেন মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ.-

إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ، فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ

এই ইলম তো দ্বীন, সুতরাং লক্ষ করে দেখ কার নিকট থেকে নিজ দ্বীন নিচ্ছ।

-সহীহ মুসলিম, ; সুনানে দারেমী, বর্ণনা ৩৯৯; মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার, বর্ণনা ১৫৩

 

তলাবা উলামাও জিজ্ঞাসা থেকে বেনিয়ায নয়

জিজ্ঞাসাকে জ্ঞানাহরণের মাধ্যম তো সর্বাপেক্ষা বেশি বানানো উচিত তলাবা উলামার। সত্যিকারের উলামাও প্রকৃতপক্ষে তলাবাই। তালিবুল-ইলম অর্থ যখন জ্ঞানের সন্ধানী, তখন জিজ্ঞাসা অর্থাৎ জানার ইচ্ছা তো তার মজ্জাগতই থাকবে। তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, প্রতিটি লোমকূপে উঠবে অদম্য কৌতূহলের আকুলতা। সেই আকুলতা নিবারণের জন্য সে জিজ্ঞাসার আশ্রয় নেবে। আমি জিজ্ঞাসাশব্দটিকে সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি। প্রশ্ন অপেক্ষা শব্দটিই আলোচ্য বিষয়ের পক্ষে বেশি ব্যঞ্জনাময়। আমার বড় ভালোবাসার শব্দ এটি। এর ঝঙ্কার বাজুক প্রত্যেক তালিবুল-ইলমের অন্তরে। আজ এর বড় অভাব দেখি। এক ছাত্র যেন আরেক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করতে লজ্জাবোধ করে। এরূপ লজ্জাশ্রয়ী ছাত্র ইলমের রাজ্য কিভাবে বিচরণ করতে পারে। জিজ্ঞাসায় সপ্রতিভ থাকাই তো হওয়া উচিত শিক্ষার্থীর শান। এই শান যে অবলম্বন করতে পারবে সম্ভাবনা সামর্থ্যের উচ্চতায় সে না পৌঁছে যায় না। খুব সম্ভব ইমাম আজম ইমামুল-আইম্মতিল-ফুকাহা আবূ হানীফা -রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ওয়া আলা আসহাবিহী- সম্পর্কে কোথাও পড়েছিলাম, তাঁর জ্ঞানের সাগর হয়ে ওঠার উপায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, আমি যা জানি না, সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে কখনও লজ্জাবোধ করিনি। একই রকম জিজ্ঞাসার জবাবে হিবরুল-উম্মাহ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবক্ষাস রা. বলেছিলেন, জিজ্ঞাসাপ্রিয় রসনা সমঝদার অন্তঃকরণের কারণে’(- যা কিছু শিখেছি) আমি যত বড় আলেম দেখেছি তাদের সকলকেই ব্যাপারে স্বচ্ছন্দ অনাড়ষ্ঠ পেয়েছি। আর নিঃসন্দেহে তাদের বড় হয়ে ওঠার পেছনে গুণের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং জ্ঞানের রাজ্যে যারা অবাধ বিচরণ করতে চায়, তাদের গুণ অর্জন করতেই হবে। তাফাক্কুহ-ফীদ-দ্বীন তথা দ্বীনের স্বচ্ছ গভীর জ্ঞানার্জন যাদের লক্ষ্য তাদের ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শনের কোনও অবকাশ নেই। এর মাধ্যমে তারা পারে অন্যের সাধনালব্ধ জ্ঞানের অংশীদার হতে। অন্যের কাছে প্রশ্ন করা মতবিনিময়ের দ্বারা বিষয়ের আগাপাছতলা পরিস্ফুট হয়, নজর প্রসারিত হয় এবং অচিন্তিত দিকের দ্বারোম্মোচন হয়। এত বড় উপকারী জিনিসকে অবহেলা করা যায়, না করা উচিত? তা ছাড়া প্রশ্ন করা যায় আপন মনেও। অন্যের কাছে জিজ্ঞাসার আগে নিজে নিজে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সকল দিকে নজর বোলালে আপন মনে প্রশ্ন তুলে তার জবাব হাতড়াতে থাকলে বিষয়টির প্রসার গভীরতার সন্ধান পাওয়া যায়। তালিবুল-ইলমের তলব’-এর সেটাই তো প্রথম যাত্রা। অগ্রযাত্রাকে সচল রাখার পক্ষে যে প্রাণশক্তি দরকার কৌতূহল দ্বারাই তা অর্জিত হতে পারে।

 

বাড়াবাড়িমূলক প্রশ্ন

এমন বহু লোকও আছে, যারা দরকারি বিষয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে না অথচ অহেতুক বিষয়ে প্রশ্ন করতে বেজায় উৎসাহ বোধ করে। এমন সব বিষয়ে তারা প্রশ্ন করে, যাতে না আছে কোনও দ্বীনী ফায়দা, না দুনিয়াবী উপকার। এরকম নিরর্থক বিষয় নিয়ে তারা বাকশক্তির অপচয় করে, সময় নষ্ট করে অন্যকে করে বিব্রত। একে তো অহেতুক বিষয়ে লিপ্ত হওয়া মুসলিমের শান নয়। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ

অহেতুক বিষয় পরিহার করা ইসলামের এক সৌন্দর্য। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩১৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৯৭৬

তদুপরি এটা অন্যের পক্ষে বিব্রতকর। যেমন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতামাতা জান্নাতে যাবে কি না, প্রশ্নের পেছনে পড়ার কোনও দরকার আছে? এটা জানা কি ঈমানের অংগ। না জানলে কি ইসলাম ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাবে? যাকে প্রশ্ন করা হয় সে এর কী উত্তর দেবে? যদি বলে জান্নাতী, তবে কুরআন-হাদীসে যাদের সুনির্দিষ্টভাবে জান্নাতী বলা হয়নি, তাদের জান্নাতী হওয়ার সার্টিফিকেট কে দিতে পারে? আর যদি বলে জান্নাতী নয়, তবে নবীপ্রেমে উজ্জীবিত এক বক্তা শ্রোতার পক্ষে এরকম কথার উচ্চারণ হৃদয়ে শরাঘাত অপেক্ষাও কঠিন নয় কি? হাঁ, তারা জান্নাতে যাবেন এই আশাবাদ তো ব্যক্ত করাই যেতে পারে, কিন্তু এরূপ প্রশ্নের কর্তা তো অতটুকুতেই সন্তুষ্ট হওয়ার নয়। তো যেই প্রশ্নের উত্তর তাকে সন্তুষ্ট করবে না, তার পেছনে তার পড়াই বা কেন? জাতীয় এক প্রশ্ন করা হয়েছিল ইমাম আবূ হানীফা রাহ.-কে। জিজ্ঞাসা ছিল হযরত আলী রা. হযরত মুআবিয়া রা.-এর মধ্যে কে সঠিক ছিলেন এবং সিফফীনের যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছিলেন, আখিরাতে তাদের কী হবে? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন-

إذا قَدِمْتُ على الله يسألني عما كَلَّفَنِي ولا يسألني عن أمورهم .

আমার তো ভয় নিজের সম্পর্কে যে, না জানি আল্লাহ তাআলা আমাকে কোন্ কোন্ বিষয়ে সওয়াল করেন। কিয়ামতে যখন আমাকে তাঁর সামনে দাঁড় করানো হবে, তখন তাদের কোনও বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করা হবে না। প্রশ্ন তো করা হবে তাঁর প্রদত্ত বিধানাবলী সম্পর্কে যে, আমি তা কতটুকু পালন করেছি। কাজেই তাতে ব্যস্ত থাকাই শ্রেয়। (উকূদুল জুমান) অর্থাৎ দুনিয়া আখিরাতের লাভ-লোকসান যে বিষয়ের সাথে জড়িত নয়, তা নিয়ে প্রশ্নোত্তরে লিপ্ত হওয়া কিছু বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এরকম অহেতুক বিষয়ে প্রশ্ন করতে কুরআন মাজীদেই নিষেধ আছে। যখন হজ্ব ফরয করা হয় এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, হজ্ব কি প্রতি বছর ফরয? উত্তরে তিনি বললেন, যদি আমি হাঁবলি তবে তাই হবে। যে বিষয়ে তোমাদেরকে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করো না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল হয়-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَسْـَٔلُوْا عَنْ اَشْیَآءَ اِنْ تُبْدَ لَكُمْ تَسُؤْكُمْ  .

হে মুমিনগণ! তোমরা সে সব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যা প্রকাশিত হলে তোমরা দুঃখিত হবে। [সূরা মায়িদা () : ১০১] -জামে তিরমিযী, হাদীস ৮১৪

একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরামকে সতর্ক করে দেন যে, দেখ, তোমাদের আগের জাতিসমূহ বাড়তি প্রশ্নের কারণে ধ্বংস হয়েছে। তাদেরকে তাদের নবী যখন কোনও বিষয়ে হুকুম করতেন, তারা তার বিপরীতে নানা প্রশ্ন করে তাকে উত্ত্যক্ত করত। (সাবধান তোমরা সে রকম করো না। তবে) তোমরা যদি আমাকে কোনও বিষয়ে জিজ্ঞেস কর আমি অবশ্যই তা তোমাদের বলে দেব। তখন বিভিন্নজন বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফা রা. প্রশ্ন করে বসলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা কে? বললেন, তোমার পিতা হুযাফা ইবনে কায়স। তারপর তিনি নিজ মায়ের কাছে গিয়ে বৃত্তান্ত জানালেন। তার মা তাকে ধমক দিয়ে বললেন, ছি বাবা! কথা কেন জিজ্ঞেস করলে? আমরা জাহিলী যুগে ছিলাম। কত রকম খারাপ কাজ করতাম। সে মতে যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কাউকে তোমার বাবা বলতেন কিয়ামত পর্যন্ত আমার মুখে চুনকালি পড়ত। অন্য এক বর্ণনায় আছে, এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, আমার প্রবেশ কোথায় হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জাহান্নামে। অবস্থা দেখে হযরত উমর রা. সচকিত হয়ে উঠলেন। তিনি হাটু ভেংগে বসে পড়লেন এবং বললেন-

رَضِينَا بِاللَّهِ رَبًّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا.

আমরা রাযী সন্তুষ্ট যে, আমাদের রব আল্লাহ, আমাদের দ্বীন ইসলাম এবং  আমাদের রাসূল নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৫৯; সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস  ১২৬৫৯, ১০৫৩১

কুরআন মাজীদের সতর্কবাণী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরবিয়তের ফলে সাহাবায়ে কিরামের পরিপূর্ণ ইসলাহ সাধিত হয়েছিল, যে কারণে দুচারটি ঘটনার বাইরে তাদের জীবনে বাড়তি প্রশ্নের কোনও নজীর পাওয়া যায় না। কিন্তু পরবর্তীকালের মানুষের মধ্যে যারা সাহাবায়ে কিরামের প্রত্যক্ষ তরবিয়ত পায়নি এবং তারও পরে যারা তাবিঈগণের সাহচর্য থেকে জীবন গড়েনি, তারা ক্রমে নববী শিক্ষা থেকে দূরে সরে যায়। তাই তাদের প্রশ্নের ধরন-ধারণও পাল্টে যায়। অনেকে অহেতুক অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়েও প্রশ্ন করতে শুরু করে। এরূপ সীমালংঘন যে ঘটবে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। যেমন এক বর্ণনায় আছে, প্রখ্যাত তাবিঈ মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ. বলেন, একদা আমি হযরত আবূ হুরায়রা রা.-এর কাছে বসা ছিলাম। এসময় এক ব্যক্তি তাকে একটা বিষয়ে প্রশ্ন করে। আমি জানি না বিষয়টা কী? হযরত আবূ হুরায়রা রা. বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার! বিষয়ে এর আগে আরও দুজন প্রশ্ন করেছে। এই হচ্ছে তৃতীয়জন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, একদল লোক খুব বেশি প্রশ্ন করবে এবং তাদের প্রশ্নের মাত্রা পর্যায়ে পৌঁছে যাবে যে, জিজ্ঞেস করে বসবে, আল্লাহ তাআলা সব মাখলুক সৃষ্টি করেছেন, তা আল্লাহকে সৃষ্টি করেছে কে? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৫, ২১৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৭৯০

সহজেই বোঝা যায় এটা এক অবান্তর প্রশ্ন। কারণ সকলের যিনি স্রষ্টা তিনি তো মাখলুক হতে পারেন না যে, তার কোনও সৃষ্টিকর্তা থাকবে। তা থাকলে তিনি স্রষ্টাই হতে পারতেন না আর তখন কোনও সৃষ্টিরই অস্তিত্ব লাভ হত না। তো এই যে অবান্তর প্রশ্নের সূচনা হয়েছে তখন থেকে কালক্রমে এর বিস্তার ঘটতে থেকেছে। আর আজ অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মানুষ দরকারি বিষয়ে প্রশ্ন করে না, অথচ এমন সব বেদরকারি বিষয়ে প্রশ্ন করে, দুনিয়া আখিরাতে যার কোনও ফায়দা নেই। সে সম্পর্কে না কবরে, হাশরে প্রশ্ন হবে আর না তা অজানা থাকলে কোনও জ্ঞানী লোক তাকে অজ্ঞ ঠাওরাবে।

এই সীমালংঘন অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কাজের কথা ছেড়ে অকাজে লিপ্ত হওয়া কোনও  আকলমন্দী নয়। আকেল বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার জীবনের সীমিত সময় কেবল প্রয়োজনীয় কাজেই খরচ করবে। সে হিসেবে যা জানা দরকার সে সম্পর্কে সে অবশ্যই বিজ্ঞজনকে জিজ্ঞেস করবে আর যা জানা অপ্রয়োজনীয়, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হতে বিরত থাকবে। প্রশ্নোত্তর সওয়াল-জওয়াবের ক্ষেত্রে এটাই মধ্যপন্থা। আল্লাহ তাআলা সকলকে পন্থা ধরে রাখার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

 

advertisement