‘চান্দ্রমাস’ বই : একটি পর্যালোচনা : চাঁদ দেখার হাদীসসমূহের বিকৃতি ও অবমাননা
(পৃর্ব প্রকাশিতের পর)
পাঠকবৃন্দ জানেন, এই প্রবন্ধে আরো বার বার পড়ে এসেছেন যে, হিলাল দেখে রোযা রাখা এবং হিলাল দেখে রোযা ছাড়া (ঈদ করা) এবং হিলাল দেখার আগে রোযা শুরু না করা ও হিলাল দেখার আগে রোযা না ছাড়া (ঈদ না করা)-এর বিধান কেবল এক দুইটি হাদীসেই নয়; বরং বিপুল সংখ্যক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিধান ঘোষণা করেছেন। আর সেসব হাদীস সনদের দিক থেকে যেমন মুতাওয়াতির (নিরবচ্ছিন্ন বহু সূত্র পরম্পরায় বর্ণিত), তেমনি অর্থ ও বক্তব্যের দিক থেকেও মুতাওয়াতির, মুতালাক্কা বিল কবুল (সর্বজনসমাদৃত) ও মুজমা আলাইহি (সর্ববাদী সম্মত)। এবং আমলের দিক থেকেও এটিই মুমিনগণের পালিত অভিন্ন ধারা ও চিরঅনুসৃত পথ।
উম্মতে মুসলিমার এই সর্বসম্মত পথের বাইরে গিয়ে ভিন্নমত অবলম্বন করেছিল শীয়া বাতেনিয়া। শীয়া বাতেনিয়া একটি খোদাদ্রোহী বদদ্বীন ফেরকা, যারা ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ব্যাপারে সকল আহলে হক একমত।
শীয়া বাতেনিয়া হিলাল দেখার বিধান পরিত্যাগ করে হিসাবের ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ পালনের পথ এখতিয়ার করেছিলো। আফ্রিকা ও আলেকজান্দ্রিয়ার মধ্যবর্তী একটি অঞ্চলের নাম হল বারকা। সেখানকার কাযী ছিলেন ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হুবুলি রাহ.। একবার বারকার আমীর (গভর্নর) এসে তাকে বললেন, কাল ঈদ। কাযী বললেন,
حتى نرى الهلال، ولا أُفَطِّرُ الناسَ وأَتَقَلَّدَ إثمَهم.
‘না, যতক্ষণ না আমরা হিলাল দেখি। হিলাল দেখা ব্যতিরেকে মানুষকে রোযা ছাড়তে বলতে পারি না। এর গোনাহের দায়ভার আমি নিতে পারি না’। জবাবে আমীর বললেন, খলীফা মনসূরের ফরমান এসেছে যে, কাল ঈদ করতে হবে!! (কারণ এরা হিসাবের সাহায্যে আগেই তারিখ নির্ধারণ করে ফেলতো। চাঁদ দেখার অপেক্ষা করতো না। প্রকাশ থাকে যে, এই মনসূর আবক্ষাসী খলীফা আবু জা‘ফর মনসূর নয়। বরং এ হচ্ছে, উবাইদি শাসনের ফাতেমী খলীফা আবু তাহের ইসমাঈল ইবনে মুহাম্মাদ। যার জন্ম ৩০২ হিজরীতে আর মৃত্যু ৩৪১ হিজরীতে)।
ঘটনাক্রমে সে রাতে চাঁদ দেখা গেল না। কিন্তু এদিকে আমীর তো ঈদের জন্য তৈরি হয়ে ঢোল-তবলা নিয়ে নেমে পড়েছে! কিন্তু কাযী মুহাম্মাদ ইবনে হুবলি রাহ. বললেন, আমি যাব না। নামাযও পড়াব না। আমীর অন্য একজনকে খুতবার যিম্মাদারি দিল এবং পুরো ঘটনা লিখে জানাল। খলীফা কাযীকে তলব করল। এবং বলল, নিজের মত প্রত্যাহার করে নাও, ক্ষমা করে দেব!
কাযী ছিলেন শরীয়তের অনুগত। বাতিলের সামনে নতজানু ছিলেন না। তিনি রাজি হলেন না। অতএব জালেম খলীফা হুকুম দিল, তাকে রোদের মধ্যে ঝুলিয়ে দাও। এবং তাই করা হল। আর এ অবস্থাতেই তার মৃত্যু উপস্থিত হল। পানি চেয়ে পানিও পেলেন না তিনি। কিন্তু এতেও খলীফার মন ভরল না। তাই শূলিতে চড়িয়ে তার অবশিষ্ট আক্রোশ মিটাল!!
মহান ইসলামী ঐতিহাসিক শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. (৭৪৮ হি.) এ মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করে লেখেন : فلعنة الله على الظالمين ‘জালেমদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত’। -সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী, খ. ১৫, পৃ. ৩৭১
আল্লাহ তাআলা ঐ উবাইদী জালেমদের হাত থেকে উম্মতকে রেহাই দিয়েছেন। কিন্তু তাদের জাহেলী প্রথার পুনর্জীবনের পাঁয়তারা চলছে। শুধু এই ঘটনাটি থেকেই পাঠকবর্গ অনুমান করতে পারেন, ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ এনামুল হক কি হাজার বছরের ত্রুটির সংশোধন করছেন নাকি সাড়ে চৌদ্দশ বছর ধরে চলে আসা নববী সুন্নতকে ছেড়ে হাজার বছর আগের এক মৃত জাহেলী প্রথাকে পুনর্জীবিত করতে চলেছেন! আয় আল্লাহ! তুমি এই লোককে সত্য সঠিক পথে ফিরাও। আমীন!
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যদি চাঁদ দেখার পরিবর্তে হিসাবের পক্ষপাতিত্বের এই কাজটি কেবল বুদ্ধি-চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে করতেন কিংবা ঐ বাতেনী সম্প্রদায়ের রেফারেন্সে করতেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত বিষয় ছিল। বিচ্ছিন্নতার এই পথ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আরো অনেকেই অবলম্বন করেছে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের স্বাতন্ত্র্য হল তিনি এই ভ্রান্তিকে প্রমাণিত করবার জন্য কুরআন ও সুন্নাহর বিকৃতি সাধন করেছেন এবং কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে অনবরত মিথ্যাচার করে গেছেন।
চাঁদ দেখা বিষয়ক হাদীসসমূহ অস্বীকার করার জন্য তিনি নানান বাহানা আবিষ্কার করেছেন। তার সেসমস্ত বাহানার খতিয়ান পেশ করার ইচ্ছা আমার নেই। এবং তার বিশেষ প্রয়োজনও নেই। আমি শুধু তার ধোঁকাবাজির গোড়ার কয়েকটি দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সামনে এগোতে চাই। দেখুন-
১. একবার বলেছেন, হিলাল দেখতে বলার উদ্দেশ্য হল, হিসাবের মাধ্যমে বুদ্ধির সাহায্যে হিলাল সম্পর্কে অবগত হয়ে রোযা ও ঈদ কর।
২. কয়েকটি জায়গায় বলেছেন, যেহেতু ঐ যামানায় (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের যামানায়) মানুষজন হিসাব জানতো না তাই একটি সাময়িক বিকল্প হিসেবে চাঁদ দেখে রোযা ও ঈদ করতে বলা হয়েছে। এখন যামানা অনেক উন্নত হয়েছে। অতএব এখন দেখা নয়, বরং হিসাবের মাধ্যমে চান্দ্রমাসসমূহের সূচনা মেনে আমল করতে হবে!! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো নিজেই বলেছেন, আমরা উম্মী উম্মত। লিখতেও জানি না, হিসাবও করতে জানি না!!
ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের দ্বিতীয় কথাটি প্রথম কথার বিপরীত। যদি হিসাব না জানার কারণে দেখার বিধান দিয়ে থাকেন তাহলে ‘হিলাল দেখা দ্বারা’ হিসাবের মাধ্যমে হিলাল সম্পর্কে অবগত হওয়া কী করে উদ্দেশ্য হতে পারে? যদি বলেন, আগে উদ্দেশ্য ছিল ওটা, এখন এটা, তাহলে এটা হবে গায়ের জোরে বলা। হাদীসের মর্ম সুনির্ধারিত হয়ে যাবার পর তাকে অপরিচিত অর্থে ব্যবহার করা- এরই নাম হাদীসের বিকৃত সাধন।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কাছে আরেকটি প্রশ্ন হল, আপনি তো বলেছিলেন যে, ‘হিলাল’ অমাবস্যা পরবর্তী পৃথিবী থেকে দর্শনযোগ্য নতুন চাঁদ নয়; বরং এ হল, অমাবস্যার অন্ধকারাচ্ছন্ন চাঁদ। তো অন্ধকারাচ্ছন্ন চাঁদ তো সেইকালেও দর্শনযোগ্য ছিল না, বর্তমানকালেও না। যদি ‘হিলাল’ অমাবস্যার চাঁদই হবে তাহলে আপনার এ কথা কীভাবে সঠিক হয় যে, হিসাব জানতো না বলে তারা হিলাল দেখে রোযা এবং ঈদ করতো!! তবে কি অন্ধকারাচ্ছন্ন চাঁদ ঐ যামানায় দেখা যেতো, এই যামানায় দেখা যাচ্ছে না, এমন?! যিনি বলেছেন সত্য বলেছেন-
دروغ گو را حافظہ نباشد
তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ‘আমরা উম্মী উম্মত, আমরা লিখি না, হিসাবও করি না। অতপর উভয় হাতের আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করে বললেন, মাস ২৯ দিনে হয় কিংবা ৩০ দিনে।’ এই হাদীসে চান্দ্রমাস কখনো উনত্রিশা আর কখনো ত্রিশা হওয়ার হেকমত বর্ণনা করা হয়েছে। এতে তো এ কথা বলা হয়নি যে, আমাদের হিসাব জানা নেই বিধায় তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখ এবং হিলাল দেখে রোযা ছাড়। সহীহ, হাসান তো পরের কথা কোনো যয়ীফ রেওয়ায়েতেও এ ধরনের কোনো হাদীস বর্ণিত নেই। বরং একাধিক সহীহ হাদীসে আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিলাল দেখে রোযা ও ঈদ করার বিধান এজন্য দিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলা হিলালকে মিকাত বানিয়েছেন। এ বিষয়টা খুব ভালো করে বুঝে নেয়া চাই। কারণ বিচ্ছিন্ন চিন্তা পোষণকারী বহু লোক এই ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়েছে কিংবা বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।
এখন যদি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব দাবি করেন যে, উক্ত হাদীসে উম্মী হওয়াটাকে হেকমত হিসেবে নয়; বরং ইল্লত বা কারণ স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে২, আর এই কারণটি এখন আর বিদ্যমান নেই। কেননা তার মতে উম্মতের অধিকাংশ মানুষ এখন হিসাব কিতাবে দক্ষ হয়ে গেছে! অতএব পূর্বোক্ত বিধান পাল্টে যাবে (নাউযুবিল্লাহ)। যদি তিনি এই দাবি করেন তাহলে তার উচিত এখন চান্দ্রমাসকে কখনো উনত্রিশা আর কখনো ত্রিশা গণ্য করার বদলে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবের আলোকে পৃথিবীকে চাঁদের প্রদক্ষিণ প্রকৃত সময়কালের বিচারে চান্দ্রমাসের হিসাব করা। জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব অনুসারে সামগ্রিকভাবে এক একটি চান্দ্রমাস হচ্ছে ২৯ দিন বারো ঘণ্টা, ৪৮ মিনিট, ৩ সেকেন্ড। এটা গড় সময়সীমা। তাফসীল বিবেচনা করা হলে এ সময়সীমা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। তো যাইহোক, জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব অনুযায়ী প্রকৃত সময়কাল যা দাঁড়ায় সেই নিরিখেই তাকে চান্দ্রমাস গণনা করতে হবে। কারণ উম্মীয়তের (নিরক্ষরতার) যামানার বিধান তার মনঃপূত নয়। অথচ তিনি তার বইয়ে বারবার একথাই বলে গেছেন যে, চান্দ্রমাস গণনায় ভগ্নাংশ ধর্তব্য হবে না। বরং কখনো উনত্রিশ কখনো ত্রিশ!!
যেই বিধানের মধ্যে উম্মী হবার কথা উল্লেখ রয়েছে সেটাকে তো আপনিও পাই টু পাই মান্য করেন। আর যেই বিধানের মধ্যে কুরআনের আয়াত ২ : ১৮৯-এর উদ্ধৃতি দিয়ে এই আয়াত অনুযায়ী আমলের তরীকা বাতানো হয়েছে; যেখানে উম্মী হবার কথা কোনো রেওয়ায়েতেই উল্লেখ নেই- সেটাকে এই বলে অস্বীকার করা হচ্ছে যে, এখন আমরা আর উম্মী নেই। সেয়ানা হয়ে গেছি! আখের তামাশারও তো একটা সীমা থাকা উচিত!
৩. নতুন চাঁদ দেখার হাদীসসমূহের বিকৃতি সাধনের জন্য তৃতীয় যে বাহানাটি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব খাড়া করেছেন তা সত্যিই বড় অদ্ভুত! যদি কোনো প্রকার ধোঁকা-প্রতারণার জন্য মোবারকবাদ দেয়া বৈধ হতো তাহলে এই ক্ষেত্রে তিনি মোবারকবাদ পেতে পারতেন। তার সে বাহানাটি হল তার মতে-
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো হাদীসে বারো চান্দ্রমাসের কথা উল্লেখই করেননি।
২. বারো মাসের শুরু কীভাবে করা হয়ে থাকে, এ ব্যাপারে কিছু বলেননি।
৩. বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ বঞ্চিত সেই যমানায় অপারগতা বশত শুধু রোযা রাখার জন্য চাঁদ দেখার বিধান দিয়েছিলেন। চাঁদ দেখে বাদবাকি এগারো মাস তো নয়ই স্বয়ং রমযান মাসও শুরু করতে বলেননি!!
কেননা তার মতে রমযানসহ বারো মাস সূচনার যে তরীকা কুরআন বর্ণনা করেছে তা হল, হিসাবের মাধ্যমে অমাবস্যার মধ্যে শুরু হওয়া এস্ট্রনমিক্যাল নিউমুন দিয়ে মাস আরম্ভ করা (নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বলেন, ‘এজন্যই বুখারী হাদীস ১৭৬৪ ও হাদীস ১৭৬৫ তে ‘রমযান’ বলেছে, ‘শাহরু রমাযান’ (রমযান মাস) বলেনি। কারণ রমযানের মাস তো যতযাই হোক চাঁদ দেখে শুরু করা যায় না। কেননা এতে করে কুরআনের বিরুদ্ধাচরণ অবধারিত হয়ে যায়। চাঁদ দেখে রোযা রেখে ফেলা, এটা তো অপারগতার সময়কার জন্য ছিল, এর বেশি কিছু না। ‘রমযানের মাস’ তো অমাবস্যার মধ্যে শুরু হওয়া নবচন্দ্র দিয়েই আরম্ভ করতে হবে।৩
পর্যালোচনা
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তাজ কোম্পানির অনূদিত বুখারীর হাওয়ালা দেন। সেখানে ১৭৬৪ নম্বর হাদীসটি হল-
إِذَا جَاءَ رَمَضَانُ فُتِحَتْ أَبْوَابُ الجَنَّةِ.
অর্থাৎ যখন রমযান আসে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়।
আর ১৭৬৫ নম্বর হাদীসটি হচ্ছে-
إِذَا دَخَلَ رَمَضَانُ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الجَنَّةِ، وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ وَسُلْسِلَتِ الشَّيَاطِينُ.
অর্থাৎ ‘যখন রমযান আসে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানদের জিঞ্জির পরানো হয়’।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বলছেন, এ সকল হাদীসে রমযান বলা হয়েছে। ‘শাহরু রমাযান’ বলা হয়নি।৪ এতে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রমযান মাস চাঁদ দেখে শুরু করা হবে না; বরং অমাবস্যা থেকে শুরু হবে। সম্মানিত পাঠক! আপনারাই বলুন, উপরিউক্ত হাদীস দুটি থেকে একথা কীভাবে বোঝা যায়? আচ্ছা, ‘রমযান’ এবং ‘শাহরু রমাযান’ এর মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? তবে কি এ হাদীসগুলোতে ‘রমযান’ কোনো মানুষ কিংবা অন্য কোনো মাখলুকের নাম যে, ‘শাহর’ শব্দের উল্লেখ না থাকলে এর উদ্দেশ্য হবে একটা, আর উল্লেখ থাকলে হবে অন্য কিছু।
তদুপরি উপরিউক্ত হাদীসগুলোতে তো উর্ধ্বজগতের কর্মতৎপরতার উল্লেখ করা হয়েছে। এর সাথে মানুষের কর্মকা--র কী সম্পর্ক? মানুষের তো এখান থেকে শুধু রমযানের ফযীলতটুকু জেনে নেয়া কর্তব্য। এরপর এই রমযানে কী কী করতে হবে এবং কীভাবে, সেটা তো এ দুই হাদীসে নেই। সেটার উল্লেখ আছে অন্যান্য বহু হাদীসে। এবং রীতিমত শাহ্র (মাস) শব্দসহ। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব সেই হাদীসগুলো উল্লেখ করেন না কেন?
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে,
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِهِلَالِ شَهْرِ رَمَضَانَ: إِذَا رَأَيْتُمُوهُ فَصُومُوا ثُمَّ إِذَا رَأَيْتُمُوهُ، فَأَفْطِرُوا فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَاقْدُرُوَا لَهُ ثَلَاثِينَ يَوْمًا.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসের চাঁদের উল্লেখ করে বলেছেন, যখন হিলাল দেখ তখন রোযা রাখ। এরপর যখন হিলাল দেখ তখন রোযা ছাড়। যদি হিলাল দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায় তাহলে তাকে ত্রিশ দিন গণনা করো। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস ৭৩০৭, বাবুস সিয়াম, ‘তুরুকু হাদীসি ইবনি উমর ফি তারাইল হিলাল’ মুহাদ্দিস, খতীব বাগদাদী পৃ. ১৭
قال الراقم : والإسناد رجاله ثقات من رجال الصحيحين.
হাসান (বছরী রাহ.) থেকে বর্ণিত,
أَحْصُوا هِلَالَ شَعْبَانَ لِرُؤْيَةِ شَهْرِ رَمَضَانَ، فَإِذَا رَأَيْتُمُوهُ، فَصُومُوا، ثُمَّ إِذَا رَأَيْتُمُوهُ، فَأَفْطِرُوا، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا الْعِدَّةَ.
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা শাবানের হিলাল ভালভাবে গুণে রাখ রমযান মাস দেখার জন্য। ব্যস, যখন তা দেখে নাও তখন রোযা রাখ। এরপর যখন তা দেখ তখন রোযা ছাড়। যদি তা আড়ালে পড়ে যায় তাহলে (ত্রিশ) সংখ্যা পূর্ণ কর’। -মুসান্নাফে আবদুর রায্যাক, হাদীস ৭৩০৩, বাবুস সিয়াম৫
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لَا تَقَدَّمُوا شَهْرَ رَمَضَانَ بِصِيَامِ يَوْمٍ أَوْ يَوْمَيْنِ، إِلَّا رَجُلًا كَانَ يَصُومُ صَوْمًا فَلْيَصُمْهُ.
তোমরা একটি বা দুইটি রোযা আগে রেখে রমযান মাসকে অগ্রবর্তী করো না। হাঁ, যদি কেউ কোনো বিশেষ দিনের রোযা রাখছিলো (আর ঘটনাক্রমে সেটা ৩০ শাবানের দিন হয়) তাহলে সে রোযা রাখুক। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১০১৮৪, জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৯৩; আল মুনতাকা, ইবনুল জারুদ, হাদীস ৩৭৮, পৃ. ১৩৮
ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটি حسن صحيح (অর্থাৎ উচ্চ পর্যায়ের সহীহ হাদীস)।
আবু হুরায়রা রা. থেকে এ রেওয়ায়েতও রয়েছে যে,
قَالَ النَّبِي صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَقَدَّمُوا الشَّهْرَ بِيَوْمٍ وَلَا بيَوْمَيْنِ، إِلَّا أَنْ يُوَافِقَ أَحَدُكُمْ صَوْمًا كَانَ يَصُومُهُ، صُومُوا لِرُؤْيَتِه وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِه، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَأَتِمُّوا ثَلَاثِينَ يَوْمًا، ثُمَّ أَفْطِرُوا.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা (রমযান) মাসকে এক বা দুই দিন অগ্রবর্তী করো না। তবে যদি এমন হয় যে, কারো বিশেষ কোনো রোযার মামুল আছে...। হিলাল দেখে রোযা রাখো এবং হিলাল দেখে রোযা ছাড়ো। যদি হিলাল আড়ালে পড়ে যায় তাহলে ত্রিশ দিন পূর্ণ করো। তারপর (ঈদুল) ফিত্র (পালন) করো। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৬৫৪, খ. ২, পৃ. ৮৩৮, জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৯২, কিতাবুস সওম, বাব : ২) ইমাম তিরমিযী বলেন, এই হাদীস حسن صحيح
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত-
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَا تَسْتَقْبِلُوا الشَّهْرَ اسْتِقْبَالًا، صُومُوا لِرُؤْيَتِه وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِه، فَإِنْ حَالَ بَيْنَكَ وَبَيْنَ مَنْظَرِه سَحَابٌ أَوْ قَتَرَةٌ فَأَكْمِلُوا الْعِدَّةَ ثَلَاثِينَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা (রমযানের) মাসকে এগিয়ে এনো না। হিলাল দেখে রোযা রাখ এবং হিলাল দেখে রোযা ছাড়। যদি তোমাদের মাঝে এবং হিলাল দেখার মাঝে মেঘ কিংবা ধূলা অন্তরায় হয় তাহলে পূর্ণ ত্রিশ গণনা করো। -সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৯১২, কিতাবুস সওম, বাব : ২৯; সহীহ ইবনে হিবক্ষান, হাদীস ৩৫৯০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৯৮৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩২৭
তাই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের এ দাবি করা যে, বারো মাসের শুরু কীভাবে করতে হয় এ ব্যাপারে কোনো হাদীস নেই- এই দাবি পুরোপুরিই মিথ্যা। তার কারণ প্রথমত হিলাল দেখে রোযা রাখা এবং হিলাল দেখে ঈদ করা বিষয়ক সমস্ত হাদীসের প্রেক্ষাপট এটাই যে, ইসলামী চান্দ্রমাস হিলাল দেখে শুরু হয় এবং পরবর্তী হিলাল দেখার মাধ্যমে শেষ হয়। এ থেকে এই তত্ত্ব বের করা যে, রোযা এক জিনিস আর রমযান আরেক জিনিস- এটা নিজের নির্বুদ্ধিতারই প্রমাণ দেয়া। নতুবা এটা কি কল্পনা করা সম্ভব যে, রমযান মাস শুরুই হয়নি অথচ রমযানের ফরয রোযা শুরু হয়ে গিয়েছে! বা শুরু হয়নি! আবার রমযান শেষ হয়নি, কিন্তু রমযানের রোযা শেষ হয়ে গিয়েছে? বা রমযান শেষ কিন্তু রোযা এখনো শেষ হয়নি! এ ধরনের কথা লিখবার সময় মানুষের তার নিজের বিবেকের মর্যাদাটুকু বিস্মৃত না হওয়া কাম্য! দ্বিতীয়ত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াত ২ : ১৮৯-এর দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা হিলালকে আমাদের জন্য মীকাত বানিয়েছেন। অতএব তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখ এবং হিলাল দেখে রোযা ছাড়। তো যখন আয়াত ২ : ১৮৯-এ হিলালী মাসসমূহের ব্যবস্থার উল্লেখ রয়েছে তখন হাদীসে তো ঐ ব্যবস্থাকেই আরো স্পষ্ট করা হয়েছে। অর্থাৎ আয়াতে আমাদেরকে হিলাল দেখে মাস আরম্ভ করতে বলা হয়েছে। যে কারণে রমযানের রোযাও আমাদেরকে হিলাল দেখে শুরু করতে হবে এবং শাওয়ালের হিলাল দেখার মাধ্যমে শেষ করতে হবে। বোঝা গেল, হিলাল দেখে রোযা শুরু করা- এটা চান্দ্রমাস আরম্ভের কুরআনী তরীকা অনুযায়ী আমল করার উদ্দেশ্যে, উম্মী হবার অপারগতায় নয়।
তৃতীয়ত, চান্দ্রমাসসমূহ শুরু করার পদ্ধতি আলাদাভাবেও সহীহ হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
الشَّهْرُ هكَذَا وَهكَذَا وَهكَذَا ثَلَاثِينَ، وَالشَّهْرُ هكَذَا وَهكَذَا وَهكَذَا، وَيَعْقِدُ فِي الثَّالِثَة، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا ثَلَاثِينَ.
মাস এরকম, এরকম এবং এরকম হয় অর্থাৎ ত্রিশা আবার মাস এরকম, এরকম ও এরকম হয়, তৃতীয়বার এক আঙ্গুল বন্ধ করে (অর্থাৎ ঊনত্রিশা)। সুতরাং যদি চাঁদ আড়ালে চলে যায় তাহলে ত্রিশ পূর্ণ করো। -সহীহ ইবনে খুযায়মা, খ. ২, পৃ. ৯২১, হাদীস ১৯০৯, সহীহ ইবনে হিবক্ষান খ. ৮, পৃ. ২৩৪, হাদীস ৩৪৫১
এখানে রমযানের উল্লেখ নেই। চান্দ্রমাসের স্বভাবধারা বর্ণনা করা হয়েছে। সেটা কখনো ত্রিশ হয়। কখনো ঊনত্রিশ। সেজন্য ঊনত্রিশের রাতে হিলাল দৃষ্টিগোচর না হলে ত্রিশ পূর্ণ করার বিধান দিয়েছেন। অর্থাৎ হিলাল দৃষ্টিগোচর হলে আগামীকাল হবে নতুন মাসের প্রথম দিন। অর্থাৎ গত মাসটি হবে ২৯ দিনের।
চান্দ্রমাসের এই ইসলামী নিয়ম অনুসারে বারো মাসের নবম মাস রমযানও এই পদ্ধতিতেই শুরু করতে হয়। এ নয় যে, হিলাল দেখা কেবল রোযার জন্য, মাসের জন্য নয়। ইরশাদ হয়েছে-
الشَّهْرُ تِسْعٌ وَعِشْرُونَ لَيْلَةً، فَلاَ تَصُومُوا حَتَّى تَرَوْهُ، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا العِدَّةَ ثَلاَثِينَ.
অর্থাৎ, মাস ঊনত্রিশ রাত্রির (হিলাল দৃষ্টিগোচর না হলে ত্রিশ রাত্রির) অতএব তোমরা হিলাল না দেখে রোযা রেখো না। হিলাল আড়ালে পড়ে গেলে (আগের মাসের) গণনা ত্রিশ পূর্ণ করো। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৭, কিতাবুস সওম, বাব : ১১
আরো ইরশাদ হয়েছে-
لَا تَقَدَّمُوا الشَّهْرَ حَتَّى تَرَوْا الْهِلَالَ قَبْلَهُ أَوْ تُكْمِلُوا الْعِدَّةَ، ثُمَّ صُومُوا حَتَّى تَرَوْا الْهِلَالَ، أَوْ تُكْمِلُوا الْعِدَّةَ قَبْلَهُ.
অর্থাৎ মাসকে আগেই শুরু করে দিয়ো না। প্রথমে হিলাল দেখে নাও। অথবা পূর্ববর্তী মাসের গণনা (৩০) পূর্ণ করে নাও। তারপর রোযা রাখতে থাক। যে পর্যন্ত না হিলাল দেখ কিংবা রমযানের গণনা (৩০) পূর্ণ কর।’ -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩২০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২১২৬; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৯১১, সহীহ ইবনে হিবক্ষান, হাদীস ৩৪৫৮
চান্দ্রমাস শুরু করার যে তরীকা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে শাবান রমযান এবং শাওয়ালের ক্ষেত্রে ঐ তরীকা অবলম্বনের বিধানই এ হাদীসগুলোতে দেয়া হয়েছে। এটা শুধু রোযার জন্য খাস কোনো বিধান ছিল, এমন নয়।
বিশেষভাবে শাবানের বিষয়ে হাদীসে এসেছে-
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَحَفَّظُ مِنْ هِلَالِ شَعْبَانَ مَا لَا يَتَحَفَّظُ مِنْ غَيْرِهِ، ثُمَّ يَصُومُ لِرُؤْيَةِ رَمَضَانَ، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْهِ، عَدَّ ثَلَاثِينَ يَوْمًا، ثُمَّ صَامَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য মাসের হিলালের চেয়ে শাবানের হিলালের বেশি খেয়াল রাখতেন (কেননা এর সাথেও রয়েছে রমযানের সম্পর্ক)। এরপর রমযানের হিলাল দেখে রোযা রাখতেন। যদি তা দৃষ্টির আড়ালে পড়ে যেতো তাহলে ত্রিশ দিন গণনা করতেন তারপর রোযা রাখতেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৫১৬১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩২৫; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৯১০, সহীহ ইবনে হিবক্ষান, হাদীস ৩৪৪৪
যিলহজ্বের ব্যাপারেও হাদীসের ইরশাদ-
إِذَا رَأَيْتُمْ هِلَالَ ذِي الْحِجَّةِ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِه وَأَظْفَارِه.
যখন তোমরা যিলহজ্বের হিলাল দেখতে পাও তখন যার কুরবানী করার ইচ্ছা রয়েছে সে নিজের চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৭, কিতাবুল আযাহী, বাব ৭
মুহাররম সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, হাকাম ইবনুল আরাজ আব্দুল্লাহ ইবনে আবক্ষাস রা.-কে আশুরার রোযার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করল। তখন তিনি বললেন,
إِذَا رَأَيْتَ هِلَالَ الْمُحَرَّمِ فَاعْدُدْ، وَأَصْبِحْ يَوْمَ التَّاسِعِ صَائِمًا.
যখন মুহাররমের হিলাল দেখ তখন থেকে গুনতে থাক। আর নবম দিন রোযা অবস্থায় ভোর করো।৬ তিনি জিজ্ঞেস করলেন-
هكَذَا كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُهُ؟
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি এভাবেই আশুরার রোযা রাখতেন?
বললেন, نَعَمْ হাঁ। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৩৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৩
হিলাল (নতুন চাঁদ) দেখার এই ইসলামী নীতিমালা সকল চান্দ্রমাসের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হতো। কাতাদা রাহ. বলেন, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিলাল দেখতেন তখন বলতেন-
هِلَالُ خَيْرٍ وَرُشْدٍ ثَلَاثًا، ثُمَّ قَالَ: آمَنْتُ بَالَّذِي خَلَقَكَ.
তারপর বলতেন-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي ذَهَبَ بِشَهْرِ كَذَا، وَكَذَا، وَجَاءَ بِشَهْرِ كَذَا، وَكَذَا.
-মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, হাদীস ৭৩৫৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৫১, কিতাবুল আদব, ما يقول إذا رأى الهلال
তো হিলাল দেখে দুআ পাঠ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি অমুক মাস পূর্ণ করে দিয়েছেন আর অমুক মাসের আগমন ঘটিয়েছেন।
মোটকথা হিলাল দেখা ইসলামী চান্দ্রমাসসমূহের কুরআন বর্ণিত এবং শরীয়ত নির্ধারিত নীতি। এটা উম্মী হওয়া বা অন্য কোনো অপারগতার পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িক সমাধান ছিল না। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের একথাও গলদ যে, চান্দ্রমাস শুরু করার কোনো ব্যবস্থা হাদীসে নেই। এটাও গলদ যে, হিলাল দেখে মাস শুরুর বিষয়ে কোনো কওলী (বাণী) হাদীস নেই। এটাও গলদ যে, হাদীসে হিলাল সম্পর্কিত বিধানে ‘শাহরু রমাযান’ বলা হয়নি, শুধু রমযান বলা হয়েছে। তদ্রূপ এটাও গলদ যে, বছর বারো মাসে হওয়ার বিষয়ে কোনো হাদীস নেই। হাদীস শরীফে স্পষ্ট এসেছে-
السنة اثنا عشر شهرا، منها أربعة حُرُم، ثلاثة متواليات، ذو القعدة، وذوالحجة، والمحرم، ورجب مُضَر الذي بين جمادى وشعبان
অর্থাৎ বছর বার মাসে হয়। তার মধ্যে চারটি মাস মুহতারাম। তিনটি তো ধারাবাহিক; যুলকাদা, যুলহিজ্জা ও মুহাররম। আর একটি মাস পৃথক; রজব। যা জুমাদা ও শাবানের মাঝখানে।
এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জের এক খুতবায় ইরশাদ করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ, ৫/৩৭, হাদীস ২০৩৮৬; সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১৯৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৭৯)
অতএব ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কথা বানানোর কোনো সুযোগ নেই। তবে মানা না মানা- এটা তাঁর কাজ। আমরা শুধু দুআই করতে পারি যে, আল্লাহ তাআলা তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনুন।
৪. নতুন চাঁদ দেখার হাদীসসমূহকে অস্বীকারের জন্য আরেকটি বাহানা তিনি অন্য কিছু বিচ্ছিন্ন মত পোষণকারী লোকজন থেকে ধার করেছেন। কিন্তু তাদের উদ্ধৃতি না দিয়েই সারা বইয়ে খুবই উচ্ছ্বাস আর খুবই গর্বের সাথে বারংবার তার পুনরাবৃত্তি করে গেছেন। সেটি এই যে, এই যামানায় যেমন নাকি নামাযের সময় জানার জন্য কাঠি পরিমাপের হাদীসের প্রয়োজন নেই; বরং আমাদের বিজ্ঞানের উপহার ঘড়িই যথেষ্ট তেমনিভাবে এখন বিজ্ঞানের উৎকর্ষের এই যুগে হিলাল দেখার হাদীসসমূহের প্রয়োজন নেই। এখন হিজরী ক্যালেন্ডারই যথেষ্ট। এটা ওর চেয়েও ভালো এবং উন্নত বিকল্প।
এই অযৌক্তিক যুক্তিবাদিতা সম্পর্কে তো প্রবন্ধের আগামি কিস্তিতে ইনশাআল্লাহ আলোচনা করা হবে। এই মুহূর্তে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, এধরনের বুদ্ধিসর্বস্ব প্রমাণ উপস্থাপন করে যে কোনো ব্যক্তি শরীয়তের যে কোনো বিধানের ব্যাপারে বলতে পারে যে, এটা এই উৎকর্ষলব্ধ যুগের সঙ্গে মানানসই নয়। এখন এর অমুক ভালো বিকল্প এসে গেছে। যাদের দৃষ্টিতে আল্লাহ তাআলার দেয়া দ্বীন ও শরীয়তের মর্যাদা মাখলূকের তৈরি আইন-কানুনের মতই তারা এ ধরনের কথা খুব সহজেই বলতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনকে চিরন্তন বলে বিশ্বাস করে এবং শরীয়তের নীতিমালাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম মোতাবিক চিরন্তন মনে করে, যার দৃষ্টিতে ঈমান সকল কিছুর আগে তার কল্পনার ত্রিসীমানাতেও এ ধরনের শয়তানী ওয়াসওয়াসা আসতে পারে না।
اللهم يا مقلب القلوب ثبت قلوبنا على دينك.
(চলবে ইনশাআল্লাহ)