Rabiul Auwal 1438   ||   December 2016

এখানেই শেষ নয়!

Mawlana Muhammad Zakaria Abdullah

ভারতের একটি জায়গার নাম থানাভবন। এখানে বাস করতেন একজন বড় মনীষী বুযুর্গ। গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণে সে সময়ের বড় আলিমগণ তাঁকে ভূষিত করেছিলেন হাকীমুল উম্মতউপাধিতে। হাঁ, তিনি হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী। থানা ভবনের অধিবাসী হওয়ায় তাকে বলা হয় থানভী

একবারের ঘটনা। হযরত থানভী রাহ. সাহারানপুর থেকে কানপুর যাবেন। সাথে যে মালপত্র ছিল তাঁর মনে হল, একজন যাত্রী বিনা ভাড়ায় যা সাথে নিতে পারে এ তার চেয়ে বেশি। সুতরাং অতিরিক্ত মালপত্রের ভাড়া পরিশোধ করা উচিত। তিনি স্টেশনে নির্ধারিত কাউন্টারে গেলেন এবং কর্মরত ব্যক্তিকে তার মালপত্র ওজন করে ভাড়া নিতে বললেন। লোকটি ছিল অমুসলিম তবে তাঁর পূর্ব-পরিচিত। তাই খাতির করে বলল, আপনাকে অতিরিক্ত মালের ভাড়া দিতে হবে না। আমি রেলের গার্ডকে বলে দিচ্ছি, সে কোনো আপত্তি করবে না।

: এই গার্ড আমার সাথে কতদূর যাবে? থানভী রাহ. জিজ্ঞাসা করলেন।

: গাজিআবাদ পর্যন্ত।

: এরপর কী হবে?

: সে আরেকজনকে বলে দিবে।

: দ্বিতীয় জন কতদূর যাবে?

: কানপুর পর্যন্ত।

: এরপর কী হবে?

: এরপরে আর কী প্রয়োজন? আপনি তো কানপুর পর্যন্তই যাচ্ছেন।

: না, আমার সফর তো কানপুরেই শেষ নয়! থানভী রাহ. বললেন।

কাউন্টারের লোকটির এবার অবাক হওয়ার পালা। সে থানভী রাহ.-এর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

থানভী রাহ. বললেন, না! আমার সফর কানপুরেই শেষ নয়। আমাকে যেতে হবে আরো অনেক দূর এবং সবশেষে আমাকে গিয়ে দাঁড়াতে হবে আল্লাহ তাআলার সামনে। ঐখানে তো আপনার গার্ড আমার সাথে থাকবে না।

লোকটি হযরত থানভী রাহ.-কে  আগে থেকেই চিনতো। আজ তাঁকে যেন আবার নতুন করে চিনল।

* * *

এই যে ন্যায়-অন্যায় বোধ আর অন্যায় প্রস্তাবে, তা যতই সুবিধাজনক হোক, ‘নাবলার যোগ্যতা- এ তিনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন? এ তিনি পেয়েছিলেন কুরআন-সুন্নাহ থেকে, ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ থেকে, সত্য-ন্যায়ের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ও জীবনী থেকে।

যুগে যুগে কুরআন-সুন্নাহই তো আলো জ্বেলেছে অসংখ্য-মানুষের জীবনে, যে আলোয় আলোকিত হয়েছে তাদের চিন্তা ও বিশ্বাস, স্বভাব ও কর্ম। তাই আমরা বারবার ফিরে যাই কুরআন-সুন্নাহর কাছে, প্রিয় নবীর (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পবিত্র জীবনের কাছে। একটি ঘটনা বলি-

৭ম হিজরীর কথা। ঐ বছর হয়েছিল খাইবারের যুদ্ধ। মদিনা থেকে খাইবারের দূরত্ব প্রায় একশ মাইল। ওখানে ছিল ইহুদিদের বসতি। এরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনেক কষ্ট দিয়েছিল। কিন্তু দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারবার ওদের ক্ষমা করেছেন। দেখেও না-দেখার ভান করেছেন। বুঝেও না-বোঝার ভান করেছেন। কিন্তু পরিশেষে যখন ওদের অন্যায় সীমা ছাড়িয়ে গেল এবং মুসলমানদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যে চুক্তি ছিল তা ভেঙ্গে সরাসরি নবীজীকে হত্যা করার চেষ্টা করল তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওদের দমন করার জন্য যুদ্ধে নামলেন।

খাইবারে ইহুদিদের ছিল অনেকগুলো দূর্গ। মুসলিম মুজাহিদগণ কাছাকাছি জায়গায় ছাউনি ফেললেন। এদিকে খাইবারের এক হাবশী রাখাল, যে এক ইহুদি মালিকের ছাগল চরাতো, ছাগল চরাতে চরাতে মুসলিম ছাউনির কাছে এসে পড়েছিল। আরবীতে রাখালকে বলে রায়ী। আর হাবশী হওয়ায় তার গায়ের রং ছিলো কালো। তাই তার নাম পড়ে গিয়েছিল আসওয়াদ রায়ী- কালো রাখাল। তার প্রকৃত নাম ছিল ইয়াসার। যাই হোক, মুসলিম ছাউনির কাছে এসে তার মনে সাধ জাগল, মুসলমানদের যিনি নেতা সেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সে একনজর দেখবে। লোকমুখে সে কত কথা শুনেছে তাঁর সম্পর্কে। এই তো আজো দূর্গের ভেতর শুনে এল নানা কথা। তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যই তো দূর্গের ভেতরে সাজ সাজ রব। আজ এই সুযোগে সে যেভাবেই হোক একনজর তাঁকে দেখে যাবে।

আসওয়াদ রায়ী ধীরে ধীরে মুসলিম ছাউনির দিকে এগিয়ে এল। সাথে তার ছাগলের পাল। কাছে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখার বাসনা প্রকাশ করল। সাহাবীগণ দেখিয়ে দিলেন, ঐ যে তাবুটি, ওখানেই আছেন দোজাহানের সরদার। আসওয়াদ রায়ী বিস্মিত হয়, এই অতি সাধারণ তাঁবুতে অবস্থান করছেন মদীনার প্রতাপশালী রাজা! সে এগিয়ে যায় দুরুদুরু বুকে। দেখা পেয়ে যায় প্রিয় নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। আর প্রাণভরে শোনে তাঁর অমীয় বাণী। এরপর ঈমান এনে হয়ে যান তাঁর সাহাবী রাযিআল্লাহু আনহু। আগেই বলেছি তাঁর আসল নাম ইয়াসার। তো ইসলাম গ্রহণের পর ইয়াসার রা. আবেদন করলেন, আল্লাহর রাসূল! আমিও জিহাদে শামিল হতে চাই। নবীজী অনুমতি দিলেন।

ইয়াসার রা. বললেন, আমার সাথে যে ইহুদি মালিকের এক পাল ছাগল তা কী করব?

নবীজী বললেন, তা দূর্গের দিকে হাঁকিয়ে দাও। আল্লাহ তোমার আমানত মালিকের কাছে পৌঁছে দিবেন।

দেখ, সময়টা ছিল যুদ্ধের। আর ছাগলগুলো ছিল শত্রুপক্ষের। এত বড় মুজাহিদ বাহিনীর খাবারেরও তো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিতে বললেন। কারণ ইয়াসার রা. যখন এই ছাগলের পাল নিয়ে দূর্গ থেকে বের হয়েছেন তখনও তিনি মুসলমান হননি। মালিকের সাথে তার বিশ্বস্ততা রক্ষার যে অঙ্গিকার ছিল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ভঙ্গ করার অনুমতি দেননি।

এই হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। ইসলাম আমানতদারি ও বিশ্বাস রক্ষার ধর্ম, খেয়ানত ও বিশ্বাস-ভঙ্গের সুযোগ ইসলামে নেই। যে সততার ঘটনা কেউ দেখে না তা আল্লাহ দেখেন। এর প্রতিদান দুনিয়াতে না-পেলেও আখিরাতে পাওয়া যাবে। তেমনি যে অন্যায় কেউ দেখে না তা-ও আল্লাহ দেখেন। এর শাস্তি পৃথিবীতে না হলেও আখিরাতে অবশ্যই হবে। যদি না আল্লাহ ক্ষমা করেন। তাই পৃথিবীর এ জীবনই শেষ নয়, এরপর রয়েছে আরেক জীবন, আখিরাতের জীবন। আখিরাতই হচ্ছে ঐ শেষ মঞ্জিল যেখানে যেতে হবে সবাইকে- বিশ্বাসীকেও এবং অবিশ্বাসীকেও। 

 

 

 

advertisement