Rabiul Auwal 1438   ||   December 2016

এতদঞ্চলে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’পরিচিতি, মহিমা ও মজলুমি-৪

Mawlana Muhammad Abdul Malek

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কাফির আখ্যাপ্রাপ্ত বুযুর্গ আলিমগণের প্রকৃত মাকাম এবং গালির মন্দ পরিণাম

১. শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.

(জন্ম : ১১৯৩ হি., শাহাদাত : ১২৪৬ হি. ১৮৩৭ ঈ.)

শাহ ছাহেবের ইলমী মাকাম কত উঁচু ছিল তা  আল্লামা ফযলে হক্ব খায়রাবাদী রাহ.-এর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে, যা ইতিপূর্বে বরাতসহ উল্লেখিত হয়েছে। খায়রাবাদী ছাহেব শাহ ছাহেবের সমসাময়িক ছিলেন। তাদের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য ও সমসাময়িকতার প্রতিদ্বন্দিতাও ছিলএ সত্ত্বেও ইলমের ব্যাপারে শাহ ছাহেবের উচ্চ মাকামের কত স্পষ্ট স্বীকৃতি খায়রাবাদী ছাহেব দিয়েছেন!

এবার শাহ ইসমাঈল শহীদ এবং খায়রাবাদী উভয়ের উস্তায হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল আযীয রাহ.-এর সাক্ষ্য শুনুন। হিজরী তের শতকের শুরুতে এই ভুল ধারণার বিস্তার ঘটেছিল যে, হিন্দুস্তানের অধিবাসীদের উপর রাস্তা নিরাপদ না হওয়ার কারণে হজ্ব ফরয নয়। এই ভ্রান্ত প্রচারণার বিরুদ্ধে শাহ শহীদ রাহ. ও তাঁর সঙ্গী মাওলানা আব্দুল হাই বুড্ঢানভী রাহ. একটি দীর্ঘ ফতোয়া লেখেন। তাদের এই ফতোয়া এবং এর বিপরীত ফতোয়া শাহ আব্দুল আযীয রাহ.-এর খেদমতে পেশ করা হয়। শাহ আব্দুল আযীয রাহ. শাহ শহীদ ও আব্দুল হাই রাহ.-এর ফতোয়াকেই সমর্থন করেন এবং তাদের তাজুল মুফাসসিরীন’ (মুফাসসিরগণের মাথার মুকুট), ফখরুল মুহাদ্দিসীন (মুহাদ্দিসগণের গৌরব) সারআমদে উলামায়ে মুহাক্কিক্বীন (গবেষক আলেমগণের শীর্ষস্থানীয়) ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করেন এবং পরিষ্কার লেখেন যে, এই প্রশ্ন আমার কাছে পাঠানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ তারা দুজন তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, উসূল, মানতিক কোনো বিষয়েই আমার চেয়ে কম নন। তাদের মোহর ও দস্তখত যেন আমারই মোহর ও দস্তখত। এই দুই প্রিয় ফাযেলের প্রতি আল্লাহ তাআলার যে দয়া ও দান হয়েছে এর শোকর আদায় করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়...। তিনি আরো বলেন, ‘আমার দোস্ত মৌলভী আব্দুল হাই ও মৌলভী ইসমাঈলকে উলামায়ে রাব্বানীর মধ্যে গণনা করা চাই। আমার মেহেরবান, যদিও এসব কথায় পরোক্ষভাবে আত্মপ্রশংসা হয়ে যায় কিন্তু বাস্তবতা যাদের জানা আছে তাদের তা প্রকাশ করাও অপরিহার্য। তাই এ বিষয়ে মৌনতা সমীচীন মনে হয়নি।-সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ, মাওলানা সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী খ. ১ পৃ. ২৬০-২৬১

সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা, উম্মাহর ইসলাহ এবং আপন জীবন ও কর্মে শাহ শহীদ রাহ. কোন্ পর্যায়ের ব্যক্তি ছিলেন তা আহমদ রেযা খানের প্রশংসিত আলেম মুফতী ছদরুদ্দীন দেহলভী রাহ. এবং সদরুস সুদূর মাওলানা আব্দুল কাদের রামপুরী রাহ.-এর জবানিতেই শুনুন। মুফতী সদরুদ্দীন দেহলভী (মৃত্যু ১২৮৫ হি.) বলেন, ‘তাকবিয়াতুল ঈমানকিতাবটিতে সংক্ষেপে নজর বুলিয়েছি। মূলনীতি ও মৌলিক উদ্দেশ্যের দিক থেকে কিতাবটি খুবই ভালো। মৌলভী ইসমাঈল ছাহেবকে এমন দেখলাম যে, এরপর আর কাউকে তেমনটা দেখিনি। এরা ওইসব ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা চতুর্থ পারায় সূরা আলে ইমরানের নবম রুকুতে (আয়াত ১৭৩) বলেছেন-

اَلَّذِیْنَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ اِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوْا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ اِیْمَانًا وَّ قَالُوْا حَسْبُنَا اللهُ وَ نِعْمَ الْوَكِیْلُ.

এদেরকে লোকেরা বলেছে, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জমায়েত হয়েছে, সুতরাং তোমরা তাদেরকে ভয় কর; কিন্তু এ তাদের ঈমান দৃঢ়তর করেছিল এবং তারা বলেছিল, ‘আল্লাহ্ই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক-শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ., ড. আল্লামা খালেদ মাহমূদ, পৃ. ৩০

সদরুস সুদূর আব্দুল কাদের রামপূরী লেখেন, ‘দিল্লীতে মৌলভী ইসমাঈল যিনি মৌলভী আব্দুল গণী বিন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী-এর উত্তর পুরুষ। সুন্দর উপস্থাপন, শক্তিশালী উদ্ভাবন ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে এ যুগে তার দাদা ও চাচাদের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিতেন। লোকজনকে ওইসব বিদআত থেকে বিরত রাখার ব্যাপারে সাহসে বুক বেঁধেছিলেন, যেগুলোকে লোকেরা মুস্তাহাব বরং ওয়াজিব বিষয়াদির সাথে মিশ্রিত করে ফেলেছিল। জুমার দিন জামে মসজিদে এবং অন্যান্য দিন এই ধরনের মজমা ও মাহফিলে বয়ান করতেন।ওক্বাইয়ে আব্দুল কাদির খান, ইলম ও আমল, খ. ২, পৃ. ২৩২; শাহ ইসমাঈল রাহ., ড. আল্লামা খালেদ মাহমূদ, পৃ. ৩০

এবার হাদিয়ে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রাহ.- খলীফা, হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ-এর ফয়সালা শুনুন। হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রাহ. মুকাশাফাতে রহমতকিতাবে লেখেন-এ দেশের কালিমা পাঠকারী আম-খাস, নারী-পুরুষ এমনভাবে শিরকে নিমজ্জিত হয়েছিল যে, গোঁড়ামি ও হঠকারিতায় ভারতীয় মুশরিক ও জাহেলী যুগের মক্কাবাসী মুশরিকদের চেয়েও এক কাঠি বেশি ছিল। এ অবস্থায় মুমিনদের সাহায্যার্থে এবং মুশরিকদের শিরকী আকিদা ও হঠকারিতা চুরমার করার জন্য হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল মুহাদ্দেসে দেহলভী, শহীদ ফী সাবীলিল্লাহ, আপন চাচা এবং উস্তায ও মুর্শিদ হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দেসে দেহলভী, কুদ্দিসা সিররুহু-এর আকীদা ও রচনাবলির আলোকে তাকবিয়াতুল ঈমাননামক অতি উত্তম কিতাবটি রচনা করেন। এই কিতাবের মাধ্যমে ব্যাপক হেদায়েত হয়েছে এবং মুশরিকদের জিদ; বরং ওদের কোমর ভেঙ্গে গেছে। তখন ওইসব অসৎ আলেম এই কিতাবের লেখক সম্পর্কে কুফরীর ফতোয়া রচনা করেছে এবং ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী ও সাধারণ জনগণকে কুমন্ত্রণা দিয়েছে যে, ‘তাকবিয়াতুল ঈমানেনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফাআতকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং নবী ও ওলীগণের শানে বেআদবীমূলক কথাবার্তা লেখা হয়েছে। এমন কি এই সব কথা হিন্দি ও তুর্কি ভাষায় ছেপে বিলি করেছে। এই ফাসাদি কর্মকা- ও মিথ্যা প্রপাগান্ডার কারণে দুর্বৃত্তশ্রেণির ও আকসার জাহেল লোকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ বাস্তব কথা এই যে, এ কিতাবে তাওহীদ, ইত্তেবায়ে সুন্নত এবং শাফাআতে উযমার স্বরূপ সম্পর্কে বড় সুন্দর শিক্ষা রয়েছে।-মুকাশাফাতে রহমত, পৃ. ১৯, যখীরায়ে কারামতের প্রথম কিতাব

রেজভী বন্ধুরা হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রাহ.-এর নাম নিয়ে থাকেন এবং তাঁর প্রশংসা করে থাকেন। এখন দেখা যাক শাহ শহীদ রাহ. ও তাকবিয়াতুল ঈমান সম্পর্কে হযরত জৌনপুরী রাহ.-এর এ মন্তব্য তারা কীভাবে মূল্যায়ন করেন।

এই আলেমে রাব্বানী ও শহীদ ফী সাবীলিল্লাহ সম্পর্কে মন্তব্য করতে আবেদ শাহ সাহেবের মনে আল্লাহর ভয় জাগেনি; বরং আলোচিত পুস্তিকার ২য় পৃষ্ঠায় পনেরটি কুফরী ও গোমরাহী কথা শাহ শহীদ রাহ.-এর উপর আরোপ করেছেন এবং অতি দুঃসাহসের সাথে এই মিথ্যাচারও করেছেন যে, ‘এইসব কথা ইসমাঈলের কিতাবে আছে।অথচ ঐ পনের কথার একটিও শাহ শহীদের কোনো কিতাবে নেই। আবেদ শাহ সাহেবের এই চ্যালেঞ্জ যারা বিলি করছে আমরা তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি ও আখেরাতের জবাবদিহিতা স্মরণ করিয়ে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, তারা যেন এই মিথ্যাচার থেকে নিবৃত্ত হয়।

কোনো রেজভী ভাইয়ের বুকে যদি বল থাকে তাহলে সে যেন শাহ ছাহেবের যে কোনো আরবী, ফার্সী, উর্দূ কিতাব থেকে ঐ কথাগুলো বের করে দেখায়। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, এরা এই পনের কথার একটিও দেখাতে পারবে না। কিছু কথা তো আগা-গোড়া পুরোটাই বানোয়াট আর কিছু কথা এমন যা শাহ শহীদ রাহ.-এর সহীহ কথাগুলোর সাথে কিছু কুফরী কথা জোড়া দিয়ে বানানো।

আমরা বারবার চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, আমাদেরকে ঐসব কথা শাহ শহীদের কিতাব থেকে দেখিয়ে দাও। এইসব কথা যদি তাঁর কিতাবে থাকত তবে তোমরা কিতাবের নাম ও পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখ করনি কেন? ঐ কিতাবের মূল পৃষ্ঠাই বা উদ্ধৃত করলে না কেন? মিথ্যাচারেরও তো একটা সীমা থাকে!

وَلا تَحْسَبَنَّ اللهَ غافِلاً عَمَّا يَعْمَلُ الظَّالِمُونَ

শাহ শহীদ রাহ.-এর অন্তরে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুহাব্বত, বড়ত্ব ও মহত্বের আকীদা কত বিশুদ্ধ ও শক্তিশালী ছিল তা তাঁর রচনাবলি- তাকবিয়াতুল ঈমান, তাযকীরাতুল ইখওয়ান, সীরাতে মুসতাকীম, মানসিবে নবুওত এবং তার কাসীদা সমগ্র মছনবীয়ে ছিলকে নূরথেকে পরিষ্কার জানা যায়। আমি এখানে মানসিবে নবুওতসীরাতে মুসতাকীমথেকে একটি করে উদ্ধৃতি পেশ করব।

মানসিবে ইমামত’-এ শাহ শহীদ রাহ. বলেন, ‘জানা উচিত, নবীগণ আলাইহিস সালাম অন্যান্য মানুষের চেয়ে অনন্য সাধারণ। কুদরতের বিশেষ কৃপা এবং আসমানী অনুগ্রহে তাঁরা লাভ করেন বিশেষ আনন্দ। তাঁরা প্রভূত প্রাপ্তিতে সৌভাগ্যশালী এবং অঝোর করুণা ধারায় বিশেষভাবে সিক্ত। তাঁরা মুহাব্বতের গুলবাগিচার ইয়াসমীন ফুল আর মাকবূলিয়াতের মাহফিলে তখ্ত-নাশীন। নৈকট্য-নীলিমার উজ্জ্বল তারকা এবং পুণ্য-ভূবনের মহাকর্তা। বড় পদপ্রাপ্তির তাঁরাই যোগ্য এবং গুরু দায়িত্ব সম্পাদনে তাঁরাই উপযুক্ত। নৈকট্যপ্রাপ্তদের মাহফিলে তাঁরাই সদরআর পবিত্রাত্মাগণের বাহিনীর সিপাহসালার। তাঁদের বিশেষ দৃষ্টি অর্গলবদ্ধ দুয়ারসমূহের চাবি আর তাঁদের প্রার্থনা নিঃসন্দেহে মকবুল। তাঁদের প্রতি মুহাব্বত পোষণকারী রাব্বুল ইয্যতের প্রিয় আর তাঁদের প্রতি বিদ্বেষী তাঁর দরবারে ধিকৃত। তাঁদের ভালোবাসা মর্তবা বুলন্দির উপায়। আর তাঁদের অসীলা গ্রহণই নাজাতের তরীকা।  -মানসিবে ইমামত পৃ. ৪, হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ আওর মুআনিদীনে আহলে বিদআত কে ইলযামাত, মাওলানা মুহাম্মাদ মানযুর নোমানী পৃ. ৯৩-৯৪

হযরত সাইয়েদ শহীদ রাহ.-এর মাওয়ায়েজের সংকলন সীরাতে মুসতাকীম’, যা শাহ শহীদ রাহ. সংকলন করেছেন, তাতে আছে- এখানে সারকথা এই যে, হযরত মুহাম্মাদ আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টির সেরা পেশোয়াঁ ও সর্ব বিচারে প্রিয় জেনে সর্বান্তকরণে তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে এবং হিন্দী-সিন্ধী, রোমক-পারসিক যত রীতি-নীতি তাঁর বিপরীত হবে কিংবা তাঁর সাহাবীগণের অনুসৃত পথে কোনো প্রকারের সংযোজন সাব্যস্ত করবে তা বর্জন করবে এবং অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবে। -সীরাতে মুসতাকীম (ফার্সী) পৃ. ৬৪, উর্দূ অনুবাদ পৃ. ৮৪, ইবারাতে আকাবির, মাওলানা সরফরায খান সফদর দা. বা. পৃ. ৭১-৭৪

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে যার বিশ্বাস ও ভক্তি এরূপ তাকে গোস্তাখে রাসূল বলা চূড়ান্ত অপরাধ নয়?

 

২. হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী রাহ.

(জন্ম ১২৪৮ হি. মৃত্যু ১২৯৭ হি.)

হাদীস, তাফসীর ও ফিক্হ শাস্ত্রে তাঁর যে মাকাম ছিল তা তো সর্বজনবিদিত। হিকমত ও ফালসাফাতেও তাঁর এই পর্যায়ের ব্যুৎপত্তি ছিল যে, ফালসাফায় এক নতুন চিন্তারীতির জনক হিসেবে আখ্যায়িত। তিনি এত গভীর চিন্তাশক্তির অধিকারী ছিলেন যে, কোনো একটি বিষয়ে তাহকীকের জন্য ইমাম রাযীর মত ইমামুল ফালসাফা ওয়াল কালামের তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে কাবীরঅধ্যয়ন করে বলেন, আমাদের ধারণা ছিল ইমাম রাযী অতি গভীর মেধার অধিকারী কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে তাঁর চিন্তা বিস্তৃতিতে অনেক দূর ছড়ায় কিন্তু গভীরতায় বেশি দূর যায় না।-মাজালিসে হাকীমুল উম্মত পৃ. ২৬৮-২৬৯

আল্লাহ তাআলা হযরত নানুতুবী রাহ.-এর দ্বারা তাজদীদ ও সংস্কারের যে কাজ নিয়েছেন তা নিম্নরূপ :

 

১. পাদ্রীদের ফিতনার মোকাবেলা 

১২৯৩ হিজরীতে শাহজাহানপুরের চাঁদপুর জেলার আম জলসায় পাদ্রীদেরকে এমন লা-জওয়াব করেন যে, তারা ঐ জলসা থেকেই পলায়ন করতে বাধ্য হয়। এমনকি হুড়াহুড়ির মধ্যে বেশ কিছু বইপত্রও তারা রেখে যায়। আল্লাহ তাআলা হযরতের মাধ্যমে ইসলামের কালিমা বুলন্দ করেন।

 

২. আর্য ফেতনার মোকাবেলা 

এই ফেতনাকে জ্ঞান ও যুক্তির সাহায্যে এমনভাবে তছনছ করে দেন যে, আর্য সমাজের পক্ষে তাদের ভ্রান্ত মতবাদ দ্বিতীয়বার জ্ঞানী সমাজে উপস্থাপনের দুঃসাহস হবে না। এ বিষয়ে হযরতের রচনা ইনতিছারুল ইসলাম’ ‘কিবলানুমাএবং তুর্কী বতুর্কীচূড়ান্ত ফায়সালা ও শেষ কথার মর্যাদা রাখে।

 

৩. ইসলামের নুসরত

ইসলামের বিরুদ্ধে নতুন বিভ্রান্তিসমূহের জওয়াব ও ইসলামী বিষয়াদির যুগোপযোগী ব্যাখ্যা ও উপস্থাপনার জন্য এক নতুন দর্শনশাস্ত্রের উদ্ভাবন, যা তাঁর মুনাযারা ও রচনাবলিতে প্রোজ্জ্বলভাবে উপস্থিত।

 

৪. দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা

এ প্রতিষ্ঠান ও তার সকল খিদমত যে আকাবির বুযুর্গানে দ্বীনের সদাকায়ে জারিয়া রূপে বিদ্যমান, তাঁদের তালিকায় হযরত নানুতুবী রাহ.-এর নাম প্রথম সারিতে। দারুল উলূম দেওবন্দের দ্বীন সংরক্ষণ, হকের প্রতিষ্ঠা ও বাতিলের মূলোৎপাটনের যে দীর্ঘ ইতিহাস তার একটি ঝলকও যারা দেখেছেন তারাও অনুমান করতে পারবেন যে, এটিই যদি হত হযরত নানুতুবী রাহ.-এর একমাত্র কীর্তি তাহলেও তা তাঁর উচ্চ মর্যাদার পক্ষে যথেষ্ট হত।

 

৫. রচনাবলী

বাতিল ফের্কাসমূহের খ-নে, বিচিত্র দ্বীনী বিষয়ে ও বিভিন্ন জটিল ও সূক্ষ্ম বিষয়ে রচনাবলির এক মূল্যবান সম্ভার। এর মধ্যে রয়েছে সহীহ বুখারীর শেষ পাঁচ পারার টীকা, যা সহীহ বুখারীর সবচেয়ে কঠিন অংশ। যালেম বৃটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদে শরীক হওয়ার সৌভাগ্যও আল্লাহ তাঁকে দান করেছিলেন।[1]

এই মর্দে মুজাহিদ ও ইমামে মুজাদ্দিদের প্রতি কুফরীর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা ছাড়া জনাব আহমদ রেযা খানের শান্তি হল না! তিনি হযরত নানুতুবী রাহ.-এর কিতাব তাহযীরুন্নাসথেকে কিছু বাক্য তুলে এনে নিজের মত করে সাজিয়ে একটি কুফরী কথার রূপ দান করে। যার অর্থ দাঁড়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খতমে নবুওতের ইনকার। এভাবে এ কথাটি সে হযরত নানুতুবী রাহ.-এর উপর আরোপ করে। আবেদ শাহ সাহেব খান বেরেলবীর অনুসরণে সেই অপকর্মটিই করেছে এবং বলেছে, ‘কোরানের আয়াত খাতামুন্নবিয়িনের অর্থ শেষ নবী নয় বরং আয়াতের অর্থ উত্তম নবী, এই আয়াতের অর্থ শেষ নবী করা আল্লাহর উপর এক তোহমত (অপবাদ দেওয়া), রাসুলুল্লাহ (দঃ)র পরে নতুন নবী হওয়া জায়েজ রাখিয়াছে।’ (প্রচারিত লিফলেট, পৃ. ৩)

অথচ তাহযীরুন্নাসেএকথা তিনি লেখেননি। ওখানে লেখা আছে যে, ‘খাতামুন্নাবিয়্যীনঅর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং সর্বশেষ নবী। অর্থাৎ আমাদের নবী সকল নবীর শ্রেষ্ঠ নবী ও শেষ নবী।

তাঁর এ কথায় কী ভুল আছে?

আবেদ শাহ সাহেব ও রেজভী বন্ধুরা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষ নবী হওয়ার পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ নবী স্বীকার করেন না? যদি স্বীকার করে থাকেন এবং তাদের বিশ্বাসও এ-ই হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, তাহলে হযরত নানুতুবী রাহ.-এর কথাকে কাটাচেরা করে তাঁর উপর কুফরীর মিথ্যা অপবাদ কেন আরোপ করলেন?

এক ব্যক্তি বড় সুন্দর বলেছেন, মাওলানা নানুতুবী রাহ.-এর তাহযীরুন্নাসথেকে খতমে নবুওতের বিপরীত কিছু দেখানো এমনই যেমন কোনো বদদ্বীন কুরআনের নামে বলে, কুরআনে কারীমে আছে-

নেককার লোকেরা জাহান্নামে যাবে। নাউযুবিল্লাহ।

অথচ কুরআনে আছে-

اِنَّ الْاَبْرَارَ لَفِیْ نَعِیْمٍ وَ اِنَّ الْفُجَّارَ لَفِیْ جَحِیْمٍ.

নেককার লোকেরা জান্নাতে যাবে আর বদকাররা জাহান্নামে যাবে। [সূরা ইনফিতার (৮২) : ১৩-১৪] এখন প্রথম বাক্য থেকে নেককার লোকেরাঅংশটুকু নেওয়া হল আর দ্বিতীয় বাক্য থেকে জাহান্নামে যাবেঅংশটুকু। এরপর দুই অংশকে একত্র করে উপরের মিথ্যা কথাটি তৈরি করা হল। এদের জালিয়াতিগুলো এ প্রকারেরই।

হযরত নানুতুবী রাহ. তাহযীরুন্নাস’-এর এক জায়গায় স্পষ্ট লিখেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষ নবী অস্বীকারকারী কাফের। তাঁর পরে আর কোনো নবী হবে না। এই আক্বীদা খাতামুন্নাবিয়্যীন সম্বলিত আয়াত, সহীহ হাদীস ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। -তাহযীরুন্নাস-এর নবম পৃষ্ঠার ১০ নং লাইন থেকে এগারতম পৃষ্ঠার ৭ নং লাইন পর্যন্ত।

হযরত নানুতুবী রাহ. অপর এক কিতাবে লিখেছেন, ‘আমার দ্বীন ও ঈমান এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে অন্য কারো নবী হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। যে এতে কোনো প্রকারের তাবিল করবে তাকে কাফের মনে করি। -মুনাযারায়ে আজীবাহ পৃ. ১০৩; জওয়াবে মাখদূরাত পৃ. ৫০

আরো জানার জন্য দেখুন, ড. আল্লামা খালেদ মাহমূদের রচনাবলি- শরহে তাহযীরুন্নাস; মুতালাআয়ে বেরেলবিয়্যাত খ. ১, পৃ. ৩০০-৩২২; শাহ ইসমাঈল শহীদ পৃ. ১৪৫-১৪৬

এই সব সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণের পরও কি রেজভী বন্ধুরা তাদের মিথ্যা দাবি থেকে প্রত্যাবর্তন করবেন না?

 

৩. ফকীহুন নফ্স মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.

(জন্ম ১২৪৪ হি. মৃত্যু ১৩২৩ হি.)

তাঁর বৈশিষ্ট্য ও অবদান অনেক। শুধু গংগুহতেই পঞ্চাশ বছরেরও অধিককাল ফিক্হ-ফতোয়া এবং ইসলাহ ও সংশোধনের মহান কাজে নিমগ্ন ছিলেন। তাঁর দরসে হাদীস কোন্ মানের ছিল তার কিছু ঝলক পাওয়া যায় তাঁর কতিপয় শাগরিদ কর্তৃক সংকলিত তাঁর দরসী আলোচনাসমূহে। যেমন লামেউদদারারী দরসে বুখারী, আলকাওকাবুদ্দুররী, দরসে তিরমিযী, আলহল্লুল মুফহিম দরসে মুসলিম।

সুন্নতের প্রচার-প্রসার এবং বিদআতের খ-ন ও প্রতিরোধ ছিল তাঁর বিশেষ গুণ। দারুল উলূম দেওবন্দের অবিচলতায় তাঁর প্রভাব ছিল অনেক বড়। এজন্য এই প্রতিষ্ঠানটিও তাঁর সদাকায়ে জারিয়া। উপরন্তু রয়েছে তাঁর শাগরিদ ও খলিফাগণ। যাদের শিক্ষা-দীক্ষা তাঁর হাতেই সম্পন্ন হয়েছে এবং যাদের খেদমত ও অবদানের ধারা এখনো চলমান।

ইমামুল আস্র মাওলানা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ. তাঁকে ফকীহুন নফ্সউপাধীতে স্মরণ করতেন এবং বলতেন, ‘আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহ. থেকেও তাঁর মাকাম উঁচু ছিল।এ থেকে বোঝা যায়, শরীয়তের জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় তাঁর স্থান কত উঁচু ছিল।

তাঁর রেখে যাওয়া কীর্তিসমূহের মাঝে ফতোয়া রশীদিয়্যাহছাড়া আরো আছে এক ডজনেরও বেশি কিতাব। যা সবই তাহকীক ও গবেষণা সমৃদ্ধ এবং যার সবগুলোরই আলোচ্য বিষয় অতি সূক্ষ্ম ও জটিল। এর অধিকাংশ কিতাবই তালিফাতে রশীদিয়্যাহশীর্ষক রচনা-সংকলনে স্থান পেয়েছে।[2]

সাইয়েদুত ত্বাইফা হযরত ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রাহ. (যাঁকে বেরেলভী বন্ধুরাও একজন নির্ভরযোগ্য ও বুযুর্গ ব্যক্তি মনে করেন) তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব জিয়াউল কুলূব’-এ লেখেন, ‘এবং যারা এই ফকীরের (হযরত নিজে) প্রতি মুহাব্বত ও আস্থা রাখেন তারা যেন মৌলভী রশীদ আহমদ ছাহেবকে এবং মৌলভী মুহাম্মাদ কাসেম ছাহেবকে -যারা উভয়ে ইলমে জাহেরী ও ইলমে বাতেনীর সকল পূর্ণতার অধিকারী- আমি ফকীর লেখকের স্থলাভিষিক্ত; বরং আমার চেয়ে অনেক অনেক উঁচু মাকামের মনে করেন। যদিও বাহ্যত ব্যাপারটা উল্টো হয়ে গেছে যে, তাঁদের (প্রকৃত) স্থানে আমি রয়েছি আর আমার (প্রকৃত) স্থানে তাঁরা রয়েছেন। এদের সাহচর্যকে যেন গনীমত মনে করেন। কারণ, এ ধরনের ব্যক্তিত্ব এ যুগে অতি বিরল। তারা যেন এঁদের বরকতময় সান্নিধ্য দ্বারা উপকৃত হন এবং আত্মশুদ্ধির যে পন্থা এ পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে তা তাঁদের তত্ত্বাবধানে অর্জন করেন, ইনশাআল্লাহ তারা বঞ্চিত থাকবেন না। আল্লাহ তাআলা এঁদের জীবনে বরকত নসীব করুন। মারেফতের নিয়ামতরাজি এবং নৈকট্যের কামালাত দ্বারা ভূষিত করুন, সুউচ্চ মাকামসমূহে পৌঁছে দিন এবং তাদের নির্দেশনার আলোয় জগতকে আলোকিত করুন এবং কিয়ামত পর্যন্ত তাদের ফয়েয জারি রাখুন। আমীন বিহুরমাতিন নাবী ওয়া আলিহিল আমজাদ। -কুল্লিয়াতে ইমদাদিয়াহ পৃ. ১৭৮

হযরত হাজী ছাহেব রাহ.-এর এ বাণীই হযরত গংগুহী রাহ. ও তাঁর মাকাম বোঝার জন্য যথেষ্ট।

আবেদ শাহ সাহেব এই মর্দে হকের ব্যাপারে লেখেন, ‘আল্লাহ মিথ্যা কথা কহিয়াছেন । এই ফতোয়ার ফটো কপি দেওবন্দী মাজহাবকিতাবে মওজুদ আছে। (প্রচারিত লিফলেট, পৃ. ৩)

তাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত, এই ফতোয়ার মূল কপি কোথায়? তোমাদের আলা হযরতের মত তোমরাও কেন শুধু এই ফতোয়ার ফটোকপির উদ্ধৃতি দাও? তাও আবার মিথ্যা অপবাদকারী গোলাম মেহের আলী-এর জালিয়াতিতে পরিপূর্ণ বই  দেওবন্দী মাজহাবে  উদ্ধৃতিতে?

যখন হযরতের নামে এই জাল ফতোয়াটি তৈরী করা হয় তখনও হযরত জীবিত ছিলেন কিন্তু তিনি তা অবগত হননি। মাওলানা মুরতাজা হাসান চাঁদপুরী রাহ. এই জাল ফতোয়ার ব্যাপারে জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ গংগুহতে হযরতের খেদমতে পত্র লেখেন যে, আপনার ব্যাপারে প্রচার করা হচ্ছে, আপনি এই ফতোয়া লিখেছেন, বাস্তব ব্যাপার কী? এর জাওয়াব আসে যে, ‘এই ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আমার ব্যাপারে এ কথা বলা যে, আমি এই ফতোয়া দিয়েছি- সম্পূর্ণ ভুল। আল্লাহর পানাহ, আমি এমন কথা কীভাবে লিখতে পারি’? -তাযকিয়াতুল খাওয়াতির, মাওলানা চাঁদপুরী, পৃ. ৩৩; আসসাহাবুল মিদরার, মাওলানা চাঁদপুরী পৃ. ৩০

এছাড়া গংগুহী রাহ.-এর মুদ্রিত ফাতোয়া সংকলন যা ফতোয়া রশিদিয়্যাহনামে বহুল পরিচিত। তাতে পরিষ্কার ভাষায় নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তরটি রয়েছে :

প্রশ্ন : আল্লাহ তাআলার সত্তা মিথ্যার বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যবান হতে পারে কি? যে মনে করে আল্লাহ তাআলা মিথ্যা বলতে পারেন, শরীয়তের দৃষ্টিতে সে কেমন?

উত্তর : আল্লাহ তাআলার সত্তা এ থেকে পাক পবিত্র যে, তাঁর সাথে মিথ্যার বৈশিষ্ট্য যুক্ত করা হবে। নাউযুবিল্লাহ, তাঁর কোনো কথায় কক্ষনো মিথ্যার লেশমাত্রও নেই। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللهِ قِيلًا.

যে আল্লাহ তাআলার সম্পর্কে এই আকীদা রাখে বা মুখে বলে যে,  তিনি মিথ্যা বলেন- সে নিঃসন্দেহে কাফের ও অভিশপ্ত এবং কুরআন, হাদীস, ও ইজমায়ে উম্মতের বিরোধী।

সে কখনো মুমিন হতে পারে না।

تعالى الله عما يقول الظالمون علواً كبيراً.

-ফতোয়া রশীদিয়্যাহ পৃ. ৯৬, কিতাবুল আকাইদ-এর সূচনা

এখন রেজভী বন্ধুদের কে বুঝাবে যে, তোমরা হযরত গংগুহী রাহ.-এর কিতাবে থাকা এই ফতোয়া ছেড়ে কেন একটি জাল ফতোয়া নিয়ে মেতে আছ আর এরই ভিত্তিতে একজন আলেমে রব্বানীকে কাফের আখ্যা দিয়ে কেন নিজেদের সর্বনাশ করছ?

 

৪. ফকীহুল উম্মত হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রাহ.

(জন্ম ১২৬৫ হি. মৃত্যু ১৩৪৬ হি.)

অনেক বড় ফকীহ ও উঁচু মানের মুহাদ্দিস ছিলেন। ফতোয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সময়ের আকাবির ব্যক্তিগণের মারজিও প্রত্যাবর্তনস্থল ছিলেন। দারুল উলূম দেওবন্দ এবং মাজাহিরুল উলূম সাহারানপুর, উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় এই দুই মাদরাসায় তিনি হাদীস ও ফিকহের উচ্চপর্যায়ের কিতাবাদির অধ্যাপনায় দীর্ঘদিন রত ছিলেন। হাদীস ও সুন্নাহর গুরুত্বপূর্ণ কিতাব সুনানে আবু দাউদের উঁচু মানের ভাষ্যগ্রন্থ লিখেছেন, যার নাম বজলুল মাজহুদ লিহল্লি আবী দাউদ। আরব জাহানের আলিমগণও তা পছন্দ করেছেন। ভাষ্যগ্রন্থটি বৈরুত থেকে বিশ খণ্ডে প্রকাশিত।

যালেম ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর তৎপরতা ইংরেজের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। ১৩৩৪ হিজরীতে তাকে বোম্বাই থেকে গ্রেফতার করে নৈনিতাল জেলে অন্তরীণ রাখা হয়। দীর্ঘদিন পর তিনি ওখান থেকে মুক্তি লাভ করেন। জেলখানায় অন্তরীণ থাকা অবস্থায় তিনি সত্য প্রকাশে অবিচল থাকেন এবং স্পষ্ট ভাষায় নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। দেশব্যাপী এর প্রভাব অত্যন্ত ইতিবাচক হয়।

মদীনা তৈয়্যেবায় মৃত্যুবরণ করার ও সমাহিত হওয়ার বাসনা নিয়ে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। পরিশেষে ১৩৪৬ হিজরীতে তাঁর মনের বাসনা পূরণ হয়। তিনি মদীনা শরীফে মৃত্যুবরণ করেন এবং বাকীকবরস্থানে  সমাহিত হন। হযরতের জীবনী ও ইলমী অবদানসমূহ জানার জন্য পড়ুন, তাযকিরাতুল খলীল, মাওলানা আশেক ইলাহী মীরাঠী; ইবারতে আকাবির, মাওলানা সরফরায খান সফদর পৃ. ১৪৮-১৫১; মুকাদ্দিমায়ে ফাতাওয়ায়ে খলীলিয়্যাহ, মাওলানা শাহেদ সাহারানপুরী; তারীখে মাজাহিরুল উলূম সাহারানপুর।

আবদে শাহ সাহেব খান বেরলভী সাহেবের অনুসরণ করে তাঁর সম্পর্কে এই মিথ্যাচার করেছেন যে, ‘রসুলুল্লাহ (দঃ) এর এলেম হইতে শয়তানের এলেম বেশী।’ (প্রচারিত লিফলেট, পৃ. ৩)

অথচ হযরত সাহারানপুরী বারাহীনে ক্বাতিআহবা অন্য কোনো কিতাবে এ ধরনের কোনো কথা বলেননি। এটা সরাসরি মিথ্যাচার, যা খান বেরেলভী সাহেব তাঁর বক্তব্যের আগে-পিছের কথা বাদ দিয়ে মাঝখান থেকে একটি কথা তুলে নিয়ে এবং এর অপব্যাখ্যা করে তৈরী করেছে।

এই মিথ্যাচারটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে মাওলানা মুরতাজা হাসান চাঁদপুরী রাহ. হযরত সাহারানপুরী রাহ.-কে চিঠি লেখেন, এ ধরনের কোনো কথা বারাহীনে কাতিয়াহবা অন্য কোনো কিতাবে আপনি লিখেছেন কি না?

হযরত সাহারানপুরী রাহ. উত্তরে লেখেন, “মৌলভী আহমদ রেযা খান বেরেলভী বান্দার উপর যে অভিযোগ আরোপ করেছে তা সম্পূর্ণ অসার ও ভিত্তিহীন। কেউ যদি অভিশপ্ত শয়তান কেন, যে কোনো মাখলুককে জনাব সারওয়ারে আলাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে ইলমের দিক দিয়ে অগ্রগামী মনে করে, আমি ও আমার উস্তাযগণ তাকে কাফের, মুরতাদ ও অভিশপ্ত মনে করি।

বারাহীনে কাতেআহ-এর পৃ. ৪-এ এ কথা আছে যে, ‘কোনো একজন সাধারণ মুসলমানও ফখরে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নৈকট্য ও গুণাবলিতে অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষ মনে করে না

খান সাহেব আমার প্রতি যে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছেন এর হিসাব কিয়ামতের দিন হবে। এই কুফরী কথা- অভিশপ্ত শয়তানের ইলম নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বেশি- বারাহীনে কাতেআহ-এর কোথাও নেই। স্পষ্টভাবেও নেই, অস্পষ্টভাবেও নেই।...

মোটকথা, খান সাহেব একটি নির্জলা মিথ্যা এ বান্দার উপর আরোপ করেছে। আমার মনে সারা জীবনেও এ রকম কোনো কথার কল্পনাও আসেনি যে, অভিশপ্ত শয়তান কেন, কোনো ওলী বা ফেরেশতাও নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইলমের সমকক্ষ হতে পারে। তাঁর চেয়ে আগে বেড়ে যাওয়া তো দূরের কথা।

এই আকীদা, যা খান সাহেব আমার উপর আরোপ করেছে এটা সম্পূর্ণ কুফরী আকীদা, তার এই যুলুমের হিসাব কিয়ামতের দিন হবে, আমি এ থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত। وَكَفى بِاللهِ شَهِيداً 

-আসসাহাবুল মিদরার, মাওলানা চাঁদপুরী, পৃ. ৪৯-৫০

আরো দেখুন, হযরত সাহারানপুরী রাহ.-এর কিতাব আল মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদপৃ. ২৩৭-২৪২। এ কিতাবে তিনি আরবের আলেমগণের প্রশ্নের উত্তরে খান বেরেলভীর এই মিথ্যা অপবাদ স্পষ্ট ভাষায় প্রত্যাখান করেছেন এবং দলীল-প্রমাণ দ্বারা তা খ-ন করেছেন। আগ্রহী পাঠক এই মিথ্যা অপবাদ আরোপের ইতিহাস জানতে চাইলে পড়তে পারেন হযরত মাওলানা মানযুর নোমানী রাহ. কৃত মারিকাতুল ক্বলম, ফয়সালা কুন মুনাযারা, পৃ. ১৭২-১৮১।

আবেদ শাহ সাহেব বারাহীনে কাতেআহসম্পর্কে দ্বিতীয় কথাটি এই লিখেছেন যে, ‘আল্লাহ মিথ্যা কথা কইতে পারে। (প্রচারিত লিফলেট, পৃ. ৩) এখানেও তিনি অর্থগত বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছেন। খান বেরেলভী সাহেবের মিথ্যা অপবাদের পর আরবের আলেমগণ যখন বাস্তব অবস্থা জানতে চাইলেন তখন হযরত সাহারানপুরী রাহ. স্পষ্ট ভাষায় লেখেন, ‘আমরা ও আমাদের মাশাইখ এই বিশ্বাস রাখি যে, আল্লাহ তাআলা থেকে যে কালামই প্রকাশিত হয়েছে বা আগামীতে প্রকাশিত হবে তা নিঃসন্দেহে সত্য এবং  সন্দেহাতীতভাবে বাস্তব। তাঁর কোনো কথাতেই মিথ্যার লেশমাত্র নেই। যে এই আকীদার বিপরীত বিশ্বাস পোষণ করবে বা তার কোনো কালামে মিথ্যার বা অবাস্তবতার সন্দেহ পোষণ করবে, সে কাফের, মুলহিদ ও যিন্দীক, তার মধ্যে বিন্দুমাত্রও ঈমান নেই। -আল মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ, পৃ. ২৫৭-২৫৮

আসল কথা হল বিদআতের খ-নে বারাহীনে কাতেআঅতি উত্তম একটি গ্রন্থ। রেজাখানীদের পক্ষে এর কোনো জবাব লেখা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। অথচ কিতাবটি লেখার পর শতবর্ষেরও বেশি অতিবাহিত হয়েছে। এ কারণে কিতাবটির প্রভাব হ্রাস করার জন্যই হয়ত এরা নানা প্রকারের মিথ্যার আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)



[1] ১. তাঁর ইসলামী জ্ঞান ও সমাজ-সংস্কার, এবং জাতীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গনের অবদান সমূহ জানতে পড়ুন, সাওয়ানেহে কাসেমী, মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী (৩ খণ্ডে)

[2] ২. হযরতের জীবনী ও তাঁর ইলমী ও ইসলাহী অবদানসমূহ জানার জন্য পড়ুন তাযকিরাতুর রশীদমাওলানা আশেক ইলাহী মিরাঠী ও তাঁর পরিশিষ্ট শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভী রাহ., ইবারাতে আকাবির মাওলানা সরফরায খান সফদর রাহ. পৃ. ১১১-১১৫

 

advertisement