সবার একই প্রশ্ন : আমাদের মানবিক মূল্যবোধগুলো কেন হারিয়ে গেল?
বর্তমানে আমরা একটা দুঃসময় অতিক্রম করছি। নীতি-নৈতিকতা ও মানবিকতার এমন কোনো দিক নেই, যেখানে আমরা চরম অধঃপতনের শিকার নই। খুন, গুম, ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানি এখন সমাজের স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরাধ, অনৈতিকতা ও অসভ্যতার এমন নিত্যনতুন প্রকার ও ধরন প্রকাশিত হচ্ছে, যা ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষকে হতবাক করে দিচ্ছে। কোনো উদাহরণের প্রয়োজন নেই। কারণ এখন এক ঘটনার নির্মমতায় ভারাক্রান্ত সমাজের দীর্ঘশ্বাস না সরতেই তার চেয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা আঘাত হানে মানুষের হৃদয়ে। বর্বরতা ও অসভ্যতার ক্ষেত্রে আমরা জাহেলী যুগকে উপমা হিসাবে পেশ করি। বাস্তবেও তা উপমার যোগ্য। কিন্তু চরম বাস্তবতা হল অন্যায় ও অপরাধের অসংখ্য পথে বর্তমান সমাজ জাহেলী যুগকেও যেন ছাড়িয়ে গেছে। কারণ, ইতিহাসের পাতা থেকে জাহেলী যুগের বর্বরতার অগণিত ঘটনা তুলে ধরা গেলেও শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার অপরাধে হাজারো মানুষ ও অসংখ্য মিডিয়ার সামনে একজন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার লাশের উপর নৃত্য-উল্লাস করার মত পাশবিকতার চিত্র কোনো ঐতিহাসিক তুলে ধরতে পারবে না। একটি নিষ্পাপ শিশুর পেটে মেশিন দিয়ে হাওয়া ঢুকিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় তাকে হত্যা করা, বাবার কাছে চাঁদার টাকা না পেয়ে তার অবুঝ শিশু সন্তানকে হত্যা করে ময়লা-আবর্জনার ডোবায় ফেলে রাখা, প্রেম নিবেদনে সাড়া না দেয়ায় মা-বাবার আদরের কন্যাকে এসিডদগ্ধ করে শেষ করে দেয়া, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য মানুষভর্তি চলন্ত গাড়ীতে পেট্টোল মেরে নিরপরাধ মানুষকে জ্বালিয়ে দেয়ার মত বর্বরতা জাহেলী যুগেও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একটা সময় ছিল যখন মানুষ জিন, হিংস্র প্রাণী ইত্যাদিকে অস্বাভাবিক ভয় পেত। তাই নির্জন পথে বা অন্ধকারে কোনো মানুষের উপস্থিতির আভাস পেলে নিরাপত্তাবোধ করতো, সাহস ও সান্ত্বনা পেত। কিন্তু এখন মানুষকেই মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। তাই এখন ভরদুপুরেও নির্জন পথে অপরিচিতি কাউকে দেখলে জানমাল হারাবার ভয়ে মানুষের বুক দুরুদুরু করে।
বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত ঘটনার ভয়াবহতায় সবাই নির্বাক। সব ব্যথিত হৃদয়ে একই প্রশ্ন- আমাদের মানবিক মূল্যবোধগুলো কোথায় হারিয়ে গেল? কীভাবে আমাদের সমাজ এমন দুঃখজনকভাবে পাল্টে গেল? গত ৩ নভেম্বর ২০১৬ঈ. সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজাকে পরীক্ষা দিয়ে যাওয়ার পথে দিনে-দুপুরে ধারালো চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে আহত করে একটি ছাত্র সংগঠনের নেতা বদরুল আলম। উপস্থিত অনেকেই এই নৃশংস দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করলেও অসহায় ছাত্রীটিকে বাঁচাবার জন্য দরদ ও সাহস নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। মুহূর্তেই ভিডিওসহ এই সংবাদ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সমাজের আহত হৃদয়ে আবার প্রচণ্ড ঘা লাগে। এবার খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে বলে ফেললেন- “আমাদের মানবিক মূল্যবোধগুলো কেন হারিয়ে গেল?”
হাঁ! এই প্রশ্ন আজ জাতির প্রতিটি সদস্যের, আহত সকল বিবেকের। কিন্তু এর উত্তর কী? আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের মূল কারণ চিহ্নিত করতে না পারলে এই অধঃপতন থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে কি? আমাদের বুদ্ধিজীবিরা এসব ঘটনার পর সেমিনার, টকশো, গোলটেবিল আলোচনায় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, সামাজিক সচেতনতার অভাব, অসহিষ্ণু মানসিকতা ইত্যাদি গৎবাঁধা কিছু কথা বলে যান। রাজনৈতিক নেতারা একদল আরেক দলের উপর দোষ চাপান। সঠিক কারণ নিয়ে কেউ ভাবেন না। এই কারণের পেছনের কারণের দিকে কারো দৃষ্টি যায় না। ফলে উত্তরণের সঠিক পথে হাঁটার সুযোগ হয় না। তাই আমাদের সমাজিক অবক্ষয়ের কারণ খতিয়ে দেখার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তীব্রভাবে।
যখন আমাদের সমাজে এত শিক্ষিত ছিল না। ছিল না এত প্রযুক্তি ও আইন-আদালত। একাডেমিক শিক্ষার আভাব ছিল, কিন্তু মানুষ অসভ্য ও বর্বর ছিল না। অভাব-অনটন ছিল, ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ মরেছে, কিন্তু ছিনতাই, রাহাজানির জন্য এতদূর হিংস্র হয়ে ওঠেনি। শুধু দূর অতীত নয়, নিকট অতীতের দিকে তাকালেও আমাদের সামাজিক অধপতনের ভয়াবহতার হিসাব স্পষ্ট হয়ে যাবে। স্পষ্ট হয়ে যাবে পরিবর্তনের কারণটাও ।
১৯৯৫ সালে পুলিশের পৈশাচিক নির্যাতনে নিহত হয় ইয়াসমিন নামের এক তরুণী। সারা দেশে এই নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। গোটা জাতি কেঁদেছে ইয়াসমিনের জন্য। এখনো প্রতি বছর ইয়াসমিন দিবস পালন করা হয়। অর্থাৎ তখন একটা খুন ছিল পুরো জাতিকে আহত করার মত বিরল ও নির্মম ঘটনা। তাই কেউ অন্যায়ভাবে খুন হলে জাতির প্রতিটি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতো। সেই ঘটনা নিয়ে লেখা হত অসংখ্য দুঃখের কবিতা। সেগুলো শুনে শুনে চোখের পানিতে বুক ভাসাতো বাংলার মানুষগুলো। কিন্তু আজ খুন, গুম, হত্যা, ধর্ষণ সংবাদের নিয়মিত অংশ। লাশের মিছিলের হিসাব এখন আর কেউ রাখে না। অথচ আমরা শিক্ষা, অর্থ ও প্রযুক্তিতে বিস্ময়কর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। ঘরে ঘরে এখন শিক্ষিত মানুষ। অজপাড়াগাঁয়ের কিশোরের হাতের মুঠোয় আজ সারা বিশ্ব। কিন্তু মানবিকতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। মানুষ যেন এখন আর মানুষ নেই।
আরো ভাববার বিষয় হল, আমাদের সমাজের বেশিরভাগ অন্যায়-আপরাধের মূল কারিগর বর্তমান সমাজের একশ্রেণির শিক্ষিত মানুষ। দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া, অশ্লীলতা ও বেলেল্লাপনায় রেকর্ড করা, খুন, গুম, চাঁদাবাজি সবকিছুতেই আমাদের কিছু সংখ্যক শিক্ষিত লোকেরাই জড়িত। আজ শিক্ষিত মানুষের চেয়ে অশিক্ষিত মানুষের কাছেই সাধারণ মানুষের জীবন বেশি নিরাপদ। কিন্তু কেন? অতীতে আমাদের এত কিছু ছিল না, কিন্তু সমাজে শান্তি ছিল। মানুষগুলো মানুষ ছিল। আজ আমাদের এত কিছু আছে অথচ পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে কোথাও শান্তি নেই। মানবিক মূল্যবোধ নেই। তাহলে তখন এমন কী ছিল যা এখন নেই বা আগের মত নেই? তাই উভয় সময়ের চিত্র এত ভিন্ন! এত বিপরীত! হাঁ সেটা আর কিছু নয়। মহাসত্য ইসলাম। অতীতে আমাদের অনেক কিছু ছিল না। কিন্তু আমরা ইসলামের আরো কাছাকাছি ছিলাম। ইসলাম থেকে আমরা যত দূরে সরেছি আমাদের দেশ ও সমাজ তত বেশি অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। এটা এক অনিবার্য পরিণতি। কারণ ইসলাম শুধু পরকালীন বিষয় নয়, পার্থিব জীবনের সুখ ও সাফল্যের একমাত্র পথও ইসলাম। ইসলামী জীবনের মূল শিক্ষা হল আল্লাহর ভয় এবং পরকালীন জবাবদিহিতা। আর এটাই একমাত্র উপাদান, যা মানুষকে অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে। মানুষকে করতে পারে সহনশীল, পরহিতৈষী, সত্যিকারের সৃষ্টির সেরা জীব। যে শিক্ষা মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় ও পরকালীন জবাবদিহিতার বোধ সৃষ্টি করে না, সে শিক্ষা মানুষকে ব্যবহারিক জীবনে গতিশীল করতে পারে, করতে পারে উপার্জন ও ভোগবিলাসে উন্নত, কিন্তু সে শিক্ষা মানুষের অপরাধ-প্রবণতা দমাতে পারে না। তাকে সত্যিকারে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না। যার বাস্তব চিত্র আমাদের আজকের সমাজ।
আমাদের জানা ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায় হল জাহেলী যুগ। যে যুগের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে আমরা বারবার থেমে যাই। ভাষা আমাদের ভাব প্রকাশ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করে। কিন্তু ইসলামের পরশে মাত্র তেইশ বছরের ব্যবধানে সেই মানুষগুলোই পরিণত হলেন ইতিহাসের সোনার মানুষে। সেই যুগ পরিণত হল মানবেতিহাসের সোনালী অধ্যায়ে। ইসলাম কত বিস্ময়কর পরিবর্তন এনেছিল সেই সমাজে ।
এটা সেসব মানুষ ও মানচিত্রের ঘটনা, যেসব মানুষ ও মানচিত্রকে অপরাধ-প্রবণতা ও বিশৃংখলার কারণে কোনো শাসক তার অধীনে আনতে পারেনি। অথচ সেই মানুষগুলোই পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বকে শৃংখলা শিখিয়েছে। নিজেদের অধীনে নিয়ে এসেছে অর্ধ পৃথিবী। সুতরাং যাবতীয় বিপর্যয় ও অবক্ষয় থেকে উত্তরণের জন্য আমাদেরকে ইসলামের দিকেই ফিরে আসতে হবে। ইসলাম আমাদেরকে শান্তিময় জীবন ও সোনালী ইতিহাস উপহার দিয়েছিল। ইসলাম ছাড়া আমাদের মুক্তির কোনো পথ নেই। এক্ষেত্রে হযরত ইমাম মালিক রাহ.-এর একটি বাণী স্মরণ রাখার মত। তিনি বলেন-
لن يصلح آخر هذه الأمة إلا بما صلح به أولها.
এই উম্মতের শেষভাগের শুদ্ধিও সে পথেই হবে, যে পথে উম্মতের প্রথম অংশের শুদ্ধি হয়েছিল।
হযরত উমর রা.-এর এই বাণীটিও এখানে স্মরণীয়-
إنا كنا أذل قوم، فأعزناالله بالإسلام، مهما نطلب العزة بغيره أذلنا الله.
আমরা ছিলাম সবচেয়ে হীন জাতি, আল্লাহ ইসলামের মাধ্যমে আমাদের মর্যাদাবান করেছেন। আমরা যদি (আল্লাহর দেয়া মর্যাদার পথ) ইসলাম ছেড়ে অন্য পথে মর্যাদা অন্বেষণ করি তাহলে আল্লাহ আমাদের লাঞ্ছনায় পতিত করবেন।
আর ইসলামকে মানতে হবে পরিপূর্ণভাবে। ইসলাম যেভাবে মানতে বলেছে ঠিক সেভাবে। জীবনের এক অংশে ইসলাম আরেক অংশে অন্য কিছু। ইচ্ছা হলে মানা, ইচ্ছা না হলে না মানা- এমন ধর্ম ইসলাম নয়। আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-
ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً
তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে দাখেল হও। -সূরা বাকারা (২) : ২০৮
সুতরাং যাবতীয় সমস্যার সমাধান এবং সকল অবক্ষয় থেকে উত্তরণের জন্য তথা পার্থিব ও পরকালীন সুখ ও সাফল্যের জন্য পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করতে হবে। এটা আমরা যত দ্রুত বুঝব, আজকের করুণ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথে তত দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব।