Safar 1438   ||   November 2016

যেমনটি দেখেছি হযরত পাহাড়পুরী হুযুরকে

Ishaq Ubaydi

মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে আরো একজন স্বনামধন্য মুহাদ্দিস ও আল্লাহর ওলি দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গত ২৫ শে আগস্ট আমার প্রিয় উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা আহমাদ কারীম ছাহেব (মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর) ইন্তেকাল করেন। তাঁর শোক সামলাতে না সামলাতেই মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে ২৯ শে আগস্ট চলে গেলেন আমার প্রিয় মানুষটি হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী হুযুর।

নোয়াখালী ফতেহপুর ইসলামিয়া মাদরাসায় হযরত প্রফেসর হামিদুর রহমান ছাহেব দা. বা.-এর আগমন হয় গত ২৯ শে আগস্ট ২০১৬-তে। মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা হাফেয বেলাল হুসাইন ফতেহপুরী ছাহেব আমাকে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিলেন। যথাসময়ে হযরতের আগমনের পূর্বেই উপস্থিত হয়েছিলাম। আমাকে পেয়ে হযরত খুব খুশি হলেন। হযরত খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এমন সময় হযরতের ছোট ছাহেব যাদার কাছে ঢাকা থেকে ফোন এলো- পাহাড়পুরী হুযুর এইমাত্র খিদমাহ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ঘুমে থাকার কারণে তার কাছে খবর পৌঁছতে এক ঘণ্টা বিলম্ব হয়ে যায়। বাদ আসর হযরতের বয়ান রাখার কথা, আবার রাত ৯টায় নাকি জানাযার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, তাই হযরত আর সাথে সাথে ঢাকা যাওয়ার চিন্তা করলেন না। প্রফেসর হযরতের সাথে থাকায় মৃত্যুর সংবাদটি আমি অল্প সময়ের মধ্যেই পেয়ে যাই।

পাহাড়পুরী হুযুর ও প্রফেসর হযরত পরস্পর পীর ভাই ছিলেন। তাঁরা দুজনই হযরত হাফেজ্জী হুযুরের আজাল্লে খলিফা। বর্তমান ঢাকা শহরের মাত্র গুটি কয়েক বুযুর্গ ব্যক্তির মধ্যে তাঁরা অন্যতম। হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রাহ. ছিলেন বর্তমান ঢাকা নগরীর একজন স্বনামধন্য মুহাদ্দিস ও বড় বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর খাস শাগরিদ ও ছোট মেয়ের জামাতা। সর্বোপরি হযরতের একজন আজাল্লে খলিফা ও ছা-হেবুস্ সির। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার ইলিয়েটগঞ্জ বাজারের উত্তর দিকে অবস্থিত মুরাদনগর থানার একটি গ্রামের নাম পাহাড়পুর, সে গ্রামে হাফেজ্জী হুযুরের একজন খলিফা ছিলেন- মাওলানা আখতারুজ্জামান ছাহেব। মাওলানা আলতাফ আলী রাহ.সহ তাঁরা কয়েকজন মিলে সে গ্রামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। আবদুল হাই পাহাড়পুরী ছাহেব এই মাওলানা আখতারুজ্জামান ছাহেবের বড় ছেলে। শুরু থেকে বাবার মাদরাসায় পড়া লেখা করেন। পরে লালবাগ মাদরাসা থেকে মেশকাত ও দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। তারপর পাকিস্তানের মুলতানে অবস্থিত খাইরুল মাদারিসে ফুনূনের তাকমীল করেন। তাঁর বাবা হযরত মাওলানা আখতারুজ্জামান ছাহেব ছিলেন হযরত মাওলানা সাঈদ আহমদ ছাহেব (চারিয়ার মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুর)-এর স্নেহধন্য খাস শাগরিদ। তাই তিনি পরবর্তীকালে বহুত বড় বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

পাহাড়পুরী হুযুরের আম্মাজান ছিলেন কুমিল্লার প্রখ্যাত ধামতি আলিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল, পীরে কামেল হযরত মাওলানা আযীমুদ্দিন রাহ.-এর বড় মেয়ে। তাই দেখা যায় পাহাড়পুরী হুযুর দুই ওলির পরশে জন্ম লাভ করা একজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। পাহাড়পুরী হুযুরকে তার বাবা হযরত হাফেজ্জী হুযুরের কাছে সোপর্দ করেছেন। তিনি এই ছেলেকে আপন মহিমায় গুণান্বিত  করে প্রকৃত মানুষ করে তোলেন এবং পরবর্তীকালে মাদরাসায়ে নূরিয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন। সর্বশেষ নিজের মেয়ের জামাতা ও খলিফা বানিয়ে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান।

হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ. বিশেষ কোনো পেরেশানীতে পড়লে পাহাড়পুরী হুযুরকে ডেকে তাঁর কাছে তাঁর পেরেশানীর কথা তুলে ধরতেন। পাহাড়পুরী হুযুর তাকে সান্ত্বনা দিয়ে ভারমুক্ত করতেন। হযরতের গোপনীয় কোনো আলোচনাও এই পাহাড়পুরী হুযুরের সাথেই করতেন। তাই তাকে হুযুরের ছা-হেবুস্ সিরবা একান্ত বিষয়ে আলোচনার পাত্র বলা হতো। এককথায় তার জীবন গঠনে হযরত হাফেজ্জী হুযুরের তরবিয়ত তাকে পরশ পাথরে রূপান্তরিত করেছে। ফলে হাফেজ্জী হুযুরের ইন্তেকালের পর হুযুরের অনেক গুণী-জ্ঞানী ভক্ত-মুরিদও পাহাড়পুরী হুযুরকেই পীর বা শায়েখ বানিয়ে নেন।

দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুসাহিত্যিক, আমার একান্ত সুহৃদ জনাব মাওলানা আবু তাহের মেসবাহকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি তো হাফেজ্জী হুযুরের হাতে মুরিদ ছিলেন, হযরতের ইন্তেকালের পর এখন কার কাছে মুরিদ হয়েছেন? তিনি বললেন, আমার সঙ্গী-সাথী হলেও পাহাড়পুরী হুযুর, একান্ত বন্ধু হলেও পাহাড়পুরী হুযুর এবং একান্ত উস্তায ও পীর বললেও পাহাড়পুরী হুযুরকেই আমি সব জ্ঞান করি। তাঁর পরামর্শে ও দিকনির্দেশনা-ই আমার চলার পথের পাথেয়। ফলে দেখা যায় পাহাড়পুরী হুযুর যেমন হাফেজ্জী হুযুরকে সব জ্ঞান করার কারণে তার জীবনটা ধন্য করে তার আদর্শের এক মহাপ্রতিক হয়ে যান, তদ্রূপ পাহাড়পুরী হুযুরের ছাত্র আবু তাহের মেসবাহও তাঁকে সব জ্ঞান করার কারণে তিনিও এখন এ যুগের এক বটবৃক্ষে রূপান্তরিত হতে চলেছেন। (আল্লাহ তাঁকে কবুল করুন)

বিষয়টি শুধু অনুসরণীয় একজনকে মান্য করা ও তাকে অনুসরণ করার বিষয়, অন্য কিছু নয়। এ জিনিসটার এখন বড় অভাব, যার ফলে হাজার হাজার ফারেগীন দেখা গেলেও সত্যিকার অর্থে গুণে দেখলে হতাশ হতে হয়। কাউকে মান্য করে তার পরামর্শে কাজ করলে কী হয়? তার একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ ছাহেবের লেখা বাইতুল্লাহর মুসাফির বইটি তার লেখার ইচ্ছা হয়েছিল ২৫ বছর আগে; প্রথম হজ¦ করার পর। কিন্তু তার উস্তায, তার বন্ধু বা পীর পাহাড়পুরী হুযুর অনুমতি দেননি তখন। ২৫ বছর পর লেখার অনুমতি দিয়েছেন। তা এখন বাংলা সাহিত্যে সাহিত্য ও ভ্রমণকাহিনীর ইতিহাসে এক বিরল সাহিত্যকর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কলম এবং কলবের সংমিশ্রণে তা হয়ে উঠেছে সাহিত্য ও আধ্যাত্মিকতার এক অপূর্ব সমন্বয়। ২৫ বছর পূর্বে লিখলে কিন্তু এটা হতো না বলেই আমার বিশ্বাস। তাই আমাদের উচিত বড় কাউকে মান্য করে তার পরামর্শে জীবন পরিচালনা করা। পৃথিবীতে যারা বড় হয়েছেন, তারা সবাই এ পথ ধরেই বড় হয়েছেন। এর ব্যতিক্রম খুব একটা নেই বললেই চলে।

যাইহোক, পাহাড়পুরী হুযুরের শত শত গুণের মধ্যে ছাত্র গড়ার গুণটি আমার খুব একান্ত মনে হয়েছে। কত শত হতোদ্যম ছাত্রের জীবনে তিনি উদ্যম ও প্রাণ ফিরিয়ে এনেছেন- এর হিসাব তাঁর ছাত্ররাই বেশি জানবে।

কত বেয়াড়া ছেলেকে কীভাবে সুকৌশলে আপন করে তাদের কাছ থেকে কাজ উদ্ধার করে নিয়েছেন তিনি। আসলে তাঁর ছাত্র গড়ার কারিগরি বিদ্যাটা খুব চমৎকার ছিল।

১৯৮১ সনের ১০ই ফেব্রুয়ারি আমার আব্বাজানের ইন্তেকালের পর আমি কামরাঙ্গিরচরে প্রতিষ্ঠিত হযরত হাফেজ্জী হুযুরের মাদরাসা নূরীয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। আমার রাজনৈতিক বন্ধু, বড় ভাই কারী আহমাদুল্লাহ আশরাফের পরামর্শে আব্বার মৃত্যুর পূর্বেই আমার যোগদানের বিষয়টা হযরত হাফেজ্জী হুযুরের অনুমোদন লাভ করেছিল। আব্বার মৃত্যুর পর ভাই মাওলানা আহমাদুল্লাহ ছাহেবকে বলার পর তিনি বললেন, আপনি কি আগামীকালই আসতে পারবেন? আমি বললাম, জী, ইনশাআল্লাহ। সে মোতাবেক আমি পরের দিন রেডিও বাংলাদেশের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নূরীয়া মাদরাসায় চলে যাই। ঐ মাদরাসায় আমার পূর্ব পরিচিত লোক বলতে শুধু আমার দীর্ঘ ছয় বছরের সাথী জনাব মাওলানা আবু বকর ছাহেব ও আমার ছোট বোনের জামাতা মাওলানা কারী ইউসুফ ছাহেব এই দুজনই ছিলেন। আর বড় ভাই তো তখন মাদরাসায় ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাইতুল মোকাররম মসজিদে। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসার কারণে অনেকেই আমাকে খুব আদর যতœ করেছেন। তবে কেন জানি আমার বেশি সম্পর্ক হয়ে যায় পাহাড়পুরী হুযুর, মাওলানা ইসমাঈল বরিশালী ও মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ-এর সাথে। আবু তাহের ছাহেব তো একপর্র্যায়ে আমার একান্ত বন্ধু হয়ে যান। আর পাহাড়পুরী হুযুর হয়ে যান আমার হিতাকাঙ্ক্ষী প্রধান মুরুব্বী।

কথা প্রসঙ্গে শফকতের সাথে আমাকে একটা নসীহত করলেন, বললেন আমি যখন হযরত হাফেজ্জী হুযুরের এখানে প্রথম এসেছিলাম তখন আমার আব্বাজান আমাকে একটি নসীহত করেছিলেন, আবার আমার আব্বাকে এই নসীহতটি আমার দাদাজান করেছিলেন, সেই নসীহতই আমি আপনাকে করতে চাচ্ছি। আমি বললাম, হুযুর বলুন। হুযুর বললেন, “কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করা, অনেক কথা শুনেও না শোনার ভান করা এবং স্বীয় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা। আমি হুযুরকে প্রশ্ন করলাম, হুযুর! আপত্তিকর কিছু দেখলেও কি চুপ করে থাকতে হবে। হুযুর বললেন, জী, আপত্তিকর কিছু দেখলেও চুপ থাকতে হবে। আমি বললাম, বুঝতে পারলাম না হুযুর! বললেন, প্রতিবাদ দ্বারা তো এসলাহই মাকসাদ। যদি তা না হলো তাহলে কী ফায়দা! তার চেয়ে আপনি যদি এখন স্বীয় কাজ নিয়ে পড়ে থাকেন তাহলে ভবিষ্যতে এমনও সময়      আসবে, যখন সব কাজ আপনাকেই করতে হবে, তখন আপনি ঠিকঠাকভাবে সব কাজ আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবেন। আমি বললাম আমি মনে হয় তা পারবো না, আমার মেজাযে এটা খুব কষ্টকর হবে হয়তো। যাইহোক, এটা ছিল আমার প্রতি পাহাড়পুরী হুযুরের শফকতের একটি নসীহত। যা তিনি সনদে মুত্তাসিলের সাথে আমাকে করেছিলেন।

পাহাড়পুরী হুযুরের বয়স প্রায় আমার বয়সের সমান, আমার এখন উনসত্তর বছর বয়স চলছে, হুযুরও উনসত্তর বছর বয়সেই চলে গেলেন। তবে তিনি অনেক আগে থেকেই অনেকগুলো রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। মারাত্মক ডায়াবেটিস থাকায় অনেক আগেই চোখের দেখা বন্ধ হয়ে যায়। আবার কয়েকবার ব্রেইন স্ট্রোক করাতে আরো কাবু হয়ে যান। সবশেষে গত রমযানের আগের রমযানে ৯টি রোযা রাখার পর আবার স্ট্রোক করে বসেন, এতে হুযুরের কথা বন্ধ হয়ে যায় এবং হুঁশ-জ্ঞানও বিলুপ্ত হয়ে যায়। গত রমযানের পূর্বে আমার ঢাকা সফরকালে হযরত হাফেজ্জী হুযুরের যেয়ারতে গেলাম। সেখান থেকে বড় ভাই কারী আহমাদুল্লাহ আশরাফ ছাহেবকে দেখতে গেলাম। তিনিও খুব অসুস্থ। আমার নাম বলাতে একটু হাসলেন আর কিছু বলতে পারলেন না। তারপর পাহাড়পুরী হুযুরকে দেখার জন্য তাঁর বাসায় গেলাম। আমার মাজুরীর কারণে বহু কষ্টে তিন তলায় উঠলাম এবং হুযুরকে দেখলাম। চোখ বন্ধ, অচেতন, খাবার দেয়ার জন্য নাকে পাইপ লাগানো। হুযুরের বড় ছাহেবযাদাহ মাওলানা আশরাফ বললেন, এই অবস্থা নাকি গত রমযানের ১০ তারিখ থেকে আরম্ভ হয়েছে। আমি শুনে খুব ব্যথিত হলাম। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। রমযানে হুযুরের জন্য খুব দুআও করেছি। এই সব কষ্টের উসিলায় আল্লাহ তাআলা তাঁকে মাফ করে দিয়েছেন এবং দারাজাত বুলন্দ করেছেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আল্লাহ হযরতকে গরীকে রহমত করুন। আমীন

পুনশ্চ : হযরত মাওলানা ওবায়দী দা. বা.-এর প্রবন্ধটি আরও দীর্ঘ ছিল। এতে গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু কথা ছিল। আশা করি হুযুরের জীবনীগ্রন্থে পুরো প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবে। غذاء الكبار سم للصغار -এর উসূল মোতাবেক এখানে পুরো লেখাটি ছাপা হলো না। সেজন্য হযরত ওবায়দীর খেদমতে আফওয়ান-আবদুল মালেক 

 

advertisement