কুরআন মাজীদের কিছু বৈশিষ্ট্য
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমর্থক
কুরআন মাজীদ তার নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছে তার একটি হল, ‘সে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমর্থক’। তার এ সমর্থনের বিভিন্ন দিক আছে, যথা সেসব কিতাবে যে মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস ও সাধারণ সৎকর্মসমূহের বর্ণনা আছে, কুরআন মাজীদেও তা বর্ণিত হয়েছে, যথা আল্লাহ তাআলার তাওহীদ, রাসূলের রিসালাত, আখিরাত, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, ফিরিশতা ও তাকদীরের সত্যতা; দয়া, সত্যকথন, আমানতদারি, ওয়াদারক্ষা, বদান্যতা প্রভৃতি সদগুণের প্রশংসা; জুলুম, প্রতারণা, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতি মন্দ চরিত্রের নিন্দা। সব কিতাবেরই প্রাণবস্তু ছিল এক আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীর দাওয়াত ও তাঁর সংগে কাউকে শরীক করার নিষেধাজ্ঞা। কুরআন মাজীদেরও কেন্দ্রীয় বিষয় সেটাই। সেসব কিতাবের প্রত্যেকটি বিশেষ কোনও নবীর প্রতি নাযিল হয়েছে, যেমন তাওরাত হযরত মূসা আ.-এর প্রতি, ইন্জীল হযরত ঈসা আ.-এর প্রতি, যাবূর হযরত দাউদ আ.-এর প্রতি এবং হযরত ইবরাহীম আ.-এর প্রতিও কোনও এক কিতাব নাযিল হয়েছিল, কুরআন মাজীদও এ কথার সাক্ষ্য দান করে এবং কুরআন মাজীদের সে সাক্ষ্য অনুযায়ী ওই সকল কিতাব ও তার নবীগণের প্রতি ঈমান আনা আমাদের জন্যও জরুরি।
ওই সকল কিতাবের আরও একটা বিষয় ছিল সর্বশেষ নবী ও তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী। সেই ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী প্রত্যেক কিতাবের অনুসারীগণ শেষ নবীকে চিনত ও তাঁর প্রতি যে কিতাব অবতীর্ণ হওয়ার কথা সেই কুরআন সম্পর্কেও জানত। তো ওইসকল কিতাবে প্রদত্ত ভবিষ্যদ্বাণী যে সত্য, কুরআন মাজীদ তার সপক্ষে সাক্ষ্য দান করে। অর্থাৎ কুরআন জানাচ্ছে ওইসকল কিতাবে যে শেষ নবীর আগমনী সংবাদ জানানো হয়েছে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই সেই নবী এবং তাঁর প্রতি যে কিতাব নাযিল হওয়ার কথা কুরআন মাজীদই সেই কিতাব।
এই যাবতীয় সমর্থনের প্রতি ইঙ্গিত করেই কুরআন মাজীদ ঘোষণা করছে-
وَ مَا كَانَ هٰذَا الْقُرْاٰنُ اَنْ یُّفْتَرٰی مِنْ دُوْنِ اللهِ وَ لٰكِنْ تَصْدِیْقَ الَّذِیْ بَیْنَ یَدَیْهِ وَ تَفْصِیْلَ الْكِتٰبِ لَا رَیْبَ فِیْهِ مِنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ.
এ কুরআন এমন নয় যে, তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ হতে রচনা করা হবে; বরং এটা এর পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সমর্থন করে এবং তোমাদেরকে যে বিধান দেওয়া হয়েছে তা ব্যাখ্যা করে। এতে কোনও সন্দেহ নেই। এটা জগৎসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হতে। -সূরা ইউনুস (১২) : ৩৭
অর্থাৎ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহও যে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ এবং তাতে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা সত্য, এ কিতাব তা প্রত্যয়ন করে। কুরআন যেহেতু পূর্ববর্তী কিতাবসমূহকে সমর্থন করে, তাই সে বিশেষভাবে সেইসব কিতাবের অনুসারীদেরকে ঈমানের দাওয়াত দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ اٰمِنُوْا بِمَاۤ اَنْزَلْتُ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ وَ لَا تَكُوْنُوْۤا اَوَّلَ كَافِرٍۭ بِهٖ وَ لَا تَشْتَرُوْا بِاٰیٰتِیْ ثَمَنًا قَلِیْلًا .
আর আমি যে বাণী নাযিল করেছি তাতে ঈমান আন, যখন তা তোমাদের কাছে যে কিতাব আছে তার সমর্থকও বটে। তোমরা এর প্রথম অস্বীকারকারী হয়ো না। আর আমার আয়াতসমূহ তুচ্ছমূল্যের বিনিময়ে বিক্রি করো না। -সূরা বাকারা (২) : ৪১
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ اٰمِنُوْا بِمَا نَزَّلْنَا مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَكُمْ.
হে কিতাবীগণ! তোমাদের কাছে যে কিতাব (পূর্ব থেকে) আছে, তার সমর্থকরূপে (এবার) আমি যা (অর্থাৎ কুরআন) নাযিল করেছি, তোমরা তাতে ঈমান আন। -সূরা নিসা (৪) : ৪৭
অর্থাৎ কুরআন ও কুরআনের নবী সম্পর্কে যেহেতু আগে থেকেই তোমাদের জানা আছে, তাই সে জানার দাবি হল, আর সকলের আগে তোমরাই ঈমান আনবে। কিন্তু আহলে কিতাব, বিশেষত ইহূদী জাতি তাদের সে জ্ঞানের দাবি অনুযায়ী কাজ করেনি; উল্টো তারা আরবজাতির প্রতি ঈর্ষাকাতর হল এবং সেই ঈর্ষাবশে কুরআন ও কুরআনের নবীকে অস্বীকার করল। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
وَ لَمَّا جَآءَهُمْ كِتٰبٌ مِّنْ عِنْدِ اللهِ مُصَدِّقٌ لِّمَا مَعَهُمْ وَ كَانُوْا مِنْ قَبْلُ یَسْتَفْتِحُوْنَ عَلَی الَّذِیْنَ كَفَرُوْا فَلَمَّا جَآءَهُمْ مَّا عَرَفُوْا كَفَرُوْا بِهٖ ؗ فَلَعْنَةُ اللهِ عَلَی الْكٰفِرِیْنَ بِئْسَمَا اشْتَرَوْا بِهٖۤ اَنْفُسَهُمْ اَنْ یَّكْفُرُوْا بِمَاۤ اَنْزَلَ اللهُ بَغْیًا اَنْ یُّنَزِّلَ اللهُ مِنْ فَضْلِهٖ عَلٰی مَنْ یَّشَآءُ مِنْ عِبَادِهٖ فَبَآءُوْ بِغَضَبٍ عَلٰی غَضَبٍ وَ لِلْكٰفِرِیْنَ عَذَابٌ مُّهِیْنٌ وَ اِذَا قِیْلَ لَهُمْ اٰمِنُوْا بِمَاۤ اَنْزَلَ اللهُ قَالُوْا نُؤْمِنُ بِمَاۤ اُنْزِلَ عَلَیْنَا وَ یَكْفُرُوْنَ بِمَا وَرَآءَهٗ وَ هُوَ الْحَقُّ مُصَدِّقًا لِّمَا مَعَهُمْ.
যখন তাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে এমন এক কিতাব আসল, যা তাদের কাছে (পূর্ব থেকে) যা আছে তার (অর্থাৎ তাওরাতের) সমর্থন করে (তখন তাদের আচরণ লক্ষ করে দেখ), যদিও পূর্বে তারা কাফেরদের (অর্থাৎ আরব পৌত্তলিকদের) বিরুদ্ধে (এ কিতাবের মাধ্যমে) আল্লাহর কাছে বিজয় প্রার্থনা করত, কিন্তু যখন সেই জিনিস আসল, যাকে তারা চিনত তখন তাকে অস্বীকার করে বসল। সুতরাং এমন কাফেরদের প্রতি আল্লাহ তাআলার লানত। কতই না নিকৃষ্ট সেই মূল্য, যার বিনিময়ে তারা নিজেদের আত্মাকে বিক্রি করেছে। তা এই যে, তারা আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবকে কেবল এই অন্তর্জালার কারণে অস্বীকার করছে যে, আল্লাহ নিজ অনুগ্রহের কোনও অংশ (অর্থাৎ ওহী ও কিতাব) নিজ বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা (অর্থাৎ আরবীয় নবীর প্রতি) কেন নাযিল করবেন? সুতরাং তারা (তাদের অন্তর্দাহের কারণে) গযবের উপর গযব নিয়ে ফিরল। বস্তুত কাফেরগণ লাঞ্ছনাকর শাস্তিরই উপযুক্ত। যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যে কালাম নাযিল করেছেন তার প্রতি (অর্থাৎ কুরআনের প্রতি) ঈমান আন, তখন তারা বলে, আমরা তো কেবল সেই কালামের উপরই ঈমান আনব, যা আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ তাওরাত)। আর এছাড়া সবকিছু তারা অস্বীকার করে। অথচ তাও সত্য এবং তা তাদের কাছে যে কিতাব আছে তার সমর্থনও করে। -সূরা বাকারা (২) : ৮৯-৯১
কুরআন মাজীদে এরকম আরও বহু আয়াত আছে, যা প্রমাণ করে এ কিতাব পূর্বের আসমানী কিতাবসমূহের মৌল শিক্ষার সমর্থক। এ দ্বারা একদিকে যেমন সেইসব কিতাবের সত্যতা প্রমাণিত হয়, সেই সংগে কুরআন মাজীদ যে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে প্রেরিত কিতাব তাও প্রমাণ হয়ে যায়। কেননা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন উম্মী ও নিরক্ষর ব্যক্তি ছিলেন। পূর্বেকার আসমানী কিতাবসমূহে কী কী বিষয় আলোচিত হয়েছে তা তার জানার কথা নয়। তা সত্ত্বেও তিনি যখন কুরআনের আয়াতে সেইসব কিতাবের শিক্ষা তুলে ধরেছেন, তখন স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি তা আল্লাহর নিকট থেকে ওহী মারফতই জানতে পেরেছেন। সুতরাং তিনি একজন নবী এবং তিনি যা আবৃত্তি করে শোনান তা আল্লাহর কিতাব। তো ইহূদী ও খ্রিস্টান জাতি যখন দেখতে পাচ্ছে কুরআন তাদের কিতাবের সমর্থন করে আর তা দ্বারা এ কিতাবের সত্যতা এবং এর নবীর নবুওত প্রমাণ হয়ে যায়, তখন তাদের কর্তব্য হয়ে যায় শেষনবী ও তাঁর কিতাবের প্রতি ঈমান আনা। কুরআন মাজীদও এই যুক্তিসম্মত ডাকই তাদেরকে দিয়েছে। কিন্তু তারা আরবজাতির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। কিতাবধারী হওয়ার কারণে তারা নিজেদেরকে দুনিয়ার অন্যসব জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করত। তারা জ্ঞানের অহমিকায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ আসমানী কিতাব তাদের বাইরে নিরক্ষর আরবদের কাছে আসবে আর ঈমান এনে তারা সেই নিরক্ষরদের সাথে এক কাতারভুক্ত হয়ে যাবে, এটা কিছুতেই মানতে পারছিল না। এই অহমিকাজনিত বিদ্বেষই তাদের ধ্বংস করে। ফলে তাদের অল্পকিছু সংখ্যক ছাড়া অধিকাংশই ঈমানের বাইরে থেকে যায়। না কুরআনকে আসমানী কিতাব বলে স্বীকার করে আর না হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওত মেনে যায়। বস্তুত এটাই হয় অহংকারীর অনিবার্য পরিণাম। তার পক্ষে কখনও সত্য মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। অহংকার তার সামনে এক দুর্লংঘ্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সংরক্ষক
কুরআন মাজীদের গুণ-বৈশিষ্ট্য-
وَ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیْهِ مِنَ الْكِتٰبِ وَ مُهَیْمِنًا عَلَیْهِ.
এবং (হে রাসূল!) আমি তোমার প্রতি সত্য-সম্বলিত কিতাব নাযিল করেছি তার পূর্বের কিতাবসমূহের সমর্থক ও তার সংরক্ষকরূপে। -সূরা মায়িদা (৫) : ৪৮
অর্থাৎ কুরআন মাজীদ যেমন সাক্ষ্য দেয় তাওরাত, ইন্জীল প্রভৃতি কিতাব আল্লাহ তাআলারই নাযিলকৃত, মানুষকে পথ দেখানোর জন্য সেগুলো বিশেষ-বিশেষ নবীর প্রতি নাযিল হয়েছে, তেমনি এ কিতাব সেগুলোর শিক্ষা-সংরক্ষকও বটে। সংরক্ষণের প্রয়োজন হয়েছে এ কারণে যে, ওইসব কিতাবকে বারবার মতলববাজদের উঞ্ছবৃত্তির শিকার হতে হয়েছে। তার অনুসারীরা নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থের জন্য তাতে অনেক রদবদল ঘটিয়েছে। এমনসব কথা তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে, যা আদৌ আসমানী তালিমের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। দ্বীনের সাম্য ও সম্প্রীতির বাণীকে তারা ক্ষুণ্ন তো করেছেই, তদুপরি যেই তাওহীদের শিক্ষা নিয়ে নবী-রাসূলগণ দুনিয়ায় আগমন করেছিলেন, তাকেও পর্যন্ত তারা বিকৃত করে ফেলেছে। কুরআন মাজীদ তাদের সেই দুষ্কর্মের প্রতি অংগুলীনির্দেশ করত সেগুলোর মৌলিক শিক্ষা ও প্রকৃত হিদায়াত কী ছিল তা পরিষ্কার করে দিয়েছে। ফলে কুরআন মাজীদের আপন হেফাজতের ভেতর দিয়ে সেসব কিতাবের হিদায়াত ও শিক্ষাও কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত হয়ে গেছে। উদাহরণত হযরত ঈসা আ.-এর ঈশ্বরত্ব, পুত্রত্ব ও উপাস্য হওয়ার বিষয়টাকেই দেখা যেতে পারে। খ্রিস্টজাতি এটাকে তাদের ধর্মের মূল আকীদা বানিয়ে তাদের ধর্মগ্রন্থ ইন্জীলের ভেতরও একে প্রক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। ফলে প্রচলিত ইন্জীলের পাঠক যখন ইন্জীলের পৃষ্ঠা ওল্টায়, তার ভেতর সে এরকম শিক্ষাই পায় যে, হযরত ঈসা আ. ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন। (পিতা-পুত্র ও পাক কালাম) ঈশ্বরের (এই) তিন সত্তার এক সত্তা হিসেবে স্বয়ং ঈশ্বরও ছিলেন এবং ঈশ্বর হওয়ার কারণে তার পূজা-অর্চনা করা মানুষের কর্তব্য। এসব ধারণা যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং মানুষের মনগড়া সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন যে-কেউ তা এমনিতেই বুঝতে পারে। তা সত্ত্বেও আসমানী কিতাবের পবিত্রতা রক্ষার্থে সর্বশেষ কিতাব কুরআন মাজীদের মাধ্যমেও আল্লাহ তাআলা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, ওসব কথা মানুষের মনগড়া। এর বিপরীতে ইন্জীলের শিক্ষা কী ছিল কুরআন তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। হযরত মাসীহ আ.-এর যবানীতে কুরআন বলছে-
وَ قَالَ الْمَسِیْحُ یٰبَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ اعْبُدُوا اللهَ رَبِّیْ وَ رَبَّكُمْ اِنَّهٗ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَیْهِ الْجَنَّةَ.
মাসীহ বলেছিল, হে বনী ইসরাঈল, আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমারও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সংগে (কাউকে) শরীক করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। -সূরা মায়িদা (৫) : ৭২
অর্থাৎ আমিও তোমাদেরই মত আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা আমার ও তোমাদের সৃষ্টিকর্তা ও মালিকেরই ইবাদত কর। এভাবে তিনি নিজেকে আল্লাহর বান্দা বলতেন এবং মানুষকে আল্লাহরই ইবাদতের দিকে ডাকতেন, নিজেকে ঈশ্বর বলতেন না এবং মানুষকে নিজেদের ইবাদত-উপাসনার দিকে ডাকতেন না, যেমনটা প্রচলিত ইন্জীল দ্বারা বোঝা যায়।
হাশরের ময়দানে আল্লাহ তাআলা যখন বলবেন, ‘হে ঈসা ইবন মারয়াম! তুমি কি মানুষকে বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার মা’কেও মাবূদরূপে গ্রহণ কর?’ -সূরা মায়িদা (৫) : ১১৬
তখন ঈসা আ. বলবেন-
سُبْحٰنَكَ مَا یَكُوْنُ لِیْۤ اَنْ اَقُوْلَ مَا لَیْسَ لِیْ بِحَقٍّ اِنْ كُنْتُ قُلْتُهٗ فَقَدْ عَلِمْتَهٗ تَعْلَمُ مَا فِیْ نَفْسِیْ وَ لَاۤ اَعْلَمُ مَا فِیْ نَفْسِكَ اِنَّكَ اَنْتَ عَلَّامُ الْغُیُوْبِ مَا قُلْتُ لَهُمْ اِلَّا مَاۤ اَمَرْتَنِیْ بِهٖۤ اَنِ اعْبُدُوا اللهَ رَبِّیْ وَ رَبَّكُمْ وَ كُنْتُ عَلَیْهِمْ شَهِیْدًا مَّا دُمْتُ فِیْهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّیْتَنِیْ كُنْتَ اَنْتَ الرَّقِیْبَ عَلَیْهِمْ وَ اَنْتَ عَلٰی كُلِّ شَیْءٍ شَهِیْدٌ.
আমি তো আপনার সত্তাকে (শিরক থেকে) পবিত্র মনে করি। যে কথা বলার কোনও অধিকার নেই, সে কথা বলার সাধ্য আমার ছিল না। আমি এরূপ বলে থাকলে আপনি অবশ্যই তা জানতেন। আমার অন্তরে যা গোপন আছে আপনি তা জানেন, কিন্তু আপনার গুপ্ত বিষয় আমি জানি না। নিশ্চয়ই যাবতীয় গুপ্ত বিষয়ে আপনি সম্যক জ্ঞাত। আপনি আমাকে যে বিষয়ের আদেশ করেছিলেন তা ছাড়া অন্য কিছু আমি তাদেরকে বলিনি। তা এই যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমারও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক এবং যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন আমি তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলাম। তারপর আপনি যখন আমাকে তুলে নিয়েছেন তখন আপনি স্বয়ং তাদের তত্ত্বাবধায়ক থেকেছেন। বস্তুত আপনি সবকিছুর সাক্ষী। -সূরা মায়িদা (৫) : ১১৬-১১৭
এমনিভাবে খ্রিস্ট সম্প্রদায় আরও যত ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসমূলক কথা ইন্জীলে প্রক্ষেপণ করেছে, কুরআন মাজীদ তার ভ্রান্তি তুলে ধরে সেসব বিষয় থেকে আসমানী ইন্জীলের পবিত্রতা সংরক্ষণ করেছে। ইহূদী জাতি তাওরাত-গ্রন্থের মারাত্মক বিকৃতি ঘটিয়েছে এবং তাতে এমনসব কথা জুড়ে দিয়েছে, যা আদৌ তাওরাতের অংশ নয়। কুরআন বলছে-
وَ قَدْ كَانَ فَرِیْقٌ مِّنْهُمْ یَسْمَعُوْنَ كَلٰمَ اللهِ ثُمَّ یُحَرِّفُوْنَهٗ مِنْۢ بَعْدِ مَا عَقَلُوْهُ وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ.
তাদের একটি দল এমন ছিল, যারা আল্লাহর কালাম শুনত। তারপর তা ভালোভাবে বোঝার পরও জেনেশুনে তাতে বিকৃতি ঘটাত। -সূরা বাকারা (২) : ৭৫
তারা যে কেবল মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে কিতাবের বিকৃতি ঘটাত তাই নয়; বরং নিজেদের পক্ষ থেকে কথা বানিয়ে তা কিতাবের ভেতর জুড়ে দিত। কুরআন বলছে-
فَوَیْلٌ لِّلَّذِیْنَ یَكْتُبُوْنَ الْكِتٰبَ بِاَیْدِیْهِمْ ثُمَّ یَقُوْلُوْنَ هٰذَا مِنْ عِنْدِ اللهِ لِیَشْتَرُوْا بِهٖ ثَمَنًا قَلِیْلًا فَوَیْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا كَتَبَتْ اَیْدِیْهِمْ وَ وَیْلٌ لَّهُمْ مِّمَّا یَكْسِبُوْنَ.
সুতরাং ধ্বংস সেই সকল লোকের জন্য, যারা নিজ হাতে কিতাব লেখে, তারপর (মানুষকে) বলে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে, যাতে তার মাধ্যমে কিঞ্চিৎ আয়-রোজগার করতে পারে। সুতরাং তাদের হাত যা রচনা করেছে সে কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস এবং এবং তারা যা উপার্জন করেছে, সে কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস। -সূরা বাকারা (২) : ৭৯
এসব ইচ্ছাকৃত রদবদলের পাশাপাশি তাদের অবহেলাও ছিল চরম। তাওরাতের শিক্ষা অনুযায়ী আমল তো করতই না, উপরন্তু শিক্ষার চর্চা ও হেফাজতের ব্যাপারেও ছিল গাফিল। ফলে তাওরাতের বহু শিক্ষা তারা ভুলে গিয়েছিল এবং তাদের কাছ থেকে তা হারিয়ে গিয়েছিল। কুরআন বলছে-
یُحَرِّفُوْنَ الْكَلِمَ عَنْ مَّوَاضِعِهٖ وَ نَسُوْا حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُوْا بِهٖ .
তারা কথাসমূহ তার আপনস্থান থেকে সরিয়ে দেয় এবং তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল তার একটা বড় অংশ ভুলে যায়। -সূরা মায়িদা (৫) : ১৩
একইরকম উদাসীনতা প্রদর্শন করেছিল খ্রিস্টজাতিও। কুরআন বলছে-
وَ مِنَ الَّذِیْنَ قَالُوْۤا اِنَّا نَصٰرٰۤی اَخَذْنَا مِیْثَاقَهُمْ فَنَسُوْا حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُوْا بِهٖ .
যারা বলেছিল, আমরা নাসারা, তাদের থেকেও প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম। অতপর তাদেরকে যে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তার একটা বড় অংশ তারাও ভুলে যায়। -সূরা মায়িদা (৫) : ১৪
মোটকথা তাদের উদাসীনতা, মনগড়া ব্যাখ্যা ও শাব্দিক প্রক্ষেপণ- এ সকল প্রকারেই তাওরাত, ইন্জীল প্রভৃতি আসমানী কিতাবে প্রচুর রদবদল ও বিকৃতি ঘটে গেছে। সবশেষে কুরআন মাজীদ এসে তার নিশানদিহি করে দেয় এবং তার প্রকৃত শিক্ষা আমাদের সামনে তুলে ধরে। আল্লাহ তাআলা বলছেন-
یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ قَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلُنَا یُبَیِّنُ لَكُمْ كَثِیْرًا مِّمَّا كُنْتُمْ تُخْفُوْنَ مِنَ الْكِتٰبِ وَ یَعْفُوْا عَنْ كَثِیْرٍ قَدْ جَآءَكُمْ مِّنَ اللهِ نُوْرٌ وَّ كِتٰبٌ مُّبِیْنٌ.
হে কিতাবীগণ! তোমাদের নিকট আমার (এই) রাসূল এসে পড়েছে, যে (তাওরাত ও ইন্জীল) গ্রন্থের এমন বহু কথা তোমাদের কাছে প্রকাশ করে, যা তোমরা গোপন কর এবং অনেক বিষয় এড়িয়ে যায়। আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের কাছে এক জ্যোতি এবং এমন এক কিতাব এসেছে, যা (সত্যকে) সুস্পষ্ট করে। -সূরা মায়িদা (৫) : ১৫
অর্থাৎ তাদের অন্যায় হস্তক্ষেপ ও অবহেলার কারণে আসমানী কিতাবের যা-কিছু শিক্ষা পর্দার অন্তরালে চলে গিয়েছিল, তার মধ্যে যা দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকাশ করা জরুরি ছিল, প্রকাশ না করলে কর্ম ও বিশ^াসগত দিক থেকে দ্বীনী ক্ষতি অবধারিত ছিল, সেগুলো শেষনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ করে দিয়েছেন, আর যেগুলো প্রকাশ না করলে কোনও ক্ষতির আশংকা ছিল না, তা তিনি এড়িয়ে গেছেন।
সারকথা কুরআন না হলে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে মানুষ চিরকাল অজ্ঞ থেকে যেত। এ কারণেই কুরআনকে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের সংরক্ষক বলা হয়েছে।
(চলবে ইনশা আল্লাহ)