প্রফেসর আব্দুস সামাদ সারেম রাহ.-এর আয়াতসংখ্যার আলোচনা : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
[নোট : এটি মূলত ‘কুরআন মাজীদের আয়াতসংখ্যা : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা’ শীর্ষক আমার প্রবন্ধের একটি অধ্যায়। প্রবন্ধটি মাসিক আলকাউসারের ‘কুরআনুল কারীম সংখ্যা ১৪৩৭’-এর ৮৬ পৃষ্ঠা থেকে ১৬১ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। যারা প্রবন্ধটি পড়েছেন তারা বক্ষমান পর্যালোচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগত আছেন। (আবদুল মালেক)]
প্রফেসর আব্দুস সামাদ সারেম রাহ. খুব সম্ভব লাহোরের ওরিয়েন্টাল কলেজে থাকাকালে কুরআনের ইতিহাস বিষয়ক তার ‘তারিখুল কুরআন’ বইটি লিখেন। আমার সামনে এর ১৯৮০ সনের পরিমার্জিত ষষ্ঠ সংস্করণ রয়েছে। মাকতাবা মঈনুল আদব লাহোরের ছাপা এই কিতাবটি দারুল উলূম করাচীর মাকতাবা ইলমিয়্যায় সংরক্ষিত আছে। আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে এর একটি ফটোকপি মাওলানা সাঈদ আহমদ বিন গিয়াসুদ্দীন আমার জন্য সংগ্রহ করেছিলেন। বিগত ১৪৩৬ হিজরীর শা‘বানে এ বইয়ের ১৯৬৩ সনে প্রকাশিত দ্বিতীয় মুদ্রণের ফটোকপি আলীগড় ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরী থেকে মৌলবী মুশতাক আহমদ সংগ্রহ করে দেন। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
এ কিতাবের আয়াতসংখ্যা সংক্রান্ত আলোচনা মানোত্তীর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও কোনো কোনো কিতাবে এর উদ্ধৃতি এসেছে। বাংলা ভাষার কুরআন সংকলনের ইতিহাস সংক্রান্ত একটি বইয়ে আয়াতসংখ্যার আলোচনা হুবহু এই কিতাবের অনুসরণে লেখা হয়েছে। তাই সারেম রাহ.-এর উক্ত আলোচনার উপর সংক্ষেপে পর্যালোচনার প্রয়োজন বোধ করছি। যাতে তার অনিচ্ছাকৃত হওয়া ভুলগুলোকে অজ্ঞতাবশত কেউ অনুসরণীয় ভেবে না বসে।
সারেম রাহ. এই কিতাবে ‘গণনা’ শিরোনামে অক্ষর, শব্দ ও আয়াতসংখ্যা নিয়ে যে আলোচনা করেছেন তার সবচে’ বড় দুর্বল দিক হলো, গ্রন্থ রচনার উৎস-গ্রন্থগুলোর মধ্যে আয়াতসংখ্যা সংশ্লিষ্ট কোনো গ্রন্থ নেই। অথচ এই গ্রন্থ রচনাকালে (১৯৬৩) এ বিষয়ের অনেক কিতাব ছাপা হয়ে গিয়েছিল। ওই সময়ে দুনিয়া জোড়া প্রসিদ্ধ ছিল মিশরীয় মুসহাফ। ওই মুসহাফের শেষেও এ শাস্ত্রের কিছু গ্রন্থের আলোচনা ছিল। সারেম রাহ.-এর হয়ত এসবের ব্যাপারে অবগতি ছিল না অথবা তিনি এগুলো পড়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি।
দুর্বলতার দ্বিতীয় দিক হলো, এ আলোচনায় তিনি শুধু তিনটি কিতাবের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, ইবনুল জাওযী রাহ.-এর ‘ফুনূনুল আফনান’, সুয়ূতী রাহ.-এর ‘আলইতকান’ এবং আহমাদ উশমূনীর ‘মানারুল হুদা ফিল ওয়াকফি ওয়াল ইবতিদা’ (আলোচ্য কিতাবে লেখা আছে মিনারুল হুদা)। কিন্তু তিনি এ আলোচনায় এমন অনেক বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যা এ তিন কিতাবের কোনো কিতাবে নেই। এজন্য ভিন্ন কোনো উদ্ধৃতিও তিনি ব্যবহার করেননি। অথচ এসব বিষয়ের কিছু সন্দেহযুক্ত, কিছু একেবারে ভুল এবং বাস্তববিরোধী। এরচে’ অবাক করা বিষয় হলো, আলোচনায় তিনি এমন সব কথাও এনেছেন যা উদ্ধৃত তিন কিতাবের পরিপন্থী।
দুর্বলতার তৃতীয় দিক হলো, তিনি আলোচনায় সাধারণ বোধ ও স্বাভাবিক বিষয়গুলোর দাবিও সামনে রাখেননি। তাই তার আলোচনায় এমন কিছু কথাও এসেছে যা স্বাভাবিকভাবেই বাতিল হয়ে যায়। ভূমিকার পর তার আয়াতসংখ্যা সংক্রান্ত আলোচনার সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় যাওয়া যাক।
একটি মারাত্মক ভুল
সারেম রাহ. আলোচনার শুরুতেই মারাত্মক একটি ভুল করে বসেছেন। তিনি লিখেছেন, তার ধারণায় খুব সম্ভব আয়াতের গণনা নবীযুগে শুরু হয়নি। এমনকি আবু বকর রাযি.-এর আমলেও আয়াত গণনা শুরু হওয়ার কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়নি।
এ ধরনের বক্তব্য থেকে আল্লাহর পানাহই কাম্য। তিনি বলেন, খুব সম্ভব হযরত উমর রাযি.-এর আমলে প্রথমবারের মতো আয়াত গণনা হয়। কারণ, তিনি আদেশ দিয়েছিলেন, ‘তারাবীর প্রতি রাকাতে ত্রিশ আয়াত যেন পড়া হয়।’ Ñতারীখুল কুরআন : ১১৭ (অষ্টম মুদ্রণ); ১১৮ (দ্বিতীয় মুদ্রণ)
এটা সারেম রাহ.-এর মারাত্মক ভুল। সাধারণ বিচার-বুদ্ধি, বাস্তবতা ও শাস্ত্রবিদদের ঐকমত্য ছাড়াও শতের কাছাকাছি বর্ণনা রয়েছে, যেগুলো এ কথার প্রমাণ বহন করেÑ নবীযুগে কুরআনের কোনো অংশ নাযিল হলেই গণা হয়ে যেত। কোনো সূরার অবতরণ সম্পন্ন হলে ঐ সূরার মোট আয়াতসংখ্যাও স্থির হয়ে যেত। ইমাম আবূ আমর আদদানী রাহ. একাই আলবয়ান ফি আদ্দি আয়িল কুরআন কিতাবে ৫৯ টি রেওয়ায়াত সনদসহ বর্ণনা করেছেন। এরপরও সারেম রাহ. লেখেন, আয়াতসংখ্যা সংশ্লিষ্ট তিনি সুস্পষ্ট কোনো রেওয়ায়াত পাননি। অথচ সূরা ফাতিহা সাত আয়াত, সূরা মুলক ত্রিশ আয়াত হওয়ার হাদীস এবং সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত ও শেষ দশ আয়াত মুখস্থ করার ফযিলতের কথা তিনি নিজেও উল্লেখ করেছেন। তিনি এ রেওয়ায়াতও উল্লেখ করেছেন,
وَ اتَّقُوْا یَوْمًا تُرْجَعُوْنَ فِیْهِ اِلَی اللهِ ثُمَّ تُوَفّٰی كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَ هُمْ لَا یُظْلَمُوْنَ۠ .
এ আয়াত নাযিল হলে জিবরাইল আ. বলেন, এ আয়াতটি সূরা বাকারার ২৮০ নাম্বার আয়াতের পর অন্তর্ভুক্ত করুন। (সারেম, তারীখুল কুরআন, পৃষ্ঠা : ১১৭ ও ৫১) কুরআনে কারীম খুললে দেখতে পাবেন উল্লেখিত আয়াতটি ২৮১ নাম্বারেই আছে।
তো খোদ সারেম রাহ.-এর বর্ণিত রেওয়ায়াতই তো সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে যে, কুরআন অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে আয়াত গণনার কাজও চলত। তাহলে তিনি কীভাবে বলেন, নবীযুগে আয়াত গণনা করা হয়নি?[1]।
সারেম রাহ.-ই তারীখুল কুরআনে ১২০ পৃষ্ঠায় লেখেন, সুনানে আবূ দাউদ, সুনানে ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ ও তবাকাতে ইবনে সা‘দে বর্ণিত আছে, সকীফ গোত্রের প্রতিনিধিদল হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে অবস্থানকালে একদিন হুজরা থেকে বের হলেন। বললেন, দৈনিকের অযীফা রয়ে গিয়েছিল। অযীফা পূর্ণ করায় ব্যস্ত ছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেল। আউস সাকাফী সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করে নবীজীর নি¤েœাক্ত অযীফা জানতে পারেন :
দিন |
সূরার সংখ্যা |
সূরার নাম |
1 |
3 |
বাকারা, আলে ইমরান, নিসা |
2 |
5 |
মায়েদাহ, আনআম, আরাফ, আনফাল, বারাআত |
3 |
7 |
ইউনুস, হুদ, ইউসুফ, রা’দ, ইবরাহীম, হিজর, নাহল |
4 |
9 |
বানী ইরাঈল, কাহফ, মারইয়াম, ত্বহা, আম্বিয়া, হজ্ব, মুমিনূন, নূর, ফুরকান |
5 |
11 |
শুআরা, নামল, কাসাস, আনকাবূত, রূম, লুকমান, সাজদা, আহযাব, সাবা, ফাতির, ইয়াসীন |
6 |
13 |
আসসাফফাত, সাদ, যুমার, মু‘মিন, হা-মীম সাজদাহ, শূরা, যুখরূফ, দুখান, জাছিয়া, আহকাফ, মুহাম্মাদ, ফাতহ, হুজুরাত |
7 |
65 |
মুফাসসাল (সূরা ক্বাফ থেকে নাস) |
সারেম রাহ. যে রেওয়ায়েত এখানে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন তার মূল আরবী পাঠ নি¤œরূপ :
فلما كان ذات ليلة أبطأ عن الوقت الذي كان يأتينا فيه فقلت يا رسول الله لقد أبطأت علينا الليلة قال إنه طرأ علي حزبي من القرآن فكرهت أن أخرج حتى أتمه قال أوس فسألت أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم كيف تحزبون القرآن قالوا ثلاث وخمس وسبع وتسع وإحدى عشرة وثلاث عشرة وحزب المفصل وحده.
সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৯৯৩, শরহু মুশকিলিল আসার, তাহাভী ২/৩৯৯-৪০২, হাদীস ১৩৭২, ১৩৭৩
সাত মনযিলে কুরআন খতম করার এ পদ্ধতি নবীযুগে ও সাহাবাযুগে প্রসিদ্ধ ছিল, এ অনুযায়ী আমল হত। প্রতি সপ্তাহে সহজে এক খতম করার জন্য এভাবে মনযিলে বিভক্ত করার পাশাপাশি নবীযুগেই আয়াতের পরিমাণ হিসেবে সূরার বিভক্তিকরণ সম্পন্ন হয়েছিল। প্রতি ভাগের পৃথক নামও প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। এরপর আর কী সন্দেহ থাকে যে, নবীযুগেই প্রতি সূরার আয়াতের বিন্যাসের মতোই আয়াতসংখ্যাও সুপরিচিত ছিল।
السبع الطوال দীর্ঘ সাত সূরা।
المئون শত আয়াতবিশিষ্ট সূরা।
المثاني শত আয়াত থেকে কম আয়াতবিশিষ্ট সূরা।
المفصل ওই সকল সূরা যা ছোট হওয়ার কারণে এ সবের মধ্যবর্তী বিসমিল্লাহর ব্যবধান খুব ঘন ঘন।
উল্লেখিত চারটি নাম তো নবী যুগের সুপ্রসিদ্ধ নাম।
(মুসনাদে আহমাদ, ৪/১৮৮, হাদীস ১৬৯৮২; তাফসীরে তাবারীর ভূমিকা ১/ ৯৬-১০০, ফাতহুল বারী ২/৩০০ কিতাবুল আযান, অধ্যায় : ১০৬)
তারপর مفصل তিন প্রকার :
طوال المفصل (মুফাসসালের বড় সূরাসমূহ)
أوساط المفصل (মুফাসসালের মাঝারি সূরাসমূহ)
قصار المفصل (মুফাসসালের ছোট সূরাসমূহ)
এসব শ্রেণীবিন্যাস আয়াতসংখ্যার ভিত্তিতেই আর এই শ্রেণীবিন্যাস এবং নামও পূর্ব থেকেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। [2]তারপরও কীভাবে এ কল্পনা করা যায়, নবীযুগের লোকজন আয়াতসংখ্যার ব্যাপারে বেখবর ছিলেন? উল্লেখিত তথ্যাবলী সারেম রাহ.-এর গ্রন্থেও সগৌরবে বিদ্যমান। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, তিনি আপন গ্রন্থের উল্লেখিত তথ্যাবলী ও বর্ণনাসমূহের অনিবার্য দাবী ও তার নির্ধারিত ফলাফলের ব্যাপারেও একেবারে বেখবর।
সারেম রাহ. সম্ভবত সোনালী যুগের সোনার মানুষদের আপন যামানার লোকদের উপর বিচার করে থাকবেন। যারা তাহফীজের মাদরাসাসমূহে প্রত্যেক পারার পৃথক পৃথক পৃষ্ঠার নাম্বার অনুযায়ী হিফজ করে থাকে। কোনো আয়াত জানার জন্য তারা বলে অমুক পারার অমুক পৃষ্ঠায় আছে, কিন্তু সূরার নাম এবং আয়াত নাম্বার বলে না। সোনালী যুগে কুরআন হিফজের এই তরীকার প্রচলনই ছিল না। তারা কুরআন শরীফ হিফজ করতেন সূরা এবং আয়াত অনুযায়ী। অমুক সূরার অমুক আয়াত। অমুক সূরার শুরু ভাগের এত আয়াত এবং শেষ দিকের এত আয়াত। অমুক আয়াত থেকে অমুক আয়াত পর্যন্ত। তাদের মুসহাফে প্রত্যেক আয়াতের পর পর নাম্বার যুক্ত ছিল না। এমনকি সাহাবাযুগে প্রত্যেক আয়াতের পর আয়াত সমাপ্তির নির্দেশক কোনো চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না। তাই তারা আয়াতের ফাসেলা এবং আয়াতসংখ্যা স্বতন্ত্রভাবে মুখস্থ ও আত্মস্থ করতেন।
তাই নবীযুগের আলেমে কুরআন, কারিয়ে কুরআন ও হাফেজে কুরআন কেবল কুরআন শিক্ষা কিংবা শুধু কুরআন শরীফ হিফজ করার সুবাদেই সূরাসংখ্যা ও আয়াতসংখ্যার ব্যাপারে পুরোপুরি অবহিত হতেন। সে যুগে এ ধারণা ও অনুভূতির অবকাশই ছিল না যে, কারো কোনো সূরা মুখস্থ থাকবে আর সে তার আয়াতসংখ্যা সম্পর্কে অন্ধকারে থাকবে।
তো নবীযুগেই যখন হাফেজে কুরআন ও কারীয়ে কুরআন সাহাবাদের প্রতিটি আয়াতের ফাওয়াসেলও জানা ছিল আর আয়াতের সর্বমোট সংখ্যাও তাই সিদ্দিকীযুগে নতুন করে তা গণনার কোনো প্রয়োজন রয়নি ফলে সারেম রাহ.-কে ইতিহাসে এর আলোচনা খুঁজতে হবে।
সিদ্দিকীযুগ এমনকি পুরো খেলাফতে রাশেদার যুগেই কুরআন শিক্ষার ক্ষেত্রে নবীযুগের সেই পদ্ধতিই প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ দশ আয়াত দশ আয়াত করে শিক্ষা প্রদান করা হত। তাতে কী কী ইলম রয়েছে এবং করণীয় আমল কী কী আছে এবং কোথায় থেমে দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনা করা উচিত আর কোথায় যিকির, দুআ ও শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে থামা উচিত। তাফসীরে তাবারীতে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন,
كان الرجل منا إذا تعلم عشر آيات لم يجاوزهن حتى يعرف معانيهن، والعمل بهن.
আমাদের কেউ দশ আয়াত শিখলে সে উক্ত দশ আয়াতের মর্মার্থ অনুধাবন করা এবং তদানুযায়ী আমলের পদ্ধতি রপ্ত করে নেওয়ার পূর্বে সামনে অগ্রসর হত না। Ñতাফসীরে তাবারী ১/৩৫
ইমাম আবু আবদুর রহমান সুলামী যার কুরআন শিক্ষার ধারার সূচনা খেলাফতের তৃতীয় যুগ থেকে। যিনি সিদ্দীকী ও ফারুকী যুগে শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম থেকে কুরআন এবং ইলমে কুরআন অর্জন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর একটি বাণী ইমাম আহমাদ রাহ. নকল করেন,
حدثنا من كان يقرئنا من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم أنهم كانوا يقترئون من رسول الله صلى الله عليه وسلم عشر آيات فلا يأخذون في العشر الأخرى حتى يعلموا ما في هذه من العلم والعمل قالوا فعلمنا العلم والعمل.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে সাহাবী আমাদের কুরআন শিক্ষা দিতেন তিনি আমাদের বলেন, তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দশ আয়াত দশ আয়াত করে শিখতেন, সামনের দশ আয়াত তখন শুরু করতেন যখন আগের দশ আয়াতের ইলম ও আমল ভালোভাবে রপ্ত হয়ে যেত। তারা বলেন, এভাবে আমরা ইলম ও আমল উভয়টা শিখেছি। Ñমুসনাদে আহমাদ ৫/৪১০, হাদীস ২৩৪৮২
তো যাদের শিক্ষাপদ্ধতিই আয়াতসংখ্যা গণনার উপর ভিত্তি করে তাদের যুগে আয়াতের গণনা হয়নি বলে ধারণা পোষণ করা কত বড় যুলুম। আর এ ধরনের কথা-বার্তা কতটা ভিত্তিহীন ও বাস্তবতা বিবর্জিত?!
সংখ্যা কিংবা বিশেষ চিহ্ন দিয়ে আয়াতের সমাপ্তি নিরুপণের লিখিত কোনো ব্যবস্থা ছিল না কিন্তু পঠন-পাঠন এবং হিফজ ও জবতের মাধ্যমে ওই যুগের হাফেজে কুরআন ও কারিয়ে কুরআনদের এ বিষয়টি রপ্ত ছিল, কোন আয়াত সংশ্লিষ্ট সূরার কত নম্বর আয়াত। আর এ জন্যই হযরত উমর রাযি. কোনো পূর্ব ভূমিকা ছাড়াই তারাবীর ইমামদের প্রতি রাকাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়াত তেলাওয়াতের ফরমান জারী করা সম্ভব হয়। শুধু সরকারীভাবে গণনা হয়েছে আর শুধু এই গণনার ভিত্তিতে হাফেজদের কীভাবে নির্দেশ দেওয়া যায় যে, তোমরা এই পরিমাণ আয়াত পড়। কারণ, যখন সে সর্বমোট আয়াতসংখ্যাই জানে না তখন সিরিয়ালে কোন আয়াত কত নাম্বারে তার জ্ঞান থাকবে কোত্থেকে।
বিভিন্ন বর্ণনায় আছে, হযরত উমর রাযি. তারাবীর ইমামদের সমবেত করলেন এবং এই নির্দেশ দিলেন যার তেলাওয়াত দ্রুত সে প্রতি রাকাতে ত্রিশ আয়াত, যার তেলাওয়াত ধীরস্থির ও সুচিন্তিত সে প্রতি রাকাতে বিশ আয়াত আর যার তেলাওয়াত এ দুয়ের মাঝামাঝি সে প্রতি রাকাতে পঁচিশ আয়াত করে পড়বে। Ñমুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, ৫/২২০-২২১, হাদীস ৭৭৫৩; আস-সুনানুল কুবরা, বায়হাকী, ২/৪৯৭
সারেম রাহ. সংক্ষিপ্তভাবে এই বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন আর এর ভিত্তিতেই তিনি এ বিষয়টি মেনে নিয়েছেন, ফারুকী যুগে আয়াতের গণনা সম্পন্ন হয়েছিল। পক্ষান্তরে তিনি এত অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত ও বর্ণনার ভিত্তিতে এ কথাটুকু বলতে পারলেন না যে, নবীযুগ থেকে হাফেজগণ শুধু সর্বমোট সংখ্যাই নয়, বরং এক এক আয়াতের সুনির্দিষ্ট নাম্বার পর্যন্ত রপ্ত করে রেখেছিলেন। যে তথ্য-উপাত্ত ও বর্ণনার একটি বড় অংশ আবু আমর আদদানী রাহ. আল-বয়ানের স্বতন্ত্র অধ্যায়ে বর্ষসংখ্যা অনুপাতে একত্র করে দিয়েছেন। এটা সারেম রাহ.-এর এক আজব রীতি।
যদি তার এই ভিত্তিহীন বিষয়ের বাংলা তরজমা না হত তাহলে আমার তা রদ করার প্রয়োজন হত না। প্রত্যেক ভিত্তিহীন বিষয় এমন নয় যে, তা রদ করতে হবে। আর এও কুদরতের কারিশমা যে ১৯৬০-এর দশকে একদিকে ওরিয়েন্টাল কলেজের প্রফেসর এ ভিত্তিহীন বিষয় লিখছেন অন্যদিকে ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার পূর্বে আয়াতসংখ্যা নিয়ে রচিত তার বাংলা প্রবন্ধে বিভিন্ন হাদীস ও আসারের বরাতে বাস্তব কথাটি লিখেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগেই আয়াতসংখ্যা স্থির ও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। তার বক্তব্যের ইবারত ও মূলপাঠ নি¤œরূপÑ
‘ইহা হইতে আমাদের সিদ্ধান্ত যে, আঁ হযরতের সময়েই কুরআন শরীফের আয়াতের সংখ্যা স্থির করা হয়েছিল প্রমাণিত হয়।’ Ñড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কুরআন প্রসঙ্গ : ১০৬, প্রকাশক : মুহাম্মদ সফিউল্লাহ, রেনেসাস প্রিন্টার্স, ঢাকা, মুদ্রণ : জিলহজ্জ ১৩৮৯/ফেব্রুয়ারী ১৯৭০
সারেম রাহ.-এর দ্বিতীয় কথা
সারেম রাহ. লিখেছেন,
‘হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত আনাস ইবনে মালেক, হযরত আবুদ দারদা, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর এবং হযরত আয়েশা রাযি. আয়াত গণনা করেছেন’।[3]
‘এই গণনাগুলো হয়তো সাহাবীদের শাগরেদ তাবেয়ীগণের দিকে মানসুব অথবা স্থানের দিকে মানসুব। হযরত উসমান রা.-এর গণনা শামী গণনা হিসেবে প্রসিদ্ধ এবং তা আবদুল্লাহ ইবনে আমের ইবনে হুসাইন-এর দিকে মানসুব। হযরত আলী রা.-এর গণনা কুফী গণনা হিসেবে প্রসিদ্ধ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর গণনা মাদানী আওয়াল ও হযরত আয়েশা রা.-এর গণনা মাদানী দুওম গণনা হিসেবে প্রসিদ্ধ’।[4](তারীখুল কুরআন, সারেম, পৃষ্ঠা ১১৭)
এখানে সারেম রাহ.-এর উপস্থাপন শৈলী দ্বারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় যে, আর কোনো সাহাবী আয়াতসংখ্যা গণনার কাজ করেননি। অথচ এ ধারণা সঠিক নয়। ভালোভাবে অনুসন্ধান করলে আরও অনেকের নাম বেরিয়ে আসবে। ইলমে আদাদ-সংখ্যাবিদ্যার শাস্ত্রীয় প্রাচীন ও উৎসগ্রন্থগুলোতে হযরত উবাই রাযি.-এর নাম বিদ্যমান, ইমাম ফজল ইবনে শাযান তাঁর আয়াত গণনার কথা উল্লেখ করেছেন। আবু আমর আদদানী রাহ.-এর উদ্ধৃতিতে আলবয়ানে নকল করেছেন। সারেম রাহ.-এর বক্তব্যের মূলপাঠের কতিপয় প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আরবী হাশিয়ায় তালিবে ইলমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
সারেম রাহ.-এর তৃতীয় কথা
সামনে অগ্রসর হয়ে সারেম রাহ. লিখেছেন,
‘আয়াতসমূহের সংখ্যা নিরূপণে মতপার্থক্য রয়েছে। এর কারণ হলো, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও আয়াতের শেষে থামতেন আবার কখনও মিলিয়েও পড়তেন। তাই কেউ থামার বিষয়টি গ্রহণ করেছেন আর কেউ মিলিয়ে পড়ার দিকটি গণ্য করেছেন’। (তারীখুল কুরআন, পৃষ্ঠা ১১৭)
আয়াতসংখ্যার গণনা বৈচিত্র্যের এটি একটি সম্ভাব্য কারণ। আর এই সম্ভাবনা খুবই দুর্বল। এ কথা ইবরাহীম ইবনে উমর জা‘বারী রাহ.-এর বক্তব্যের কাছাকাছি, যার আলোচনা পর্যালোচনাসহ তালাবায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে রচিত প্রবন্ধের উর্দূ সংস্করণে ‘ফসলুন ফিত তাসামুহাত’ শীর্ষক অধ্যায়ে ইনশাআল্লাহ পড়তে পারবেন।
আয়াতসংখ্যার গণনা-বৈচিত্র্যের মূল উৎস ও কারণ তা-ই যা আবু আমর আদদানী রাহ. এবং অন্যান্য শাস্ত্রীয় ইমামের বরাতে চতুর্থ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। Ñআলকাউসার কুরআনুল কারীম সংখ্যা, পৃ. ১০৪-১০৬
সারেম রাহ.-এর চতুর্থ কথা
তারপর সারেম রাহ. ‘আয়াতসংখ্যা’ শিরোনামে একটি তালিকা পেশ করেছেন যা নি¤œরূপ:
আয়েশার গণনা : 6666 |
শামী : 6250 |
ইবনে মাসউদের গণনা : 6218 |
বসরী : 6216 |
মক্কাবাসীর গণনা : 6212 |
কুফী : 6236 |
ইসমাঈল ইবনে জাফর মাদানী : 6214 |
ইরাকী : 6214 |
আকওয়ালে আম্মাহ (সাধারণ্যে প্রচলিত) 6666 |
তালিকার সর্বপ্রথম নামই হযরত আয়েশা রাযি.-এর। তাঁর গণনা ৬৬৬৬ লেখা আছে। যেমন পূর্বে সবিস্তারে আরজ করা হয়েছে যে, এটা লিপিকারের ভুল। সারেম রাহ. এখানে ৬২১৪ অথবা ৬২১০ লিখে থাকবেন। কেননা, তিনি বলেছেন, (তার জানা-শোনা মোতাবেক) উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা রাযি.-এর গণনাসংখ্যা মাদানী দুওম হিসেবে প্রসিদ্ধ। আর এ বিষয়টি শাস্ত্রবিদের নিকট স্বীকৃত যে, মাদানী দুওমের গণনাসংখ্যা হলো, ৬২১৪ আরেক বর্ণনায় ৬২১০। যদি ধরে নেওয়া হয়, এটি লিপিকারের ভুল নয়, স্বয়ং সারেম রাহ.-এর কলমেই লিখিত তাহলে তিনি স্বজ্ঞানে উল্লেখিত আপন বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত ৬৬৬৬ সংখ্যা লিখে বড় ধরনের বিচ্যুতির শিকার হয়েছেন। যার একমাত্র উৎস হলো, সিরাজুল কারীর অন্ধানুকরণ।
সারেম রাহ.-এর পুরো আলোচনা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তার বিচ্যুতির ব্যাপারে সতর্ক হওয়া ছাড়াই জনৈক লেখক বাংলা ভাষায় তা তরজমা করে ফেলেন। আর জনৈক আলেম তার প্রসঙ্গ ও পূর্বাপর চিন্তা-ভাবনা করা ছাড়াই সারেম রাহ.-এর তালিকার প্রথম ঘরে যা দেখেছেন তা-ই নিজের গ্রন্থে নকল করে দিয়েছেন। অথচ যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রসিদ্ধ ভুল সংখ্যাটি উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত বলে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে এই দুই ভুল ছাড়া আর কোনো উৎস নেই এক. সিরাজুল কারীর ভুল। দুই. সারেম রাহ.-এর তারীখুল কুরআন-এ ঘটিত লিপিকারের ভুল। প্রকৃত বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর আশা করি কেউ এই ভিত্তিহীন সংখ্যাটি উম্মুল মু’মিনিন হযরত আয়েশা রাযি.-এর বলে আখ্যায়িত করবেন না। Ñআলকাউসার Ñকুরআনুল কারীম সংখ্যা, পৃ. ১১১-১২৪
সারেম রাহ.-এর তালিকায় দ্বিতীয় নাম্বারে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি.-এর নাম এসেছে। তাঁর গণনা সংখ্যা ৬২১৮ বলা হয়েছে যা সঠিক। আর এই সংখ্যার ব্যখ্যাও পাঠকবৃন্দ পঞ্চম অধ্যায়ে পড়েছেন। [কুরআনুল কারীম সংখ্যা, (পাদটীকা) ১০৬-১০৭]
তৃতীয় সংখ্যা মক্কাবাসীর, এখানে সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৬২১২। পেছনে বলা হয়েছে এই সংখ্যাটি মূলত হুমাইদ মাক্কীর। মক্কাবাসীর সংখ্যা হলো ৬২১৯। আবু আমর আদদানী রাহ.সহ বিভিন্ন বিদগ্ধ শাস্ত্রবিদ এ কথাই লিখেছেন। সারেম রাহ. মানারুল হুদার বরাত দিয়েছেন, সেখানে মক্কী সংখ্যা ৬২১৯-এর কথা উল্লেখ আছে, ৬২১২-এর কথা নয়। (وأما في الفنون ف ৬২২০ دون ৬২১২)
প্রথম মাদানী সংখ্যার কথা সারেম রাহ. উল্লেখ করেননি। অবশ্য মাদানী দ্বিতীয় গণনা সংখ্যা তার বর্ণনাকারী ইসমাঈল জাফর মাদানীর সূত্রে ৬২১৪ লিখেছেন। এটা সঠিক।
শামী সংখ্যা ৬২৫০ লিখেছেন। অথচ বিশুদ্ধ মতানুযায়ী শামী সংখ্যা হলো ৬২২৬, আবু আমর আদদানীসহ অন্যান্য কুশলী শাস্ত্রবিদ এটাই লিখেছেন। এ ক্ষেত্রে সারেম রাহ. মানারুল হুদার উদ্ধৃতি দিয়েছেন অথচ তাতে শামী গণনা সংখ্যার কোনো উল্লেখ নেই। ফুনূনের বরাত দিয়েছেন তাতে ৬২২৭ সংখ্যা আছে। ইতকান-এর বরাত দিয়েছেন অথচ ইতকানে কোনো সংখ্যাই পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়নি। তাই সারেম রাহ.-এর এই তালিকা সবদিক থেকে প্রবল আপত্তিকর।
যদি আপনি বলেন, তিনি যদিও উদ্ধৃতি দেননি তবুও খুব সম্ভব তিনি বুসতানুল আরেফীনের উপর নির্ভর করে এই তালিকা তৈরি করেছেন। তাহলেও শেষ রক্ষা হয় না। কারণ, বুস্তানুল আরেফীনেও শামী সংখ্যা ৬২২৬ই লেখা আছে। অবশ্য কতিপয় শামবাসীর বরাতে ৬২৫০ লিখেছেন। কোথায় শামের ব্যক্তি বিশেষের সংখ্যা আর কোথায় ‘শামবাসীর’ সংখ্যা। এ দুয়ের মধ্যে কত বিরাট ব্যবধান।
এরপর বসরী সংখ্যা লিখেছেন ৬২১৬, এটাও ফুনূন, মানার ও বুস্তানসহ সকল গ্রন্থের বিবরণের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বসরী সংখ্যার ক্ষেত্রে কেউ ৬২১৬ সংখ্যার কথা বলেননি। সহীহ এটাই যে, বসরী সংখ্যা হলো ৬২০৪, বিদগ্ধ শাস্ত্রবিদদের ফায়সালা এটাই।
কুফাবাসীর সংখ্যা সঠিক লেখা হয়েছে ৬২৩৬। তারপর তিনি লিখেছেন, ইরাকী সংখ্যা ৬২১৪। এটা বড় আজব এক সংযোজন। কুফী সংখ্যা ও বসরী সংখ্যার পর এই ইরাকী সংখ্যার আবিষ্কার কোত্থেকে হলো। কুফা ও বসরা ইরাকের মহান এ দুই নগরীই তো ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার দুই প্রাণকেন্দ্র ছিল। ইলমে আদাদ কিংবা ইলমে কেরাতের নির্ভরযোগ্য কোনো কিতাবে আমার জানা মতে আয়াতসংখ্যার ব্যাপারে ইরাকী গণনার কথা কেউ লেখেনি। এটা সারেম রাহ.-এর আবিষ্কার। আয়াতসংখ্যা বিষয়ক গ্রন্থরাজিতে কোন্ ‘ফাসেলা’ কোন্ গণনা অনুযায়ী আয়াতের সমাপ্তি আর কোন্ ‘ফাসেলা’ আয়াতের সমাপ্তি নয়, এই পার্থক্য বর্ণনা করতে গিয়ে সংক্ষিপ্ততার খাতিরে কোনো কোনো লেখক এই রীতি স্থির করে নিয়েছেন যে, যেখানে কুফী ও বসরী উভয় গণনার ফলাফল এক হয় সেখানে শুধু ইরাকী লেখা হবে। তদ্রƒপ যেখানে মক্কী, প্রথম মাদানী ও দ্বিতীয় মাদানী এক হয়ে যাবে সেখানে ‘হেজাযী’ লেখা হবে। এই সূত্রেই ইলমে আদাদের কিতাবসমূহে ‘ইরাকী’ ও ‘হেজাযী’ শব্দদ্বয়ের সূত্রপাত ঘটেছে।[5] এর অর্থ এই নয় যে, ইরাকী ও হেজাযী গণনা নামে স্বতন্ত্র কোনো গণনার অস্তিত্ব বিদ্যমান। আর না তাদের স্বতন্ত্র কোনো সংখ্যা বিদ্যমান।
তালিকার শেষে লেখা আছে ‘আকওয়ালে আম্মাহ ৬৬৬৬’। এ বিষয়টি বুঝে আসেনি যে, সারেম সাহেব ‘আকওয়াল’ বহুবচন লিখলেন কেন? এখানে আম্মাহ সাধারণের একটি মাত্র কওল ও মতের কথা উল্লেখ করেছেন ৬৬৬৬। তবুও ‘আকওয়াল’। তা যাই হোক তবে প্রশ্ন হলো, এই ছয় ছয়ের কথা সারেম সাহেব কীসের ভিত্তিতে লিখলেন। তার উৎসগ্রন্থসমূহ ফুনূন, ইতকান ও মানার এ এর নাম নিশানাও নেই।
কুরআনুল কারীম সংখ্যায় ‘কুরআন মাজীদের আয়াত সংখ্যা : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা’ লেখার পঞ্চম অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছেÑ এই প্রসিদ্ধ ভিত্তিহীন সংখ্যার হাকীকত কী? আর কোত্থেকে এবং কীভাবে এই সংখ্যাটি খ্যাতি লাভ করে। আর কীভাবে ‘আম্মাহ’ শব্দের ভুল তরজমা করা হয়েছে। আশা করি এখানে ওসব বিষয়ের পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন নেই।
বাংলা ভাষায় কুরআন সংকলনের ইতিহাস নিয়ে লেখা যে কিতাবে আয়াতসংখ্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তা যদিও সারেম রাহ.-এর আলোচনারই তরজমা তাতে ‘আকওয়ালে আম্মাহ’-এর স্থলে লেখা হয়েছে, তবে সাধারণভাবে কুরআনের সর্বমোট সংখ্যা ৬৬৬৬ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
এই তরজমা ভুল। আর যদি এটি ওই লেখকের নিজস্ব মত হয় তাহলে প্রশ্ন হলো, ৬৬৬৬ সংখ্যার খ্যাতি বিদগ্ধ মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতেই খ্যাত নাকি ভিত্তিহীন জনশ্রুতি। যদি দ্বিতীয়টি হয়ে থাকে আর বাস্তবেও তাই, তাহলে তা রদ করা উচিত ছিল। আর কথা যদি প্রথমটি হয়ে থাকে তাহলে তার ভিত্তি কী? আর আলেমদের মধ্যে কারা এ সংখ্যার কথা বলেছেন কিংবা তা সত্যায়ন করেছেন। এসব বিষয় উল্লেখ করার দরকার ছিল। কিন্তু এসবের উত্তর তিনি কীভাবে দিতে পারবেন? কারণ, এ বিষয়টিই তো আগাগোড়া ভিত্তিহীন ও অবাস্তব।
এখানে পুনরায় এ বিষয়টি স্মরণ করুন, এটি সারেম রাহ.-এর তালিকার শেষ ঘর। [6]‘আকওয়ালে আম্মাহ’-এর ঘরে ৬৬৬৬ লেখা এ কথার আলামত বহন করে যে, সারেম রাহ. তালিকার প্রথম সারিতে হযরত আয়েশা রাযি.-এর সংখ্যা ৬৬৬৬ লেখেননি। কেননা, যদি ধরে নেওয়া হয় (শুধুই ধরে নেওয়া) ‘আম্মাহ’-এর অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ তাহলে আয়েশা রাযি.-কে স্বতন্ত্রভাবে কেন উল্লেখ করবেন? তিনি কি তবে গরিষ্ঠসংখ্যকের বিপরীত মতামত পোষণ করতেন? আর ‘আম্মাহ’ দ্বারা যদি আওয়াম উদ্দেশ্য হয় (আর এটাই সঠিক অর্থ) আবার তা (অর্থাৎ ৬৬৬৬) আয়েশা রাযি.-এর সংখ্যাও হয় তাহলে তা আওয়ামী কথা কীভাবে হয়? উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রাযি. তাহলে কি আওয়াম? নাউযুবিল্লাহ।
আসল কথা হল, এ সংখ্যাটি একেবারেই ভিত্তিহীন। আয়েশা রাযি.-এর সাথে এর আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। জাহেল আওয়াম ছাড়া এটি কারোই বক্তব্য নয়।
আরেক আজব কা- ; সবকিছুই কি হাজার আর হাজার
৬৬৬৬ এই ভিত্তিহীন সংখ্যাটি কিছু মানুষের এত পছন্দ হয়েছে যে, এরই ভিত্তিতে তারা কুরআনুল কারীমের আয়াতসমূহের ভাগও সম্পন্ন করেছেন। আর এক্ষেত্রে বাস্তবতার চেয়েও অগ্রাধিকার পেয়েছে হাজারী ছন্দ। সুতরাং তারা চোখ বন্ধ করে বলতে থাকে কুরআনে আদেশসূচক আয়াত ১০০০ নিষেধবাচক ১০০০ অমুক বিষয়ে ১০০০ অমুক বিষয়ে ১০০০।
এজাতীয় কথা এক শ্রেণীর দায়িত্ববোধহীন কিস্সা-রসিক মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধ ছিল। সারেম রাহ.-কে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করেন! তিনি এই ভিত্তিহীন কথাগুলো তার গবেষণাধর্মী বই ‘তারীখুল কুরআনে’ দাখিল করে দিয়েছেন। তিনি লেখেন কোনো কোনো বুযুর্গ এভাবে ভাগ করেছেন :
প্রতিশ্রুতি (ওয়াদা) |
1000 |
হুঁশিয়ারি (ওয়ীদ) |
1000 |
নিষেধ (নাহী) |
1000 |
আদেশ (আমর) |
1000 |
উপমা (আমছাল) |
1000 |
ঘটনা (কাসাস) |
1000 |
হালাল |
250 |
হারাম |
250 |
তাসবীহ |
100 |
রহিত (মানসূখ) |
66 |
Ñতারীখুল কুরআন, পৃ. ১১৯, দ্বিতীয় মুদ্রণ
আশ্চর্যের বিষয় হলো সারেম রাহ. যে ভিত্তিহীন ও অবাস্তব কথাটি নাম নাজানা কারো হাওয়ালায় উল্লেখ করেছেন সে কথাটি দস্তুরুল উলামা আহমদ নগরীর পরিশিষ্টে (খ- : ৪ পৃষ্ঠা : ৬) আবদুর রহমান জামী থেকে বর্ণিত বলে দাবি করা হয়েছে আর এ বিষয়ে নি¤েœাক্ত কবিতামালা তার রচিত বলে দেখানো হয়েছে।
آیت قرآن کہ خوب و دلکش است + شش ہزار و ششصد و شصت و شش است
یک ہزارش وعده و دیگر وعید + یک ہزارش امر و یک نہی شدید
یک ہزارِ او مثال و اعتبار+ یک ہزارِ از قصہاش یاد دار
پانصدش بحث حلالست و حرام+ صد دعا تسبیح و وِرْد صبح و شام
شصت و شش منسوخ و ناسخ ازکتاب + فہم کن و الله أعلم بالصواب
কুরআন শরীফের মনোমুগ্ধকর আয়াত ছয় হাজার ছয়শ ছেষট্টি। এক হাজার ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি সম্বলিত। আরেক হাজার হুঁশিয়ারি সম্বলিত। এক হাজার আদেশসংশ্লিষ্ট। আরেক হাজার নিষেধসংশ্লিষ্ট। এক হাজার দৃষ্টান্ত ও দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা সংক্রান্ত। আরেক হাজার কিসসা ও ঘটনা সংক্রান্ত। পাঁচশ হালাল-হারাম সম্পর্কে। আর একশ সকাল সন্ধ্যার দুআ সম্পর্কে আর ছেষট্টিটি নাসেখ মানসূখ বিষয়ক, ভালো করে বুঝে রাখুন। সঠিক বিষয় আল্লাহই ভালো জানেন।
ছন্দ ও অন্ত্যমিলের আকর্ষণের কারণেই এই কবিতাগুলো খ্যাতি লাভ করেছে। আর এ আকর্ষণই কতিপয় মানুষের দৃষ্টিতে উল্লেখিত বণ্টনের (যাতে প্রতি জিনিস এক হাজার এক হাজার) বিশুদ্ধতার দলীলেও পরিণত হয়েছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আমি জামীর কাব্যসমগ্রে নজর বুলিয়েছি কিন্তু এই কবিতামালা নজরে পড়েনি। তবে বিষয়টি যেহেতু নিরেট বাতিল ও বানোয়াট তাই তার রচয়িতা খোঁজে বের করার কোনো প্রয়োজন নেই। এর চেয়েও বড় আশ্চর্যের বিষয় হলো, শুধু এ কবিতাগুলোই নয় বরং এই কবিতাসম্বলিত আদাবুল কুরআন শিরোনামে কোনো প্রকাশক হাকীমুল উম্মত থানভীর নাম জুড়ে দিয়ে স্বতন্ত্র পুস্তিকা ছেপে দিয়েছে।
এই আদাবুল কুরআন কার পুস্তিকা?
হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর রচনাবলীর সূচিপত্রে আদাবুল কুরআন-এর নাম উল্লেখ আছে। এটা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জনৈক সুহৃদ দেওবন্দের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দারুল কিতাব দেওবন্দের ছাপা পুস্তিকা আদাবুল কুরআন হিন্দুস্তান থেকে এনে দেন, যা অধমের কাছে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল।
কভার পরবর্তী প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা আছে, ‘হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.’ অপর পৃষ্ঠায় পুস্তিকা সংক্রান্ত তথ্যাবলিতে লেখা আছে, কিতাবের নাম : আদাবুল কুরআন। লেখক : হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৪০ পৃষ্ঠা। প্রকাশকাল : ১৯৯৬। তত্ত্বাবধানে : ওয়াসিফ হুসাইন। মালিক দারুল কিতাব, দেওবন্দ।
এই পুস্তিকায় আবুল লাইছ সমরকান্দীর বুস্তানের উদ্ধৃতিতে গণনা ও সংখ্যার আলোচনা লেখা হয়েছে কিন্তু তাতে ভুল ও বিকৃতির কোন সীমা-পরিসীমা নেই। এদিকে হাজারী বণ্টন সংক্রান্ত উল্লেখিত কবিতাগুলোও তাতে বিদ্যমান। আশ্চর্য লাগল হাকীমুল উম্মতের কলম থেকে এমন বিষয় কীভাবে বের হতে পারে। এদিকে বর্ণনাশৈলীও অপরিচিত। তাহলে ঘটনা কী? তবে খুব সহজেই এই পেরেশানীর সমাধান বেরিয়ে এল। পুস্তিকার শুরুতেই লেখা আছে,
اما بعد! بندۂ گنہ گار راجی برحمت ایزد غفار خادم آستانہ عالیہ قدوۃ العارفین جناب حضرت مولانا شہباز محمد دیوانہ قدس سرہ محمد اشرف عالم بن جناب حضرت سیدنا ومرشدنا مولانا محمد عابد شاہ نوری نور اللہ مرقدہ قدس اسرارہ متوطن شہر بھاگلپور محلا ملاچک، خدمت جمیع مسلمانوں کی عرض کرتا ہے کہ بعد تالیف نسخہ مجمع الآداب اس فقیر سراپا تقصیر کے دل میں یہ خواہش و تمنی تھی کہ کوئی رسالہ فضائل و آداب قرآن میں حدیث و فقہ وقراءت وغیرہ کی کتابوں سے جمع کرے ۔۔۔
পর কথা! বড় ক্ষমাশীল প্রভুর রহমতের আশাবাদী পাপী বান্দা, আস্তানায়ে আলীয়া কুদওয়াতুল আরেফীন জনাব হযরত মাওলানা শাহবায মুহাম্মদ দেওয়ানা কুদ্দিসা সিররুহুর খাদেম মুহাম্মদ আশরাফ আলম বিন জনাব হযরত সায়্যিদুনা ও মুরশিদুনা মাওলানা মুহাম্মদ আবেদ শাহ নূরী নাওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু ওয়া কুদ্দিসা সিররুহু ভাগলপুর শহরের নিবাসী সকল মুসলমানের সমীপে নিবেদন করছে যে, মাজমাউল আদাব নুসখা সংকলনের পর আপদমস্তক নাকেছ আর অপূর্ণের মনে এ কামনা ও তামান্না ছিল যে, হাদীস, ফিকহ ও কেরাত ইত্যাদির কিতাবাদি থেকে ফাযায়েল ও আদাবে কুরআন সম্বলিত কোনো পুস্তিকা সঙ্কলন করব...।’ (আদাবুল কুরআন, পৃষ্ঠা : ২, ৩)
কে না জানে যে, হাকীমুল উম্মতের পিতার নাম আবেদ নয়, আবদুল হক। তিনি ভাগলপুরের নন। তিনি থানাভবনের অধিবাসী। তো এখন দেখুন কোথায় আশরাফ আলী বিন আবদুল হক আর কোথায় আশরাফ আলম বিন আবেদ, কোথায় আশরাফ আলী থানভী আর কোথায় আশরাফ আলম ভাগলপুরী। কোথায় আশরাফ আলী খলীফা ও জানেশীনে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী আর কোথায় আশরাফ আলম খাদেমে শাহবায মুহাম্মদ দেওয়ানা?!
আল্লাহ পাক এসকল মূর্খ ও মূঢ় প্রকাশকদের হেদায়েত নসীব করুন।
যাই হোক কোনো ভদ্রলোক আশরাফ আলমের পুস্তিকার উপর হাকীমুল উম্মত রাহ.-এর নাম দেখে (যা নিছক মূর্খতা কিংবা মূর্খতা ও খেয়ানত উভয় কারণে লেখা হয়েছে) প্রতারণার শিকার না হন। আর এ কথা মনে না করেন যে, হাকীমুল উম্মত রাহ.ও ছয় ছয়ের সংখ্যা লিখে দিয়েছেন কিংবা এ কথা মনে না করেন যে, হাকীমুল উম্মত রাহ. হাজারী বণ্টনের কবিতা লিখে দিয়েছেন। হযরত থানভী রাহ.-এর আসল পুস্তিকা আদাবুল কুরআন সম্পর্কে ১৪৩৪ হিজরীতে খানকায়ে এমদাদিয়া ও মাদরাসা এমদাদুল উলূম থানাভবনের মুহতামিম মাওলানা নাজমুল হাসানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তরে তিনি বললেন, আমার ধারণা অনুযায়ী এই পুস্তিকা হযরত রাহ.-এর কিতাব ইসলাহে ইনকিলাবে উম্মতের অংশ।
যাই হোক হযরত থানভী রাহ.-এর পুস্তিকা এখন কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে তা আরো অনুসন্ধান ও গবেষণার দাবী রাখে। তবে দারুল কিতাব দেওবন্দ থেকে যে পুস্তিকা ছাপা হয়েছে তা আশরাফ আলমের, আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর নয়।
এবার আসুন আমরা আয়াত বিষয়ক উপরোক্ত ভাগটির পর্যালোচনা করি।
ভূমিকা
বিস্তারিত পর্যালোচনার পূর্বে ভূমিকাস্বরূপ আরজ করছি, কুরআনে কারীম সংশ্লিষ্ট অসংখ্য আলোচনার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হলো, কুরআনের বিষয়সমূহ নিয়ে। অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হলো, কুরআনের ‘সম্বোধনশৈলী’। কুরআনে কারীমের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যবিষয় হলো, তাওহীদ, রিসালাত, আখেরাত, আদাব, আখলাক, যিকির ও দুআ, নসীহত ও শরীয়ত।
কুরআনে কারীমের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে তাওহীদে রুবুবিয়্যাত (রবের একত্ব), তাওহীদে উলূহিয়্যাত (ইলাহিয়্যাতের একত্ব), আল্লাহ পাকের মহান নামাবলী এবং গুণাবলী আরও রয়েছে তাঁর অপার কুদরত ও নিআমতের আলোচনা। একটি বড় অংশ জুড়ে আছে নবুওত ও রিসালাতের আকীদার প্রামাণিকতা এবং নবীদের দাওয়াত এবং তাদের উম্মতদের ঘটনাবলীর বিবরণ। আর একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সৃষ্টির সূচনা ও পরিণতি এবং আখেরাত ও আখেরাতের অবস্থার প্রামাণিকতার আলোচনা। আর এই তিন আলোচ্য বিষয়ের অধীনে বেশির ভাগ আর কিছু স্বতন্ত্র আয়াতেও আদাব ও আখলাক এবং যিকির ও দুআর শিক্ষা, নসীহত ও মাওইজায়ে হাসানার আলোচনা বিদ্যমান। আর কিছু আয়াত হালাল হারাম এবং হুদূদ ও শরয়ী দ-বিধি সংক্রান্ত।
কুরআনে কারীম আপন শিক্ষাদীক্ষা ও পথনির্দেশনা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে শুধু আদেশ ও হুকুমের শৈলী অবলম্বন করেনি রবং বিভিন্ন আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর শৈলী অবলম্বন করেছে। কুরআনে কারীমের সম্বোধনশৈলী অনেক, যেসব শৈলী বেশী পাওয়া যায় তন্মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছে :
১. আদেশসূচক।
২. নিষেধসূচক।
৩. অনুপ্রেরণামূলক ও ভীতিপ্রদর্শনমূলক কিংবা আশ্বাস ও হুঁশিয়ারিসূচক।
৪. সংবাদসূচক।
৫. উপমা ও দৃষ্টান্ত পেশ সূচক।
৬. কসম ও শপথ সূচক।
৭. গল্প ও ঘটনাসূলভ।
৮. দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন ও বিতর্কমূলক।
কুরআনে কারীম না বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয় অনুযায়ী বিন্যস্ত আর না সম্বোধনশৈলী অনুপাতে বিন্যস্ত, কোথাও তাওহীদের আলোচনা এসে গেলে তখন এরই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো বিষয়ের আলোচনা এসে যায়। অনেক সময় একই আয়াতে বিভিন্ন বিষয়ের সমাবেশ ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদ্রƒপ এক আয়াতে সম্বোধনশৈলী এক রকম তো পরবর্তী আয়াতে অন্য কোনো সম্বোধনশৈলী। অনেক সময় একই আয়াতে বিভিন্ন প্রকারের সম্বোধনশৈলীর সমাবেশ ঘটে যায়।
কুরআনে কারীমকে আল্লাহ তাআলা মূলত বিভিন্ন সূরায় ভাগ করেছেন। আর প্রতিটি সূরাকে কিছু আয়াতে ভাগ করেছেন। এটাই কুরআনে কারীমের স্বাভাবিক বিন্যাস ও বিভাজন। কুরআনে কারীম না বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে বিন্যস্ত যে, প্রথমে তাওহীদ বিষয়ক আয়াতের আলোচনা থাকবে, তারপর রিসালাত সংশ্লিষ্ট আয়াত। আর না তা সম্বোধনশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিন্যস্ত যে, প্রথমে আদেশসূচকশৈলী পর্ব শেষ হবে, তারপর নিষেধসূচকশৈলী পর্ব শুরু হবে।
নিপুণভাবে বিষয় থেকে বিষয়ান্তর হতে থাকা আর এক সম্বোধনশৈলী থেকে আরেক সম্বোধনশৈলীতে কুশলতার সঙ্গে স্থানান্তর হতে থাকা যে, শ্রোতারও বিরক্তিবোধ না হয়। না তার যেহেন বিক্ষিপ্ত হয়। আর না বক্তব্যের বিশুদ্ধতা ও অলঙ্কার নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর না তার প্রাঞ্জলতা ব্যহত হয়। এটা কুরআনে কারীমের ই‘জায ও অলৌকিকতার কারণসমূহের অন্যতম একটি কারণ।
যাই হোক, এটি একটি চাক্ষুস হাকীকত ও বাস্তবতা যে, কুরআনে কারীম না আলোচ্যবিষয় ও বিষয়বস্তু অনুযায়ী বিন্যস্ত আর না সম্বোধনশৈলীর অনুযায়ী। তা সূরা ও আয়াত অনুযায়ী বিন্যস্ত ও বিভাজিত।
এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর এখন নি¤েœাক্ত নিবেদনসমূহ লক্ষ করুন :
এক. কুরআনে কারীমের অর্থ ও মর্ম সম্পর্কে কিছুমাত্র অবহিত তেলাওয়াতকারীর এ বিষয়টি জানা থাকার কথা যে, কুরআনে কারীমের বহু আয়াত এমন রয়েছে যাতে একাধিক সম্বোধন শব্দ ও শৈলী বিদ্যমান। যেমন একই আয়াতে আদেশসূচক ও নিষেধসূচক সম্বোধন আছে। আবার এতেই ওয়াদা কিংবা হুঁশিয়ারিসূচক কোনো বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে, কিংবা ঘটনা ও দৃষ্টান্তমূলক কোনো বিষয়। পর্যবেক্ষণের আলোকে এ বিষয়টিও জানা যায় যে, অনেক সময় একই আয়াতে কোনো বস্তু হালাল হওয়ার বিবরণের পাশাপাশি অন্য একটি বস্তু হারাম হওয়ার বিবরণও রয়েছে। তদ্রƒপ ঘটনা ও দৃষ্টান্ত সম্বলিত আয়াতসমূহে আদেশ ও নিষেধ এবং হালাল ও হারামের বিষয়াবলীও বিদ্যমান।
প্রকৃত অবস্থা যখন এই তখন আমরা যদি সম্বোধনসূচক শব্দ গণনা করতে চাই তাহলে তার হিসাব আলাদা হবে আর যদি সর্বমোট আয়াতের গণনা করতে চাই তাহলে তার হিসাব হবে আলাদা। যেসব আয়াতে আদেশসূচক সম্বোধন রয়েছে তা যদি গণনা করি আর ধরে নেই তা সর্বমোট নয়শ হয়। তারপর পুরো কুরআনের সেসকল আয়াত গণনা করি যাতে নিষেধসূচক সম্বোধন রয়েছে আর উদাহরণস্বরূপ তার সমষ্টি দাঁড়ায় তিনশ। এখন এ কথা বলা ঠিক হবে না যে, কুরআনে আদেশ ও নিষেধসূচক সর্বমোট আয়াতসংখ্যা বারো শ। কারণ, এতে অনেক এমন আয়াত আছে যা দু’বার গণনা করা হয়েছে একবার আদেশসূচকের ক্ষেত্রে আরেকবার নিষেধসূচকের ক্ষেত্রে।
এভাবে হিসাব করলে সর্বমোট সংখ্যা বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি দাঁড়াবে। উদাহরণত এই আয়াত তেলাওয়াত করুন,
وَأَطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَه وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ وَاصْبِرُوا إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِينَ.(سورة الأنفال : ৪৬ )
এ আয়াতে আদেশও আছে, নিষেধও আছে, শেষে আছে ওয়াদাও। এখন যদি একে উল্লেখিত বণ্টননীতি অনুযায়ী গণনা করা হয় তাহলে এক আয়াতকে তিন আয়াত গণ্য করতে হবে। আর যদি এই আয়াতটি আদেশসূচক, নিষেধসূচক কিংবা দৃষ্টান্তমূলক তিন শ্রেণির শুধু এক শ্রেণীতে গণ্য করা হয় তাহলে আদেশ, নিষেধ কিংবা দৃষ্টান্তমূলক সম্বোধনশৈলীর সর্বমোট সংখ্যা কমে যাবে।
তাই বিষয়বস্তু কিংবা সম্বোধনসূচক শব্দের দৃষ্টিকোণ থেকে গণনা করলে তাকরার ও পুনরুক্তিবিহীন মূল ও আসল আয়াতসংখ্যা কত তা পরিষ্কার হবে না। কিন্তু অন্ত্যমিল-পাগল কবিদের সঙ্গে -যাদের সহযাত্রী সারেম রাহ.ও হয়ে গেছেন- তারা বিষয়বস্তু ও সম্বোধনশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদেরকে সর্বমোট আয়াতসংখ্যা বণ্টন করে দেখাবেন আর তাও ভিত্তিহীন সংখ্যা ছয় ছয়ের বণ্টন!! আরও কিছু আয়াত দেখুনÑ
وَآتِ ذَا الْقُرْبى حَقَّه وَالْمِسْكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا. (سورة الإسراء : ২৬ )
এ আয়াতে আদেশ ও নিষেধ উভয় শৈলীর সম্বোধন রয়েছে।
وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّه وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولاً. (سورة الإسراء : ৩৪)
এতে আদেশ, নিষেধ এবং হুঁশিয়ারি তিনো প্রকারের সম্বোধনশৈলীই রয়েছে। বিষয়টি আরও স্বচ্ছতা ও সুস্পষ্টতার জন্য এখানে আদেশ, নিষেধ, ওয়াদা ও হুঁশিয়ারি এই চার বিষয়ের আয়াতের একটি তালিকা দেখুন যে, এতে কী পরিমাণ পুনরুক্তি ঘটেছেÑ
আদেশ |
নিষেধ |
ওয়াদা |
ওয়ীদ |
২ : ১০৪ |
২ : ১০৪ |
২ : ১৬০ |
২ : ১৬০ |
২ : ১৯১ |
২ : ১৯১ |
৩ : ১৬১ |
৩ : ১৬১ |
২ : ২২২ |
২ : ২২২ |
১০ : ৪ |
১০ : ৪ |
২ : ২৩১ |
২ : ২৩১ |
১১ : ১৫ |
১১ : ১৫ |
৪ : ২ |
৪ : ২ |
১৩ : ৩৫ |
১৩ : ১৫ |
৪ : ১৫ |
৪ : ১৫ |
২১ : ১১১ |
২১ : ১১১ |
৪ : ১৯ |
৪ : ১৯ |
২৯ : ৬ |
২৯ : ৬ |
৪ : ২৪ |
৪ : ২৪ |
৩১ : ২৪ |
৩১ : ২৪ |
৪ : ২৫ |
৪ : ২৫ |
৩৩ : ৭ |
৩৩ : ৭ |
৫ : ২ |
৫ : ২ |
৩৬ : ৫২ |
৩৬ : ৫২ |
৫ : ৩ |
৫ : ৩ |
৪২ : ২২ |
৪২ : ২২ |
৫ : ৩৮ |
৫ : ৩৮ |
৪৭ : ১৫ |
৪৭ : ১৫ |
এখন চিন্তা করে দেখুন, আদেশ ও নিষেধসূচক ওয়াদা ও হুঁশিয়ারিমূলক উভয় সম্বোধন সম্বলিত এমনকি তিন-চার প্রকার বিষয়বস্তু সম্বোধনশৈলী সম্বলিত এসব আয়াতকে যদি প্রতিটি শিরোনামে গণনা করা হয় তাহলে সঠিক সর্বমোট সংখ্যা কী করে সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার হবে? তাই সর্বমোট আয়াতের গণনায় এই পদ্ধতি ভুল, যা সারেম রাহ. নাম উল্লেখ ছাড়া কোনো কোনো বুযুর্গের উদ্ধৃতিতে নকল করেছেন। সমস্ত আয়াতের সর্বমোট সংখ্যা বের করার সঠিক পদ্ধতি হলো এই যে, কোন সূরায় কত আয়াত আছে এ সবের সর্বমোট সংখ্যা বের করা, কিংবা কোন পারায় কত আয়াত কিংবা কোন রুকূতে কত আয়াত আছে এ সবের মোট সংখ্যা বের করা। বিষয়বস্তু কিংবা সম্বোধনশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে আয়াতসমূহকে ভাগ করে সর্বমোট সংখ্যা বের করা হলে তা সঠিক সর্বমোট সংখ্যা হওয়া সম্ভবই নয়।
দুই. এই বণ্টন ও শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যে কুরআনে কারীমের অনেক মৌলিক বিষয়বস্তু ও সম্বোধনশৈলীর আলোচনাই আসেনি। যদি বিষয়বস্তু ও সম্বোধনশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে আয়াতের শ্রেণী ও প্রকার বর্ণনা করতে হয় তাহলে প্রশ্ন হলো, এতে তাসবীহের আলোচনা তো আছে কিন্তু তাওহীদ, রিসালাত ও পরকালের অবস্থা ইত্যাদির শিরোনাম কোথায় গেল? আদেশ ও নিষেধসূচক শৈলীর আলোচনা এসেছে কিন্তু ইখবার ও সংবাদবাচক শৈলী, যা কুরআনে কারীমের অন্যতম একটি সম্বোধনশৈলী, তার আলোচনা কোথায়, ইকসাম ও শপথসূচক শৈলী যা কুরআনে কারীমের অনেক সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ সম্বোধনশৈলী, তার আলোচনা অনুপস্থিত কেন?
তিন. হুরুফে মুকাত্তাআতের বেশির ভাগই এমন যা স্বতন্ত্র আয়াত হিসেবে গণ্য করা হয়। যেমন, یٰسٓ الٓـمّٓصٓ الٓـمّٓ ইত্যাদি। উল্লেখিত বণ্টনে এই আয়াতসমূহ কোন্ প্রকারের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে; এসবের অর্থ তো আল্লাহ পাকই জানেন তাই এসব আয়াত উল্লেখিত বণ্টন ও বিভক্তির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তো এসব আয়াতসমূহ হিসেবে গণনা করা ছাড়া যে সর্বমোট সংখ্যা বের করা হয়েছে তা কীভাবে সঠিক হতে পারে?
চার. এই বন্টনে মানসূখ আয়াত সংখ্যা লেখা হয়েছে ৬৬। যাদের শুধু ‘নূরুল আনওয়ার’ ও ‘আলফাউযুল কাবীর’ পড়া আছে তারাও বুঝে এ কথা কোনোভাবেই ঠিক নয়। কারণ, মানসূখুল হুকুম আয়াতের সংখ্যা এরচে’ অনেক কম। আর মানসূখুত তিলাওয়াত আয়াতের সংখ্যা এরচে’ অনেক বেশী।
[7]পাঁচ. এর চেয়ে বড় কথা হল, বেনামী ঐ বুযুর্গের নামে জুড়ে দেওয়া এই বণ্টনের মধ্যে মানসূখ ছাড়া যে দশ বিষয়বস্তু ও সম্বোধনশৈলীর আলোচনা এসেছে, যেসব আয়াত সরাসরি ওই সকল শিরোনামের মধ্য হতে কোনোটার অন্তর্ভুক্ত নয় সেসবের সংখ্যাও কম নয়। আমাদের অনুসন্ধান অনুযায়ী এ ধরনের আয়াতের সংখ্যা দু’হাজারেরও ঊর্ধ্বে। এরপরও এ বণ্টনকে কীভাবে সঠিক আখ্যায়িত করা যেতে পারে?
ছয়. সবচে’ বড় কথা হলো, উল্লেখিত এগারো শিরোনামের মধ্য থেকে কোনো শিরোনামের অধীনে উল্লেখিত সংখ্যাই বাস্তবিক নয়। মানসূখের আলোচনা তো পূর্বে গত হয়েছে, বাকি শিরোনামগুলোর ব্যাপারেও আমরা বিস্তারিত লিখতে পারতাম। আমাদের ছাত্ররা প্রতিটি শিরোনাম সংশ্লিষ্ট আলাদা আলাদা সূচিপত্র তৈরি করেছে।
যা হোক এখানে সংক্ষেপে নিবেদন করছি :
ক. আমর দ্বারা কী উদ্দেশ্য? ছীগায়ে আমর নাকি প্রত্যেক এমন ছীগাসম্বলিত আয়াত যা আমর নির্দেশক। শুধু আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে জারি হওয়া আমর উদ্দেশ্য, না কোনো নবী কিংবা অলি বা অন্য কোনো ব্যক্তির কথা-বার্তায় বিদ্যমান আমর যা আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন আয়াতে আলোচনা করেছেন। তারপর আমরে তাশরীয়ী উদ্দেশ্য, না তাকবীনী আদেশ। হাজারী ভাগে বণ্টনকারীরা এসবের কিছুই পরিষ্কার করেনি। বাহ্যত, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে জারি হওয়া তাশরীয়ী আদেশমালা সম্বলিত আয়াতসমূহই উদ্দেশ্য। এ ধরনের আয়াত শুধু আমর সম্বলিত আয়াত, আমরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর কোনো সম্বোধনশৈলী সম্বলিত আয়াত উভয় প্রকার মিলে এক হাজার থেকে কম।
মনে রাখতে হবে, এক হলো, কুরআনে কারীমে উল্লেখিত আদেশসূচক শব্দমালা, দ্বিতীয় হলো, কুরআনে প্রদত্ত আদেশসূচক বিধান। তৃতীয় হলো, আমর সম্বলিত আয়াতসমূহ। এক আয়াতে যেহেতু কখনো একাধিক আমর বিদ্যমান থাকে তাই আমর সম্বলিত আয়াতসংখ্যা আদেশসূচক শব্দ থেকে কম হবে। আল্লাহ তাআলা অনেক সময় একেকটি বিষয়ে একাধিকবার আমর করেছেন তাই আদেশসূচক বিধানসংখ্যার চেয়ে আদেশসূচক শব্দসংখ্যা বেশি হওয়াটা একটি পরিষ্কার বিষয়। আদেশসূচক শব্দসংখ্যা ধরুন যদি এক হাজার বা তারচে’ বেশি হয় এতে এ ধারণা করা ঠিক নয় যে, আদেশসূচক আয়াতও এক হাজার বা তারচে’ বেশি। যেমন ‘সালাত-নামায’ একটি আদিষ্ট বিধান কিন্তু তার ব্যাপারে আমর ও আদেশসূচক শব্দ অনেক অনেক বার এসেছে।
‘যাকাত’ একটি আদিষ্ট বিধান কিন্তু তার ব্যাপারে আমরও বহুবার এসেছে।
সারকথা হলো, যেভাবেই বিশদায়ন হোক আমর সংক্রান্ত আয়াতকে এক হাজার বলা কিছুতেই ঠিক হবে না।
খ. তদ্রƒপ নাহী-নিষেধবাচক শব্দ দিয়ে শুধু ছীগায়ে-নাহী-সম্বলিত আয়াতসমূহ উদ্দেশ্য, না কোনো কিছুর নিষিদ্ধতা কিংবা হারাম নির্দেশক এমন যে কোনো সম্বোধনশৈলী-সম্বলিত আয়াতও তার অন্তর্ভুক্ত। শুধু তাশরীয়ী নাহীর ছীগা, না তাকবীনী নাহীও তার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা অন্য কারোও নাহী ও নিষেধকরণের কথা আলোচনা করেছেন, তা-ও তার অন্তর্ভুক্ত, না অন্তর্ভুক্ত নয়। এসবের মধ্য থেকে কোনো এক প্রকার নাহীসম্বলিত আয়াতসংখ্যা কোনোভাবেই এক হাজার নয়। সবধরনের নাহী-সম্বলিত আয়াতসমূহ যদি একত্রে গণনা করা হয় (হোক শুধু নাহী সম্বলিত আয়াত কিংবা ওইসব আয়াত যাতে নাহীর পাশাপাশি অন্য কোনো বিষয়ের আমরও উল্লেখ থাকুক অথবা অন্য কোনো সম্বোধনশৈলীতে কোনো বিষয়ের বিবরণ থাকুক) তারপরও ছয়শ থেকে কম হবে।
গ. উপমা ও দৃষ্টান্তমূলক আয়াতসমূহ তো একেবারেই পরিষ্কার, যেসব আয়াতে মাছাল কিংবা আমছাল শব্দ বিদ্যমান (সেগুলোই উপমা ও দৃষ্টান্তমূলক আয়াত) যে কেউ একবারের তেলাওয়াতেই তা একত্রে করে নিতে পারে এধরনের আয়াত কিছুতেই দু’শর বেশি হবে না।
ঘ. যেসব আয়াতে ঈমান ও নেক আমলের বিনিময়ে জান্নাতের সুসংবাদ কিংবা পরকালীন অন্য কোনো সাওয়াব বা পার্থিব কোনো প্রতিদান ও পুরস্কারের ওয়াদা করা হয়েছে অথবা সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে সে সবের সংখ্যা আটশ অতিক্রম করবে না।
ঙ. যেসব আয়াতে কুফ্র, শিরক, নেফাক, অন্তরের ব্যাধি, নিন্দনীয় স্বভাব-চরিত্র, অন্যায় অপরাধ এবং গোনাহ ও পাপাচারের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এবং এসবের ব্যাপারে কঠিন শাস্তি ও আযাবের কথা বলা হয়েছে এ ধরনের আয়াতসংখ্যা আটশ’র কাছাকাছি।
চ. যদি বিষয়বস্তুর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয় তাহলে ঘটনা-সংক্রান্ত আয়াত কুরআনে কারীমে অনেক বেশি। ঘটনা-সংক্রান্ত আয়াত শুধু এক হাজার বলা পরিষ্কার ভুল। এ সংক্রান্ত আয়াতসংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশি।
ছ. আয়াতে তাসবীহ দিয়ে উদ্দেশ্য যদি এই শব্দ ও এই শব্দ থেকে নির্গত শব্দমালা সম্বলিত আয়াতই কেবল উদ্দেশ্য হয় তাহলে তা একশরও কম। আজব ব্যাপার যে, হামদ, তাকবীর ও তাওহীদের শিরোনামগুলোর উল্লেখ এ বণ্টনে আসেইনি। তবে বড়ই গনিমতের ব্যাপার যে, তাতে তাসবীহ শিরোনামের উল্লেখ রয়েছে।
জ. সোনালী যুগ থেকে ‘আয়াতুল আহকাম’ নামে একটি শিরোনাম চলে আসছিল। আর উসূলে ফিকহের কিতাবাদিতে আয়াতুল আহকাম পাঁচ শ হিসেবে প্রসিদ্ধ। কেউ কেউ আহকামের পরিবর্তে ‘হালাল ও হারাম’ নামেও উল্লেখ করেছেন। এখন এই ভালো মানুষরা পাঁচ শ’কে আধা আধি ভাগ করার মতো আজব ও অদ্ভুত কাজ করে দাবি করছে যে, হালাল সংক্রান্ত আয়াত আড়াইশ আর হারাম সংক্রান্ত আয়াত আড়াইশ। এ আধাআধি বণ্টন তো একেবারে আন্দাযি ও অনুমান নির্ভর। বাস্তবতার সঙ্গে এর দূরতম সম্পর্কও নেই।
উসূলে ফিকহে যে আয়াতে আহকামের কথা প্রায় পাঁচ শ বলা হয়েছে তাতে প্রত্যেক স্তরের আহকাম ও বিধান অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ শুধু হালাল হারাম নয় বরং ফরয ওয়াজিব, সুন্নত মুস্তাহাব, আদাব, মোবাহ আর বর্জনের ক্ষেত্রে হারাম মাকরূহে তাহরীমি, মাকরূহে তানযীহি অনুত্তম সব স্তরের বিধানই শামিল আছে। আর এসব আয়াতের ছীগায়ে খেতাব-সম্বোধনসূচক শব্দও আম ও ব্যাপক। হোক তা ‘হালাল’ শব্দ ও ‘হারাম’ শব্দ এবং তা থেকে নির্গত শব্দমালার কোনো শব্দ, হোক ‘হালাল’ ও ‘হারাম’করণ সংক্রান্ত অন্যান্য শব্দ ও বাক্যমালা। যেমন, আমর, নাহী, কোনো কাজের তাগিদ, কোনো কাজের নিন্দা কিংবা কোনো এমন বক্তব্যশৈলী যার দ্বারা কোনো শরয়ী হুকুম প্রমাণিত হয়।
তালিবে ইলমদের জানা আছে, মুল্লা জিয়ুন রাহ. আয়াতে আহকামের তাফসীর লিখেছেন যা ‘আততাফসীরাতুল আহমদিয়া’ নামে খ্যাত। এতে চার শ আশি থেকে কিছু বেশি আয়াতের তাফসীর বিদ্যমান, এতে উপরে আলোচিত প্রতিটি স্তরের বিধানসম্বলিত এবং সব ধরনের সীগায়ে খেতাবের আয়াতই বিদ্যমান। বর্তমান আলোচনাধীন বণ্টনে যখন আমর, নাহী এবং ওয়াদা ও ওয়ীদ সম্বলিত আয়াতকে আলাদা উল্লেখ করা হয়েছে তখন এর আহকাম সংক্রান্ত প্রকারে পাঁচ শ আয়াত কোত্থেকে আনবে। কিছু আয়াতকে যদি এখানে গণনা করেন আবার ওখানেও তাহলে এর দ্বারা সঠিক সর্বমোট সংখ্যা কীভাবে বের হতে পারে?
আশা আছে, আয়াতে আহকামের একটি বিস্তারিত তালিকা ও সূচিপত্র আলকাউসারের আগামী বিশেষ কোনো সংখ্যায় পেশ করা হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
বর্তমানে এই কিছু নিবেদন পাঠক সমীপে পেশ করে আলোচনা শেষ করছি। এগুলো নিয়ে যদি চিন্তা-ভাবনা করা হয় তাহলে ইনশাআল্লাহ সহজেই বুঝে এসে যাবে যে, এটি একটি ভিত্তিহীন সংখ্যার ভিত্তিহীন বণ্টন। ৬৬৬৬-এর মত একটি অবাস্তব সংখ্যার অবাস্তব বণ্টন বৈ কিছুই নয়। ফার্সী কবিতার আকর্ষণে যদিও কাছাকাছি যুগের কতিপয় লেখক এ বিষয় আপন কিতাবে লিখে দিয়েছে আর তাদের দেখাদেখি ‘দায়েরায়ে মাআরেফে ইসলামিয়া লাহোর’, কুরআন সংকলনের ইতিহাস সংক্রান্ত বাংলা কিতাবে এবং বাংলা বিশ্বকোষেও এ বিষয়টি ঢুকে গেছে। আল্লাহ তাআলা এসব শিথিলতার মন্দ প্রভাব প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
এ ধরনের দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট নিবেদনমালার পরও যদি কোনো ভাই এই বণ্টনের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে জেদ ধরে তাহলে আমরা তার সমীপে শুধু এই নিবেদন করব যে, আলহামদু লিল্লাহ কুরআনে কারীম বিদ্যমান, সবার সংগ্রহে তা আছে। আপনি গভীর চিন্তা-ভাবনাসহ তেলাওয়াত করুন এবং এই বণ্টন অনুযায়ী আমাদেরকে আয়াতে কারীমার একটি তালিকা তৈরী করে দিন। এক বছরের পরিবর্তে আপনি তিন বছর সময় নিন তাতেও কোনো আপত্তি নেই।
এই সামান্য কিছু নিবেদনের মাধ্যমে প্রফেসর আব্দুস সামাদ সারেম রাহ.-এর কিতাব তারীখুল কুরআন-এর আয়াত সংক্রান্ত আলোচনার ব্যাপারে আমার সংক্ষিপ্ত ও বিনয়াবনত পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন সমাপ্ত করছি।
আল্লাহ তাআলার কাছে তা উপকারী ও মাকবুল হওয়ার আশা করছি এবং নিজের নফস ও মন্দ আমলের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।[8]
ভাষান্তর : ওয়ালিউল্লাহ বিন আব্দুল জলীল
[1] সারেম রাহ. এ বাতিল দাবির স্বপক্ষে কারণ দর্শাতে গিয়ে বলেছেন, ‘কারণ, ওহীর ধারা নবীজীর ইন্তেকালের নয় দিন পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।’
আয়াত গণনার জন্য নয় দিন কি কম সময়? যখন যতটুকু নাযিল হত ততটুকুর গণনাই সম্পন্ন হয়ে যেত। তো শেষ দিনগুলোতে যা নাযিল হয়েছে তা এতদিন নাযিল হওয়া আয়াতের সঙ্গে যোগ করতে কতটুকুইবা সময় লাগে। আফসোস লেখক যদি আয়াতসংখ্যা বিষয়ক একটি কিতাবও পেয়ে যেতেন। আফসোস তিনি যদি শুধু আবু আমর আদদানীর আল বয়ান ফি আদ্দি আয়িল কুরআনই পেয়ে যেতেন। তাহলে তিনি না ভেবে না বোঝে এমন আজব ও অদ্ভুত ও বিরল আলোচনার অবতারণা করতেন না।
افسوس ہے کہ صارم نے یہ بھی لکھا کہ سورتوں کا شمار بھی عہد رسالت میں نہیں ہوا بلکہ اول مرتبہ عہد صدیقی میں ہوا، انا للہ وانا الیہ راجعون، حالانکہ دیگر قطعی دلائل کے علاوہ خود صارم کی ذکر کردہ اوس ثقفی رضی اللہ کی وہ حدیث بھی اس بات کی واضح دلیل ہے کہ عہد رسالت میں سورتوں کا شمار اور سورتوں کی ترتیب ایک جانی پہنچانی بات تھی، افسوس لوگ نازک ترین معاملے میں بھی تخمین کی بنیاد پر بات کرتے ہیں، اور کبھی مشتبہ اور مبہم اقوال سے دھوکہ بھی کھاتے ہیں. (عبد المالک)
[2] হাদীসের কিতাবসমূহে মাসনূন কেরাতের আলোচনায় এসব পরিভাষার উল্লেখ রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম নামাযের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আকাবিরে সাহাবার কেরাত কী ও কতটুকু ছিল তা বর্ণণা করার সময়ও এসব পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। দ্র. মুয়াত্তা মালেক, পৃষ্ঠা ৭২ القراءة في المغرب والعشاء ; সহীহ বুখারী, হাদীস ৭০১, ৭৬৪; কিতাবুল আযানের ১০৬ নং অধ্যায়, باب الجمع بين السورتين في الركعة ...; মুসনাদে আহমাদ ২/৩৩০, হাদীস ৮৩৬৬
[3] لم يذكر صارم مأخذه في هذه الفهرست، وقد ذكر فيها من لا يوجد فيه التصريح على وجه التعيين أنه عد جميع الآي،كما قد فاته بعض من نص أهل الفن أنه كان من أئمة العدد، كأبي بن كعب رضي الله عنه.
هذا، وقد ذكر أحمد الأشموني في >منار الهدى في الوقف والابتداء< ص ২২ (طبع مصطفى البابي الحلبي، الطبعة الثانية ১৩৯৩هـ/১৯৭৩م): >التنبيه الثاني عشر: قد عد أربعة من الصحابة الآي : عبد الله بن عمر، وعبد الله بن عباس، وأنس بن مالك، وعائشة<. والمنار من مصادر صارم، وكلام المنار هذا مأخوذ من >البيان< للداني، والداني إنما ذكر هؤلاء الأربعة بصدد أنهم كانوا يعدون الآي عند القراءة في الصلاة، لا بصدد أنهم كانوا عدوا آي القرآن كلها لمعرفة مجموعها.
فتخصيص الأشموني أئمة العدد من الصحابة في هؤلاء الأربعة خطأ محض، ومن لم يوجد فيه التصريح من هؤلاء أنه عد جميع الآي فالجزم فيه بذلك منظور فيه أيضاً، وهذه أمور دقيقة ينبغى للطلاب أن ينتبهوا إليها عند الاستفادة من كتاب، وبالله تعالى التوفيق (عبد المالك)
[4] ذكر صارم هنا المراجع : الفنون، الإتقان، ومنار الهدى، كتباً ثلاثة فقط، وليس في شيء منها أن عائشة رضي الله عنها أخذ عنها عدد المدني الأخير أو غيرها من الأعداد، ونسبة المدني الأول إلى ابن مسعود رضي الله عنه خطأ، فإن عدده ৬২১৮، في حين أن المدني الأول ৬২১৭، وإن نقل ابن الجوزي أن عدده رضي الله عنه ৬২১৭، ومع ذلك فلم يقل إن المدني الأول منسوب إليه رضي الله عنه، راجع >فنون الأفنان< ص ২৪২، من طبعة حسن ضياء الدين عتر.
وأما العدد الشامي فقال ابن الجوزي في >الفنون< ص ২৪১: >وأما الشامي فمنسوب إلى عبد الله بن عامر اليحصبي، وروى قوم أن أيوب بن تميم زعم أنه عدد عثمان بن عفان، والأول أصح<
ففي نقل صارم تساهل، لاسيما وإنه أخطأ في ذكر العدد الشامي في جدوله الآتي، فجعله ৬২৫০، فكأنه نسب إلى عثمان رضي الله هذا العدد، وهذا خطأ على خطأ، إذ نسب إليه بالواسطة عددا شاذا!! والغريب أن كتاب >تاريخ تدوين القرآن< البنغالي الصادر من دار الكتاب ببنغله بازار، قد اعتمد هذا الذي ذكره صارم بالواسطة، فصرح بأن عدد عثمان رضي الله عنه هو ৬২৫০، إنا لله وإنا إليه راجعون، ولا اعلم لذلك مأخذا إلا الغلط الذي أوهمه كلام صارم!!
[5] দেখুন, ‘নাফায়েসুল বয়ান শরহু ফারাইদিল হিসান ফি আদাদি আয়িল কুরআন’, আব্দুল ফাত্তাহ আলকাযী (১৪০৩ হি.) পৃষ্ঠা ২৮, দারু ইবনিল জাওযী, বৈরুত, ১৪২৯ হি.
[6] ‘তারীখুল কুরআনে’র দ্বিতীয় মুদ্রণ অনুযায়ী যা ১৯৬৩ সালের। যার ফটোকপিকৃত নুসখা আলীগড় ইউনিভার্সিটি থেকে মৌলভী মুশতাক আহমদ সংগ্রহ করেছেন। ১৯৮২-এর নুসখায় ‘আকওয়ালে আম্মাহ’ তালিকার তৃতীয় ঘরে আছে।
[7] در اصل ان غیر ذمدار تقسیم ہزاری والوں نے یہاں منسوخ التلاوۃ ہی مراد لیا ہے، انہوں نے لکھا ہے:
شصت وشش زانست منسوخ از حساب + در عمل نہ در قرائت نہ کتاب
کسی اور نے کہا:
شصت وشش ازاں ہست منسوخ الکتاب + ختم شد واللہ اعلم بالصواب
پہلا شعر "آداب القرآن" اشرف عالم میں موجود ہے، اسی طرح مجہول المصنف ایک ورقی رسالہ "نظم خوش بیان" میں بھی، جو "مجموعۂ بست وسہ" میں مطبع مجیدی کانپور سے ذو الحجہ 1330 ھ مطابق ڈسمبر 1992م کو چھپا ہے، اس مجموعہ کا ایک نسخہ دار العلوم حسینیہ علماء بازار فینی کے کتب خانے میں موجود ہے، ہمارے شاگرد مولانا عبد اللہ استاذ مدرسۂ مذکور کے واسطے سے اس نادر نسخہ کی زیارت ہوئی۔
دوسرا شعر اسی مجموعہ کے ایک اور مجہول المصنف رسالے میں ہے، جس کا عنوان ہے: "تعداد سیپارہ وسورتہا و رکوع وسجود"۔
تو جب منسوخ سے انہوں نے منسوخ التلاوۃ ہی مراد لیا ہے تو اسے مجموعۂ عدد آیات میں شمار کرنے کا کیا معنی؟ جسے اللہ نے قرآن میں رکھا ہی نہیں وہ مجموعۂ عدد آیات میں کیسے آیا؟
پھرمنسوخ التلاوۃ کو 66 میں محدود کرنا کتنی بڑی جہالت ہے، وہ تو نورالانوار کا طالب علم بھی جانتا ہے، درج ذیل روایت بھی ملاحظہ فرمائیں:
أخرج عبد الله في زوائد >المسند< (21207): عن زر، قال: قال لي أبي بن كعب: كأين تقرأ سورة الأحزاب؟ أو كأين تعدها؟ قال: قلت له: ثلاثا وسبعين آية، فقال: قط، لقد رأيتها وإنما لتعادل سورة البقرة، ...، وراجع رقم 21206 أيضا من >المسند< ورواه آخرون منهم النسائي في >الكبرى< برقم 7112 ، قال ابن كثير في فاتحة تفسير سورة الأحزاب : >هذا إسناد حسن<. ويراجع النوع 47 من >الإتقان< للسيوطي.
تاریخ تدوین قرآن پر تصنیف کردہ بنگلہ کتاب میں صارم کے اتباع میں یہ تقسیم ہزاری لکھی گئی، لیکن اس میں "منسوخ: 66" کی جگہ لکھا ہے: "متفرقات: 66"، حالانکہ اس تقسیم کےباقی دس عنوان سے غیر متعلق آیات کم و بیش دو ہزار ہے، اس لئے اس تبديلی کی وجہ سے یہ غلط تقسیم صحیح نہیں ہوجائیگی۔
یہاں ضمنا یہ بات بھی عرض کر دوں کہ اس “مجموعہ بست و سہ” میں ایک رسالہ مقصود القاری بھی ہے جس کی طرف صارم نے ایک ایسی بات نسبت کر دی جو اس میں نہیں ہے۔ اس غلط پر اور فیروزآبادی کی بصائر ذوی التمییز میں مذکور تقسیم پر مختصر تبصرہ ان شاء اللہ تعالی مقالے کے اردو ایڈیشن میں ملے گا (عبد المالك)
[8] طلبۂکرام کی اطلاع کيلئے عرض ہے کہ قاری رحیم بخش پانی پتی رحمہ اللہ کی کتاب " ہدایات الرحیم فی آیات الکتاب الحکیم" میں مذکورہ تقسیم ہزاری کے بارے میں ایک فاحش تسامح ہواہے ،جس پر فصل فی التسامحات میں تبصرہ کیا گیا ہے ،قاری رحیم بخش رح کی يہ کتاب اور ان کے استاذ حضرت مولانا قاری فتح محمد رحمہ اللہ کی کتاب" سراج الغایات فی عد الآیات " کے نسخے بندہ کيلئے برادر عزیز مولانا ظہیر الدین بابر استاذ جامعۃ الرشید کراچی نےبھیجے ہيں، انہوں نے ان کا عکس دار العلوم کراچی کے کتب خانہ سے لیا ہے ،فجزاہ اللہ تعالی ۔
صارم کی بحث پر تبصرے کا کچھ حصہ مقالے کے اردو ایڈیشن میں ملے گا ان شاء اللہ تعالی۔