সাক্ষাৎকার : দাম্পত্য জীবন যেভাবে মধুর হয়
(হযরত মাওলানা কাজী মু‘তাসিম বিল্লাহ রাহ.-এর মুহতারামা সহধর্মিণীর সাক্ষাৎকার)
[জীবনের প্রতিটি ধাপে অবতরণের আগে আমরা প্রথমে ওই ধাপটি সম্পর্কে জানি এরপর কাজ শুরু করি। ব্যবসা করার আগে ব্যবসা শিখি। চাকুরী করার আগে পড়ালেখা করি। এটাই স্বাভাবিক ও স্বীকৃত নীতি। কিন্তু জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপÑ দাম্পত্য জীবন শুরু করি একেবারে অজ্ঞতা থেকে। বড় বড় ডিগ্রী থাকে কিন্তু দাম্পত্য জীবন মধুর হয় না। এর দৃষ্টান্ত মোটেও কম নয়। এর কারণ আমরা দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে আগে থেকে জানার চেষ্টা করি না। কীভাবে একজন আদর্শ স্বামী হব, আদর্শ স্ত্রী হব, আদর্শ পিতা-মাতা হব এসব জানার চেষ্টা করি না। স্বামী-স্ত্রী একে-অপরের প্রতি কীরূপ আচরণ কাম্য, বিয়ের পর নিজ পিতা-মাতা ও স্ত্রীর বিরোধ হলে কী করণীয়, পুত্রবধুর সাথে কীরূপ আচরণ হওয়া উচিত ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে ভাবি না। জানার চেষ্টা করি না। না বিয়ের আগে, না বিয়ের পরে। বিজ্ঞ কোনো মুুরুব্বী থেকেও এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা গ্রহণের প্রয়োজন অনুভূত হয় না। এতে দেখা যায়, বাহ্যিক অনেক পড়ালেখা থাকা সত্ত্বেও দাম্পত্য জীবন মধুর হয় না। ধীরে ধীরে তিক্ত হয়ে উঠে। যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।
আল্লামা কাজী মু‘তাসিম বিল্লাহ রাহ.। বাংলার স্বনামধন্য এক আলেম। তাঁর সহধর্মিণী আজো জীবিত। আল্লাহ পাক তাঁকে সুস্থতার সাথে দীর্ঘ হায়াত দান করুন। তিনি বিখ্যাত আলেম পরিবারের কন্যা। অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট বাংলা ভাষায় কথা বলেন।
মৌলবী আব্দুল হালীম। আমার ছাত্র। সুদীর্ঘ ১৪ বছর যাবৎ কাজী ছাহেব হুযুরের বাসার খেদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছে। তাকে একদিন বললাম, আমাদের আম্মা ছাহেবা একটি বিশাল সময় কাটিয়েছে কাজী ছাহেবের সাথে। তাঁর শিক্ষা-দীক্ষায় আলোকিত হয়েছেন। নিজেও জ্ঞান ও গুণে অতুলনীয় এক মহিয়সী। তাঁর নিকট থেকে দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে কিছু দিক-নির্দেশনা সংগ্রহ করো। আমি কিছু নমুনা প্রশ্নও তৈরি করে দিলাম। সে অনুযায়ী সময়ে সময়ে সে প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে আমাদের সকলের প্রিয় আম্মা ছাহেবা থেকে এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশনা সংগ্রহ করে। নিঃসন্দেহে নবীন-প্রবীণ সকলের জন্যই তা বেশ উপকারী হবে ইনশাআল্লাহ। সাক্ষাৎকারটি কলমে আসার পর আম্মা ছাহেবা দেখে দিয়েছেন। দুআ করি, মেহেরবান আল্লাহ আমাদের মধ্যে এই ছায়াটি আরো দীর্ঘায়িত করুন। Ñআব্দুল্লাহ মাসুম, মালিবাগ জামিয়া]
■ সন্তানকে মানুষ করার জন্য কিছু দিক-নির্দেশনা প্রদান করুন?
■■ সন্তানকে মানুষ করার সঠিক দিক-নির্দেশনা তো সে-ই দিতে পারে, ইসলামের সঠিক ও পূর্ণ জ্ঞান যার রয়েছে। এ ব্যাপারে আমার তো কোনো জ্ঞানই নেই।
তবে সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে আমি যা বুঝিÑ
ক. সন্তান হবে মাতা-পিতার ¯েœহ মমতার কেন্দ্রবিন্দু। সন্তানকে তারা গভীর ¯েœহ ও মমতা নিয়ে লালন-পালন করবে। সন্তানের ইচ্ছা ও আবেগ-অনুভূতির মর্যাদা দেবে। তাদেরকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করবে। এমন ব্যবহার করবে না, যার ফলে তাদের মন ভেঙ্গে যায়। তাদের আত্মসম্মান ও অহংবোধে আঘাত লাগে। অবোধ শিশু এমন অনেক কিছুই করে, যা মাতা-পিতার পছন্দ নয়। তাই বলে এ কারণে তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। আদরের সাথে বুঝিয়ে দিতে হবে। শিশু তো শিশুসুলভ আচরণ করবেÑ এটাই স্বাভাবিক। বাড়ির মূল্যবান আসবাব-পত্রের হয়তো ক্ষতি করবে। কখনো কথা শুনবে না । তাই বলে এ কারণে শিশুর সাথে কোনোক্রমেই কষ্টদায়ক আচরণ করা যাবে না। শিশুকে অমূলক কোনো ভয় দেখানো, মিথ্যে প্রতিশ্রুতি প্রদানÑ এসব করা যাবে না।
খ. শিশু-সন্তানকে ভাল কাজে উৎসাহ দিতে হবে। এতে তার মধ্যে কর্মের স্পৃহা জাগবে। শিশুর সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না।
গ. আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পিতা-মাতা সন্তানের সামনে পরস্পরে ঝগড়া-কলহ করবে না। সন্তানরা পিতা-মাতার এ আচরণ দেখলে নিষ্ঠুর ও কলহপ্রিয় হবে।
ঘ. শিশুর প্রতি রহমদিল হতে হবে। তাহলে শিশুও বড় হয়ে ন¤্র স্বভাবের হবে। আমরা অন্য মায়ের সন্তানকে আদর-স্নেহ করি। অন্যের সন্তানকে অযতেœ-অনাহারে দেখলে হৃদয়-মন ব্যথিত হয়। আপন সন্তানের ক্ষেত্রেও এমনটি হওয়া চাই। বরং এর চেয়েও বেশী কাম্য। এটিই স্বাভাবিক বিষয়।
ঙ. মনে রাখতে হবে পিতা-মাতাই হল সন্তানের সবচে’ পরম বন্ধু। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়তে হবে। সন্তান যেন বুঝেÑ পিতা-মাতাই তার সবচেয়ে বড় হিতাকাক্সক্ষী, সবচেয়ে বড় বন্ধু। সন্তানের সাথে পিতা-মাতার বন্ধুত্বের সম্পর্ক এমন হওয়া উচিত যেন সন্তান অন্য বন্ধুদের মতামতের উপর পিতা-মাতার মতামতকে প্রাধান্য দেয়। সুখে-দুঃখে সব বিষয়ে পিতা-মাতাকে বন্ধু মনে করেই যেন সন্তান পরামর্শ করে। অপর দিকে পিতা-মাতাও নিজেদের সারা জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে পরামর্শ দিয়ে তাদের এ মানিককে বড় মহীরুহ করে তুলবে। বিশ্বের মানচিত্রে তাকে গ্রহণীয় ও বরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। তাক্বওয়া তথা খোদাভীতির গুণেও সে হবে সবার উপরে।
চ. আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, সর্বদা সন্তানের সামনে গুরু-গম্ভীর হয়ে থাকা, অত্যধিক কাঠিন্য, সর্ববিষয়ে চাপা-চাপি করা কোনটিই আমার কাছে পছন্দনীয় নয়। অন্যের সন্তানের অপরাধ ক্ষমা করলেও আমার সন্তানের ক্ষেত্রে আমি হেকমতের আচরণ করি না? এ কারণেই অনেক সময় সে মাতা-পিতার আদর-সোহাগ, চির নন্দিত কোল বর্জন করে, সমাজের নিচু, ইতর ও চরিত্রহীন বন্ধুদের আশ্রয় নিয়ে নিজের জীবনের অশুভ পরিণাম বয়ে আনে। এর দায়ভার কে বহন করবে? তবে এক্ষেত্রে মাতা-পিতা উভয়কে ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অতি কঠোর হওয়া যাবে না। আবার অতি দয়াবানও হওয়া যাবে না। দুটিই সন্তানের জন্য ক্ষতি। মাঝামাঝি আচরণ করতে হবে। কখনো কঠিন, কখনো সহজ। অথবা অবস্থা ভেদে একজন কঠোর ও আরেকজন উদার হলেও বিশেষ সুফল আশা করা যায়।
ছ. সন্তানের জন্য পর্যাপ্ত সময়ও দিতে হবে। তাদের থেকে ততটুকুই সফলতা আশা করা যায়, যতটুকু সময় তাদের পিছনে ব্যয় করা হবে। প্রাইভেট টিচার তথা শুধু গৃহশিক্ষকের হাতে ছেড়ে দিয়ে সন্তানকে আদর্শবান বানানোর চিন্তা বোকামী বৈ কিছুই নয়।
■ পুত্রবধুর সাথে শ্বশুর-শাশুড়ীর আচার-ব্যবহার কীরূপ হওয়া কাম্য? অনেক সময় দেখা যায়, শাশুড়ী ও পুত্রবধুর মধ্যে টানাপোড়েন ও ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হয়। এজাতীয় কলহ-বিবাদ কীভাবে নিরসন করা যায়?
■■ পুত্রবধুর সাথেও শ্বশুর-শাশুড়ীর সম্পর্ক হবে পিতা-মাতা ও বন্ধু-বান্ধবের মতো। তাকে ঘরের সেবিকা মনে করা যাবে না। আপন মেয়ের মতই মনে করতে হবে। সে তো আমার ঘরের বউ। বউয়ের সাজেই থাকবে। উন্নত কাপড়, গয়না-গাটি দিয়ে পরিপাটি হয়ে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নরূপে, সেজে-গুজে বউ হয়েই থাকবে। সে অন্যের মেয়ে বটে কিন্তু স্বীয় ছেলের বউ তো, সুশীল মানুষেরা পুত্রবধুর সর্বাঙ্গীন উন্নতির চিন্তা না করে থাকতে পারেন না।
আমি আমার বউদের সাজ-গোজকে খুব পছন্দ করি। তাদেরকে আমি নিজের মেয়ের চেয়েও বেশী মুহাব্বত করি। মেয়ে তো সর্বদা কাছে থাকতে পারে না। আর এ আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী। সর্বদা আমাকে সঙ্গ দেয়। কাছে থাকে, খেদমত করে। সর্বোপরি সব আপন ভুলে সে আমাদেরকে আপন বানিয়েছে। তার সাথেও আপনের আচরণ করাই ইনসাফের দাবি। তার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি খেয়াল রাখা কাম্য। বৈধ ও সঙ্গত আবদার রক্ষা করাও উচিত। সব কাজে ভুল ধরা, গালি-গালাজ ও মারধর করে দাজ্জাল শ্বশুর-শাশুড়ীর পরিচয় দেওয়া মোটেও কাম্য নয়।
আমাদের বোঝা উচিত, পুত্রবধু তো শাশুড়ীর কাছেই যাবতীয় কাজ শিখবে। করতে না পারা, কাজে ভুল হওয়া এ তো শাশুড়ীরই ব্যর্থতা। তার অদক্ষতার জন্য কটূক্তি করা নির্বুদ্ধিতা।
■ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক কেমন হলে সংসারে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? দাম্পত্য জীবন হতে পারে মধুর!
■■ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কীরূপ হওয়া উচিত, তোমরা কুরআন হাদীস পড়ে আমার চেয়ে ভালো জেনেছো। এ ক্ষেত্রে আমি যা বুঝিÑ
ক. স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য শোভাস্বরূপ। একে অপরের মুখাপেক্ষী। একান্তই মুখাপেক্ষী। এটা শুধু দৈহিক প্রয়োজন পূরণের জন্যেই নয়। সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজনে স্ত্রী তার স্বামীর, আর স্বামী তার স্ত্রীর মুখাপেক্ষী হয়। স্বামী অসুস্থ হলে স্ত্রীর চেয়ে বেশী খেদমত কেউ করতে পারে না। তাই তো আশি বছরের বুড়োও স্ত্রী মারা গেলে আবার বিয়ে করতে চায়।
খ. স্বামীকে আনন্দিত ও প্রফুল্ল রাখার দায়িত্ব তার স্ত্রীর। স্বামী বেচারা বাহিরের কাজ করে ঘরে আসে স্ত্রীর কাছে প্রশান্তি লাভের জন্য। তাই প্রিয়তম স্বামীর মেজায বুঝে ঘরে প্রবেশের পুর্বেই স্ত্রী প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুত করে রাখবে। ঘরের কোনো কাজ অসম্পূর্ণ না রাখা। যতক্ষণ স্বামী ঘরে থাকবেন, ছায়ার মতো তাকে সঙ্গ দেওয়া। যাবতীয় প্রয়োজনে এগিয়ে আসা।
গ. স¦ামীকে ছাড়া একাকী বাপের বাড়িতে আনন্দ করতে অভ্যস্ত না হওয়া। আবার স্বামীর সুবিধা মতো চলে আসতে আপত্তি না তোলা। একান্তই মাতা-পিতাকে দেখতে মন চাইলে দু’জনেই যাবে। স¦ামী ছাড়া স্ত্রীর আনন্দ তো পূর্ণ হওয়ার মতো নয়।
ঘ. স্বামীর ইশারায় কাজে অভ্যস্ত হওয়া। তাহলে স্বামীও মন উজাড় করে প্রিয়তমাকে মুহাব্বত করবে, ভালবাসবে। আসলে স্ত্রীর গুণেই সংসার সুখের হয়। অনেক সময় স্ত্রীই সংসার ধ্বংসের কারণ হয়।
ঙ. স্বামীর সম্পদে স্ত্রীর মিতব্যয়ী হওয়া উচিত। তার অনুমতি ছাড়া সম্পদে হাত না দেওয়া। পর্দার ব্যাপারে যতœবান হওয়া।
চ. স্বামীর সাথে কথায় কথায় ঝগড়া করবে না। বর্তমান সময়ের বহু মেয়ে বড় নির্লজ্জ ও বেহায়া। স্বামীর সাথে কথায় কথায় ঝগড়া করে। মুখের উপর তর্ক করে। স্বামী রেগে কিছু বকা-ঝকা করলেও তো তার চুপ থাকা উচিত। মেজায ঠা-া হলে প্রকৃত ব্যাপারটি স্পষ্ট করবে।
আগেকার মহিলাগণ গরীব ও কম শিক্ষিত হলেও আদব কায়েদা যথেষ্ট ছিল। ঝগড়া-ফাসাদ তো দূরের কথা, প্রসঙ্গক্রমেও স্বামীর নাম ধরে ডাকতে ইতস্তত করত। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতো, সহ্য করত কিন্তু স্বামীর নামে অভিযোগ করাই বুঝতো না। করার প্রয়োজনও মনে করতো না।
ছ. স্বামীর কাছে অযথা অথবা অসঙ্গত বাহানা না করা। এটা দাও, ওটা দাও। এখানে নিয়ে যাও, ঐখানে নিয়ে যাও ইত্যাদি বাহানা। এসব অসঙ্গত অবুঝের।
জ. অপরদিকে স্বামী স্ত্রীর প্রতি জুলুম করবে না। সুযোগ হলে, সম্ভব হলে স্ত্রীর সকল বৈধ আবদার পুরো করবে। কোনো পুরুষই অন্তর থেকে এটা চায় না যে, তার স্ত্রী-সন্তÍান কষ্ট করুক।
আলহামদু লিল্লাহ, তোমার হুযুরের সাথে আমার কখনো বড় ধরনের ঝগড়া-ফাসাদ হয়নি। সন্তানদের পড়া-লেখার বিষয়ে কখনো বকা-ঝকা করেছেন। তখন চোখ তুলে তাকানো তো দূরের কথা, সামনে দাঁড়ানোরই সাহস পেতাম না। তিনিও অত্যধিক মুহাব্বত করতেন। তাঁর আন্তরিক মুহাব্বত ও ভালবাসা আমাদের সংসারকে টিকিয়ে রেখেছে। নইলে এ সংসার করা আমার জন্য কষ্টের হয়ে যেত।
আমি ছিলাম আদরের দুলালি, ননির পুতুল। দালান-কোঠায় থেকেছি, গোশত- পোলাও খেয়েছি, আনন্দে-আহ্লাদে বেড়ে উঠেছি। ছাদহীন কুঁড়ে ঘরে থাকি কী করে? গোশত-পোলাও-এর পরিবর্তে ভাত-ভর্তাও জুটতো না অনেক সময়। সিদ্ধ কদু, তাই ভরতে হত জঠরে।
লোকটির হৃদয় ছিল মুহাব্বতে ভরপুর। দেহটি ছিল ইলমে ওহীর সাজে সজ্জিত। তার আখলাক-চরিত্রে আমি ছিলাম পূর্ণ মুগ্ধ। তাই দরিদ্রতার মাঝেও অনাবিল শান্তি অনুভব করেছি। আসলে স্ত্রীর জন্যে স্বামীর আদর সোহাগের মাঝেই রয়েছে একমাত্র প্রশান্তি। হযরত খাদিজাতুল কুবরা রা. অঢেল ধন-সম্পদের অধিকারী ছিলেন। স্বামী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর ¯েœহ ও তাঁর মুহাব্বত তাকে সম্পদের মায়া ছাড়তে বাধ্য করেছে। (পাঠকগণের অবগতির জন্য বলছি, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই পবিত্র জীবন সঙ্গিনীর নামেই আমাদের আম্মাজানের নামটি। নামের সাথে আখলাকেরও কী অপূর্ব মিল! বিয়ের পর আম্মাজানের শ্বশুর কাজী সাহেব হুযুর রাহ.-এর আব্বা, হুযুরকে বলেছিলেনÑ তোমার জন্য আমি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবন সঙ্গিনীর নামের গুণবতী জীবন সঙ্গিনী এনেছি। আমরাও কাজী সাহেব হুযুর রাহ.-এর থেকে বারবার এ কথা শুনেছি যে, আমার দ্বীনের খেদমতের ক্ষেত্রে তোমাদের আম্মাজানের অবদান অনস্বীকার্য। পিতার অঢেল ধন-সম্পদ স্বামীর হাতে দ্বীনের পথে ব্যয় করেছেন। দ্বীনের খেদমতে স্বামীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। আজ আমার অন্তিমকালে তাদেরকে অসহায় অবস্থায় রেখে যাচ্ছি। মহান আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে গেলাম। Ñআব্দুল হালীম।)
ঞ. অনেক মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর সাথে বা স্বামীর পরিবারের সাথে নিজ পিতার সম্পদের বড়াই করে। মূলত পিতার সম্পদে মেয়ের বড়াইয়ের কিছু নেই। স্বামীর মন জয় করতে পারাই হল মেয়ের আনন্দ। এটাই তার বড় সফলতা। তোমার হুযুরের বড় আলেম হওয়া, ইসলাম সম্পর্কে তার সঠিক জ্ঞান থাকাটাই আমার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সম্পদ মনে হত ।
■ সার্বিকভাবে একটি উত্তম পরিবার গঠনের ও সংসার জীবন মধুর করার ব্যাপারে আপনার সুচিন্তিত নির্দেশনা ও অভিজ্ঞতা জানলে উপকৃত হবো।
■■ একটি পরিবার সুশৃংখল ও সুষ্ঠু হওয়া খুবই জরুরি। পরিবারের প্রতিটি সদস্য যদি অপর সদস্যের হক্বের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়, যতœবান থাকে তাহলে বিষয়টি সহজ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকাটি অগ্রগণ্য। স্ত্রীর সংসারকে একান্তই আপন মনে করতে হবে। যাবতীয় কার্যাবলীকে আপন মনে করেই হাসি মুখে করে ফেলবে। স্বামীও মনে করবে ওরা আমারই উপকারের জন্য। তাই তাদের সুখ ও আনন্দের দিকটি আমাকেই বিবেচনায় রাখতে হবে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ভুল বুঝবে না। সন্দেহও করবে না। হাঁ, শরীয়ত যেন লঙ্ঘন না হয়Ñ এ ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকবে। স্ত্রী স্বামীর উপার্জনের ব্যাপারটি গভীর পর্যবেক্ষণ করবে। উপার্জন অনুপাতেই খরচ করবে। জীবনে কঠিন ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। অনেক মেয়ে অল্পতে ধৈর্যহীন হয়ে যায়। এটি পরিহার করতে হবে।
■ কন্যা সন্তানদেরকে তালীম-তরবিয়ত প্রদানের সঠিক পন্থা কী? কাজী সাহেব রাহ. কী পন্থা অবলম্বন করতেন?
■■ আমাদের তো একটিই মেয়ে ছিল। স¦ভাবতই আলেমা বানানোর ইচ্ছা জাগলো। তোমার হুযুর এ ব্যাপারে উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা তাজাম্মুল আলী রাহ.-এর কাছে পরামর্শ চাইলেন। সর্বশেষ মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দা.বা.-এর কাছে দেশীয় মহিলা মাদরাসাগুলোর হাল-চালও (কাজী ছাহেব হুযুর রাহ. শেষ জীবনে আমাদেরকে বলতেন, বর্তমান প্রচলিত মহিলা মাদরাসাগুলোর পঠন-পাঠন নীতিতে যথেষ্ট পরিবর্তন সাধন করা উচিত। এ পরিবর্তন ইনশাআল্লাহ মাদরাসাগুলোকে শরীয়ত পালনে বলিষ্ঠ সহযোগিতা করবে। Ñআব্দুল হালীম) জিজ্ঞেস করে আমাকে বললেন, তোমাকেই আমার মেয়ের পড়াশোনার যিম¥াদারি নিতে হবে। তাই আমি কিছু পড়িয়েছি। গৃহশিক্ষকও কিছু সময় পড়াত। তোমার হুযুরও বেশ সময় দিতেন। মেয়েটির যতটুকু পড়াশোনা, তা এভাবেই হয়েছে।
■ একান্নভুক্ত পরিবারে থাকতে গেলে দেখা যায় বিভিন্ন সমস্যা হয়। একদিকে মা, বোন, ভাই আবার স্ত্রী সন্তান। একজনের সাথে ভাল আচরণ করতে গেলে অন্যজন কষ্ট পায়। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য কীভাবে বজায় রাখা যায়?
■■ আসলে তোমার হুযুরের ছোটবেলায় তাঁর আম্মা ইন্তেকাল করেন। তাঁর আব্বা পরবর্তিতে বিয়ে করেন। আমার শ্বাশুড়ি আমাকে তার একান্ত বান্ধবীর মতো মনে করতেন। তারঁ সন্তানেরা তোমার হুযুরের কাছে, তাঁর তত্বাবধানে থেকে পড়াশোনা করার কারণে তাঁকে উস্তাযের মতই তাঁর সৎ মা শ্রদ্ধা ও মুহাব্বত করতেন। তো আমার জানা মতে আমাদের সংসারে তোমার উত্থাপিত বিষয়ের মতো ইতিহাস রচিত হয়নি। হলেও আমরা বিষয়টি এভাবে চিন্তা করিনি। আমাদের জীবনের বড় একটি সময় একান্নভুক্ত পরিবারে থেকেই কাটিয়েছি। সামর্থ্য হওয়ার পর আলাদা সংসার গড়েছি। (কাজী ছাহেব হুযুর রাহ. আমাদেরকে এক্ষেত্রে যে পরামর্শটি দিয়েছেন, তা হল, স্ত্রীকে মন উজার করে ভালবাসবে, মুহাব্বত করবে। তার প্রয়োজনীয় সবকিছু অত্যন্ত যতেœর সাথে গুরুত্ব দিয়ে পুরা করার চেষ্টা করবে। তাহলে স্ত্রী প্রিয়তম স্বামীকে শ্রদ্ধা করবে, মুহাব্বত করবে। স্বামীর নিকটতমদের রূঢ় ব্যবহারকেও সহ্য করে নেবে। একেবারে ভেঙ্গে পড়বে না। তবে ভাল করে খেয়াল রাখবে, স্ত্রীর মনোতুষ্টির জন্য কোনো অবস্থাতেই যেন পিতা-মাতা, ভাই-বোনের সাথে অসঙ্গত আচরণ না হয়। আবার মাতা-পিতা ও ভাই-বোনের সন্তুষ্টির জন্য স্ত্রীর সাথেও অন্যায় আচরণ করা যাবে না। স্বামীকে বলিষ্ঠ সচেতনতা ও বুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে। মাথা ঠা-া রেখে ধৈর্যের সাথে এ ধরনের অবস্থা সামাল দিতে হবে। তবেই একটি ভারসম্যপূর্ণ পরিবার গঠন সম্ভবপর হবে। Ñআব্দুল হালীম)
■ কখনো দেখা যায়, মা স্ত্রীকে বকল। এখন স্ত্রীর পক্ষ নিলে মা কষ্ট পায়। আবার মার পক্ষ নিলে স্ত্রী কষ্ট পায়। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
■■ তোমাদেরকে আল্লাহ তাআলা দ্বীনী জ্ঞান দিয়েছেন। সে অনুসারে যেভাবে চললে কেউ কষ্ট না পায় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। হাঁ, আমাদের ক্ষেত্রেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল কখনো কখনো। হুযুর (কাজী ছাহেব হুযুর রাহ.) তখন চুপ থাকতেন। ভাবটি এমন যেন তিনি কিছুই শুনেননি, বুঝেননি। পূর্বের মতো সবার সাথে স্বাভাবিক আচার-ব্যবহার করতেন।
■ এখন দেখা যায় অনেকেই একান্নভুক্ত পরিবার থেকে বের হয়ে আসতে চায়। এ ব্যাপারটি কীভাবে দেখেন?
■■ এ ক্ষেত্রে তোমার হুযুর (কাজী ছাহেব রাহ.) বলতেন, বাস্তবেই যদি কোনো পরিবার এমন হয় যে, একত্রে থাকলে শরীয়ত লঙ্ঘন হয়, পর্দার বিধান লঙ্ঘিত হয়। অথবা একত্রে থাকলে কোনো সদস্যের আর্থিক বা সাংসারিক উন্নতি বিঘিœত হয়। তাহলে পরিবারের কর্তার কর্তব্য হল, তাকে পৃথক করে দেওয়া। এক্ষেত্রে শুধু কর্তার নিজের উন্নতির দিকটি বিবেচনা রাখা কাম্য নয়। আল্লাহর উপর ভরসা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আরেকটু এগিয়ে বললে বলা যায়, কোনো একান্নভুক্ত পরিবারের পারিবারিক কোন্দল যদি সদস্যদের পৃথক হয়ে যাওয়ার দ্বারা নিরসন হয় তাহলে পৃথক হয়ে যাওয়াই শ্রেয়।
■ আপনার বক্তব্য থেকে এই তিনটি বিষয় উঠে এসেছে, এর পরও ভিন্নভাবে নিজের ফায়েদার জন্য জানতে চাই তা হল, আদর্শ স্বামী হওয়ার জন্য কী কী গুণ থাকা চাই?
■■ আদর্শ স্বামী তো সে-ই হতে পারে যে স্বীয় স্ত্রীকে একান্ত করে মুহাব্বত করবে। শরীয়তের গ-িতে থেকে ফুলের মতো সাজিয়ে স্ত্রীর হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা লাভ করবে। স্ত্রীর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হয়ে থাকবে।
■ আদর্শ স্ত্রী হওয়ার জন্য কী কী গুণ থাকা চাই?
■■ যার দক্ষ কারিগরিতায় স্বামী, তার ভাই-বোন, শ্বশুর-শাশুড়ী ও অন্যান্য আত্বীয়-স্বজনদের মাঝে মুহাব্বতের একটি শক্তিশালী বন্ধন সৃষ্টি হবে। যার বিজ্ঞ পরিচালনায় স্বামীর সংসার হবে একটি সোনালি সংসার। যার সান্নিধ্যে আল্লাহ-ভোলা স্বামীও ইবাদতের অনুপ্রেরণা পাবে। যে হবে হযরত বিবি হাজেরা আ.-এর মতো আল্লাহর হুকুমের পূর্ণ অনুগত বান্দি। যাকে স্বামী ইব্রাহীম আ. বিভীষিকাময় নির্জন জনমানবহীন প্রান্তরে সম্পূর্ণ রিক্ত হস্তে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন। আর তিনি আল্লাহর হুকুমের কথা শুনে অত্যন্ত প্রশান্ত মনে জবাব দিলেন, যে মালিক আপনাকে চলে যাওয়ার নির্দেশ করেছেন তিনিই আমাকে হেফাজত করবেন। তাও এমতাবস্থায় যে দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিল তার কোলে। যে হবে উম্মুল মুমিনীন খাদিজা রা.-এর মতো মহিয়ষী নারী। ইসলামের মুহাব্বতে সারা জীবনের সঞ্চিত ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। স্বামীকে দ্বীন প্রচারে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। এমন মহিলাই হতে পারে সমাজের একজন আদর্শ মহিলা। একজন আদর্শ স্ত্রী।
■ আদর্শ পিতা-মাতা হওয়ার জন্য কী কী গুণ থাকা চাই?
■■ সন্তান মানুষ হবে, আদর্শবান হবে, সৎ হবে। এমন চিন্তা ও পেরেশানীতে যে বাবা-মা অস্থির থাকে, চোখের নোনাজল বিসর্জন দেয় তারাই আদর্শ বাবা-মা। নিজেদের প্রিয় মানিককে মহিরুহ করে গড়তে প্রানান্তকর চেষ্টা করে এমন পিতা-মাতাই আদর্শ পিতা-মাতা।
নাহ! আর পারছি না। খুবই অসুস্থ, তোমাদের কাছে খাতেমা বিল খায়েরের দুআ চাই। পরকালে তোমার হুযুরকে পেতে চাই। সকলের কাছে অনুরোধ রইল, দুআ করবে, আল্লাহ যেন আমার গুনাহগুলো মাফ করে দেন।
■ আপনাকে অনেক-অনেক শুকরিয়া। আল্লাহ তাআলা আপনাকে সিহ্হাতের সাথে দীর্ঘ হায়াত দান করুন। আমীন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : আব্দুল হালীম