Shaban-Ramadan 1437   ||   May-June 2016

আল্লাহর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা এবং মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা

আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী আলআযহারী

هُوَ الَّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَه بِالْهُدٰی وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَه عَلَی الدِّیْنِ كُلِّه وَ لَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ.

তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়েত সত্য দ্বীনসহ, সকল দ্বীনের উপর তা বিজয়ী করার জন্য, যদিও মুশরিকগণ তা অপসন্দ করে। Ñসূরা সফ (৬১) : ০৯

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য এবং তাঁর নবুওতী জীবনের সাফল্য কিসেÑ তা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহর যমিনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ম-িত করা, সর্বপ্রকার বিকৃত ধর্ম, মানবরচিত মতবাদ বা বাতিল মতাদর্শকে পরাভূত করা, এটাই নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য। এবং যারা আল্লাহর সাথে অন্যান্য সত্তাকে শরীক করতে অভ্যস্ত তাদের নাক সিটকানো, বাধা দানকে উপেক্ষা করেই তাঁকে মিশন পূর্ণ করতে হবে।

নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ তেইশ বছরের নবুওতী জীবনে সে মিশন সফলভাবে পূর্ণ করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের কয়েকমাস আগে পূর্বে এই আয়াত নাযিল হয়েছেÑ

اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا.

আজকের দিন আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিয়েছি। তোমাদেরকে প্রদত্ত আমার নিয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীনরূপে মনোনীত করেছি। Ñসূরা মায়িদাহ (০৫) : ০৪

এই ধর্মে কোনো অপূর্ণতা নেই। কোনো ফাঁক-ফোকর নেই। তাই একজন মুসলমানকে প্রতিটি কাজ তার দ্বীনের আলোকে, কুরআনের দিকনির্দেশনার আলোকে, নবীর সুন্নাতের আলোকে সম্পন্ন করতে হয়। জন্যেই তো আল্লাহ তাআলার নির্দেশÑ

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا ادْخُلُوْا فِی السِّلْمِ كَآفَّةً ۪ وَّ لَا تَتَّبِعُوْا خُطُوٰتِ الشَّیْطٰنِ ؕ اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ.

ওহে যারা ঈমান এনেছ (শোন)! ইসলামে প্রবেশ কর পুরোপুরিভাবে। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। Ñসূরা বাকারা (০২) : ২০৮

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দাওয়াতের কাজ শুরু করেছিলেন তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্বের আহ্বান দিয়ে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে তাঁর সত্তায় বা গুণাবলীতে শরীক করা যাবে না। তাঁর দাওয়াতের কালিমাটি ছিলÑ

لا إله إلا الله محمد رسول الله

আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।

আল্লাহর মাহাত্ম্য জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর মিশনের এক গুরুত্বপূর্ণ কথা। তাই মানুষের অন্তরে বিরাজিত অসার প্রভুর মিথ্যা প্রভুত্বকে ঝেড়ে মুছে ফেলে দিয়ে এক আল্লাহর আধিপত্যের ধারণাকে মানুষের মনে-প্রাণে বদ্ধমূল করে দেয়া এবং তাঁরই পসন্দসই জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর দাওয়াতের এক উল্লেখযোগ্য অংশ। তাই আলকুরআন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছে :

اَلَّذِیْنَ یَتَّبِعُوْنَ الرَّسُوْلَ النَّبِیَّ الْاُمِّیَّ الَّذِیْ یَجِدُوْنَهٗ مَكْتُوْبًا عِنْدَهُمْ فِی التَّوْرٰىةِ وَ الْاِنْجِیْلِ،  یَاْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوْفِ وَ یَنْهٰىهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ ، وَ یُحِلُّ لَهُمُ الطَّیِّبٰتِ وَ یُحَرِّمُ عَلَیْهِمُ الْخَبٰٓىِٕثَ وَ یَضَعُ عَنْهُمْ اِصْرَهُمْ وَ الْاَغْلٰلَ الَّتِیْ كَانَتْ عَلَیْهِمْ.

যারা সেই উম্মী নবীর আনুগত্য করে, যার কথা তারা তাদের কাছে রক্ষিত তওরাতে ইনজীলে লিখিত পায়। তিনি তাদেরকে সৎকাজের আদেশ করেন, মন্দকাজ থেকে বারণ করেন। পবিত্র বস্তুসমূহকে তাদের জন্যে হালাল করেন এবং নোংরা বস্তুসমূহ তাদের জন্যে হারাম করে দেন। আর তাদের উপর যে বোঝা শৃঙ্খল ছিল তা থেকে তাদেরকে মুক্ত করেন... Ñসূরা রাফ () : ১৫৭

কী ছিল সেই বোঝা শৃঙ্খলগুলো? তাদের পূর্ববর্তী বিকৃত দ্বীন জীবন ব্যবস্থা, যা তাদের জীবনকে দুর্বিসহ সংকীর্ণ করে তুলেছিল। সেখানে আল্লাহর প্রভুত্বের স্থলে প্রতিষ্ঠিত ছিল মানুষেরই প্রতিষ্ঠিত বিধি-বিধানÑ যা কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও দলতন্ত্র, কোথাও গোষ্ঠীতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল।

ইসলামের নবী এসে ঘোষণা করলেন, আল্লাহ ছাড়া আর কারো বিধান, কারো জারিজুরি তাঁর বান্দাদের উপর চলবে না।

اِنِ الْحُكْمُ اِلَّا لِلهِ ؕ یَقُصُّ الْحَقَّ وَ هُوَ خَیْرُ الْفٰصِلِیْنَ.

হুকুম একমাত্র আল্লাহর। তিনিই যথার্থ বর্ণনা দেন এবং তিনিই উত্তম ফয়সালাকারী বা সিদ্ধান্তদাতা। Ñসূরা আনআম (০৬) : ৫৭

বলাবাহুল্য, ¯্রষ্টা নিজে যেহেতু তাঁর বান্দাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাই পক্ষপাতহীন ন্যায্য ফয়সালা, সিদ্ধান্ত, আইন একমাত্র তিনিই দিতে পারেন। অন্য কেউ যে ফয়সালা বা আইন দেবে, তা অবশ্য অবশ্যই তার নিজের স্বার্থেই দেবে। ফলে অন্যরা বঞ্চিত হবে। যদি কোনো বিশেষ শ্রেণী বা গোষ্ঠী আইন রচনা করে, তবে তারা তাদের স্বার্থেই সে আইন করবে। তাদের গোষ্ঠী বহির্ভূতরা ন্যায় থেকে বঞ্চিত হবে। এজন্যে আল্লাহ অধিকারটা অন্য কারো হাতেই ছেড়ে দেননি। তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করে দিয়েছেনÑ

اِنَّ رَبَّكُمُ اللهُ الَّذِیْ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ فِیْ سِتَّةِ اَیَّامٍ ثُمَّ اسْتَوٰی عَلَی الْعَرْشِ ۫ یُغْشِی الَّیْلَ النَّهَارَ یَطْلُبُهٗ حَثِیْثًا ۙ وَّ الشَّمْسَ وَ الْقَمَرَ وَ النُّجُوْمَ مُسَخَّرٰتٍۭ بِاَمْرِهٖ ؕ اَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَ الْاَمْرُ ؕ تَبٰرَكَ اللهُ رَبُّ الْعٰلَمِیْنَ.

তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। যিনি আকাশম-লী পৃথিবী ছয়দিনে সৃষ্টি করেন। তারপর তিনি আরশে ইসতিওয়া করেছেন। তিনিই দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন, যাতে ওদের একে অন্যকে দ্রুত গতিতে অনুসরণ করে। আর সূর্য, চন্দ্র নক্ষত্ররাজি যা তাঁরই আজ্ঞাধীন তা তিনিই সৃষ্টি করেছেন। জেনে রেখো, সৃজন তাঁর এবং আদেশও তাঁরই। মহিমাময় বিশ্বজগতের প্রতিপালক। Ñসূরা রাফ (০৭) : ৫৪

সুতরাং তিনি কেবল মানব-দানবেরই নয়, সকল সৃষ্টিকুলের ¯্রষ্টা নিয়ন্তা। তাই আইন বা হুকুমও চলবে একমাত্র তাঁরই। অন্য কোনো সৃষ্টির আল্লাহর বান্দাদের উপর ছড়ি ঘুরাবার অধিকার নেই।

এতসব যুক্তি প্রমাণের পরও যারা কথাটি মানতে রাজী নয়, নিজেদেরই সর্দারী মুখতারী-স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যেতে চায় তাদের প্রতি উচ্চারিত হয়েছে কঠোর শ্লেষাত্মক বাণীÑ

اَفَحُكْمَ الْجَاهِلِیَّةِ یَبْغُوْنَ ؕ وَ مَنْ اَحْسَنُ مِنَ اللّٰهِ حُكْمًا لِّقَوْمٍ یُّوْقِنُوْنَ.

তবে কি ওরা জাহিলী বিধি-বিধান কামনা করে? বিশ্বাসী মুমিনদের জন্যে বিধান দানে আল্লাহ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতর? Ñসূরা মায়িদা (০৫) : ৫০

এমন কি আল্লাহ তাঁর নবী রাসূলগণকেও অধিকারটি দেননি যে, তাঁরা তাঁদের ইচ্ছেমত মর্জিমত আইন রচনা করে উম্মতের উপর, মানবজাতির উপর চাপিয়ে দেবেন।

কথাটিই আল্লাহ বলেছেন এভাবে :

مَا كَانَ لِبَشَرٍ اَنْ یُّؤْتِیَهُ اللهُ الْكِتٰبَ وَ الْحُكْمَ وَ النُّبُوَّةَ ثُمَّ یَقُوْلَ لِلنَّاسِ كُوْنُوْا عِبَادًا لِّیْ مِنْ دُوْنِ اللهِ.

কোনো মানুষেরই অধিকার নেই যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমত নবুওত দান করবেন তারপরও সে লোকজনকে বলবে, তোমরা আল্লাহকে (অর্থাৎ তার অবতারিত বিধানকে) বাদ দিয়ে আমার বান্দা হয়ে যাও (আমার মতেরই অনুসরণ কর, আমার আইনকেই আইন জ্ঞান কর।) Ñসূরা আলে ইমরান (০৩) : ৭৯

নিজের মনগড়া আইন মানতে লোককে বাধ্য করা মানে যে তাদেরকে নিজের দাসত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করা, আর যারা তা এভাবে চোখকান বুঁজে মেনে নেয়, সে তাদের মাবূদ বা উপাস্য হয়ে বসে। সে আলোচনায় আমরা পরে আসছি। সূরা মায়িদার ৪৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেনÑ

وَ اَنِ احْكُمْ بَیْنَهُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللهُ وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَهُمْ وَ احْذَرْهُمْ اَنْ یَّفْتِنُوْكَ عَنْۢ بَعْضِ مَاۤ اَنْزَلَ اللهُ اِلَیْكَ ؕ فَاِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ اَنَّمَا یُرِیْدُ اللهُ اَنْ یُّصِیْبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوْبِهِمْ ؕ وَ اِنَّ كَثِیْرًا مِّنَ النَّاسِ لَفٰسِقُوْنَ.

তুমি তাদের মধ্যে ফয়সালা কর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার মাধ্যমে এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ কর না। আর তাদের ব্যাপারে তুমি সতর্ক থাকবে যেন তোমার প্রতি নাযিলকৃত আল্লাহর কিছু বিধান থেকে তারা তোমাকে বিচ্যুত না করে ফেলে। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের কিছু পাপের শাস্তি ( দুনিয়াতেই) দিতে চান। আর অধিকাংশ মানুষই তো ফাসিক-অনাচারী বিদ্রোহপ্রবণ। Ñসূরা মায়েদা () : ৪৯

আয়াতে মুসলমানদেরকে শিক্ষাই দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান থেকে সরে গিয়ে মানুষের প্রবৃত্তির এবং তাদের ধ্যানধারণা কল্পিত চিন্তাধারার অনুসরণের সুযোগ ঈমানদারদের নেই। আর স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্যে যদি এটা নিষিদ্ধ হয় তাহলে অন্যদের জন্য তা কী করে বৈধ হতে পারে?

বাকী রইল প্রশ্নটি যে, যদি অধিকাংশ লোকই এরূপ আল্লাহর বিধানের পরিপন্থী আইন বা বিধানের পক্ষপাতী হয়, তাহলে কী করতে হবে? আল্লাহ তাআলার সুস্পষ্ট জবাব অধিকাংশ মানুষ সব সময়ই অনাচারী খেয়ালখুশীর অনুসারী হয়ে থাকে। তাই একজন ঈমানদারের জন্য আল্লাহর সুস্পষ্ট বিধানের মোকাবেলায় এর কোনোই মূল্য নেই। এই অধিকাংশ লোক সম্পর্কে আলকুরআনের সার্টিফিকেট খুব ভালো নয়। তাই বলা হয়েছেÑ

 اَكْثَرَ النَّاسِ لَا یَعْلَمُوْنَÑঅধিকাংশ লোকই অজ্ঞ Ñসূরা আরাফ () : ১৮৭; সূরা ইউসুফ (১২) : ৬৮

اَكْثَرَ النَّاسِ لَا یَشْكُرُوْنَÑঅধিকাংশ লোকই অকৃতজ্ঞ। Ñসূরা বাকারা () : ২৪৩; সূরা ইউসুফ (১২) : ৩৮

اَكْثَرَ النَّاسِ لَا یُؤْمِنُوْنَÑঅধিকাংশ লোকই এমন যাদের ঈমান নেই। Ñসূরা হূদ (১১) : ১৭

وَ مَاۤ اَكْثَرُ النَّاسِ وَ لَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِیْنÑতোমার কামনা সত্ত্বেও অধিকাংশ লোক ঈমানদার বা বিশ্বাসী নয়। Ñসূরা ইউসুফ (১২) : ১০৩

এজন্যই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সতর্ক করে বলে দিয়েছেনÑ

وَ اِنْ تُطِعْ اَكْثَرَ مَنْ فِی الْاَرْضِ یُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِیْلِ اللّٰهِ

তুমি যদি অধিকাংশ লোকের অনুসরণ করতে যাও, তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে। Ñসূরা আনআম (০৬) : ১১৬

তাই আল্লামা ইকবাল যথার্থই বলেছেন,

جمہوريت ايك طرز حكومت ہى * بندون كو كنا جاتا ہى تولا نہين جاتا

گريز از طرز جمہوري غلامى بخت كارى شو * كہ از صد خر مغز انسانى نمي آيد

অর্থাৎ, গণতন্ত্র পদ্ধতি এক শাসনের/মাথাগুনতি মাথার ওজন হয় না/গণতন্ত্রের পন্থা ছেড়ে খোদার পাক্কা গোলাম হও/দু গাধায়ও এক মানুষের বুদ্ধি কভু হয় না।

সুতরাং তথাকথিত গণতন্ত্র বা অধিকাংশের মতের উপর ভিত্তি করে বা তার দোহাই দিয়েও আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিরোধিতা করার সুযোগ অন্ততঃ মুমিন বলে যারা নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন, তাদের জন্যে খোলা নেই। হাঁ, কেউ যদি কালেমার অঙ্গিকার থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করার দুঃসাহস দেখাতে পারে, তার জন্যে ধর্মপক্ষ ত্যাগ করে ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের অধিকার থাকলে থাকতেও পারে।

তাদের অবস্থা পরিচয় সম্পর্কেও আলকুরআন নীরব নয়। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ

اِنَّ الَّذِیْنَ ارْتَدُّوْا عَلٰۤی اَدْبَارِهِمْ مِّنْۢ بَعْدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُمُ الْهُدَی ۙ الشَّیْطٰنُ سَوَّلَ لَهُمْ ؕ وَ اَمْلٰی لَهُمْ، ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ قَالُوْا لِلَّذِیْنَ كَرِهُوْا مَا نَزَّلَ اللهُ سَنُطِیْعُكُمْ فِیْ بَعْضِ الْاَمْرِ ۖۚ وَ اللهُ یَعْلَمُ اِسْرَارَهُمْ، فَكَیْفَ اِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلٰٓىِٕكَةُ یَضْرِبُوْنَ وُجُوْهَهُمْ وَ اَدْبَارَهُمْ، ذٰلِكَ بِاَنَّهُمُ اتَّبَعُوْا مَاۤ اَسْخَطَ اللهَ وَ كَرِهُوْا رِضْوَانَهٗ فَاَحْبَطَ اَعْمَالَهُمْ۠.

যারা তাদের নিকট সুপথ স্পষ্ট হবার পরও তা পরিত্যাগ করে, শয়তান তাদের কাজকে শোভন করে দেখায় এবং ওদেরকে মিথ্যা আশা দেয়। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তারা তা অপসন্দ করে। তাদেরকে ওরা বলে, আমরা কতেক ব্যাপারে তোমাদের অনুসরণ করবো আল্লাহ ওদের গোপন অভিসন্ধি সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।

ফিরিশতারা যখন মুখম-লে পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে ওদের প্রাণ হরণ (জান কবয) করবে তখন ওদের দশাটা কেমন হবে?! এটা জন্যে যে ওরা তার অনুসরণ করে, যা আল্লাহর অসন্তোষ জন্মায় এবং তার সন্তুষ্টিকে অপ্রিয় বলে গণ্য করে। তিনি তাদের কর্মফল নিষ্ফল করে দেন। Ñসূরা মুহাম্মাদ (৪৭) : ২৫-২৮

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مَنْ یَّرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِیْنِهٖ فَسَوْفَ یَاْتِی اللهُ بِقَوْمٍ یُّحِبُّهُمْ وَ یُحِبُّوْنَهٗۤ ۙ اَذِلَّةٍ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اَعِزَّةٍ عَلَی الْكٰفِرِیْنَ  یُجَاهِدُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللهِ وَ لَا یَخَافُوْنَ لَوْمَةَ لَآىِٕمٍ ؕ ذٰلِكَ فَضْلُ اللهِ یُؤْتِیْهِ مَنْ یَّشَآءُ ؕ وَ اللهُ وَاسِعٌ عَلِیْمٌ.

হে মুমিনরা! তোমাদের মধ্যকার কোনো ব্যক্তি দ্বীন থেকে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায়কে (তার স্থলে) নিয়ে আসবেন যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালবাসবে। তারা হবে মুমিনদের প্রতি কোমল এবং সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের (কাফিরদের) বিরুদ্ধে কঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছে তাকে তিনি তা দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। Ñসূরা মায়িদা (০৫) : ৫৪

এখন আমরা যারা বুঝে-শুনে কালিমার অঙ্গিকারে আবদ্ধ হয়েছি, ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ, শান্তিময়, সুসমঞ্জস ধর্মীয় বিধানরূপে শিরোধার্য করে নিয়েছি। তারা আল্লাহর সাথে আমাদের কৃত অঙ্গিকারে অবিচল থাকবো, নাকি বিজাতীয় বিধর্মীয় বিদেশিদের নাকসিটকানির ভয়ে এই পূর্ণাঙ্গ দ্বীন থেকে ফিরে গিয়ে বলব, কতেক বিধান মানব, কতেকগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে বিজাতীয় প্রভুদের মনোরঞ্জনের বা নিজেদের প্রবৃত্তি খাহেশাতের অনুসরণ করে গযবের পাত্র হবÑ সে সিদ্ধান্তটা আমাদেরকেই নিতে হবে। কেননা কিছু মানি, কিছু মানি নাÑ নীতির সমর্থন আল্লাহর কুরআনে বা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়সাল্লামের জীবনাচরণে নেই। শুধু তাই নয় এর বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়েছে আলকুরআনের কঠোর সতর্কবাণীÑ

اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتٰبِ وَ تَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ ۚ فَمَا جَزَآءُ مَنْ یَّفْعَلُ ذٰلِكَ مِنْكُمْ اِلَّا خِزْیٌ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا ۚ وَ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ یُرَدُّوْنَ اِلٰۤی اَشَدِّ الْعَذَابِ.

তোমরা কি কিতাবের কতেক অংশে বিশ্বাস কর আর কতেক অংশকে প্রত্যাখান কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যকার যারা এরূপ করে তাদের প্রতিফল পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা-বিড়ম্বনা ছাড়া আর কী হতে পারেÑ এবং পরকালে তারা কঠিনতম শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে? Ñসূরা বাকারা (০২) : ৮৫

শ্রেষ্ঠতম নবীর উম্মতের তো এরূপ বিড়ম্বনা শাস্তি হওয়ার কথা নয়! কিন্তু এরূপ চরিত্রের মুসলমানদের পরিণাম তো এরূপই হবে বলে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। এটা কেবলই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটিতে আল্লাহর প্রভুত্ব-আধিপত্য তাঁর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে পৃথিবীর পথভ্রষ্ট আল্লাহর গযবের শিকার জাতিসমূহকে বা নিজেদের প্রবৃত্তি খেয়াল খুশিকে প্রভুত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করারই শাস্তি পরিণাম। নবী কারীমের নামে কেবল নাতিয়া-গযল গেয়ে গেয়ে এবং তাঁর এশকের নামে নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে সে ক্ষতি পূরণ হবার নয়।

ইহুদী খ্রিস্টান জাতি তাদের ধর্মীয় -িত যাজক-সন্ন্যাসীদের বিধানসমূহকে আল্লাহর বিধানের স্থলে বসিয়ে দেয়ার কারণে ঘোষিত হয়েছে আল্লাহ তাআলার কঠোর শ্লেষাত্মক বাণীÑ

اِتَّخَذُوْۤا اَحْبَارَهُمْ وَ رُهْبَانَهُمْ اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ.

তারা আল্লাহর স্থলে তাদের ধর্মীয় -িত সন্ন্যাসীদেরকে প্রভু রূপে গ্রহণ করেছে (প্রভুর আসনে বসিয়ে দিয়েছে।) Ñসূরা তাওবা (০৯) : ৩১

তারা ধর্মীয় -িত যাজকদেরকে প্রভু বানিয়ে রেখেছিল। প্রভু বানানোর অর্থ এটা নয় যে, তারা বিশ্বাস করতো যে, তাদের যাজকরাই আসমান যমীনের মালিক। কেননা এরূপ কেউ কোনোদিন অন্য কাউকে প্রতিপালক রূপে গ্রহণ করেনি। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, ইহুদীরা তাদের ধর্মীয় -িতদেরকে তাদের শাস্ত্রজ্ঞদেরকে আর খ্রিস্টানরা তাদের পোপ এবং তার নিযুক্ত পাদ্রীদেরকে দ্বীনের ব্যাপারে যে আসনটা দিয়েছিল আর তাদের সন্ন্যাসী দরবেশদের সম্পর্কে যেরূপ বিশ্বাস পোষণ করতো তা প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে প্রভুর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার তুল্য ছিল।

তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এরূপ অর্থই করেছেন। আদী ইবন হাতিম তাঈ রা. -যিনি প্রথমে খ্রিস্টান ছিলেন- বলেন, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলাম। তখন আমার গলায়   একটি স্বর্ণের ক্রুশ ছিল। (এটা দেখে)   তিনি বললেন, আদী! তোমার গলা থেকে ওটা ফেলে দাও। (আদী রা. বলেন,) তখন আমি নবীজীকে আয়াত তেলাওয়াত করতে শুনলামÑ

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللهِ.

[তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের -িতগণকে  সংসার-বিরাগিগণকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে। Ñসূরা তাওবা () : ৩১] (এক বর্ণনায় আছেÑ এটা শুনে আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তো তাদের ইবাদত করি না। জবাবে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এমনটি কি নয় যে, তারা যা হালাল বলে, তোমরা তা হালাল মনে কর এবং তারা যা হারাম বলে অভিহিত করে সেটাকে তোমরা হারাম জ্ঞান কর? আমি বললাম, জী হাঁ। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটাই তাদের ইবাদত। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ৩০৯৫; মুজামে কাবীর তবারানী, হাদীস ২১৮; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ২০৩৫০

এর দ্বারা বুঝা গেল, নিজেদের ধর্মীয় নেতাদেরকে শরীয়তের আইন প্রণেতার মর্যাদা দান অর্থাৎ তাদেরকে অধিকার দিয়ে দেওয়াÑ যা কিছু তারা তাদের প্রবৃত্তি নিজেদের অভিমত অনুসারে সাব্যস্ত করে দেয়, চোখ বুঁজে তার অন্ধ অনুকরণ-অনুসরণ করাটাই কুরআনের মতে তাদেরকে রবের মর্যাদার আসনে বসিয়ে দেওয়া। কেননা অধিকার কেবল আল্লাহর এবং আল্লাহর ওহীপ্রাপ্ত রাসূলের। অন্য কেউই মর্যাদার অধিকারী নয়। যখন অন্যদেরকেও সে অধিকার দিয়ে দেওয়া হয় তখন তা তাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করারই নামান্তর।

খ্রিস্টানদের মধ্যে এমন একটি ব্যক্তিও নেই যে পোপকে এবং তার নিযুক্ত ফাদারদেরকে খোদা মনে করে, আর না ইহুদীরাই কখনো তাদের রাব্বীদেরকে এমনটি মনে করে, কিন্তু তাদের আমলের অবস্থা এরূপই। যেন হক বাতিল, হালাল-হারাম, আযাব ছওয়াব এবং জান্নাত জাহান্নাম ভাগ করার পূর্ণ এখতিয়ার তাদেরই হাতে। তারা যাকে হালাল বলবে তা- হালাল, যাকে হারাম বলবে, তা- হারাম। যাকে ইচ্ছে ক্ষমার পরোয়ানা দিয়ে দিবে, যাকে ইচ্ছে বঞ্চিত বিতাড়িত করে দেবে। জান্নাতের চাবিকাঠিও তাদেরই হাতে। জাহান্নামের দারোগাও তারাই। তারা এমনি পবিত্র সত্তা যে, তাদের কোনো কথাই ভুল হতে পারে না। আর আল্লাহ যেন তাদেরকে এমনি ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন যে, কোনো কিছুই তাদের হুকুম এখতিয়ারের বাইরে নেই!

গোমরাহীর ফল দাঁড়ালো এই যে,

প্রথমত : আল্লাহর কিতাব যা উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছিল যে, এই কিতাব তার প্রায়োগিক ব্যাখ্যা সুন্নাতে রাসূলই প্রত্যেক বিধানের সূত্র ভিত্তি হবে তা তাদের কাছে একেবারেই প্রভাবহীন বেকার হয়ে গেল। কেননা তার স্থান তো লোকজনের অভিমত ফয়সালাই অধিকার করে নিয়েছে।

দ্বিতীয়ত : হেদায়েতের কেন্দ্র বা উৎস আর আল্লাহর হুকুম রইল না, মানুষের হুকুমই তার স্থান দখল করে নিল।

তৃতীয়ত : গোমরাহ বে-দ্বীন ধর্মীয় নেতাদের একটা স্বতন্ত্র গোষ্ঠি গড়ে উঠল। যারা লোকজনকে অন্ধ-বধির বানিয়ে দিয়ে যেমন ইচ্ছে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে লাগল।

চতুর্থত : লোকেরা সাধারণ বুদ্ধি-বিবেচনা দ্বীনের সাধারণ প্রজ্ঞা থেকে বঞ্চিত হয়ে দ্বীনের প্রাথমিক মৌলিক বিষয়াদি থেকেও গাফিল হয়ে গেল এবং পথভ্রষ্ট নেতাদের অন্ধ অনুসরণে লিপ্ত হল।

পঞ্চমত : কুসংস্কার অন্ধতার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল। কেননা যখন বিশ্বাস কর্মের সবকিছুই একটি পথভ্রষ্ট মানবগোষ্ঠীর মতামতের উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়ল, তখন অন্য কারো আর সে অধিকার রইলো না যে, নিজেদের বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগাবে। বলাবাহুল্য, এমতাবস্থায় বিবেক বুদ্ধির বিকাশের স্থলে অজ্ঞতা কুসংস্কারেরই প্রসার ঘটবে। তখন যে সমস্ত অলীক মনগড়া কথা ঐসব ধর্মনেতাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে তা- হবে লোকজনের দলীল-প্রমাণ।

ষষ্ঠত : ধর্মনেতারা উত্তম মানুষ হওয়ার স্থলে শক্তিমান দেবতায় পরিণত হল। তাদের প্রতিটি বাক্য পবিত্র বাক্য (হিন্দু পরিভাষায় বেদ বাক্য) হয়ে গেল! কেননা যখন তাদের অনুসারীদের জন্যে শরীআত আইন প্রণয়নের নিঃশর্ত সার্বভৌম অধিকার তারা লাভ করে বসল, কোনো বিধান বা কার্যের ব্যাপারে তারা জবাবদিহিতামুক্ত হয়ে গেল, তখন মানবীয় প্রবৃত্তিগত যতরূপ দুষ্টুমি অনাচার হতে পারে তা কমই ধরে নিতে হবে।

ইউরোপের যুগটির ইতিহাসের প্রতি নযর বুলান, যাকে ঐতিহাসিকরা মধ্যযুগ নামে অভিহিত করে থাকেন; বরং সে যুগের প্রতিও, যাকে রেনেসাঁ যুগ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তাহলে আপনারা প্রতি পদে পদে তার অজ¯্র নমুনা দেখতে পাবেন। কেবল পোপ পদটির বংশানুক্রমিক পরম্পরা দেখে নেয়াই এজন্যে যথেষ্ট হবে।

কুরআন যখন আওয়াযটি তুলল, খ্রিস্টীয় জগত তখন তার জবাব দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর ব্যাপারে চুপ করে থাকতে পারলো না। সময় তো খ্রিস্টানরা কুরআনের দাওয়াতের তাৎপর্য উপলব্ধি করে উঠতে পারেনি। কিন্তু সে বীজ থেকে অঙ্কুরে গজাতে ডালপালা না মেলে থাকতে পারলো না। ক্রুসেডের যুদ্ধসমূহে যখন ইউরোপের খ্রিস্টানদের মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার এবং নিকট থেকে তাদেরকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হল, তখন তার প্রভাবসমূহ সক্রিয় হতে থাকে। অবশেষে লুথার গীর্জা সংস্কারের দাওয়াত নিয়ে উঠলেন। লুথার এবং গীর্জার বিরোধের ভিত্তি ছিল সত্যের মাপকাঠি কী? আল্লাহর কিতাব, নাকি পোপের মতামত? আল্লাহর কিতাব কি কেবল এজন্যে যে তা পাঠ করা হবে এবং তা উপলব্ধি করা হবে, নাকি এজন্যে যে সবকিছুই পোপের হাতে ছেড়ে রাখতে হবে? বিরোধের সূত্রপাত হয় যুক্তির প্রশ্ন নিয়ে। অর্থাৎ যুক্তি ঈমান-বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল নাকি পোপের ক্ষমার সনদের উপর? বলা বাহুল্য, এটা হুবহু সেই কুরআনী আহ্বানের প্রতিধ্বনি ছিল যাতে বলা হয়েছেÑ

اِتَّخَذُوْۤا اَحْبَارَهُمْ وَ رُهْبَانَهُمْ اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ.

তারা তাদের ধর্মীয় -িত সন্ন্যাসী যাজকদেরকে আল্লাহর স্থলে প্রভু বানিয়ে রেখেছে। Ñসূরা তাওবা (০৯) : ৩১

আজ বাস্তব সত্যটি ইতিহাসের সর্বজন স্বীকৃত সত্য যে, ইউরোপের মনঃবিপ্লব এবং বাস্তব উন্নতি প্রগতির যুগের সূচনা হয়েছে এই গীর্জা সংস্কারের দাওয়াতের মাধ্যমেইÑ এটি যেমন সত্য, তেমনি সত্য এটাও যে, গীর্জা সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তি ঐদিনই স্থাপিত হয়েছিল যেদিন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাজরানের বিশপকে এই সংস্কার প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন কুরআনের এই আয়াতের মাধ্যমেÑ

یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ تَعَالَوْا اِلٰی كَلِمَةٍ سَوَآءٍۭ بَیْنَنَا وَ بَیْنَكُمْ اَلَّا نَعْبُدَ اِلَّا اللهَ وَ لَا نُشْرِكَ بِهٖ شَیْـًٔا وَّ لَا یَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللهِ.

হে কিতাবী সম্প্রদায়! এসো এমন একটি ব্যাপারে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই যাতে তোমরা আমরা সমান। আর সে সত্যটি হচ্ছে, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্যের ইবাদত-অর্চনা করবো না। আমরা তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করবো না এবং আমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমাদের একে অপরকে প্রভুরূপে গ্রহণ করবো না। Ñসূরা আলে ইমরান (০৩) : ৬৪

আর দিন যে দিন সূরা তাওবার আয়াতখানা নাযিল হয়েছিল।১

ষষ্ঠ শতাব্দীর খ্রিস্টানদের অজ্ঞতা অন্যায় পক্ষপাতিত্বের জন্যে যদি তারা সেদিন দাওয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতি না জানাতো, তাহলে সে অন্ধকার শতাব্দীগুলো আসতো না, সেগুলোর বর্বরতাপূর্ণ ইতিহাস ঐতিহাসিকদের লিপিবদ্ধ করতে হতো না যে যুগটাকে অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ চতুর্দশ শতাব্দী থেকে শুরু না হয়ে ষষ্ঠ শতাব্দী থেকেই এর সূচনা হতে পারতো। এটা আলাদা কথা যে, বিপ্লবের সাফল্য কেবলমাত্র শেষ কিতাবের উপর ঈমান, শেষ রাসূলের আনুগত্য শেষ শরীয়তকে শিরোধার্য করার দ্বারাই অর্জিত হতে পারে।

তো গেল সেই ঈসায়ী জগতের ইতিবৃত্ত, যাদেরকে কুরআনের সত্য দাওয়াত সম্বোধন করেছিল। কিন্তু স্বয়ং  শেষ যুগের মুসলমান যারা ইসলামী খিলাফত থেকেও মাহরূম আহলে হক উলামা-মাশায়েখের নেতৃত্ব থেকে বিমুখ ছিল তাদের অবস্থাটা কী হল, যাদের উপর দাওয়াতের প্রচার প্রসারের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল? আফসোস যে, তারাও গোমরাহী থেকে আত্মরক্ষা করতে পারিনি। তারাও তাদের দ্বীনী আইন প্রণয়নের অধিকার কিতাব সুন্নাহর পরিবর্তে মানুষের অভিমতকে প্রদান করেছে। এটা হয়তো তেকাদ-বিশ্বাসের দিক থেকে না, বাস্তব আমলের দিক থেকে। কিন্তু প্রশ্নটা এখানে আমলেরই, তেকাদ-বিশ্বাসের নয়। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, সেইসব অনর্থ অনাচারই দেখা দিল, যেগুলোর দ্বার কুরআন রুদ্ধ করতে চেয়েছিল। এর সবচাইতে বড় কুপ্রভাব এই যে, তাদের বুদ্ধির বিকাশ গত কয়েক শতাব্দী ধরে একেবারেই রুদ্ধ! পশ্চিমাদের অন্ধ অনুকরণ তাদেরকে জ্ঞানের পথ থেকে বাধাগ্রস্ত করে ফেলেছে। এমন কি অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে, তাদের সামাজিক জীবন ব্যক্তিগত জীবনে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। কেননা তারা শরীয়তের শিক্ষা ইসলামী ফিকহ থেকে গাফিল এবং যুগ-সচেতন ফকীহ আলিমগণের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত। অপরদিকে সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্র শরীআতের বিধানের উপর আমল করা ছেড়ে দিয়েছে। তার পরিবর্তে তারা ইউরোপের দেওয়ানী ফৌজদারী আইনকে গ্রহণ করে নিয়েছে। কেননা তারা সেক্যুলার শিক্ষা-দীক্ষায় প্রভাবিত। এবং ইসলাম ইসলামী শরীয়তের সৌন্দর্য যথার্থতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর। আর এমন কোনো ব্যক্তিও নেই যে তাদেরকে বলবে যে, আল্লাহর দেয়া শরীআত রিক্ততার উর্ধ্বে। যদি তারা কিতাব সুন্নাহর দিকে রুজু করতো তাহলে যুগেও সর্বোত্তম সর্বোপযোগী বিধান তাতে রয়েছে যেরূপ বিগত শতাব্দীগুলোতে তাতে তারা তা খুঁজে পেয়েছেন।

فيا لله وللمسلمين من هذه الفاقرة التي هي من أعظم فواقر الدين، والرزية التي ما رزئ بمثلها سبيل المؤمنين.

মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ যুগ-সন্ধিক্ষণের নির্বাচিত সভাপতি যখন ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিল। কংগ্রেস তখন নিজেদেরকে অসাম্প্রদায়িক এবং মুসলিম লীগকে মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান দাবীর জন্যে সাম্প্রদায়িক সংগঠন বলে অভিহিত করতো। এমন একজন অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের ধর্মীয় রাজনীতিক প্রজ্ঞাবান আলেম অসামান্য ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন।

বিস্তারিত আলোচনার পর আশাকরি কোনো নিরপেক্ষ পাঠক আর বিভ্রান্তিতে ভুগবেন না যে, আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সর্বশেষ নবী তাঁর সারা জীবনের সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার প্রভুত্ব সার্বভৌম অধিকারের যে হেদায়েত দিয়ে গেছেন এবং তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িতও করে গিয়েছেন, তার অন্যথা করেও নবীপ্রেমের দাবি করা যায়। ইহুদী-খ্রিস্টান ধর্মযাজক তাদের সন্ন্যাসী -িতদের প্রভুত্ব যদি অগ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে তাদের বিভ্রান্ত অনুসারীদের অনুকরণ অনুসরণে কী করে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে? 

 

advertisement