“বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিচ্ছো...”
জুমার নামাযে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত প্রথম রাকাতে সূরা আ‘লা (سبح اسم ربك الأعلى) আর দ্বিতীয় রাকাতে সূরা গাশিয়া (هل أتاك حديث الغاشية) তিলাওয়াত করতেন। কখনো প্রথম রাকাতে পড়তেন সূরা জুমুআ। যে-ই সূরার শেষের দিকে আছে এই আয়াত-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ...
আর দ্বিতীয় রাকাতে পড়তেন এর পরের সূরা, যার শুরু হলÑ
إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ...
এই সূরায় আল্লাহ মুনাফিকদের নিন্দা করেছেন। সেজন্য এ সূরার নামই হয়েছেÑ সূরা মুনাফিকূন।
আমি যে আয়াত তিলাওয়াত করেছি, তা সূরা আ‘লার শেষ অংশÑ
قَدْ اَفْلَحَ مَنْ تَزَكّٰی وَ ذَكَرَ اسْمَ رَبِّهٖ فَصَلّٰی بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَاۖ وَ الْاٰخِرَةُ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰی اِنَّ هٰذَا لَفِی الصُّحُفِ الْاُوْلٰی صُحُفِ اِبْرٰهِیْمَ وَ مُوْسٰی.
“সফলতা অর্জন করেছে সে-ই, যে পবিত্রতা অবলম্বন করেছে। এবং নিজ প্রতিপালকের নাম নিয়েছে ও নামায পড়েছে। কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও অথচ আখেরাত কত বেশি উৎকৃষ্ট ও কত বেশি স্থায়ী। নিশ্চয়ই এ কথা পূর্ববর্তী (আসমানী) গ্রন্থসমূহেও লিপিবদ্ধ আছে; ইবরাহীম ও মূসার গ্রন্থসমূহে।”
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের অবস্থা বলছেনÑ
بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا
তোমরা তো পবিত্রতার রাস্তা ধরছ না। দেহ-মনের পবিত্রতা, চিন্তার পবিত্রতা, চোখের জবানের আমলের পবিত্রতা, পবিত্রতা অবলম্বন করছ না। জিকির এবং সালাতের রাস্তা ধরছ না, বরং তোমরা তো পার্থিব জীবনকে, দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনকে প্রাধান্য দাও। وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ অথচ উত্তম হল আখেরাত। আখেরাতের জীবনই উত্তম। وَأَبْقَى এবং চিরস্থায়ী, যার শুরু আছে শেষ নেই।
এ জীবন তো ক্ষণস্থায়ী। আগেও আমি ছিলাম না। পরেও থাকব না। মাঝখানে কিছু দিন। আল্লাহ বলেন, তোমাদের অবস্থা হল, তোমরা প্রাধান্য দাও দুনিয়ার জীবনকেই। অথচ আখেরাতের জীবনই হল উত্তম এবং সেই জীবনের শুরু আছে শেষ নেই। তাহলে কোনটাকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার? আখেরাত।
এখানে আমরা খেয়াল করি, আল্লাহ এ কথা বলেননি যে, তোমরা তো দুনিয়া নিয়ে আছ। দুনিয়া কামাই কর, দুনিয়ার চিন্তায় থাকÑ এ কথা বলেননি। কারণ, এটা নিন্দনীয় নয়। দুনিয়ার চিন্তায় থাকা, দুনিয়া উপার্জন করা, দুনিয়ার কাজকাম করাÑ এগুলো খারাপ কিছু নয়। এর উপর আল্লাহর কোনো আপত্তি নেই। এর উপর আল্লাহ আপত্তি করবেনও না। বরং আল্লাহ বলেছেন, দুনিয়াতে তোমাদের যখন থাকতে দিয়েছি, মউত পর্যন্ত তোমাকে দুনিয়াতে থাকতে হবে; কবরের জীবনের আগ পর্যন্ত তো তোমাকে এই যমীনেই টিকে থাকতে হবে। এখানে থাকার জন্য যা জরুরত তা তুমি অর্জন করবে। এর তো আল্লাহ কোনো নিন্দা করেন না। এজন্যই তো ‘তোমরা দুনিয়া নিয়ে আছ’Ñ এ কথা বলেননি। বরং বলেছেন, ‘তোমরা দুনিয়াকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দাও’। প্রাধান্য দেওয়াটা হল আপত্তির বিষয়। দুনিয়ার পিছে পড়ে আখেরাত ভুলে যাওয়াÑ এটা আপত্তির বিষয়। এটা করো না তোমরা।
দুনিয়ার বৈধ সব কর, আখেরাতকে ভুলে নয়। আখেরাতকে স্মরণ রাখ। আখেরাতের জন্য দুনিয়া থেকে কামাই কর।
আচ্ছা, দ্বীন-শরীয়ত মানে না বা ইসলামই মানে না বা কালেমা পড়েছে ঠিকই কিন্তু দ্বীন-শরীয়ত, ইসলামের বিধি বিধানের কোনো খোঁজ-খবর নেইÑ এমন একজনকে দেখুন। আরেকজন দ্বীনদার লোককে দেখুন। এ দু’জনের মধ্যে তুলনা করুন; পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য কি এইÑ যে দ্বীনদার সে খায় না, অপরজন খায়? যে দ্বীনদার সে ঘুমায় না, অপরজন ঘুমায়? যে দ্বীনদার সে ব্যবসা-বাণিজ্য করে না, অপরজন করে?!
অথবা একজন লোকের মাঝে যখন পরিবর্তন আসে; প্রথমে কোনো পরোয়া ছিল না দ্বীন-শরীয়তের, কুরআন-সুন্নাহর বিধি-বিধানের। পরে আল্লাহর মেহেরবানীতে কোনো আল্লাহ ওয়ালার সান্নিধ্যে গেল বা তার বন্ধু-বান্ধব কেউ তাকে আদর-যতœ করে হজ্বে নিয়ে গেল বা কোনো তাবলীগী ভায়ের তাশকিলে তিন চিল্লা সময় লাগাল; মোটকথা কোনো না কোনো মাধ্যমে তার মাঝে পরিবর্তন এল। তো এই ব্যক্তির পরিবর্তনের আগের আর পরের অবস্থার মধ্যে পার্থক্য খোঁজেন, পার্থক্য কোথায়? পরিবর্তনের পর সে কি খাওয়া-দাওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য অফিস-আদালত ছেড়ে দিয়েছে? না সব ঠিক আছে? এর অর্থ হল, আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য কুরআন-সুন্নাহয় এমন কোনো বিধান দেননি, যার কারণে আমরা সংকটে পড়ব। সব স্বাভাবিক বিধান। আপনার দুনিয়ায় চলা-ফেরা, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকবে। পার্থক্য শুধু এই হবে যে, আগে আমি হালাল-হারামের তোয়াক্কা করতাম না, এখন হালাল-হারামের তোয়াক্কা করি। আগে কোনো বাছ-বিচার ছিল না, যা সামনে এসেছে তাই করেছি। যা-ই পেয়েছি তা-ই গ্রহণ করেছি। এখন অবৈধটা নিব না, অরেকজনের উপর যুলুম করবো না।
আমি বুঝি প্র¯্রাব-পায়খানা দুর্গন্ধ, খারাপ। শরীয়তে প্র¯্রাব-পায়খানা কি শুধু নাপাক; শরীরে লাগলে ধুয়ে ফেলতে হবে এইটুকু? নাকি ভক্ষণও না জায়েযÑ এ মাসআলা কি বলা লাগে? কিন্তু মাসআলা তো আছেÑ এগুলো খাওয়া জায়েয নয়। হারামের তালিকায় আছে। কিন্তু এটা কি কাউকে বলতে শুনেছেন? শুনেননি। কারণ, এটা কাউকে বলে দেওয়া লাগে না। এটা এমনিতেই বুঝি। কিন্তু আরো কিছু বিষয় আছে যেটা আমি বুঝি না বা বুঝলেও বিবেক অনুযায়ী চলি না। আমার বিবেক ঠিকই বলছে এটা খারাপ, কিন্তু আমি বিবেক অনুযায়ী চলি না, জযবার তালে চলি, নফসের খাহেশের তালে চলি। প্রবৃত্তির তালে চলি।
ঘুষ দেওয়া-নেওয়া হারাম। প্রস্রাব-পায়খানা ভক্ষণ যেমন হারাম, তেমনি ঘুষ দেওয়া-নেওয়া হারাম, সুদ দেওয়া-নেওয়া হারাম। (শব্দ দু’টি উচ্চারণ করতে, শুনতে খারাপ লাগে। সে জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।) এ দু’টোর নাম শুনতেই আমাদের কাছে খারাপ লাগে। আলোচনা করতেও খারাপ লাগে। কিন্তু এগুলোর চেয়ে লাখো গুণে বেশি ঘৃণিত হল, সুদ আর ঘুষ। সুদ আর ঘুষের মধ্যে কী পরিমাণ দুর্গন্ধ যদি তা অনুভব করার শক্তি আল্লাহ তাআলা দিয়ে দেন বা আল্লাহ যদি এগুলোর দুর্গন্ধ আমাদের সামনে প্রকাশ করে দেন তাহলে...। হাঁ, আখেরাতে তো সব দুর্গন্ধ প্রকাশ পেয়ে যাবে। কিন্তু দুনিয়া যেহেতু পরীক্ষার জায়গা এখানে আল্লাহ তা প্রকাশ করেন না। এখানে নবী-রাসূল পাঠিয়ে আল্লাহ পরীক্ষা নিচ্ছেনÑ আমার কথা কে শুনে, এটা আমি দেখব। এজন্য আল্লাহ তাআলা যত ধরনের পাপ আছে এগুলোর ভয়াবহতা, ওগুলোর দুর্গন্ধ প্রকাশ করেন না। কিন্তু যার আকল আছে, আল্লাহ তাআলা যাকে বিবেক দান করেছেন সে বুঝে এগুলো প্রস্রাব-পায়খানা থেকে লাখো গুণ বেশি দুর্গন্ধযুক্ত, বেশি খারাপ, বেশি ঘৃণিত। আর আল্লাহ সেই জিনিসগুলোই হারাম করেছেন।
তো যে মুমিন কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক চলে তার মাঝে আর অন্যদের মাঝে পার্থক্য হল, অন্যজন হালাল-হারামের পার্থক্য করে না, মুমিন হালাল-হারামের পার্থক্য করে। সে খারাপ কাজ করে, অপরাধ করে, মুমিন কোনো খারাপ কাজ করে না, কোনো অপরাধ করে না। সে আরেকজনের উপর যুলুম করে, মুমিন কারো উপর যুলুম করে না। মুমিন বলে,
الظلم ظلمات يوم القيامة
যুলুম তো অন্ধকার। কিয়ামতের দিন মুক্তির কোনো রাস্তাই খুঁজে পাব না যদি অন্যের উপর যুলুম করি। যুলুম মানে অত্যাচার, আর যুলমাতুন মানে অন্ধকার। শব্দের মিল আছে। ‘যুলুম’ য লাম মীম দিয়ে, এর সাথে তা যোগ করে ‘যুলমাতুন’ মানে অন্ধকার। বহুবচন হল, যুলুমা-তুন। তুমি একজনের উপর একটা যুলুম করেছ। এই একটা যুলুম অনেক অনেক অন্ধকার হয়ে দাঁড়াবে তোমার জন্য, কবরে, হাশরে। তুমি মুক্তির রাস্তা খুঁজে পাবে না। তো আমি যুলুম করব না, আরেকজনের হক নষ্ট করব না, আমার বোনের হক ধরে রাখব না, স্ত্রীর মোহর ধরে রাখব না। আরেকজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছি, সে ঋণ দিয়ে দয়া করেছে, দেওয়ার তাওফিক আছে তাও দিচ্ছি না বা অস্বীকার করে বসে আছি, বা কিছু দিয়ে বললাম যে, আর দিতে পারব না। মুমিন এমন করে না। মুমিন রিক্সাওয়ালার সাথে ভালো ব্যবহার করে, বাসের লোকদের সাথে ভালো ব্যবহার করে, ভাড়া ঠিক মতো দিয়ে দেয়। কিছু লোক আছে খামোখা তর্ক করে, বলে এত ভাড়া না। হেলপার কন্ডাকটাররা যেন মানুষই না; সিটে যিনি বসে আছেন তিনিই বাবু। এই যে আরেকজনকে মানুষ মনে না করা, এটা বিরাট অন্যায়। তোমাকেও তো আল্লাহ তার স্থানে রাখতে পারতেন। কেন তুমি ভালো ব্যবহার কর না? ঘরের বুয়াদের সাথে কেন ভালো ব্যবহার কর না? নিজের মেয়ের সাথে মহিলারা ভালো ব্যবহার করে, ছেলের জন্য বউ আনবে তার সাথে ভালো ব্যবহার করবে না। নিজের মেয়েকে এক দৃষ্টিতে দেখে, ছেলের বউকে আরেক দৃষ্টিতে দেখে।
তো তাওবা করার আগে ও পরে যে পার্থক্য হবে তা হচ্ছে, খারাপ কাজগুলো, অপরাধগুলো ছেড়ে দিবে। নতুবা সংসার এরও আছে ওরও আছে, ব্যবসা-বাণিজ্য এরও আছে ওরও আছে। এও খাচ্ছে, সেও খাচ্ছে। এও ঘুমাচ্ছে, সেও ঘুমাচ্ছে। কোনো পার্থক্য নেই। দুনিয়া কেউ ছাড়েনি। দ্বীনের উপর আসতে হলে কখনো দুনিয়া ছাড়তে হয় না। শুধুমাত্র আল্লাহ যেগুলো অপরাধ বলেছেন, পাপ বলেছেন, গুনাহ বলেছেন ওগুলো ছেড়ে দিবে। এগুলোর উপর তোমার কোনো কিছু মওকুফ না। দুনিয়াতে শান্তি পাওয়া কি ওগুলোর উপর মওকুফ? না ওগুলো আরো অশান্তি টেনে আনে!
আল্লাহ এ কথাটাই বলেছেন,
بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى.
(হে আমার বান্দারা! আমি দেখছি,) তোমরা তো দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে চলছ। প্রাধান্য দিতে হবে আখেরাতকে।
আমাদের ব্যাপারে আল্লাহর অভিযোগ শুধু একটাÑ তোমরা দুনিয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছ কেন? তোমাদের তো দুনিয়ার জন্য বানাইনি। দুনিয়াতে রেখেছি আখেরাতের জন্য। দুনিয়াকে কেন প্রাধান্য দিচ্ছ। তোমার প্রাধান্য দিতে হবে আখেরাতকে।
প্রাধান্য দেওয়ার অর্থ কী? আমি দোকানে আছি। ব্যবসা-বাণিজ্য করছি। যোহরের আযান হল, মসজিদে যাওয়া দরকার, দোকানে আর কেউ নেই, হিম্মত তো করা দরকার, আমি দোকান বন্ধ করে মসজিদে যাই, নামাযের পরে আবার দোকান খুলি। চলো, এমন হিম্মত না থাকলে তুমি দোকানেই অন্তত চার রাকাত ফরয আদায় করে নাও। কিন্তু আসরের আযান হয়ে গেছে, আমি যোহরের চার রাকাত ফরযও আদায় করিনি। কাকে প্রাধান্য দিলাম? দুনিয়াকে। এটাকে বলে প্রাধান্য দেওয়া। চার রাকাত ফরয নামাযেরও যদি সময় বের করতে পারতাম তাও আল্লাহ বলতেন নাÑ তুমি দুনিয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছ। ঠিক আছে, বান্দা ফরয তো আদায় করেছে।
পিতা জায়গা-জমি রেখে গেছেন। ভায়েরা ভাগ করে নিল। দু’জন বোন আছে তাদের। তাদেরকে তো আল্লাহ একটি অংশ দিয়েছেন। ওরা আপনার পিতার সন্তান, তাদের জন্য আল্লাহ একটি নির্ধারিত অংশ রেখেছেন। ভায়েরা তাদের অংশ দিল না। এখন তাদের জন্য আল্লাহ যে অংশ বরাদ্দ রেখেছেন তা তাদের দাও। কিন্তু তা তোমরা দখল করে বসে আছ। এটা হল দুনিয়াকে প্রাধান্য দেওয়া আখেরাতের উপর।
আপনি কবিতা আবৃত্তি করুন, আনন্দ করুন। কিন্তু আনন্দ-ফূর্তির নামে আপনি একেবারে গান-বাদ্য শুরু করলেন। আনন্দ-ফূর্তি তো আল্লাহ আপনার জন্য বৈধ করেছেন, কিন্তু আপনি এখন এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছেন যে, দুনিয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছেন আখেরাতের উপর। এই গান-বাদ্য আখেরাতে আপনার জন্য কালসাপ হয়ে দাঁড়াবে!
বলবেন, হুযুর আপনি গান-বাদ্য না শোনার ওয়ায করেন; আমরা তো এসব দেখি। ঘরের মধ্যে সব ব্যবস্থা রেখেছি। ঘরে নয় বরং পকেটে এসবের ব্যবস্থা আছে। সবকিছু হাতের মুঠোর মধ্যে। আপনি কী ওয়ায করবেন! আমি তো এত লজ্জিত হই; যখনই বয়ানের জন্য বসি, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কী বয়ান করব। পাপের সরঞ্জাম সব হাতের মধ্যে। দুনিয়ার যত অশ্লীলতা আছে এতে সব দেখে, সব শুনে। আল্লাহ কি এজন্য মোবাইল দিয়েছেন? এটি তো একটি নিআমত। এ নিআমত আল্লাহ এজন্য দেননি; তা দিয়েছেন, এর দ্বারা মা-বাবার খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য; মা কেমন আছেন। এর দ্বারা মায়ের দুআ নিবে। বা কোনো উপকারি তথ্য সংগ্রহ করবে। নেটে আছে, নেট থেকে তথ্য সংগ্রহ কর। আল্লাহ তাআলা কি গান শোনার জন্য এ নিআমত দিয়েছেন? অশ্লীল কিছু দেখার জন্য দিয়েছেন?
তো যে-ই এগুলোর ভুল ব্যবহার করবে, আল্লাহর নাফরমানীতে ব্যবহার করবে, সে-ই দুনিয়াকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দিল। প্রয়োজনে ব্যবহারের উপর আল্লাহ্র কোনো আপত্তি নেই। মানুষের সেবার জন্য এটা ব্যবহার করুন, কোনো আপত্তি নেই। গবেষণা ও ভালো কাজে ব্যবহার করুন, কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু অশ্লীলতার জন্য ব্যবহার করবেন, অন্যের ক্ষতি করার জন্য ব্যবহার করবেন, এতে আপত্তি আছে।
এটাই আল্লাহ বলেছেনÑ
بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى.
তোমরা তো দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে চলছ। আখেরাত হল উত্তম ও চিরস্থায়ী; এর শুরু আছে শেষ নেই। আখেরাতের খেয়াল রাখ।
إِنَّ هَذَا لَفِي الصُّحُفِ الْأُولَى، صُحُفِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى.
আল্লাহ বলছেন, হে উম্মতে মোহাম্মদী এই ওয়ায, এই উপদেশ-নসীহত আমি শুধু তোমাদের দিচ্ছি না, এ কথা আগের উম্মতদের বলে এসেছি। সবার জন্য এ কথা ছিল; দুনিয়াতে থাক, দুনিয়া ভোগ কর, আপত্তি নেই, তবে আখেরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিও না। যেখানে দুনিয়া ও আখেরাতে টক্কর হবে; দুনিয়ার যে ব্যবহার আখেরাতকে নষ্ট করে দিবে, আখেরাতে জাহান্নামী বানাবে সেক্ষেত্রে আখেরাতকে প্রাধান্য দিও দুনিয়ার উপর। কারণ, সে দুনিয়া তোমার প্রয়োজনের দুনিয়া নয়, তোমাকে বরবাদ করার দুনিয়া। প্রয়োজনের কোনো কিছু আল্লাহ হারাম করেননি। প্রয়োজনের কোনো কিছুর দ্বারা আখেরাত নষ্ট হয় না। আখেরাত নষ্ট হয়Ñ দুনিয়ার অন্যায় ব্যবহারের দ্বারা।
তো আল্লাহ বলেন, এ কথা সবাইকে বলে এসেছিÑ
إِنَّ هَذَا لَفِي الصُّحُفِ الْأُولَى، صُحُفِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى.
আগের উম্মতের হেদায়েতের জন্য যত কিতাব দেওয়া হয়েছে, সবগুলোতে এ নসীহত ছিল। ইবরাহীমের কিতাব, মূসার কিতাব, যাকে যে কিতাব দিয়েছি হেদায়েতের জন্য, সবগুলোতে এ কথা ছিল। যদিও ওগুলোর সংরক্ষিত কপি থাকেনি। ইহুদী-নাসারারা সংরক্ষিত রাখেনি। বিকৃত করে ফেলেছে। ইঞ্জীল নামে, বাইবেল নামে বিভিন্ন ভাষায় যা এখন প্রচার করে, সেটা আল্লাহর নাযিলকৃত তাওরাত-ইঞ্জিল নয়। যে ইঞ্জীল আল্লাহ নাযিল করেছেন, যে তাওরাত আল্লাহ নাযিল করেছেন, এর কিছু কথা এতে খুঁজে পাবেন আর সব বিকৃত ও বর্ধিত। কিন্তু যেটা আল্লাহ নাযিল করেছিলেন তাতে এগুলো ছিল। এই নসীহত আগের উম্মতদেরও আল্লাহ বলেছেন, এই উম্মতকেও বলেছেন। এই উম্মত হল শেষ উম্মত। শেষ নসীহত আল্লাহ তাআলা করে দিয়েছেন কুরআনে। আল্লাহ আমাদের কুরআন শিখার, কুরআন বুঝার, কুরআন মোতাবেক আমল করার, কুরআনের দিকে মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার তাওফিক নসীব করুন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আখেরাতকে দুনিয়ার উপর প্রাধান্য দেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন
و آخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.
(ধারণ ও লিখনে : মুহাম্মাদ ফজলুল বারী)