Rajab 1437   ||   April 2016

প্রসঙ্গ-রাষ্ট্রধর্ম : বন্ধু! কলমের মর্যাদা রক্ষা করুন

যাদের0 হাতে কলম আছে তাদেরই কর্তব্য, কলমের মর্যাদা রক্ষা করা, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে কলম পরিচালনা করা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হাতে কলম এলে অনেকেরই বিচার-বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পাঠকজনকে তারা কী বিবেচনা করেন তা তারাই ভালো বলতে পারবেন।

সম্প্রতি রাষ্ট্রধর্মের প্রসঙ্গ নিয়ে খানিকটা তোলপাড় হয়ে গেল। হাইকোর্টের রিট আবেদন ও অবশেষে তা খারিজের মধ্য দিয়ে বিষয়টি আপাতত স্তিমিত হয়েছে। কিন্তু একশ্রেণির কলমবাজ লোকের কলমচালনা থেমে নেই। তাদের কেউ লিখছেন, ‘রাষ্ট্র একটি নিষ্প্রাণ সত্তা, তার আলাদা ধর্ম থাকতে পারার বিবেচনা যে কোনো ধর্মের মৌলবাণীর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, ইসলামের ক্ষেত্রে তা সমপরিমাণে সত্য।

ধর্ম-বিশারদ ও রাষ্ট্র-বিশারদ উভয় শ্রেণির জন্যই এ উক্তিটি এক অপূর্ব তোহফা বটে। রাষ্ট্র যেহেতু নিষ্প্রাণ সত্তা আর সেকারণে যদি তার আলাদা ধর্ম না হতে পারে তাহলে এই নিষ্প্রাণ সত্তার জন্য সংবিধান কেন? এবং সংবিধানের নানা আদর্শই বা কেন? এরপর এই নিষ্প্রাণ সত্তাকে ধর্মনিরপেক্ষবানাবারই বা এত কসরত কেন? কে না জানে, ‘ধর্ম-নিরপেক্ষতাশব্দবন্ধটি বর্তমান সময়ের এক কুফরী ধর্মেরই নাম!

কেউ আবার ধমক দিয়ে লিখছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি ও জোরে একটি বিশেষ ধর্মকে সব নাগরিকের স্বতন্ত্র সমান অধিকারের উপর স্থাপন করার অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আপনার অন্যান্য অধিকার, এমনকি আপনার ব্যক্তিগত ধর্মচর্চার ওপরে হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা আপনি নিজেই তৈরি করছেন।

কিন্তু বাস্তবতা এই যে, অন্তত মুসলিম ভূখ-গুলোতে সংখ্যা-গরিষ্ঠতার কোনো জোরনেই, সুতরাং যুক্তিও নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর ও যুক্তি থাকলে আমাদের এই কলমবাজ বন্ধুরা এভাবে কলম চালনা করতে পারতেন না। আর অন্যায় হস্তক্ষেপ’? এ-ও আজকাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে হয় না; হয় পৃষ্ঠপোষকতার জোরে। শাহবাগে এক বৃদ্ধ মুসলিমের শুভ্র দাড়ির উপর যে অপবিত্র হস্তক্ষেপ হয়েছিল তা কি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর ও যুক্তিতে হয়েছিল না পৃষ্ঠপোষকতার যুক্তি ও জোরে? আরো অনেক দেয়া যাবে। কিন্তু থাক্ কথা কম বলাই নিরাপদ। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই আজ সবচেয়ে বেশি মাযলুম। ক্ষেত্র বিশেষে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। পক্ষান্তরে পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্তগণই সবচেয়ে বেশি শক্তিমান। ক্ষেত্রবিশেষে দেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক।

এখনকার বাকপটু কলমসমাজ বন্ধুদের প্রচারণায় কারো কারো মনে এ প্রশ্নও জাগতে পারে যে, ধর্ম-নিরপেক্ষতার মাধ্যমে তো সাম্প্রদায়িকতার পথ রুদ্ধ হয়। সুতরাং এতে দোষের কী আছে!

ধর্ম-নিরপেক্ষতার এই মূল্যায়ন পৃথিবীর কোনো কোনো ধর্মের ক্ষেত্রে সঠিক হলেও ইসলামের ক্ষেত্রে সঠিক নয়। ইসলাম যেহেতু ন্যায় ও ইনসাফের ধর্ম তাই এর শিক্ষা-বিধানে কোনো প্রকারের যুলুমের অবকাশ নেই। সাম্প্রদায়িকতারও অবকাশ নেই।

সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে ইসলামের শিক্ষাগুলোর দিকে নজর দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ইসলাম সাম্প্রদায়িকতাকে কীভাবে চিহ্নিত করে? একজন সাহাবী রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন আসাবিয়্যাত’ (সাম্প্রদায়িকতা) কী? জবাবে তিনি ইরশাদ করলেন, অন্যায় কাজে স্বগোত্র-স্বজাতির পক্ষে দাঁড়ানো। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৭৮

অর্থাৎ অন্যায় ও যুলুমে কাউকে শুধু এ জন্য সমর্থন করা যে, সে তার নিজ দল, গোত্র, জাতি ও ধর্মের লোকÑ এটাই সাম্প্রদায়িকতা।

সুনানে আবু দাউদের অন্য বর্ণনায় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষকে আসাবিয়্যাত (সাম্প্রদায়িকতা)-এর দিকে আহ্বান করবে (অর্থাৎ অন্যায় কাজে নিজ দল, গোত্র, জাতিকে সাহায্য করতে বলবে) সে আমাদের (মুসলমানদের) দলভুক্ত নয়। যে এমন সাম্প্রদায়িকতার কারণে মৃত্যুবরণ করবে সেও আমাদের দলভুক্ত নয়। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৮০

আর বিদায় হজ্বের বিখ্যাত ভাষণের কথা তো সকলেরই জানা। যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন, ভাষা, বর্ণ ও গোত্রের ভিত্তিতে কারো উপর কারো প্রাধান্য নেই। তিনি বলেছেন, কোনো আরব অনারবের উপর (শুধু ভাষার কারণে) প্রাধান্য পাবে না। কোনো সাদা (তার বর্ণের কারণে) কালোর উপর প্রাধান্য দাবি করতে পারবে না। প্রাধান্যের একমাত্র ভিত্তি হবে তাকওয়া। Ñমুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৪৮৭

উপরোক্ত হাদীসগুলো এবং কুরআন-সুন্নাহর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আয়াত ও হাদীস-আসারগুলো অধ্যয়ন করলে যে কোনো চিন্তাশীল মানুষ উপলব্ধি করবেন যে, ইসলামের ব্যাখ্যায় সাম্প্রদায়িকতার আওতা কত বিস্তৃত এবং কত কঠোরভাবে ইসলাম এর নিন্দা ও বিরোধিতা করে।

কিন্তু আধুনিক ইউরোপ মানুষকে দেশ, বর্ণ, দল ও ভাষার ভিত্তিতে বিভক্ত করে পুনরায় ইসলাম-পূর্ব জাহিলিয়াত-যুগেই নিয়ে গেছে। এখন দলের লোক, গোত্রের লোক, সম্প্রদায়ের লোক, নিজ পেশার বা গ্রুপের লোক কিংবা দেশের লোক যত অন্যায়ই করুক তার সম্প্রদায়ের লোকেরা তার পক্ষই অবলম্বন করবে। অন্য পক্ষ যতই মাযলুম, অসহায়, নির্যাতিত হোক তার প্রতি সদয় হবে না । আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, ছাত্রসংগঠনগুলো, বিভিন্ন পেশাজীবী সম্প্রদায় এবং তাদের কর্মকা-ে তা স্পষ্ট। দলের সর্বোচ্চ ব্যক্তি যত বড় মিথ্যা বক্তব্যই দিক তারা সেটা প্রচার করতে থাকবে। দলীয় পরিচয়ে কোনো নেতাকর্মী যত অপকর্মই করুক তারা সেটিকে দোষই মনে করবে না এবং বেশি চাপে পড়ে গেলে তা অস্বীকার করে দিবে। এমনিভাবে তাদের কোনো লোক কোনো সংখ্যালঘুর উপর আক্রমণ করলে বা তার জানমালের ক্ষতি করলেও তারা আক্রমণকারীর পক্ষেই যাবে এবং তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। এরপরও ওরা ধর্মনিরপেক্ষ সুতরাং অসাম্প্রদায়িক!!

ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম সংখ্যালঘুদের জানমাল তো মুসলমানদের মতোই। বিশ্বজিৎ হত্যাকা-ের পর আলিমগণ ইসলামী বিধানের আলোকেই এর প্রতিবাদ করেছেন। কোনো মুসলমানের পক্ষে যেমন দেশের আইন মেনে বসবাসকারী অমুসলিমের উপর কোনো ধরনের নির্যাতনের সুযোগ নেই তেমনি অন্য কোনো মুসলিমকে এমনটি করতে দেখলে সাধ্যানুযায়ী এ অন্যায় কাজ থেকে নিবৃত্ত রাখার চেষ্টা করাও তার দায়িত্ব। তা না করে উল্টো জালেমকে সমর্থন করলে সেটি হবে চরম সাম্প্রদায়িকতা।

তো সাম্প্রদায়িকতা দমনের একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে ইসলামী আদর্শে জাতিকে গড়ে তোলা, কুরআন-সুন্নাহ তথা শরীয়াহ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা, সেক্যুলার রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো সাম্প্রদায়িকতা-মুক্ত মানব জাতি উপহার দিতে পারে না।

শুধু আমাদের দেশেই নয় প্রতিবেশী দুটি দেশের রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক ঘটনা এবং পশ্চিমের দেশগুলোর স্কুল ও বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে অস্ত্রধারীদের গুলির ঘটনা ও আক্রমণকারীর বক্তব্য পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে যে, রাষ্ট্র সেক্যুলার নামধারী হলেও জাতি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হয় না। সুতরাং সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তির জন্য চাই ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা নয়।

আর একারণেই অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে মুসলিমগণ ধর্মনিরপেক্ষতাকে আত্মরক্ষার একটি কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। ঐ সকল অঞ্চলের উগ্র সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে এর যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু মুসলিম ভূখ-গুলোতে ইসলামী আদর্শই অমুসলিমদের জন্য অধিকতর স্বস্তি ও নিরাপত্তার উপায়। সুতরাং কলমবাজ বন্ধুদের বাস্তবতা-পরিপন্থী সমীকরণ-নীতি ও বাস্তবতা কোনো দিক থেকেই গ্রহণযোগ্য নয়। 

জানিনা কোন কারণে ২৮ বছর আগের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম-এর বিরুদ্ধে রিট নতুনকরে শুনানি এনে জনমনে শংকা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে শস্তির বিষয় হচ্ছে, বিজ্ঞ আদালত রিটটি খারিজ করে দিয়েছেন। এবার সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা কবে সরবে তার অপেক্ষা। 

 

advertisement