সভ্যতা : ‘সভ্য’ বর্ণবাদের উল্লাস!
শরণার্থীদের আশ্রয়শিবির। জার্মানির পূর্বাঞ্চলীয় শহর- বাউজেনে। ৩০০ শরণার্থীর জন্য একটি হোটেল। হোটেলটিকেই আশ্রয়শিবির হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি শনিবার সেই আশ্রয় শিবিরে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। আগুন যখন দাউ দাউ জ্বলতে থাকে তখন আসে দমকল বাহিনী। এসেই তারা দেখে অদ্ভুৎ একটি দৃশ্য! আগুন-জ্বলা আশ্রয়শিবিরের বাইরে একদল স্থানীয় জার্মান নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে। উৎসুক ও উৎফুল্ল। তারা কেউ আগুন নেভাতে যাচ্ছে না। আগুন নেভানো হোক- সেটাও চাচ্ছেন না। ভিনদেশী মুসলিম শরণার্থীদের আশ্রয়শিবিরে আগুন জ্বলার মজায় তারা দাঁত কেলিয়ে হাসছিল। নির্লজ্জভাবে করছিল উল্লাস। এমনকি দমকল বাহিনীর লোকদের বাধাও দিচ্ছিল। যেন তারা এগিয়ে গিয়ে আগুন নেভাতে না পারে। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে তিনশত নারী-পুরুষ-শিশুর ভষ্মিভূত হওয়ার শংকা! এর মধ্যেই এই উল্লাস ও হিংসাত্মক আচরণ! এ-ও কি সম্ভব! কোন জঙ্গলের সভ্যতায় আমরা বসবাস করছি!
জার্মান সরকারের আচরণ দুনিয়াবাসী জানে। শরণার্থীদের নিজ দেশে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মারকেলের ভূমিকা প্রশংসা কুড়িয়েছে। দেশের ভেতরে বিরোধী পক্ষের বিরোধিতা ও সমালোচনা তাকে সইতে হয়েছে ঢের। তারপরও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে মানবিক ‘সংকটের আগুন’ উসকে দেওয়ার দায় থেকে তিনি নিজের দেশ ও জাতিকে মুক্ত ভাবতে পারেননি। তাই সাড়া দিয়েছেন। বাড়িঘর-হারা বিপন্ন আশ্রয়প্রার্থীদের জায়গা দিয়েছেন। একটু দম ফেলার। একটু বেঁচে থাকার। এভাবে বিপন্নের প্রতি সহানুভূতির ক্ষেত্রে জর্মানদের হয়ে এক ‘ইমেজনির্মাতা’ প্রতিনিধির ভূমিকাই পালন করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার দেশের লোকেরা এ-ঘটনায় সেই ‘ইমেজের’ ভেতরের ছবিটা দেখিয়ে দিয়েছে। মানুষ কত নীচে নামতে পারে- দুনিয়াবাসী দেখেছে। মনে-প্রাণে তাদের মতো যারা, এতে তারা অবাক হয়নি, ক্ষুণ্ন হয়নি। কিন্তু সাধারণ বোধ-বুদ্ধি ও বিবেচনার মানুষেরা চমকে গেছেন। ভড়কে গেছেন। কারণ, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা এত নগ্নরূপে ‘হেসে উঠতে পারে’- এ যেন কারো কল্পনাতেও ছিল না।
ক’দিন আগে থেকেই নাকি স্থানীয় জার্মানদের ওখানকার আশ্রয়শিবিরগুলো ঘিরে বিভিন্ন রকম কুৎসিত আচরণ প্রকাশিত হয়ে আসছিল। ঘটনার কয়েকদিন আগে শ খানেক স্থানীয় বাসিন্দা শরণার্থীদের ‘বাড়ি চলে যা, বাড়ি চলে যা’ বলে শ্লোগান তুলেছিল। এরও আগে পাশের স্যাক্সনি শহরে শরণার্থীদের বহনকারী একটি বাসের পথ আটকে দিয়েছিল স্থানীয়রা। উদ্দেশ্য শরণার্থীদের উত্যক্ত করা। শরণার্থীদের স্বাচ্ছন্দ্যকে সংকুচিত, বিরক্তিকর ও ঘৃণার্হ্য করে তোলা। একশ্রেণির জার্মান এখন হাততালি বাজিয়ে সেটাই করছে। লজ্জা, সৌজন্য কিংবা মুখরক্ষারও কোনো দায় তাদের এই হিংস্রতা দমিয়ে রাখতে পারছে না। এজন্যই স্যাক্সনি শহরের গভর্ণর খুব লজ্জিত বোধ করেছেন। তিনি তার শহরের বাসিন্দাদের এ-জাতীয় বৈরী আচরণের তীব্র নিন্দা করেছেন এবং বলেছেন- ‘এটা খুবই ঘৃণ্য এবং লজ্জাজনক কাজ।’ স্বজাতির এ-জাতীয় নগ্ন আচরণে লজ্জায়ই পড়তে হয়েছে তাকে। এই অভিব্যক্তি ছিল সে সলাজ দুঃখবোধের বহিঃপ্রকাশ।
শরণার্থীদের পক্ষ থেকে কোনো অস্বস্তিকর ঘটনাই ঘটেনি- ঘটনা এমন নয়। বিপন্ন সহস্র মানুষের মাঝেও লোভী-দুর্বৃত্ত দু-একটা লুকিয়ে থাকতে পারে। প্রায় সবযুগে, প্রায় সবকালে। সেজন্য তো সব বিপন্ন মানুষকে আরো বিপন্ন, আরো কোণঠাসা শ্রেণিতে পরিণত করা যায় না। এ ঘটনায় জার্মানদের একটি দলকে সেই কর্মটিই কি আমরা করতে দেখছি না? আসলে অনেক সময় বর্ণবাদী ও ভেতর-কুৎসিৎ বলে আমরা কেবল আমেরিকান, বিলেতি, রাশান, স্পেনিশ কিংবা ফরাসিদের দিকেই আঙ্গুল তাক করি। বুঝতে পারি না, কথিত পশ্চিমা সভ্যতার প্রায় পুরোটারই ভেতরের চেহারা কুৎসিত। তাদের সংস্কৃতি ও বোধবিশ্বাসের ভেতরেই এই ‘ক্রুসেড-হিংস্রতা’ বুনা আছে। সেখানে এই দেশ- সেই দেশ কোনো ব্যাপার না। সেখানে শরণার্থী আর অভিবাসীও কোনো আলাদা মাপকাঠি নয়। অমানবিক ‘মানুষদের’ ‘সভ্য’ বর্ণবাদ সবখানেই যেন সমানতালে উল্লাস করে চলে। বাউজেনের জার্মানরা সেই সত্যটিই আবার মনে করিয়ে দিল। তবুও এই বর্ণবাদী ভেতর-কুৎসিত সমাজের মধ্যেও যে কজন সুস্থ চিন্তার ‘মার্কেল’ আছেন- আমরা তাদের প্রতি অভিনন্দন জানাই!