জানাযার নামাযে হামদ ও ছানা
নামাযের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীন যুগের আমলে মুতাওয়ারাছ তথা যুগ পরম্পরায় চলে আসা ব্যাপক ও অনুসৃত কর্মধারার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে মৌখিকভাবেও নামায শিক্ষা দিয়েছেন আবার তাঁদের নিয়ে নিয়মিত নামায আদায় করেছেন। তাঁদের প্রতি তাঁর এই নির্দেশও ছিল,
صلوا كما رأيتموني أصلي ‘তোমরা সেভাবে নামায পড় যেভাবে আমাকে নামায পড়তে দেখেছ।’
সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নামায শিক্ষা করেছেন, তাঁদের থেকে তাবেয়ীগণ, তাঁদের থেকে তাবে-তাবেয়ীগণ...। এভাবে প্রত্যেক উত্তরসূরী পূর্বসূরী থেকে নামায শিক্ষা করেছেন।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মত জানাযার নামাযের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। জানাযার নামাযও সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মৌখিক বর্ণনা অপেক্ষা প্রায়োগিকভাবেই বেশি শিখেছেন। তাঁদের থেকে শিখেছেন তাবেয়ীগণ, তাঁদের থেকে তাবে-তাবেয়ীগণ...। এভাবে জানাযার নামাযের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো উম্মাহর কাছে সংরক্ষিত হয়েছে।
জানাযার নামাযে হামদ-ছানা আমলে মুতাওয়ারাছের মাধ্যমে প্রমাণিত
এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। জানাযার নামাযে প্রথম তাকবীরের পর আল্লাহ তাআলার হামদ-ছানা করা হবে।[1] এটি সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীন যুগের আমলে মুতাওয়ারাছের মাধ্যমে প্রমাণিত। এক্ষেত্রে দু’জন ইমামের বক্তব্য উল্লেখ করা যায়।
এক. ইমাম আবুল ওলীদ ইবনে রুশদ আলকুরতুবী রাহ. (৫৯৫হি.) তাঁর ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ ওয়া নিহায়াতুল মুকতাছিদ’ গ্রন্থে (১/২৯৪) জানাযার নামাযে কুরআন পড়া প্রসঙ্গে লিখেছেন-
اختلف الناس في القراءة في صلاة الجنازة، فقال مالك وأبو حنيفة : ليس فيها قراءة إنما هو الدعاء. وقال مالك: قراءة فاتحة الكتاب فيها ليس بمعمول به في بلدنا بحال، قال : وإنما يحمد الله ويثني عليه بعد التكبيرة الأولى، ثم يكبر الثانية فيصلى على النبي صلى الله عليه وسلم، ثم يكبر الثالثة فيشفع للميت، ثم يكبر الرابعة ويسلم.
অর্থাৎ, ‘জানাযার নামাযে কুরআন পড়া বিষয়ে ইমামদের মতভেদ হয়েছে। ইমাম মালেক ও আবু হানীফা রাহ. বলেন, এতে কুরআন পড়া হবে না। এ তো হল দুআ। ইমাম মালেক বলেন, এতে সূরা ফাতেহা পড়ার প্রচলন আমাদের শহরে (মদীনায়) একেবারেই নেই। তিনি আরো বলেন, প্রথম তাকবীরের পর আল্লাহর হামদ ও ছানা করবে। দ্বিতীয় তাকবীর দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পড়বে। তৃতীয় তাকবীর দিয়ে মায়্যিতের জন্য সুপারিশ করবে। তারপর চতুর্থ তাকবীর দিয়ে সালাম ফেরাবে।’
এ থেকে বোঝা যায় যে, ইমাম মালেক রাহ.-এর শহর মদীনায় জানাযার নামাযে প্রথম তাকবীরের পর আল্লাহর হামদ ও ছানা করা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
দুই. ইমাম তিরমিযী রাহ. (২৭৯হি.) ‘সুনান’ গ্রন্থে (২/৩৩৪-৩৩৫, হাদীস ১০২৭) জানাযার নামাযে কুরআন পড়া বিষয়ক আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর আছারটি বর্ণনার পর লেখেন-
والعمل على هذا عند بعض أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم وغيرهم، يختارون أن يقرأ بفاتحة الكتاب بعد التكبيرة الأولى، وهو قول الشافعي وأحمد وإسحاق.
وقال بعض أهل العلم : لايقرأ في الصلاة على الجنازة، إنما هو ثناء على الله والصلاة على النبي صلى الله عليه وسلم والدعاء للميت، وهو قول الثوري وغيره من أهل الكوفة.
অর্থাৎ, ‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী ও অন্যদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক আহলে ইলমের আমল এই হাদীস অনুযায়ীই। তারা প্রথম তাকবীরের পর সূরা ফাতেহা পড়া পছন্দ করেন। এটিই ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ও ইসহাকের মত। আর কিছু সংখ্যক আহলে ইলম বলেন, জানাযার নামাযে কুরআন পড়া হবে না। এ শুধু আল্লাহর প্রশংসা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ এবং মায়্যিতের জন্য দুআ। এটিই ছাওরী ও অন্যান্য আহলে কূফার মত।’
এ থেকে বোঝা যায় যে, জানাযার নামাযে প্রথম তাকবীর দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করা কূফা শহরেও বেশ প্রচলিত ছিল।
বলাবাহুল্য, মদীনা ও কূফাবাসীরা এ শিক্ষা পর্যায়ক্রমে তাদের শহরে অবস্থানকারী আহলে ইলম সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণ থেকেই গ্রহণ করেছেন।
সাহাবী-তাবেয়ীগণেরকিছু আছার
জানাযার নামাযে প্রথম তাকবীরের পর আল্লাহর হামদ ও ছানা করা, যা মূলত সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীন যুগের আমলে মুতাওয়ারাছের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের কারো কারো থেকে মৌখিক বর্ণনা-সূত্রের মাধ্যমেও বর্ণিত রয়েছে। নি¤েœ কিছু আছার উল্লেখ করা হল-
১. সায়ীদ ইবনে আবী সায়ীদ আলমাকবুরী থেকে বর্ণিত, তিনি আবু হুরায়রা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কীভাবে জানাযার নামায পড়েন? আবু হুরায়রা রা. বললেন, আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তোমাকে জানাব। আমি মায়্যিতের পরিবার থেকে তার অনুসরণ করি। যখন খাটিয়া রাখা হয় তখন তাকবীর দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করি এবং তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর দরূদ পড়ি। তারপর এ দুআ করি-
اللَّهُمَّ إِنَّهُ عَبْدُكَ وَابْنُ عَبْدِكَ وَابْنُ أَمَتِكَ كَانَ يَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ. وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُكَ وَرَسُولُكَ. وَأَنْتَ أَعْلَمُ بِهِ. اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ مُحْسِنًا، فَزِدْ فِي إِحْسَانِهِ. وَإِنْ كَانَ مُسِيئًا، فَتَجَاوَزْ عَنْ سَيِّئَاتِهِ. اللَّهُمَّ لَا تَحْرِمْنَا أَجْرَهُ، وَلَا تَفْتِنَّا بَعْدَهُ
-মুয়াত্তা মালেক ১/১৫২, বর্ণনা নং ৫১৯; মুয়াত্তা মুহাম্মাদ পৃ. ১৬৮-১৬৯ ;মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা নং ৬৪২৫
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
مالك، عن سعيد بن أبي سعيد المقبري، عن أبيه : أنه سأل أباهريرة كيف تصلي على الجنازة؟ فقال أبوهريرة : أنا لعمر الله أخبرك، أتبعها من أهلها، فإذا وضعت كبرت وحمدت الله وصليت على نبيه، ثم أقول : اللهم إنه...
আছারটির সনদ সহীহ।
২. মুসায়্যিব ইবনে রাফি থেকে বর্ণিত, আলী রা. যখন জানাযার নামায পড়তেন, তখন নামায শুরু করে আল্লাহর প্রশংসা করতেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পড়তেন। তারপর এ দুআ করতেন-
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِأَحْيَائِنَا وَأَمْوَاتِنَا، وَأَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِنَا، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا، وَاجْعَلْ قُلُوبَنَا عَلَى قُلُوبِ أَخْيَارِنَا.
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ১১৪৯৪
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا محمد بن فضيل، عن العلاء بن المسيب، عن أبيه، عن علي : أنه كان إذا صلى على ميت يبدأ فيحمد الله ويصلي على النبي صلى الله عليه وسلم، ثم يقول: اللهم اغفر...
এই আছারের সনদে কিছু দুর্বলতা থাকলেও[2] কূফাবাসীদের তাআমুল দ্বারা তা শক্তিশালী হয়।
৩. আবু হাশিম (আররুম্মানী) থেকে বর্ণিত, আমি শাবী রাহ.-কে বলতে শুনেছি, প্রথম তাকবীরে আল্লাহর প্রশংসা, দ্বিতীয় তাকবীরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ, তৃতীয় তাকবীরে মায়্যিতের জন্য দুআ আর চতুর্থ তাকবীরে সালাম ফেরানো হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ১১৪৯৬; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, বর্ণনা নং ৬৪৩৪
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
حدثنا وكيع، عن سفيان، عن أبي هاشم، عن الشعبي قال : سمعته يقول: في الأولى ثناء على الله تعالى، وفي الثانية صلاة على النبي صلى الله عليه وسلم، وفي الثالثة دعاء للميت، وفي الرابعة تسليم.
এ আছারের সনদ সহীহ।
আরো দেখুন : মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা নং ১১৪৯৩
৪. হাম্মাদ ইবনে আবী সুলায়মান থেকে বর্ণিত, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, জানাযার নামাযে নির্ধারিত কিছু নেই। তুমি নামায শুরু করে আল্লাহর প্রশংসা করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পাঠ করবে। এবং আল্লাহর কাছে নিজের জন্য ও মায়্যিতের জন্য পছন্দমত দুআ করবে। -কিতাবুল আছার, ইমাম মুহাম্মাদ ১/২৭৪, বর্ণনা নং ২৩৮
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
أخبرنا أبو حنيفة، عن حماد، عن إبراهيم قال : ليس في الصلاة على الميت شيء موقت، ولكن تبدأ فتحمد الله، وتصلي على النبي صلى الله عليه وسلم، وتدعو الله لنفسك، وللميت بما أحببت.
আছারটির সনদ সহীহ।
আরো দেখুন :কিতাবুল আছার, ইমাম মুহাম্মাদ ১/২৭৫, বর্ণনা নং ২৩৯
জানাযার নামায সালাতরূপ দুআ
জানাযার নামাযে হামদ-ছানা প্রসঙ্গে এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে যে, জানাযার নামায নিঃসন্দেহে নামায। একারণে অন্যান্য নামাযের মত এতেও তাহারাত ফরয। তবে এই নামাযের মূলকথা হচ্ছে দুআ- নিজের জন্য, মায়্যিতের জন্য। অর্থাৎ এটি সালাতরূপ দুআ। জানাযার নামাযে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পড়া দুআগুলো থেকেই তা উপলব্ধি করা যায়। এতে তিনি এত বিচিত্র ও অর্থ-তাৎপর্যপূর্ণ দুআ করতেন এবং তা এত বিপুল ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে,[3] তাতে চিন্তা করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে, জানাযার নামায মূলত দুআ, যা নামাযের মধ্য দিয়ে করা হয়। আগে পাঠকগণ ইমাম ইবনে রুশদ রাহ.-এর বরাতে ইমাম মালেক ও আবু হানীফা রাহ.-এর এ কথা লক্ষ করেছেন যে, ‘এ (অর্থাৎ জানাযার নামায) তো দুআ।’
আর দুআর এক সুন্নত হল, শুরুতে আল্লাহ তায়ালার হাম্দ এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পাঠ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযের ভেতরে বা বাইরে কিংবা দিনরাতের অন্য সময়ে যেসব দুআ পড়তেন, তা দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং এক্ষেত্রে বহু স্পষ্ট হাদীসও রয়েছে। এখানে শুধু একটি হাদীস উল্লেখ করা হল।
ফাযালা ইবনে উবায়দ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক লোককে নামাযে দুআ করতে শুনেছেন। কিন্তু সে আল্লাহর যিকির করেনি এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পড়েনি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে ত্বরা করেছে! তারপর ডেকে তাকে ও অন্যদেরকে বললেন,
إذا صلى أحدكم فليبدأ بتحميد ربه والثناء عليه، ثم ليصل على النبي، ثم ليدع بعد بما يشاء.
অর্থাৎ, তোমাদের কেউ যখন নামায পড়ে তখন যেন নিজ প্রতিপালকের হামদ ও ছানা দিয়ে শুরু করে। তারপর নবীর উপর দরূদ পড়ে। তারপর যা ইচ্ছে দুআ করে।
-মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২৩৯৩৭; সুনানে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৭৭; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ৭১০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৯৬০
এই হাদীসটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু ঐ লোককেই শিক্ষা দেননি; বরং সকলের জন্য এই মূলনীতি বাতলে দিয়েছেন যে, দুআর শুরুতে, বিশেষ করে নামাযের দুআর শুরুতে যেন আল্লাহর হামদ-ছানা করা হয়। বস্তুত জানাযার নামাযে হামদ-ছানা বৈধ বরং সুন্নত হওয়ার জন্য এই একটি হাদীসই যথেষ্ট ছিল। অথচ তা খাইরুল কুরূনের আমলে মুতাওয়ারাছের মাধ্যমেও প্রমাণিত (পাঠকবর্গ আগে তা দেখে এসেছেন)।
মাযহাব ও তাকলীদের কঠোর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও শামসুল হক আযীমাবাদী (১৩২৯হি.), আবদুর রহমান মুবারকপুরী (১৩৫৩হি.)সহ আরো কিছু আলেম জানাযার নামাযে হামদ ও ছানা করার বিষয়টি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন। আযীমাবাদী তার ‘আউনুল মাবুদ শরহে সুনানে আবী দাউদ’ গ্রন্থে (৮/৩৫১) লিখেছেন,
وأما البداءة بالثناء قبل القراءة فلأن الإتيان بالدعوات استغفار للميت، والبداءة بالثناء ثم بالصلاة سنة الدعاء،والمقصود من صلاة الجنازة طلب المغفرة للميت، ولايقبل الله الدعاء ولايستجيبه حتى يبدأ أولا بالثناء ثم بالصلاة على النبي...
অর্থাৎ, ‘কুরআন পড়ার আগে ছানা দিয়ে শুরু করা একারণে যে, দুআ পড়া মূলত মায়্যিতের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা। আর ছানা ও দরূদের মাধ্যমে দুআ শুরু করা দুআর সুন্নত। আর জানাযার নামাযের উদ্দেশ্য মায়্যিতের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা। আর আল্লাহ দুআ কবুল করেন না যতক্ষণ না তা ছানা ও দরূদ দ্বারা শুরু করা হয়।’ এরপর তিনি ফাযালা ইবনে উবায়দ রা.-এর হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।
সামনে গিয়ে তিনি আরো বলেছেন,
فحصل من مجموع الأحاديث المذكورة في هذاالباب أن المشروع في صلاة الجنازة الثناء على الله تعالى ... بعد التكبيرة الأولى، ثم يصلي على النبي صلى الله عليه وسلم، ثم يدعو للميت.
অর্থাৎ, ‘এই অধ্যায়ে উল্লেখিত হাদীসসমূহের সমষ্টির সারকথা এই যে, জানাযার নামাযের নিয়ম হল, প্রথম তাকবীরের পর আল্লাহর প্রশংসা করা...। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পড়বে। তারপর মায়্যিতের জন্য দুআ করবে।’ -প্রাগুক্ত ৮/৩৫৮
মুবারকপুরী লেখেন, জানাযার নামাযে প্রথম তাকবীরের পর ছানা পড়ার দলীল এই যে, হযরত ফাযালা ইবনে উবায়দ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক লোককে দুআ করতে শুনেছেন...। এরপর তিনি পুরো হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন, ‘এই হাদীস থেকে জানাযার নামাযে ছানা পড়া প্রমাণিত হয়।’ এরপর আবু হুরায়রা রা.-এর আছারটি উদ্ধৃত করে বলেন, ‘এই আছার থেকেও জানাযার নামাযে প্রথম তাকবীরের পর ছানা পড়া প্রমাণিত হয়...।’ -কিতাবুল জানাইয (মাকালাতে মুহাদ্দিস মুবারকপুরী-এ মুদ্রিত) পৃ. ৩০৬-৩০৭
তার আলোচনার মূল পাঠ এই-
جنازہ کی نماز ميں پہلی تکبير کے بعد دعا ثناء پڑھنے کا ثبوت یہ ہے کہ حضرت فضالہ بن عبید رضی اللہ عنہ سے روایت ہے کہ رسول اللہ صلی اللہ علیہ وآلہ وسلم ایک شخص کو دعا کرتے ہوۓ سنا جس نے دعا کرنے سے پہلے نہ اللہ کی ثنا کی تھی اور نہ رسول اللہ صلی اللہ علیہ وآلہ وسلم پر درود بھیجا تھا. اس حدیث سے نماز جنازہ ميں دعا ثناء کا پڑھنا ثابت ہے...
حضرت ابوسعىد نے حضرت ابو ہریرہ رضی اللہ عنہ سے پوچھا کہ آپ جنازہ کی نماز كىوں كر پڑھتے ہيں؟ انہوں نے کہا کہ ميں جنازہ کے ساتھ اس کے لوگوں کے یہاں سے چلتا ہوں پس جبجنازہ رکھاجاتاہے تو اللہ اکبر کہتا ہوں اور اللہ کی حمد کرتا ہوں...حضرت ابو ہریرہ کے اس اثر سے بھی نماز جنازہ ميں پہلی تکبير کے بعد دعا ثنا ء پڑھنے کا ثبوت ہوتا ہے..ـ
আরো দেখুন : ফাতাওয়া উলামায়ে হাদীস, সংকলন ও বিন্যাস : আবুল হাসানাত আলী মুহাম্মাদ সায়েদী ৫/২০৮
সারকথা এই যে, জানাযার নামাযে প্রথম তাকবীর দিয়ে আল্লাহ তাআলার হামদ-ছানা করা জায়েয তো বটেই, সুন্নতও। এটি সাহাবা, তাবেয়ীনও তাবে-তাবেয়ীনযুগের ব্যাপক ও অনুসৃত কর্মধারার মাধ্যমে প্রমাণিত।[4] দুআর সাধারণ নিয়মও এর সমর্থন করে। তবে তা কী শব্দে করতে হবে, সেটা বিশেষভাবে বর্ণিত নয়। একারণে ফুকাহায়ে কেরাম এর জন্য বিশেষ কোনো বাক্য নির্দিষ্ট করেননি। তবে হাসান ইবনে যিয়াদ রাহ.-এর সূত্রে ইমাম আবু হানীফা রাহ. থেকে
سُبْحَانَك اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِك وَتَبَارَكَ اسْمُك وَتَعَالَى جَدُّك وَلَا إلَهَ غَيْرُك -এ ছানাটি পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে।[5] আর হামদ-ছানার উদ্দেশ্যে সূরা ফাতেহা পড়লেও কোনো অসুবিধা নেই। কোনো কোনো সাহাবী-তাবেয়ী থেকে জানাযার নামাযে যে সূরা ফাতেহা পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে, তা সম্ভবত হামদ-ছানার উদ্দেশ্যেই ছিল, কেরাআতের উদ্দেশ্যে নয়। কারণ অনেক বড় বড় সাহাবী-তাবেয়ী জানাযার নামাযে কুরআন পড়তেন না। আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিজে পড়েছেন বা পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন- এ মর্মে সনদগতভাবে নির্ভরযোগ্য ও সুস্পষ্ট কোনো হাদীস আমরা পাইনি। দু-একজন সাহাবীর এমন কিছু বক্তব্যই কেবল আছে, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ হওয়া নিশ্চিত নয়। জানাযার নামাযে কুরআন পড়ার বিধান থাকলে তা বিপুল সংখ্যক সাহাবীর সূত্রে দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্ণিত হত। যেমনটি ফরয নামাযের ক্ষেত্রে হয়েছে।[6] ইমাম আবু জাফর তহাবী রাহ. (৩২১হি.) সুন্দর বলেছেন,
يحتمل أن تكون قراءة من قرأ فاتحة الكتاب من الصحابة على وجه الدعاء، لاعلى وجه التلاوة.
অর্থাৎ, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ যে সূরা ফাতেহা পাঠ করেছেন, তা সম্ভবত দুআ হিসেবে ছিল, তিলাওয়াত হিসেবে নয়।’ -শরহে সহীহ বুখারী, ইবনে বাত্তাল ৩/৩১৭
যেসকল সাহাবী-তাবেয়ী জানাযার নামাযে কুরআন পড়তেন না, তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন, আবু হুরায়রা রা., আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা., ফাযালা ইবনে উবায়দ রা., মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন, আবুল আলীয়া, আবু বুরদা ইবনে আবী মূসা আলআশআরী, আমের ইবনে শারাহীল শাবী, বকর ইবনে আবদুল্লাহ আলমুযানী, মায়মূন ইবনে মেহরান আলজাযারী, আতা ইবনে আবী রাবাহ, সালিম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.।[7]
ইমাম ইবনে বাত্তাল (আলী ইবনে খালাফ ইবনে আবদুল মালিক রাহ., ৪৪৯হি.) তাঁর সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থে (৩/৩১৬) উমর ইবনে খাত্তাব রা., আলী ইবনে আবী তালিব রা., সায়ীদ ইবনে জুবাইর ও হাকাম (ইবনে উতায়বা) রাহ.-এর নামও উল্লেখ করেছেন। ইমাম ইবনুল মুনযির রাহ. (৩১৮হি.) ‘আলআউসাত’ গ্রন্থে (৫/৪৮৩) মুজাহিদ (ইবনে জাবর) ও হাম্মাদ (ইবনে আবী সুলায়মান) রাহ.-এর নামও উল্লেখ করেছেন।[8] (এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে মাসিক আলকাউসার এপ্রিল (২০১৫ ঈ,) সংখ্যা দেখা যেতে পারে)
এই সাহাবী ও তাবেয়ীগণের ব্যাপারে এই ধারণা পোষণ করা অসঙ্গত হবে না যে, তাঁরা যেহেতু জানাযার নামাযে সূরা ফাতেহা পড়তেন না, সেহেতু অন্য কোনোভাবে অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার হামদ ও ছানা করতেন। কারণ আগেই বলা হয়েছে যে, জানাযার নামায সালাতরূপ দুআ। আর দুআর এক সুন্নত শুরুতে আল্লাহর হামদ ও ছানা করা। আর সুন্নতের ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণের যে গুরুত্ব ও মনোযোগ ছিল, তা কারো অজানা নয়। এদিক থেকে বিবেচনা করলে হামদ ও ছানা পড়ার বিষয়টি আরো স্পষ্ট।
[1]কীভাবে করতে হবে সে সম্পর্কে কিছু কথা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ।
[2]. মুসায়্যিব ইবনে রাফিরাহ. সরাসরি আলী রা. থেকে হাদীস শুনেছেন কি নাÑ এ ব্যাপারে কোনো কোনো ইমাম কালাম করেছেন।
[3]. যে বিপুল ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানাযার নামাযের দুআ বর্ণিত হয়েছে, জানাযার নামাযের অন্য বিষয় সম্ভবত সেভাবে বর্ণিত হয়নি।
[4]. সুতরাং এ আপত্তি অবান্তর যে, ‘এটি হাদীসে নেই।’ কারণ হাদীসের একটি বড় অংশ আমলে মুতাওয়ারাছের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে।
[5]. আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৭৪-৭৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪৩-৪৫; আলইখতিয়ার লি তালীলিল মুহতার ১/১৫৯; আলবাহরুর রায়েক ২/৩২১; রদ্দুল মুহতার ৩/১০৯-১১০
[6]. দেখুন : শরহু মুখতাছারিত তহাবী, ইমাম আবু বকর আলজাস্সাস ২/২১৭
[7]. দ্রষ্টব্য : মুয়াত্তা মালেক ১/২৫২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৫২২-১১৫৩২
[8]. আরো দেখুন : আলমুদাওয়ানাতুল কুবরা ১/১৭৪