‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’ : একটি চিঠি ও তার উত্তর
জনাব মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক দামাত বারাকতুহুম
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু
বাদ সালাম!
আশা করি আপনি ভালো আছেন। আল্লাহ তাআলা আপনাকে সুস্থ রাখুন। বিগত কয়েক মাস আগে আমি একটি গ্রন্থ পাই। নাম ‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’। গ্রন্থনা ও সংকলন : মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর। পরিবেশনায় : ইমাম আযম (রহ.) রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ। প্রথম প্রকাশ : ১২ রবিউল আউয়াল, ১৪৩৬ হিজরি; ৪ জানুয়ারী, ২০১৫ ইংরেজী। এ বইয়ে আপনার তত্ত্বাবধানে লেখা ‘প্রচলিত জাল হাদীসে’র খণ্ডন করা হয়েছে। পাশাপাশি হযরত মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী দামাত বারাকাতুহুম-এর তত্ত্বাবধানে লেখা একই নামের গ্রন্থ ‘প্রচলিত জাল হাদীসে’রও খণ্ডন করা হয়েছে। গ্রন্থটি পড়ার সময় ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর কৃত ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ এবং শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. কৃত ‘সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফা ওয়ালমাওযূআহ’-এর খণ্ডনও দেখতে পেয়েছি। গ্রন্থের শুরুতে এই দাবিও করা হয়েছে যে এতে উপরিউক্ত চার গ্রন্থেরই ‘রদ’ আছে। ছয়শ পৃষ্ঠার কম এ গ্রন্থে ‘সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফা’র (যার খণ্ড সংখ্যা ২০) খণ্ডন কীভাবে হয়ে গেল তা বোধগম্য নয়।
যাই হোক, জনাবের খেদমতে দরখাস্ত করছি, আপনি এর খণ্ডনে কিছু লিখুন। মানুষ এর দ্বারা গোমরাহীর শিকার হচ্ছে। যদিও এ লেখকের লেখার আঙ্গিক শীলিত নয়। কিন্তু পাঠকের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় কিছু লেখা উচিত। এর পাশাপাশি আপনার তত্ত্বাবধানে লেখা ‘প্রচলিত জাল হাদীস’ ছাড়া বাকি তিন গ্রন্থ সম্পর্কে আপনার মতামত জানারও ইচ্ছা জাগছে। আশা করছি এ দিকেও আপনি দৃষ্টি দেবেন।
মুহাম্মাদ এনামুল হাসান, নরসিংদী
১৩/১১/২০১৫ ঈ.
উত্তর :
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
বেরাদরে আযীয মুহতারাম এনামুল হাসান সাল্লামাকাল্লাহু তাআলা
ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু
আপনার চিঠি পেয়েছি। জানি না আপনি আমাকে কেন চিঠি লিখলেন। এই চিঠি আপনি সরাসরিু এ গ্রন্থের সংকলক মাওলানা মুতীউর রহমান সাহেবকে লিখতে পারতেন। যাই হোক, আপনি যখন আমাকেই চিঠি লিখেছেন তাই মনে হল সংক্ষিপ্তাকারে কিছু কথা বলে দেওয়াই মুনাসিব হবে।
বাহাদুর সাহেবের এ কিতাব আমি পড়েছি। বিশেষ করে এ উদ্দেশ্যে পড়েছি যে, বাস্তবেই যদি আমাদের গ্রন্থে কোনো ভুল-ত্রুটি থেকে থাকে তাহলে যেন তা শুধরে নেওয়া যায়। কিন্তু এমন কিছু আমার চোখে পড়েনি। অর্থাৎ এমন কোথাও পাইনি যে, কোনো রেওয়ায়েতকে আমরা ‘মওযূ’ বা ভিত্তিহীন বলেছি আর তিনি দলীলের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে তা গ্রহণযোগ্য বা তার ভিত্তি আছে। আপনি যদি মাওলানা মুতীউর রহমানের গ্রন্থের সাথে মিলিয়ে বাহাদুর সাহেবের কিতাবটি পড়েন তাহলে সহজেই বিষয়টি আঁচ করতে পারবেন। আর মাওলানা মুতীউর রহমান সাহেবের গ্রন্থের দ্বিতীয় এডিশন, দু’বছর যাবত যার উপর নযরে ছানীর কাজ চলছে এবং যা খুব তাড়াতাড়িই ‘এসব হাদীস নয়’ নামে প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ, এর সাথে যদি বাহাদুর সাহেবের গ্রন্থটি মিলিয়ে পড়েন তাহলে তো নূরুন আলা নূর।
এ গ্রন্থ যেহেতু ইলম ও তাহকীকের ভিত্তিতে লেখা কোনো গ্রন্থ নয় তাই এর খণ্ডনে কিছু লেখার প্রয়োজন নেই। এ গ্রন্থ এর যোগ্যও নয় যে এর খণ্ডনে কিছু লেখা হবে। তবে সাধারণ পাঠকের জন্য সংক্ষিপ্ত একটি পর্যালোচনা করে দিতে অসুবিধা নেই। কারণ যাদের উসূলী ও মৌলিক কথা জানা নেই তারা বাহাদুর সাহেবের দেওয়া বেমক্কা হাওয়ালা দেখে পেরেশান হতে পারেন। সুতরাং সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা হিসেবেই সামনের কথাগুলি আরজ করছি।
বাহাদুর সাহেবের গ্রন্থের কিছু নিজস্ব আন্দায
১. দাবিকে দলীল বানানো
এ গ্রন্থের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য (?) হল, এর লেখক দাবি আর দলীলের হাকীকত বুঝেন না। তাই তিনি পুরো গ্রন্থে শত শত জায়গায় দাবিকেই দলিল হিসেবে উল্লেখ করতে থাকেন। দাবিকে দলিলের নামও দেন এবং প্রত্যেক দাবির উপর এক এক করে দলিলের নাম্বারও লাগান। যেমন তারীখ (ইতিহাস) সীরাত, মীলাদ এবং তাসাউফসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের কিতাবে সনদ ছাড়া একটি রেওয়ায়েত বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্ন শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে যার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হল, ‘প্রথম সৃষ্টি নূরে মুহাম্মাদী’। এখন প্রশ্ন হল, এই কিতাবগুলোতে যে সনদ ছাড়া এই রেওয়ায়েতটি উল্লেখ করা হল, আসলেই কি এর কোনো সনদ আছে? এবং সেই সনদে সহীহ হওয়ার শর্তাবলি রয়েছে? এর জবাবে কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবের নির্ভরযোগ্য নুসখা থেকে এই রেওয়ায়েতের এমন সনদ উল্লেখ করা চাই যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে রেওয়ায়েতটি সহীহ বা হাসান। অথবা অন্ততপক্ষে এমন যয়ীফ, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যাকে গ্রহণযোগ্য গণ্য করা হয়। কিন্তু বাহাদুর সাহেব নাম্বার লাগিয়ে হওয়ালার পর হওয়ালা উল্লেখ করতে থাকেন যে, অমুক অমুক কিতাবে এই রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ঐ কিতাবগুলো সবই সনদহীন। এর মধ্যে একটি কিতাবও এমন নেই, যাতে সনদ উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই কিতাবসমূহের লেখকরাও এমন, যাদের উলূমুল হাদীসের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। কিছু লেখক এমন আছেন, যাদের কিছুটা সম্পর্ক থাকলেও উলূমুল হাদীসে মাহারাত বা পারদর্শিতা নেই। অল্প কয়েকজন আছেন যাদের মাঝে মাহারাত ও পারদর্শিতা আছে কিন্তু তারা নিজেদের গ্রন্থে মওযূ, মুনকার ও ভিত্তিহীন রেওয়ায়েত উল্লেখ করবেন না- এমন চেষ্টা করেন না। আর কিছু আছেন এমন, যারা চেষ্টা করবেন বলে এলান করেন, কিন্তু বাস্তবে তাদের কিতাবে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাই না।
মোটকথা, প্রশ্নই তো ছিল এই যে, অমুক অমুক কিতাবে এই সনদহীন রেওয়ায়েতটি যে আছে বাস্তবে এর কি কোনো সনদ আছে না নেই? বাহাদুর সাহেব বলেন যে, হাঁ আছে। দলীল কী? বলেন যে, দলীল হল, এ রেওয়ায়েতটি এই সনদহীন কিতাবগুলোতে আছে!!
বেচারা বাহাদুর নিজের এই আবিস্কৃত পন্থা অনুসারে কোনো কোনো ভিত্তিহীন রেওয়ায়েতের শতের কাছাকাছি হাওয়ালা উল্লেখ করেছেন এবং প্রতিটি হওয়ালার উপর নম্বরও লাগিয়ে লাগিয়ে দলীল শব্দ ব্যবহার করেছেন। অথচ এভাবে দাবিকে দলিল বানালে শত কেন কোনো কোনো রেওয়ায়েতের স্বপক্ষে শতাধিক হাওয়ালা উল্লেখ করাও অসম্ভব নয়।
পুরো কিতাবেই যদিও এ কাজটি তিনি করেছেন তবে এর সর্বাধিক প্রকাশ ঘটেছে নূরের হাদীসে। এ ক্ষেত্রে তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত হাওয়ালা দিয়েছেন তার সবগুলোই সনদহীন। যখন সনদ উল্লেখ করতে গেছেন তখন তিনি কিছুদিন আগে জালকৃত মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকের একটি নুসখার হাওয়ালা দিয়েছেন। যে নুসখার নাসেখ বা লিপিকরের নাম জানা যায় না, কবে তা লেখা হয়েছে তা জানা যায় না, তাতে কোনো শাস্ত্রজ্ঞের দস্তখত নেই, কোন্ কুতুবখানায় এই নুসখাটি ছিল তা উল্লেখ নেই, কার মাধ্যমে প্রকাশক তা পেলেন তাও উল্লেখ করা হয়নি। মোটকথা কোনো কিতাবের কোনো নুসখা গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য যতগুলো শর্তের উপস্থিতি অপরিহার্য তার একটিও এতে নেই। এরপরও প্রকাশক এটি
الجزء المفقود من مصنف عبد الرزاق নামে ছেপে দিয়েছে। অর্থাৎ মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকের হারিয়ে যাওয়া অংশ। এই হারিয়ে যাওয়া অংশ প্রকাশক কার কাছে পেলেন, সেই ব্যক্তি তা কার কাছ থেকে পেয়েছে ইত্যাদি উল্লেখ করা দরকার ছিল। কিন্তু প্রকাশক এগুলো কিছুই বলতে পারেননি। তাই মিশরের আলেম মাহমুদ সায়ীদ মামদূহ যদিও প্রথমে ধোঁকা খেয়ে এর উপর প্রশংসা-মন্তব্য লিখেছিলেন কিন্তু অল্পদিন বাদেই তিনি এই মত প্রত্যাহার করে নেন। এবং এই নুসখা যে প্রমাণিত নয় এবং গলদভাবে মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকের হাওয়ালায় লেখা নূরের হাদীস যে মওযূ তা তিনি এলান করে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন। যা তার কিতাব ‘আল ইত্তেজাহাতুল হাদিসিয়্যাহ ফিল কারনির রাবিয়া আশার’ থেকে যে কেউ পড়তে পারে। কিন্তু বাহাদুর সাহেবের তা দিয়ে কাজ কী? তিনি তো মওযূ ও মুনকার রেওয়ায়েতের তরফদারি করা যেন নিজের জন্য ফরয মনে করেন!!
২. ইজমায়ী উসূল বা ঐকমত্যপূর্ণ মূলনীতির বিরোধিতা
বাহাদুর সাহেবের কিতাবের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, আইম্মায়ে ফিকহ ও আইম্মায়ে হাদীস সবার ইজমায়ী উসূল ও সর্বজনস্বীকৃত নিয়মনীতির বিরোধিতা করা। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো ধরনের দ্বিধা-সংকোচ করেন না। যেমন,
ক. একটি মুজমা আলাইহি তথা ঐকমত্যপূর্ণ মূলনীতি হল, আসরে রেওয়ায়েতের (হাদীস সংকলন সমাপ্ত হওয়ার) পরের মু‘দাল রেওয়ায়েত (সনদহীন রেওয়ায়েত)-কে ‘মুরসাল’ নাম দিয়ে কবুল করার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে এর সনদ পাওয়া যায় তাহলে সনদের অবস্থা অনুযায়ী সেই রেওয়ায়েতের হুকুম হবে, আর যদি সনদ না পাওয়া যায় তাহলে তা ভিত্তিহীন বলে বিবেচিত হবে। হানাফী উসূলে ফিকহের নির্ভরযোগ্য কিতাব ‘কাশফুল আসরারে’র তৃতীয় খণ্ডের ১৭ পৃষ্ঠায় এই মূলনীতি উল্লেখিত হয়েছে। অন্যান্য মাযহাবের উসূলে ফিকহের কিতাব ছাড়াও উসূলে হাদীসের কিতাবাদিতেও এই মূলনীতিটি উল্লেখিত হয়েছে। আল্লামা আবদুল হাই লাখনভী রাহ. ‘যফারুল আমানী’র ৩৪২-৩৪৪ পৃষ্ঠায় ও ‘الأجوبة الفاضلة’-তে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
বাহাদুর সাহেবের অভ্যাস হল, তিনি কোনো ‘বে-আসল’ ও ভিত্তিহীন রেওয়ায়েতকে ‘বা-আসল’ অর্থাৎ ভিত্তি আছে বলে প্রমাণ করার জন্য সনদ ছাড়া (অর্থাৎ ভিত্তি ছাড়া) রেওয়ায়েতেরই হাওয়ালা দিতে থাকেন। আর প্রত্যেক সনদহীন হাওয়ালাকে নাম দিতে থাকেন এভাবে- এক নাম্বার দলীল, দুই নাম্বার দলীল...।
তার এই কর্মনীতি সম্পূর্ণ ভুল ও বে-উসূলী । এই পন্থা অবলম্বন করা হলে দুনিয়ার প্রায় সব মওযূ রেওয়ায়েতকেই সহীহ বলে দেওয়া সম্ভব। আখের মওযূ রেওয়ায়েত তো কোনো না কোন গ্রন্থে থাকবেই। অনেকে তো না জেনে-বুঝে মওযূ রেওয়ায়েত নিজ গ্রন্থে উল্লেখ করেন। আর কেউ কেউ তো শুধু জেনে বুঝে নয়, জেনে বুঝে সওয়াবের নিয়তে মওযূ রেওয়ায়েত নিজ গ্রন্থে উল্লেখ করেন।
বাহাদুর সাহেবের পছন্দের লেখক ইসমাঈল হাক্কী তো এই কাজই করেন। তিনি নিজে তা স্বীকার করেছেন। দেখুন, রুহুল বয়ান, খণ্ড : ৩ পৃষ্ঠা: ৫৭০-৫৭১
বাহাদুর সাহেব হোন বা যেই হোন সবার উচিত ইমামদের এই সর্বস্বীকৃত মূলনীতি মনে রাখা যা আলাউদ্দিন আব্দুল আযীয বুখারী হানাফী (৭৩০ হি.)সহ অন্যান্য ফিকাহবিদ ও মুহাদ্দিসীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন।
আলোচনা সংক্ষেপ করার জন্য শুধু আব্দুল আযীয বুখারীর হাওয়ালা উল্লেখ করছি। তিনি লেখেন,
وذكر في المعتمد، إذا قال الإنسان في عصرنا : قال النبي عليه السلام كذا، يُقبل إن كان ذلك الخبر معروفا في جملة الأحاديث، وإن لم يكن معروفا، لا يقبل، لا لأنه مُرسل بل لأن الأحاديث قد ضُبطت وجُمعت، فما لا يعرفه أصحاب الحديث منها في وقتنا هذا، فهو كذب، وإن كان العصر الذي أرسل فيه المرسل عصرا لم يُضبط فيه السنن قبل مرسله.
এখানে তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে, ‘আসরুর রেওয়ায়াহ’-এর পরে অর্থাৎ হাদীস সংকলিত হওয়ার পর এখন কেউ সনদ ছাড়া কোনো হাদীস উল্লেখ করলে তা এই শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করা যাবে যে তা সংকলিত হাদীসগ্রন্থের কোথাও আছে। যে রেওয়ায়েত সম্পর্কে আসহাবুল হাদীস (হুফফাজে হাদীস ও হাদীস শাস্ত্রবিদগণ) জানেন না- এটির সনদ কী এবং কে তা বর্ণনা করেছে সেই রেওয়ায়েত মিথ্যা। -কাশফুল আসরার, আব্দুল আযীয বুখারী, খণ্ড :৩ পৃষ্ঠা: ১৭ বাবু বয়ানি কিসমিল ইনকিতা
আল্লামা আবুল হুসাইন বসরী রাহ. (৪৩৬ হি.) যার কিতাব ‘আলমু‘তামাদ ফি উসূলিল ফিকহ’ ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী ও আল্লামা আব্দুল আযীয বুখারীর গ্রন্থের বিশেষ উৎস, তিনি তার আলমু‘তামাদ গ্রন্থে আরও স্পষ্টভাবে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি লেখেন,
فأما الخبر الذي إذا فتش عنه أهل العلم ولم يظفروا به في جملة الأخبار، بعد استقرار السنن، فإنه يعلم كذبه، لعلمنا أن الأخبار قد دونت، ورواية الخبر بعدما دونت الأخبار هي رواية لما دون، وننظر فاذا لم يوجد ذلك علمنا كذبه، لأنا لم نشاهده، كما لو قال الراوي : هذا الخبر في الكتاب الفلاني، فلا نشاهده فيه.
‘হাদীস ও সুন্নাহ্র কিতাবাদিতে সংকলিত হয়ে স্থির হয়ে যাওয়ার পর আহলে ইলম যদি সংকলিত সমুদয় রেওয়ায়েতের মাঝে কোনো রেওয়ায়েত খুঁজে না পান তাহলে বোঝা যাবে যে তা মিথ্যা। কারণ আমরা জানি রেওয়ায়েত সংকলিত হয়ে গেছে। এখন কোনো কিছু বর্ণনা করার মানে হল সেই সংকলিত রেওয়ায়েত থেকেই কোনো রেওয়ায়েত বর্ণনা করা। তাই আমরা দেখব সংকলিত রেওয়ায়েতসমূহে উক্ত রেওয়ায়েতটি আছে কি না। যদি না থাকে তাহলে আমরা বুঝব যে তা মিথ্যা। কারণ আমরা তা পাচ্ছি না। বিষয়টি তেমন যেমন কেউ বলল, এই রেওয়ায়েতটি অমুক কিতাবে আছে। কিন্তু কিতাবটি খুলে দেখা গেল যে তা তাতে নেই।’ -আল মু‘তামাদ ফি উসুলিল ফিকহ, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৭৯, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন, ১৪০৩ হিজরী
হায় বাহাদুর সাহেব যদি উসূলে ফিকহ ও উসূলে হাদীসের এই মূলনীতিগুলোর কদর করতেন। তিনি তো উল্টা সেদিন কার লেখা পুস্তিকা ‘নূরে মুজাসসাম’-এর হাওয়ালায় ছাবেত করতে চেয়েছেন যে, নূরের হাদীস ইমাম বায়হাকীর দালায়েলুন নুবুওয়াহতে আছে। তাও তিনি বলতে চান তা দালায়েলুন নুবুওয়াহ-এর ১৩ তম খণ্ডের ৬৩ পৃষ্ঠাতে আছে। অথচ দালায়েলুন নুবুওয়াহ সাত খণ্ডের কিতাব, ১৩ খণ্ডের নয়। আশ্চর্য কথা, রেওয়ায়েত হল দালায়েলুন নুবুওয়াহ’র আর তিনি আমাদের হাওয়ালা দিচ্ছেন ‘নূরে মুজাসসামের’। যদি তার হওয়ালা সত্যি হয় তাহলে সরাসরি দালায়েলুন নুবুওয়াহ থেকে কেন দেখাচ্ছেন না। দালায়েলুন নুবুওয়াহ তো ছেপেছে এবং তার পা-ুলিপি কোথায় কোথায় আছে তাও জানা। ‘নূরে মুজাসসামে’র লেখকের কাছে কি এ কিতাবের কোন আসমানী নুসখা ছিল? আসমানি নুসখা তো দূরের কথা কোনো যমীনী নুসখাও তাঁর কাছে থাকার কোন সম্ভবনা নেই। নূরে মুজাসসামে (পৃ. ২২২) তিনি ‘খণ্ড’ উল্লেখ করে কোন উদ্ধৃতি দেননি। বাহাদুর সাহেবই তার উদ্ধৃতিকে খণ্ড ও পৃষ্ঠা বিশিষ্ট বানিয়ে দিয়েছেন। নূরে মুজাসসামের পা-ুলিপি দেখা হলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে। যাই হোক সোজা কথা হল, ‘দালায়েলুন নুবুওয়াহ’র কোনো নুসখায় এটি থাকলে তা সামনে আনা হোক। হাওয়াই কথা-বার্তার কী গ্রহণযোগ্যতা? মোটকথা, না সনদহীন গ্রন্থে কোনো রেওয়ায়েত উল্লেখিত হওয়ার কোনো গ্রহণযোগ্যতা আছে, আর না সনদসহ কিতাবের ভুয়া হাওয়ালার কোনো গ্রহণযোগ্যতা। বাহাদুর সাহেবের হাওয়ালা হয় প্রথম প্রকারের বা দ্বিতীয় প্রকারের !!
খ. আরেকটি মুজমা আলাইহি মূলনীতি হল, কোন্ রেওয়ায়েত সহীহ ও গ্রহণযোগ্য আর কোন্ রেওয়ায়েত ভিত্তিহীন বা মওযূ এর ফায়সালা করবেন আইম্মায়ে হাদীস ও নুক্কাদে হাদীস বা হাদীস শাস্ত্রের ইমাম ও বিশেষজ্ঞগণ অথবা ফিকহ শাস্ত্রের ঐ সকল ইমামগণ যারা ফিকহের পাশাপাশি হাদীস শাস্ত্রেও পারদর্শী, হাদীস শাস্ত্রে যার দক্ষতা নেই এ ক্ষেত্রে তার কথার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।
বাহাদুর সাহেবের অভ্যাস হল, তিনি যে কোনো লেখকের কথা দিয়েই রেওয়ায়েত সহীহ বা নির্ভরযোগ্য হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করতে লেগে যান। এটি শুধু ইলমী উসূলের বিরোধিতাই নয় বরং সাধারণ বিচার-বুদ্ধিরও এবং সাধারণ বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ইজমারও বিরোধী। কারণ দ্বীন-দুনিয়ার সকল শাস্ত্রে এটি স্বীকৃত যে, প্রত্যেক শাস্ত্রে সেই শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞদের কথাই দলীল হবে। আর এ কথাও স্পষ্ট যে, কোনো শাস্ত্রে কেউ একটি কিতাব লিখে ফেললেই অথবা কেউ কোনো শাস্ত্রের একটি কিতাবের দরস দিলেই তিনি সেই শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে যান না।
কিন্তু বাহাদুর সাহেব কোনো লেখকের কিতাবে তার উদ্দীষ্ট রেওয়ায়েত পেলেই ব্যস তার কথা দলীল হিসেবে উল্লেখ করে দেন। মর্জি হলে তাকে ‘মুহাদ্দিস’ উপাধিও দিয়ে দেন। তিনি তার গ্রন্থের ২১০ পৃষ্ঠায় ইবনুল হাজ মালেকীকে শুধু মুহাদ্দিস নয় ‘বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস’ লিখে দিয়েছেন। (নাউযুবিল্লাহ)
গ. এটিও একটি ‘মুজমা আলাইহি’ উসূল যে কোনো রেওয়ায়েত নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার মাপকাঠি হল সনদ। কাশফ-ইলহাম নয়। কোনো শায়েখ বা বুযুর্গের লেখায় বা কথায় তা উল্লেখিত হওয়াও যথেষ্ট নয়। এমন নয় যে, কারো কাশফ হল বা কোনো বুযুর্গের কথায় একটি রেওয়ায়েত পাওয়া গেল তো এর আর কোনো সনদের প্রয়োজন নেই; এতে একটি রেওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার শর্তাবলি আছে কি নেই- এই তাহকীকেরও প্রয়োজন নেই !!
এ উসূলটি সম্পর্কে মাওলানা মুতীউর রহমানের কিতাবের শুরুতে বিস্তারিত ও দলীলসমৃদ্ধ আলোচনা আছে। এই উসূলের বিরোধিতা করে বাহাদুর সাহেব তার গ্রন্থে কাশ্ফ দিয়ে দলীল পেশ করেছেন (পৃষ্ঠা ১০১)। আর কোনো বুযুর্গের কিতাবে যদি কোনো রেওয়ায়েত উল্লেখিত হয় তাহলে তিনি রেওয়ায়েতটি একেবারে ‘সহীহ’-এর সমার্থক মনে করেন। গোটা বইয়ে তার আঙ্গিক এ ধরনের।
৩. ‘যাল্লাত’ ও বিচ্যুতি দিয়ে দলীল পেশ
বাহাদুর সাহেবের আরেকটি নীতি হল, তিনি লেখকদের তাসামুহ ও ভুল-বিচ্যুতি দিয়ে দলীল পেশ করতে থাকেন। মুতীউর রহমান সাহেব হয়তো কোনো লেখকের সঠিক কোনো কথা নকল করেছেন বা কোনো লেখকের দলীল নির্ভর কথার হাওয়ালা দিয়েছেন, তো বাহাদুর সাহেব তার উপর এভাবে ‘এলযাম’ দেন যে, অমুক লেখক তো ঐ রেওয়ায়েতও উল্লেখ করেছেন, সেটা মেনে নিন।
এটি বাহাদুর সাহেবের বড় আশ্চর্য নীতি। সহীহ কথায় কোনো লেখকের হওয়ালা দিলে সেই লেখকের ভুল-বিচ্যুতিও গ্রহণ করতে হবে, ঐ লেখক যদি মওযূ বা মুনকার কোনো রেওয়ায়েত উল্লেখ করে তো সেটাও গ্রহণ করতে হবে- এ আবার কেমন কথা হল?
এ ধরনের একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করে দেওয়া মুনাসিব মনে হচ্ছে। মুআযযিন যখন أشهد أن محمدا رسول الله বলে তখন আযান শ্রবণকারীরা আঙ্গুলে চুমু খেয়ে তা চোখে মুছবে...। এ বিষয়ক একটি জাল বর্ণনা অনেক প্রসিদ্ধ। এ বর্ণনাটি সম্পর্কে হাফেয শামসুদ্দীন সাখাবী রাহ.-এর একটি ইবারত ভুল বুঝে মোল্লা আলী কারী রাহ. এ কথা বলে ফেলেছেন যে, এ রেওয়ায়েত মারফূআন (তথা রাসূল থেকে) প্রমাণিত না হলেও মাওকুফান (তথা সাহাবী থেকে) যেহেতু প্রমাণিত তো এতটুকুই যথেষ্ট। অথচ এই রেওয়ায়েতের সনদ শুধু একটি। একই সনদে বর্ণিত রেওয়ায়েতের এক অংশ মওকুফ (সাহাবীর আমল) আর আরেক অংশ মারফূ (রাসূলের বাণী)। যদি এই সনদ ছাবেত ও প্রমাণিত না হয় তাহলে মারফু অংশ যেমন ছাবেত হবে না তেমনি মওকুফ অংশও ছাবেত হবে না, কোন অংশই ছাবেত হবে না। কিন্তু মোল্লা আলী কারী রাহ. বিষয়টি খেয়াল করেননি। এখন মোল্লা আলী কারী রাহ.-এর এই বে খেয়ালিকে পুঁজি করে সকল রেজভীরা এ কথাই আওড়াতে থাকে যে, মারফু ছাবেত না হলেও মওকুফ ছাবেত। সব কথা তারা দায়লামী-এর হাওয়ালাতেই বলেন। পিতা দায়লামীর ‘ফিরদাউস’ এবং ছেলে দায়লামীর ‘মুসনাদুল ফিরদাউস’ উভয় গ্রন্থই তো আছে। কোনো আল্লাহর বান্দার যদি হিম্মত হয় তো সে দেখাক যে, এই হল মারফু রেওয়ায়েতের সনদ যা ছাবেত নয় (বাহাদুর সাহেবের কথা অনুযায়ী সহীহ-এর পর্যায়ের নয়) আর এই হল মওকুফ রেওয়ায়েত যার সনদ ছাবেত।
যেখানে বিষয়টি বাস্তবতার নিরিখে তাহকীক সম্ভব সেখানে শুধু সম্ভাবনার ভিত্তিতে কথা কেন? শুধু সম্ভাবনার ভিত্তিতে কি কোনো কিছু ছাবেত করা যায়?
কথা শেষ হয়নি। এ বিষয়ে মাওলানা আব্দুল হাই লাখনবী রাহ.-এরও তাসামুহ হয়ে গেছে তাঁর একটি ফতোয়ায়। লাখনবী রাহ. ‘আন নাফিউল কাবীরে’র ভূমিকা ‘উমদাতুর রিয়াআহ’তে স্পষ্ট বলেছেন, ‘জামিউর রুমুয’ অনির্ভরযোগ্য কিতাব। এমনিভাবে এই কিতাবে এবং তার অপর কিতাব ‘রদউল ইখওয়ান’ এবং ‘যফারুল আমানী’তেও স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘কানযুল উব্বাদ’ ফিকহের অনির্ভরযোগ্য গ্রন্থ এবং এ গ্রন্থে সনদ ছাড়া উল্লেখকৃত রেওয়ায়েতসমূহের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। সম্ভবত লাখনবী রাহ. জীবনের শুরুতে এই ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, আযানের সময় أشهد أن محمدا رسول الله শুনে আঙ্গুলে চুমু খাওয়া মুস্তাহাব। হাওয়ালা উল্লেখ করেছিলেন ‘জামিউর রুমুয’। ‘জামিউর রুমুযে’ এ কথাটি নকল করা হয়েছে ‘কানযুল উব্বাদ’ থেকে। চিন্তা করুন লাখনবী রাহ.-এর স্পষ্ট বক্তব্য অনুসারেই কথাটি একটি অনির্ভরযোগ্য কিতাবে আরেকটি অনির্ভরযোগ্য কিতাবের হাওয়ালায় এসেছে। এরপর আর এর গ্রহণযোগ্যতা কী? কিন্তু লাখনবী রাহ.-এর মাজমুউল ফাতাওয়া গ্রন্থে এক জায়গায় এই ডাবল অনির্ভরযোগ্য কথাটি চলে এসেছে আর এ হাওয়ালাটিই বাহাদুর সাহেবের খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু লাখনবী রাহ. তাঁর নির্ভরযোগ্য অপর একটি গ্রন্থ ‘আসসিয়াআহ’-এর মাঝে যে স্পষ্ট বাক্যে দলীলসহ এ বিষয়ে তাহকীক পেশ করেছেন তা বাহাদুর সাহেবের পছন্দ হয়নি। বাহাদুর সাহেব যে গ্রন্থের খণ্ডন করছেন সে গ্রন্থে লাখনবী রাহ.- এর ‘আসসিয়াআহ’ গ্রন্থের ইবারতের শেষ অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে লাখনবী রাহ. এ বিষয়ে তার ফায়সালা কী তা বলেছেন। তিনি বলেন,
والحق أن تقبيل الظفرين عند سماع اسم النبي في الإقامة وغيرها كلما ذكر اسمه عليه الصلاة والسلام مما لم يرو فيه خبر ولا أثر، ومن قال به فهو المفتري الأكبر، فهو بدعة شنيعة لا أصل لها في كتب الشريعة، ومن ادعى فعليه البيان، ولا ينفع الجدال المورث إلى الخسران.
‘সত্য কথা হল, ইকামত কিংবা অন্য কোথাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম শ্রবণ করা মাত্রই নখে চুমো খাওয়া (এবং তা চোখে বুলিয়ে দেওয়া) সম্পর্কে কোনো হাদীস বা সাহাবীর কোনো ‘আছার’ বা আমল বর্ণিত হয়নি। যে এরূপ দাবি করবে সে চরম মিথ্যাবাদী এবং এটি একটি ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট বিদআত; শরীয়তের কিতাবসমূহে যার কোন ভিত্তিই নেই। -আসসিয়াআহ, খণ্ড : ২ পৃষ্ঠা : ৪৬
তো বাহাদুর সাহেবের এও একটি আনকোরা পন্থা এবং তার গ্রন্থের এটিও এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য যে, তিনি একজন লেখকের দলীলনির্ভর সহীহ কথা বাদ দিয়ে তার দলীলবিহীন ভুল কথা পছন্দ করেন এবং তার তরফদারিতে লেগে যান।
৪. মওযূ বর্ণনা বিষয়ক গ্রন্থের মাধ্যমে দলীল পেশ
এটিও বাহাদুর সাহেবের আশ্চর্য একটি পদ্ধতি। তিনি কোনো রেওয়ায়েত প্রমাণ করার জন্য ঐ সকল গ্রন্থেরও হাওয়ালা দেন যা মওযূ ও ভিত্তিহীন রেওয়ায়েত চিহ্নিত করার জন্য সংকলন করা হয়েছে। এ ধরনের গ্রন্থে যদি প্রাসঙ্গিকভাবে কোনো সহীহ হাদীস চলে আসে তাহলে তা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়। কিংবা কেউ যদি বাড়াবাড়ির শিকার হয়ে কোনো সহীহ রেওয়ায়েতকে মওযূ বলে দেয় অথচ বাস্তবে তা মওযূ নয় তাহলে এমন রেওয়ায়েত উল্লেখ করে স্পষ্ট বাক্যে বলে দেওয়া হয় যে, এটি মওযূ নয়। এ ছাড়া যদি কোনো রেওয়ায়েতকে এ ধরনের গ্রন্থে উল্লেখ করা হয় তাহলে তার অর্থ এ-ই হয় যে, এই রেওয়ায়েত মওযূ বা ভিত্তিহীন। এ ক্ষেত্রে রেওয়ায়েতটি উল্লেখ করে স্পষ্টবাক্যে বলার দরকার নেই যে, এটি মওযূ। যেমন কোনো কিতাবে যদি শুধু সহীহ হাদীস উল্লেখ করা হয় তাহলে সেখানে প্রত্যেক হাদীসের পরে এ কথা বলার দরকার পড়ে না যে, هذا حديث صحيح অর্থাৎ এটি একটি সহীহ হাদীস। তেমনি মওযূ বর্ণনা বিষয়ক গ্রন্থাবলীতে কোনো রেওয়ায়েত উল্লেখ করে هذا خبر موضوع অর্থাৎ ‘এটি একটি মওযূ বর্ণনা’ বলার দরকার পড়ে না।
বাহাদুর সাহেব এই স্পষ্ট বিষয়টিও বুঝতে চান না। তাই তিনি রেওয়ায়েত প্রমাণ করার জন্য শাওকানী, তাহের পাটনী, মোল্লা আলী কারী ও অন্যান্যদের ঐ সকল গ্রন্থের হাওয়ালা পেশ করেন, যা তারা লিখেছেনই মওযূ বর্ণনা উল্লেখ করার জন্য। তিনি মাওলানা মুতীউর রহমান ও অন্যান্যদের উপর এই ‘ইলযাম’ও দিয়েছেন যে, মোল্লা আলী কারী তো রেওয়ায়েতটিকে মওযূ বলেননি। ইয়া রব! তাহলে তিনি ‘আল মওযূআত’ গ্রন্থে তা উল্লেখ করেছেন কেন? বাহাদুর সাহেবের কাছে আমাদের অনুরোধ, তিনি যেন, এসব ক্ষেত্রে মোল্লা আলী কারী রহ.-এর অমর গ্রন্থ ‘আল মাসনূ ফি মারিফাতিল হাদীসিল মওযূ’ গ্রন্থটিও দেখে নেন।
৫. لا يصح -এর ভুল অর্থ
বাহাদুর সাহেবের গ্রন্থে একটি পরিভাষার বিকৃতি হয়েছে অনেক জায়গায়। ঘটনা হল, মুহাদ্দিসীনে কেরাম অনেক রেওয়ায়েতের উপর لا يصح শব্দ ব্যবহার করে হুকুম বলেন। এ শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘সহীহ নয়’। এর দ্বারা কারো মনে হতে পারে যে, তিনি তো একে ‘মওযূ’ বলেননি, শুধু ‘সহীহ নয়’ বলেছেন। এখন হতে পারে যে, রেওয়ায়েতটি সহীহ নয় ঠিকই কিন্তু তা ‘হাসান’ বা শুধু ‘যয়ীফ’।
শাব্দিক অর্থের দিকে লক্ষ্য করে কারো এ ভ্রম হতে পারে। আর তাই ঘটেছে মোল্লা আলী কারী রাহ.সহ আরও একাধিক লেখকের বেলায়। তাই তারা লিখেছেন যে, কোনো রেওয়ায়েত সম্পর্কে لا يصح বলা হলে তা মওযূ হওয়া আবশ্যক নয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে রেওয়ায়েত সম্পর্কে لا يصح বলা হয় তা মওযূও হতে পারে আবার ‘হাসান’ বা ‘যয়ীফ’ও হতে পারে। কিন্তু তাদের এই ধারণা ছিল ভুল। তারা শুধু এ শব্দের শাব্দিক অর্থের প্রতি লক্ষ্য করেছেন, এর পারিভাষিক অর্থের প্রতি খেয়াল করেননি। এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসীনে কেরামের পরিভাষা হল, মওযূ বর্ণনা-বিষয়ক কিতাবাদিতে অথবা মিথ্যাবাদী বা মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত রাবীদের উপর ‘জারহ’ করতে গিয়ে যখন কোনো রেওয়ায়েতের ব্যাপারে لا يصح শব্দ ব্যবহার করা হয় তখন তার সুনির্দিষ্ট অর্থ হল, এই রেওয়ায়েত হয় স্পষ্ট মওযূ অথবা মওযূ এর হুকুমে, যাকে ‘মাতরূহ’, ‘মাতরূক’, ‘ওয়াহি’ প্রভৃতি শব্দে ব্যক্ত করা হয়। ‘মওযূ’ বা ‘ওয়াহি’ বর্ণনা বিষয়ক কিতাবাদিতে অথবা মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত (متهم)বা মাতরূক রাবীদের আলোচনাকালে যে সকল জায়গায় لا يصح শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, সেখানে এ কথা মনে করা যে, এর দ্বারা উক্ত রেওয়ায়েতটি ‘মওযূ’ বা ‘মাতরূহ’ হওয়ার হুকুম লাগানো হয়নি- এই ধারণা মোল্লা আলী কারী ও তাঁর অনুসারীদের ‘লাহনে জালী’ পর্যায়ের ভুল। যদি কোনো রেওয়ায়েতকে ‘হাসান’ বা ‘যয়ীফ’ই বলতে হয় তাহলে তা মওযূ বর্ণনা বিষয়ক গ্রন্থে তারা কেন আনবেন। কিংবা সেই রাবীকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত (متهم) অথবা ‘মাতরূক’ কেন বলবেন?
আরবের হানাফী মুহাদ্দিস শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণকৃত এ শব্দের ব্যবহার নিরীক্ষার আলোকে এই পরিভাষাটির (لا يصح) বিস্তারিত ও দলীলনির্ভর ব্যাখ্যা করেছেন। যা মোল্লা আলী কারী রাহ.কৃত ‘আল মাসনূ ফি মা‘রিফাতিল হাদীসিল মওযূ’-এর মুহাক্কিকের ভূমিকা এবং আব্দুল হাই লাখনবী রাহ.কৃত ‘যফারুল আমানী’র টীকায় দেখা যেতে পারে।
এ ক্ষেত্রে তিনি হানাফী মুহাদ্দিস আল্লামা যাহেদ কাওছারী রহ. ও অপর এক হানাফী মুহাদ্দিস ইবনে হিম্মাত দিমাশকী রাহ.-এর হাওয়ালাও উল্লেখ করেছেন।
বাহাদুর সাহেব মোল্লা আলী কারী রাহ.-এর এই তাসামুহকে পুঁজি করে অনেক জায়গায় মাওলানা মুতীউর রহমান ছাহেবের উপর নারাজ হয়েছেন- কেন তিনি لا يصح শব্দের অনুবাদ ‘ছাবেত নয়’ করলেন। অথচ খোদ বাহাদুর সাহেবের প্রশংসিত ও পছন্দনীয় ব্যক্তিত্ব ইসমাঈল হাক্কীও হাফেয শামসুদ্দীন সাখাবী রাহ.কর্তৃক ব্যবহৃত لا يصح শব্দকে لا يثبت বলে ব্যাখ্যা করেছেন। আশা করি বাহাদুর সাহেব তার গ্রন্থের ৮৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখকৃত ইসমাঈল হাক্কীর ইবারাত এবং নিজের বাংলা তরজমা একটু খুলে দেখবেন।
কথা শেষ হয়নি। মোল্লা আলী কারী রাহ. শুধু (ভুলবশত) এতটুকু বলেছিলেন যে, لا يصح বললে ‘মওযূ’ হওয়া আবশ্যক নয়, অর্থাৎ হতে পারে তা ‘হাসান’ বা ‘যয়ীফ’। এর সরল অর্থ তো এই যে, আবার হতে পারে তা মওযূ। কিন্তু বাহাদুর সাহেব তাঁর গ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় لا يصح -এর অর্থ সুনির্দিষ্টভাবে এই করে দিয়েছেন যে, এ রেওয়ায়েত ‘সহীহ নয়’ তার মানে হল তা ‘হাসান’। দেখুন পৃষ্ঠা: ৮৫, ৮৬, ৯৫।
এই হল তার তাহকীকের অবস্থা।
৬. নামের বিকৃতি
এটিও বাহাদুর সাহেবের গ্রন্থের একটি বড় বৈশিষ্ট্য যে আপনি এতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গ্রন্থের বিরল ও আশ্চর্যরকম উচ্চারণ পাবেন। তিনি কাসতাল্লানীকে দিয়ে এত দলীল পেশ করেন যে তার কোনো সীমা নেই। কাসতাল্লানী যদি কোনো রেওয়ায়েত সনদ ছাড়া উল্লেখ করে অথবা কোনো গ্রন্থের গলদ হাওয়ালা দেয় তবুও তা দলীল বনে যায়। কিন্তু বেচারা কাসতাল্লানী নামের উচ্চারণটা ভালোভাবে জানে না। সব জায়গায় লেখে ‘কুস্তালানী’ !!
১৮৪ পৃষ্ঠায় সুলায়মান জামাল কে লিখেছেন সুলায়মান জুমাল!
৮১ পৃষ্ঠায় হিলয়াতুল আওলিয়া-কে হুলিয়াতুল আউলিয়া লিখেছেন! এই কিতাব থেকে একটি ইসরাঈলী রেওয়ায়েত এবং মওযূ রেওয়ায়েতকে সহীহ নাম দিয়ে নকল করেছেন। কিন্তু কিতাবের নামটিও সহীহ লিখতে পারেননি, ‘হিলয়া’-কে লিখে দিয়েছেন ‘হুলিয়া’!
৭৪ পৃষ্ঠায় আবুস সুয়ূদ আল ইমাদীকে লিখেছেন ‘উমাদি’!
১১৮ পৃষ্ঠায় ‘মাতালিউল মাসাররাত’-কে লিখেছেন ‘মাতালিউল মুসাররাত’!
৪৪৫ পৃষ্ঠায় ‘ইবনে আররাক’-কে লিখেছেন ‘ইরাকি’!
৪৪৬ পৃষ্ঠায় ‘আসনাল মাতালিব’-কে লিখেছেন ‘আস-সুনানিল মুত্তালিব’!
৩৮১ পৃষ্ঠায় ‘লাতায়িফুল মিনান (لطائف المنن) -কে আরবীতে লিখেছেন (اللطائف المنن) আর বাংলায় লিখেছেন এভাবে ‘লাতায়েফুল মানান’!
৩৭৮ পৃষ্ঠাসহ আরও অনেক জায়গায় ‘ইবনুল জাওযী’-কে লিখেছেন ‘যাওজী’!
৪৭৫ পৃষ্ঠায় ‘আল ইলালুল মুতানাহিয়া’-কে লিখেছেন ‘আল-ইল্ললুল মুতানাহিয়্যাহ’!
নামের উচ্চারণের ক্ষেত্রেই যে লেখকের এ অবস্থা, তিনি তাসহীহ-তাযয়ীফ ও জারহ-তাদীল করতে তথা রাবীদের নির্ভরযোগ্য-অনির্ভরযোগ্য বলা এবং হাদীস সহীহ-যয়ীফ নির্ণয় করতে বসে গেছেন?
৭. গলদ তরজমা অথবা জেনেবুঝে বিকৃতি
বাহাদুর সাহেব তার গ্রন্থের ৩৯০ পৃষ্ঠায় ইবনে আব্দুল হাদী রাহ.-এর ইবারাত নকল করেছেন,
روى مرفوعاً عن أنس بإسناد ساقط
এর অর্থ হল, এ রেওয়ায়েত আনাস রা.-এর সূত্রে মারফু হাদীস হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তার সনদ ‘সাকেত’। অর্থাৎ এমন সনদ যার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। একেবারে নীচে পড়া। কিন্তু বাহাদুর সাহেব লিখেছেন, ‘যার সনদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রসারিত’।
ساقط শব্দের এই তরজমা বেচারা কোত্থেকে পেলেন আল্লাহই জানেন। ساقط -কে তিনি باسط বরং مبسوط কীভাবে বানিয়ে দিলেন?! ساقط শব্দ ব্যবহার করে ইবনে আবদুল হাদী এই সনদটি বাতিল হওয়ার হুকুম লাগিয়েছেন। কিন্তু বাহাদুর সাহেব বলছেন যে তিনি ‘ হাদীসের সনদের ব্যাপারে নীরব ছিলেন’?!
৪৯২ পৃষ্ঠায় أحبوا العرب -এর তরজমা করেছেন ‘আরবীকে ভালবাসবে’। অথচ এর অর্থ হল ‘আরবদের ভালবাসবে’। মুনকার রেওয়ায়েতকে ছাবেত ও প্রমাণিত বলার জন্য তার অর্থ বদলে দিয়েছেন যেন ‘নাকারাত’ ধরা না পড়ে। এটা কি অজ্ঞতার কারণে করেছেন নাকি জেনেবুঝে?
১০১ পৃষ্ঠায় ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর ইবারত ليس هذا حديثا صحيحا ولا ضعيفاً উল্লেখ করেছেন। কথার আঙ্গিকে ও আগ-পর দেখলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে এর দ্ব্যর্থহীন অর্থ- ‘এ কথা না কোনো সহীহ হাদীসে আছে, না কোন যয়ীফ হাদীসে’। যার অনিবার্য অর্থ হচ্ছে এ কথা কোনো হাদীসেই আসেনি। কিন্তু বাহাদুর সাহেব এ কথার অর্থ করেছেন মাশাআল্লাহ এরূপ- ‘এ হাদীস হাসান’।
এরপর তিনি বলছেন, ‘এই হাদিসটি প্রথমে দ্বঈফ ছিল পরবর্তীতে বুযুর্গ ওলীদের কাশ্ফ দ্বারা হাদিসখানা ‘বিশুদ্ধ’ প্রমাণিত হয়েছে’। এখন বাহাদুর সাহেবের উচিত এই হাদীসের দু’টি সনদ দেখানো ১. হাসান ২. যয়ীফ । তিনি কাশফের কথা তো উল্লেখ করেছেন কিন্তু এ রেওয়ায়েতের না হাসান কোনো সনদ উল্লেখ করেছেন না যয়ীফ সনদ। সত্তর হাজার কেন সত্তর লক্ষ বার যদি কেউ কালেমার অযীফা পড়ে তাহলে অবশ্যই সওয়াব হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সনদ ছাড়া দলীল ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে এ কথা নিসবত করা যে তিনি বলেছেন, ‘কেউ যদি সত্তর হাজার বার কালিমা পড়ে তার সওয়াব কোনো মৃত ব্যক্তিকে বখশে দেয় তাহলে সে জান্নাতী হয়ে যাবে’- এই মিথ্যাচারের কী অর্থ? কাশফের ভিত্তিতে অথবা স্বপ্নের ভিত্তিতে কোনো রেওয়ায়েতকে সহীহ বলা উসূল পরিপন্থী কাজ। এভাবে কোনো ভিত্তিহীন রেওয়ায়েতকে হাদীসে নববী বলা সম্পূর্ণ না জায়েয। সুন্নতের অনুসারী কোনো আলেম যদি এ ধরনের কোনো কাশফের কথা উল্লেখ করেন তাহলে তা হবে এমন যেমন কেউ তার স্বপ্নের কথা উল্লেখ করল। তদ্রƒপ কোনো আলেমের পক্ষ থেকে কাশফের কোন ঘটনার কথা উল্লেখিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, তিনি তা দলীলে শরয়ী মনে করে উল্লেখ করেছেন। হাঁ কেউ যদি স্পষ্টভাবে এ কথা বলে যে, এটি দলীল তাহলে তা তার ভুল ও বিচ্যুতি বলে বিবেচিত হবে। এ ক্ষেত্রে তার অনুসরণ করা জায়েয হবে না। এ সম্পর্কে মাওলানা মুতীউর রহমানের গ্রন্থের ভূমিকায় দলীল-সমৃদ্ধ আলোচনা আছে।
১৭৫ পৃষ্ঠায় ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছায়া ছিল না’ এই ভিত্তিহীন কথাটির তরফদারি করতে গিয়ে একটি হাদীসে আসা ظلي وظلكم (অর্থাৎ আমার ছায়া ও তোমাদের ছায়া) শব্দদ্বয়কে বদলে দিয়ে বানিয়েছেন شخصي وشخصكم (অর্থাৎ আমার সত্তা ও তোমাদের সত্তা)। ظل শব্দের এই অর্থ কোত্থেকে আবিস্কৃত হল তার কথা না হয় এখন থাকুক। এ হাদীসের আগের অংশে আছে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযরত অবস্থায় তার সামনে জাহান্নামকে পেশ করা হয়। এমনকি জাহান্নামের আগুনে তিনি সবার ছায়া জাহান্নামে দেখতে পাচ্ছিলেন। বাহাদুর সাহেব বলতে চাচ্ছেন, ছায়া নয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেকে ও সাহাবায়ে কেরামকে জাহান্নামে দেখতে পাচ্ছিলেন! নাউযুবিল্লাহ ছুম্মা নাউযুবিল্লাহ!! বেচারা চিন্তা করেনি যে একটি বিকৃতি করতে গিয়ে তার উপর কত বড় মুসিবত এসে পড়ছে।
তার ইবারত দেখুন,
“আর উক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা কোথাও বলেন নাই যে, আমি যমীনে আমার ছায়া ও তোমাদের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। বরং বলেছেন, জাহান্নামে ظل দেখতে পাচ্ছি। ظل অর্থ এখানে যদি ছায়া করা হয় তাহলে কেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেননি জান্নাতেও তোমাদের ছায়া দেখতে পাচ্ছি? কেননা জান্নাতও তখন উপস্থিত ছিল সবার সামনে। এখানে ظل শব্দের অর্থ হবে شخص -এর সত্তা অর্থাৎ সত্তা দেখতে পেলেন। তারা অর্থ করেছেন শুধু জাহান্নামে ظل অর্থাৎ ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। বরং অর্থ হলো জান্নাত, জাহান্নাম উভয় স্থানেই আমার সাথে তোমাদের সত্তা দেখতে পাচ্ছি। ...”
পুরো হাদীসের আরবী ইবারত এই-
عن أنس بن مالك قال : بينما النبي صلى الله عليه و سلم يصلي ذات ليلة صلاة إذ مد يده ثم أخرها فقلنا : يا رسول الله رأيناك صنعت في هذه الصلاة شيئا لم تكن تصنعه فيما قبله؟ قال : أجل إنه عرضت علي الجنة فرأيت فيها دالية قطوفها دانية فأردت أن أتناول منها شيئا فأوحى إلي أن استأخر فاستأخرت و عرضت علي النار فيما بيني و بينكم حتى رأيت ظلي و ظلكم فيها...الحديث. رواه الحاكم في "مستدركه". وقال : هذا حديث صحيح الإسناد و لم يخرجاه، ولم يتعقبه الذهبي في تلخيصه.
এখানে জান্নাতে ظل দেখার কথা নেই। শুধু জাহান্নামে ظل দেখার কথা আছে। এখন বাহাদুর সাহেবের এ কথাটি চিন্তা করুন,
“বরং অর্থ হলো জান্নাত, জাহান্নাম উভয় স্থানেই আমার সাথে তোমাদের সত্তা দেখতে পাচ্ছি।”
চিন্তা করুন কী অর্থ দাঁড়ায়। কীভাবে তিনি সবাইকে জাহান্নামী বানাচ্ছেন।
এই হল বেচারার আরবী-জ্ঞান।
৮. স্পষ্ট মিথ্যাচার ও ইলমী খিয়ানত
কেউ যদি জাহেল হওয়া সত্ত্বেও ভিন্ন শাস্ত্রে নাক গলাতে যায় তাহলে তার ভুল-বিচ্যুতি হতেই থাকে। অজান্তেই সে বিকৃতির অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। খুব স্বাভাবিক কথা যে, এটি ভিন্ন শাস্ত্রে নাক গালানোর অনিবার্য ফল।
কিন্তু বাহাদুর সাহেবের ব্যাপারটি এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তিনি - আল্লাহ তাকে হেদায়েত দান করুন- ইচ্ছাকৃত স্পষ্ট মিথ্যাচার করেন এবং হাওয়ালা দেওয়ার ক্ষেত্রে ইলমী খিয়ানত করেন। নমুনাস্বরূপ কয়েকটি উদাহরণ দেখুন-
১. তিনি তার গ্রন্থের ৪৭৪-৪৭৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
“এ বিষয়ে ইমাম যাওজী রহ. ও মুত্তাকী হিন্দী রহ. তাদের গ্রন্থে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে একটি সূত্র এভাবে বর্ণনা করেছেন-
نا عبد الرحمن بن محمد، قال نا أحمد بن علي بن ثابت، قال : أخبرني الحسن بن أبي طالب، قال : نا أبو بكر محمد بن جعفر بن العباس، قال : نا محمد بن الحسن العسكري، قال : نا العباس بن يزيد البحراني، قال : نا إسماعيل بن علية، قال نا أيوب، عن نافع، عن ابن عمر، عن النبي صلى الله عليه وسلم "وزن حبر العلماء بدم الشهداء فرجح عليهم".
এ হাদীসটি সম্পর্কে ইমাম যওজী বলেন হাদিসটি لا يصح ‘সহিহ পর্যায়ের নয়’। খতিবে বাগদাদী বলেন
قال الخطيب: رجاله كلهم ثقات غير محمد بن الحسن
এ হাদিসের সমস্ত রাবিগণ সিকাহ শুধু ‘মুহাম্মাদ বিন হাসান’ ছাড়া। আমি কিতাবের শুরুতে আলোকপাত করেছি যে কোন মুহাদ্দিস হাদিসটি ‘সহিহ নয়’ বললে তাদের সে বক্তব্য দ্বারা হাদিসটি ‘হাসান’ বুঝায়।”
মন্তব্য : এখানে এক তো لا يصح শব্দের অর্থ বিকৃত করেছেন। কিন্তু স্পষ্টভাবে যে ইলমী খিয়ানত এখানে তিনি করেছেন তা হল খতীব বাগদাদী রাহ.-এর ইবারত অর্ধেক উল্লেখ করেছেন। বাহাদুর সাহেব ইবারত নকল করেছেন ইবনুল জাওযী রাহ.-এর ‘আল ইলালুল মুতানাহিয়াহ’ থেকে। সেখানের ইবারত হল-
رجاله كلهم ثقات غير محمد بن الحسن ونراه مما صنعت يداه
অর্থাৎ এই সনদের সব রাবী ছিকা, মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আসকারী ছাড়া। আমাদের মতে সে-ই এই বর্ণনাটি জাল করেছে।
বাহাদুর সাহেব উপরিউক্ত ইবারতের দাগটানা অংশটি বাদ দিয়ে দিয়েছেন। ইবনুল জাওযী রাহ. এই ইবারত নকল করেছেন খতীব বাগদাদী রাহ.-এর কিতাব থেকে। খতীব বাগদাদীর কিতাব খুলে দেখা যাক সেখানে কী আছে। তারীখে বাগদাদের ২য় খণ্ডের ১৯৩-১৯৪ পৃষ্ঠায় মুহাম্মাদ বিন হাসানের জীবনী। সেখানে তিনি লিখেছেন,
وكان غير ثقه، يروي الموضوعات عن الثقات
অর্থাৎ এ ছিকা (নির্ভরযোগ্য) নয়। ছিকা রাবীদের নামে এ লোক মওযূ রেওয়ায়েত বর্ণনা করে।
এরপর খতীব বাগদাদী রাহ. উদাহরণ স্বরূপ مداد العلماء -এ রেওয়ায়েত ও আরও একটি মওযূ রেওয়ায়েত উল্লেখ করে বলেছেন,
رجال هذين الحديثين كلهم ثقات غير محمد بن الحسن، ونرى الحديثين مما صنعت يداه.
অর্থাৎ এই উভয় হাদীসের রাবী ছিকা, মুহাম্মাদ ইবনে হাসান ছাড়া। আমাদের মতে সে-ই এই দুই বর্ণনা জাল করেছে। (তারীখে বাগদাদ, খতীবে বাগদাদী, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১১৪)
যদি ধরে নিই বাহাদুর সাহেব সরাসরি খতীব বাগদাদীর কিতাব খুলে দেখেননি। কিন্তু ‘আল ইলালুল মুতানাহিয়াহ’ তো তার সামনে। আল ইলালুল মুতানাহিয়াহ থেকে তিনি খতীব বাগদাদীর কথা নকল করেছেন। সেই ইবারতের শেষ অংশ তিনি কেন বাদ দিয়ে দিলেন। যে অংশ তিনি বাদ দিয়েছেন তা থাকলে তো কথা স্পষ্ট হয়ে যেত যে ইমাম ইবনুল জাওযী ও খতীব বাগদাদী উভয়ই এই রেওয়ায়েতটিকে মওযূ বলছেন। এটাও স্পষ্ট হয়ে যেত যে, ইবনুল জাওযী لا يصح বলে তা ‘মওযূ’ বা ‘ওয়াহী’ হওয়ার কথাই বুঝিয়েছেন, ‘হাসান’ হওয়ার কথা নয়। বাহাদুর সাহেবের এই দাগাবাজির কোনো ব্যাখ্যা আছে কি?
শুধু আল ইলালুল মুতানাহিয়াহ নয় খতীব বাগদাদীর কিতাবও তার সামনে আছে। ৪৭৩ পৃষ্ঠায় টীকাতে তিনি খণ্ড নাম্বার পৃষ্ঠা নাম্বার এবং জীবনী নাম্বার (তিনি লিখেছেন হাদীস নাম্বার)সহ খতীব বাগদাদীর তারিখে বাগদাদের হাওয়ালা দিয়েছেন!!
৪৭৩ পৃষ্ঠায় বাহাদুর সাহেব সাখাভী রাহ.-এর কিতাব আল মাকাসিদুল হাসানা’রও হাওয়ালা দিয়েছেন। সাখাবী রাহ.-ও বলেছেন যে, এ সনদে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত রাবী (متهم بالوضع) রাবী আছে। বাহাদুর সাহেব সাখাভীর হাওয়ালা দিয়েছেন ঠিক, কিন্তু সাখাবীর এই বক্তব্য গায়েব করে দিয়েছেন?
২. বাহাদুর সাহেব তার গ্রন্থের ৯৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
“আর হযরত মূসা আ.-এর যুগের হাসিটির সনদ সহিহ পর্যায়ের।” ওই হাদীস কোনটি? ৮১ পৃষ্ঠায় ‘হিলয়াতুল আউলিয়া’র হাওয়ালায় তিনি নকল করেছেন,
حدثنا عبد الله بن محمد بن جعفر، ثنا أبو بكر الدينوري المفسر، ثنا محمد بن أيوب العطار، ثنا عبد المنعم بن إدريس، عن أبيه، عن جده وهب قال: " كان في بني إسرائيل رجل عصى الله مائتي سنة ثم مات، فأخذوا برجله فألقوه على مزبلة، فأوحى الله إلى موسى عليه السلام أن اخرج فصل عليه. قال: يا رب، بنو إسرائيل شهدوا أنه عصاك مائتي سنة، فأوحى الله إليه: هكذا كان، إلا أنه كان كلما نشر التوراة ونظر إلى اسم محمد صلى الله عليه وسلم قبله ووضعه على عينيه، وصلى عليه، فشكرت ذلك له، وغفرت ذنوبه، وزوجته سبعين حوراء "
বাহাদুর সাহেব একে তো ওহাব ইবনে মুনাব্বিহের দিকে মানসুব ইসরায়েলী রেওয়ায়েতকে হাদীস নাম দিয়ে দিয়েছেন। এরপর সিনাযুরি করে তাকে ‘সহীহ’ও বলে দিয়েছেন। অথচ তিনি নিজেই এ বর্ণনার সনদ নকল করেছেন। যদিও বাংলা অনুবাদে সনদ উল্লেখ নেই। এ সনদে আব্দুল মুনঈম ইবনে ইদরীস নামে এক রাবী আছে। যে তার পিতার হাওয়ালায় রেওয়ায়েত বর্ণনা করে। অথচ এই রাবী সম্পর্কে আসমাউর রিজালের কিতাবাদিতে লেখা হয়েছে, এ লোক তার পিতার কাছ থেকে কোন রেওয়ায়েত শোনেনি। পিতার ইন্তেকালের সময় সে দুধের বাচ্চা ছিল। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ. বলেছেন, এ লোক ওহাব ইবনে মুনাব্বিহের নামে মিথ্যাচার করতكان يكذب على وهب بن منبه ইমাম ইবনে মায়ীন বলেছেন الكذاب الخبيث খবীছ প্রকৃতির মিথ্যাচারী। (লিসানুল মীযান, ইবনে হাজার আসকালানী, খণ্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ২৮০; মীযানুল ইতিদাল, শামসুদ্দীন যাহাবী, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৬৬৮)
বাহাদুর সাহেবের বড় বাহাদুরী কর্ম, তিনি মিথ্যাচারীর রেওয়ায়েতকে সহীহ বলে দিচ্ছেন। যে ঘটনাটি ইসরায়েলী রেওয়ায়েত হিসেবেই মিথ্যা, তাকে তিনি রাসূলের হাদীস নামে চালিয়ে দিচ্ছেন!!
৩. গ্রন্থের ৩৮২-৩৮৪ পৃষ্ঠায় একটি মওযূ রেওয়ায়েতের তরফদারি করতে গিয়ে তাতে ইমাম বুখারী রাহ.-এর হাওয়ালাও লাগিয়ে দিয়েছেন। একটু খেয়াল করে লক্ষ্য করুন। ‘আসসিরাতুল হালাবিয়াহ’তে নূরুদ্দীন হালাবী রাহ. লিখেছেন,
ورأيت في كتاب التشريفات في الخصائص والمعجزات لم أقف على اسم مؤلفه، عن أبي هريرة رضي الله تعالى عنه، أن رسول الله صلى الله عليه وسلم سأل جبريل عليه الصلاة والسلام، فقال : يا جبريل كم عمرت من السنين؟ .... رواه البخاري، هذا كلامه
অর্থাৎ আমি ‘আততাশরিফাত ফিল খাসায়িসি ওয়াল মুজিযাত’ নামের একটি কিতাবে দেখেছি। এই কিতাবের লেখকের নাম আমি জানি না। এতে আবু হুরায়রা রা. থেকে রেওয়ায়েত করা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীল আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আপনার বয়স কত?... এটি বুখারীর রেওয়ায়েত। এটি এই (অপরিচিত) লোকের কথা।’
হালাবী রাহ. বলছেন, ‘আততাশরীফাত’ নামের কিতাব, যার লেখকের নাম জানা নেই, তাতে এই রেওয়ায়েত উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর এই রেওয়ায়েত উল্লেখ করে সেই অজানা লেখক এ কথা লিখে দিয়েছে যে, رواه البخاري অর্থাৎ এটি বুখারীর রেওয়ায়েত। তো এই মওযূ রেওয়ায়েতটিকে বুখারী রাহ. কর্তৃক রেওয়ায়েতকৃত হাদীস বলা- এটি আততাশরিফাত নামের কিতাবের অজানা লেখকের কা-। নূরুদ্দীন হালাবী স্পষ্ট লিখেছেন- هذا كلامه অর্থাৎ এটি আততাশরীফাতের লেখকের বক্তব্য। কিন্তু সে কে? তিনি স্পষ্ট বলেছেন, لم أقف على اسم مؤلفه ‘আততাশরীফাতের লেখক কে, আমি জানি না।’
কিন্তু বাহাদুর সাহেব ‘আসসিরাতুল হালাবিয়া’র ইবারত থেকে لم أقف على اسم مؤلفه (এর লেখক কে আমার জানা নেই) অংশটুকু বাদ দিয়ে দিয়েছেন এবং رواه البخاري -এর পরে هذا كلامه এই অংশটি গায়েব করে দিয়েছেন, যে বাক্য দিয়ে হালাবী রাহ. নিজের সম্পর্কহীনতার কথা ঘোষণা করছেন যে, বুখারী রাহ.-এর দিকে এ রেওয়ায়েত আমি মানসুব করিনি।
বড় বড় দুটি দাগাবাজি করে তিনি জোর গলায় এই দাবি করেছেন যে নূরুদ্দীন হালাবী এই রেওয়ায়েত ইমাম বুখারীর কিতাব আততাশরীফাত ফিল খাসায়েসে ওয়াল মুজিযাত থেকে নকল করেছেন?! এখানে আমরা لعنة الله على الكاذبين ছাড়া আর কী বলতে পারি! ইমাম বুখারী রাহ.-এর নামে একটি রেওয়ায়েত নয়, গোটা একটি গ্রন্থই জাল করে দিয়েছেন। তাও আবার নূরুদ্দীন হালাবীর জবানীতে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
এরপর গ্রন্থের ৩৮৩ পৃষ্ঠার টীকায় এই মওযূ রেওয়ায়েতের হওয়ালা এভাবে দিয়েছেন,
“ইমাম বুখারী : আত তাশরীফাতে ফি খাসায়েস ওয়াল মুজিজাত: ২/২৫৪পৃ.”
কেউ গিয়ে তাকে বলা দরকার, কোথায় পেয়েছেন আপনি ইমাম বুখারী রাহ.-এর ‘আততাশরীফাত’; এরপর সেই কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ড এবং ২৫৪ পৃষ্ঠা। আমাদেরকে দেখান। এভাবে প্রকাশ্যে মানুষ মিথ্যাচার করে, যে শুনতেই ঘেন্না লাগে?!
৪. বাহাদুর সাহেব তার গ্রন্থের ৩৬১-৩৬৫ ও ৩৬৯-৩৭০ পৃষ্ঠায় নূর সম্পর্কিত সেই দীর্ঘ ও স্পষ্ট মওযূ রেওয়ায়েতটির তরফদারির জন্য এই মিথ্যার অবতারণা করেছেন যে, এ রেওয়ায়েত কাসতাল্লানী রাহ. (তার উচ্চারণে কুস্তালানী)-এরও অনেক আগে শায়খুল ইসলাম ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে শরফ নববী (৬৭৬ হি.) তাঁর কিতাব ‘আদ দুরারুল বাহিয়্যাহ ফি শরহিল খাসায়িসিন নববিয়্যাহ’তে (পৃ. ৪-৮) উল্লেখ করেছেন।
মিথ্যাচারের উপর আল্লাহর লানত।
আসলে ‘আদদুরারুল বাহিয়্যাহ’ চৌদ্দ শতকের একজন ব্যক্তি মুহাম্মাদ নূরী ইবনে উমর নববী আলজাভী-এর কিতাব। মুহাম্মাদ নূরী ইন্তেকাল করেছেন ১৩১৬ হিজরিতে। কোথায় সপ্তম শতকের ইমাম নববী আর কোথায় চৌদ্দ শতকের মুহাম্মাদ নূরী। মুহাম্মাদ নূরী-এর আদদুরারুল বাহিয়্যাহ ১২৯৮ হিজরিতে ছাপা হয়। (মুজামুল মাতবুআত খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১৮৮২)
এই নূরী বেচারা যদি নূরের হাদীস লিখে থাকে তাহলে আশ্চর্যের কী আছে? কিন্তু এ রেওয়ায়েত ছাবেত করার জন্য ইমাম নববীর নাম উল্লেখ করার কি কোনো প্রয়োজন ছিল যে, শুধু একটি মওযূ রেওয়ায়েত নয় একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ তাঁর নামে জাল করে দেওয়া হল?!
৫. গ্রন্থের ৩৫২ পৃষ্ঠায় সেই নূরের রেওয়ায়েতটি সহীহ প্রমাণ করার জন্য শায়খ আলবানী রাহ.-এর দুই কিতাবের হাওয়ালা দিয়েছেন। বাহাদুর সাহেব লিখেছেন,
“আহলে হাদিস শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী তার একাধিক গ্রন্থে হাদিসটি সংকলন করেছেন। তার সু প্রসিদ্ধ সহিহ হাদিসের গ্রন্থ ‘সিলসিলাতুল আহাদিসুস সহিহাহ’ এর ১/৮২০ পৃষ্ঠায় হাদিস নং ৪৫৮ এ হাদিসটি বর্ণনা করেন। এছাড়া আলবানী তার অপর আরেকটি গ্রন্থে ‘আলবানী ফিল আকায়েদ’ এর ৩/৮১৬ পৃ. প্রশ্ন নং ২৮১, ৩/৮১৮পৃ. প্রশ্ন নং ২৮৪ এ সহ এই কিতাবটির মোট ৯ স্থানে এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।”
সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহাহ খুলে দেখা যাক তিনি কী লিখেছেন। সহীহ মুসলিমের হাদীস خلقت الملائكة من نور... এর অধীনে তিনি লিখেছেন,
وفيه إشارة إلى بطلان الحديث المشهور على ألسنة الناس : " أول ما خلق الله نور نبيك يا جابر". ونحوه من الأحاديث التي تقول بأنه صلى الله عليه وسلم خلق من نور، فإن هذا الحديث دليل واضح على أن الملائكة فقط هم الذين خلقوا من نور، دون آدم وبنيه، فتنبه ولا تكن من الغافلين.
অর্থাৎ ‘এ হাদীসে ইশারা আছে, লোকমুখে প্রসিদ্ধ যে রেওয়ায়েত ‘হে জাবের সর্বপ্রথম আল্লাহ তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন’ এবং এ ছাড়া অন্যান্য রেওয়ায়েত যাতে আছে রাসূল নূরের তৈরি- সবগুলো বাতিল। কারণ এ হাদীসে স্পষ্ট আছে যে, শুধু ফেরশতাদেরই নূর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। আদম ও বনী আদমকে নয়। সুতরাং সর্তক থাকবে। গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত হবে না।’
তো শায়েখ আলবানী নূরের রেওয়ায়েতকে বাতিল বলছেন আর বাহাদুর সাহেব শায়েখ আলবানীর হাওয়ালায় তা ছাবেত করছেন!!
এমনিভাবে বাহাদুর সাহেব ‘মওসুআতুল আলবানী ফিল আকায়েদ’ (বাহাদুর সাহেব কিতাবের নাম সহীহ লেখেননি)-এর হাওয়ালা উল্লেখ করে এই ভুল বার্তা দিতে চেষ্টা করেছেন যে, শায়েখ আলবানী এ গ্রন্থে এই রেওয়ায়েতটির সমর্থন করেছেন। অথচ এ গ্রন্থে স্পষ্ট লেখা আছে যে,
هذا حديث لا هو في البخاري ولا في مسلم ولا في السنن الأربعة ولا الأربعين ولا الأربعمائة، لا أصل لهذا الحديث إطلاقًا، إلا إذا صح التعبير في أمخاخ المخرفين، هذا له وجود هناك فقط، هذا ما هو الإسلام.
অর্থাৎ ‘এ রেওয়ায়েত সহীহ বুখারীতে নেই, মুসলিমে নেই, সুনানে আরবাআতে নেই আরো চল্লিশ কিতাব, আরো চারশ কিতাব (দেখ, কোথাও পাবে না)। এ রেওয়ায়েতের কোনো ভিত্তিই নেই। তবে যদি বলা যায় অলীক কথা তৈরিকারীর মস্তিষ্কে তা আছে। তাহলে সেখানে থাকতে পারে। (মওসূআতুল আলবানী ফিল আকায়িদ, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৮১৬-৮১৭)
শায়েখ আলবানী আরও লিখেছেন,
في الحديث إشارة إلى رد ما يتناقله الناس حتى صار ذلك عقيدة راسخة في قلوب كثير منهم وهو أن النور المحمدي هو أول ما خلق الله تبارك وتعالى، وليس لذلك أساس من الصحة، وحديث عبد الرزاق غير معروف إسناده، ...
এ হাদীসে ইশারা রয়েছে যে, নূরে মুহাম্মাদী সংক্রান্ত রেওয়ায়েত মারদূদ ও অগ্রহণযোগ্য। যাকে মানুষ এত চর্চা করেছে যে অনেকের তা দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। অথচ এর কোনো প্রামাণিক ভিত্তি নেই। আব্দুর রাযযাকের হাওয়ালায় যে রেওয়ায়েত বর্ণনা করা হয় তার সনদ জানা যায় না। (মওসূআতুল আলবানী খণ্ড : ৩ পৃষ্ঠা : ৮১৮)
আরও দেখুন সিলসিলাতুল আহাদিছিস সহীহাহ ১/১/২৫৭-২৫৮
একটু চিন্তা করুন, আলবানী সাহেবের খণ্ডন করতে বসে তার নামেই মিথ্যাচারের কী প্রয়োজন? আলবানী সাহেবের মতে নূরে মুহাম্মাদীর রেওয়ায়েত শুধু মওযূ নয় বরং অলীক কল্পকারদের মস্তিষ্কের বানানো রেওয়ায়েত। কিন্তু আমাদের বাহাদুর সাহেব তাঁর হাওয়ালায়ই এই রেওয়ায়েত সহীহ প্রমাণ করতে চাচ্ছেন।
৯. বাতিল আকীদার সমর্থন
বাহাদুর সাহেবের অসন্তুষ্টির মূল কারণ এই নয় যে, মওযূ রেওয়ায়েতকে মওযূ বলার কারণে তার খারাপ লেগেছে। আসল কথা হল, তিনি আহমদ রেজা খান বেরেলভীকে ইমাম মানেন। আহমদ রেজা খান বেরেলভী যে শিরকী বেদআত ও আমলী বেদআতসমূহের তরফদারি করেছিলেন সেগুলোর ভিত্তি ছিল মওযূ রেওয়ায়েত বা দলীলে শরয়ীর বিকৃতি। বা বেশি হলে যয়ীফ রেওয়ায়েত বা নিজের আবিষ্কার করা বিভিন্ন কিয়াস।
আমার মনে হয়, বাহাদুর সাহেব নারায হওয়ার আসল কারণ হল, যে রেওয়ায়েতগুলো রেজা খানী বিভিন্ন বিদআতী মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং রেজা খানী রসম-রেওয়াজের ভিত্তি, সে রেওয়ায়েতগুলোকে কেন মওযূ ও ভিত্তিহীন বলা হচ্ছে। বাহাদুর সাহেব এই বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম গায়েব জানা ও হাযির-নাযির হওয়া- এ ধরনের শিরকী আকীদার তরফদারিও করতে চেয়েছেন।
১০. কটূক্তি ও অশ্লীল গালিগালাজ
এ বিষয়টির দিকে আপনি নিজেও ইশারা করেছেন, এটিও বাহাদুর সাহেবের কিতাবের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। এ সম্পর্কে আলোচনা করা আমি মুনাসিব মনে করছি না।
যাই হোক এ বিষয়গুলো আলাচনার পর আশা করছি পাঠক বুঝতে পেরেছেন যে, কেন বাহাদুর সাহেবের গ্রন্থের খণ্ডন লেখা হয়নি। যদি আপনি বাহাদুর সাহেবের গ্রন্থ পড়তে চান তাহলে ‘এসব হাদীস নয়’-এর উভয় খণ্ড সামনে নিয়ে পড়–ন। উভয় খণ্ডে যে আরবী হাশিয়া আছে তাও পড়–ন। তাহলে ইনশাআল্লাহ বাহাদুর সাহেবের ভুল-বিচ্যুতি ও ভুল বয়ান দ্বারা আপনি প্রভাবিত হবেন না।
শেষ কথা
আপনি অন্য তিন গ্রন্থ সম্পর্কেও আমার মতামত জানতে চেয়েছেন। শায়খ আলবানী রাহ.-এর সিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফা ওয়াল মওযূআহ সম্পর্কে আমি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করেছিলাম আলআউসার ২০০৫-এর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। এ কিতাবে আপত্তিকর অনেক কিছু আছে। কিন্তু এর অর্থ তো এই নয় যে, শায়েখ আলবানী একটি মওযূ রেওয়ায়েতকে মওযূ বলেছেন আর বাহাদুর সাহেব জোর জবরদস্তি করে তা সহীহ ছাবেত করা শুরু করে দিবেন। জনাব ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেবের (হাফিযাহুল্লাহু ওয়া রআহু) কিতাব আমি পড়িনি। তাই এ ব্যাপারে কোনো মতামত দিতে পারছি না। কিন্ত বাহাদুর সাহবের কিতাবে তার উপর যে অন্যায় আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে, তাকে গালমন্দ করা হয়েছে তা তো নিঃসন্দেহে যুলুম। এমনিভাবে সত্য কথা হল, জনাব যাকারিয়া হাসনাবাদী সাহেবের কিতাবও আমি এখনও পড়তে পরিনি। কিন্তু তার সম্পর্কে তো কিতাবের শুরুতে হযরত বাবুনগরী ও অন্যান্য আকাবিরের মতামত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বাহাদুর সাহেবকে নিজ গ্রন্থ নযরে ছানী করে তার ভুল-বিচ্যুতিগুলো সংশোধন করে নেওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
১১/৪/১৪৩৭ হিজরী
সকাল সাড়ে পাঁচটা