Jumadal Ula 1437   ||   February 2016

প্রতিবেশী : রাষ্ট্রীয় অভয়াশ্রম!

খসরূ খান

এক সপ্তাহ আগে আর পরে। দুজন ক্ষমতাধরের দুটি বক্তব্য। মিলিয়ে দেখলে অর্থ বের হয় একটাই। দুজনই ভারতের নেতা। একজন রাজনাথ সিং। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি গত ২২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগরের এক সভায় কথা বলেছেন। তার কথা হলো, বাংলাদেশে নির্যাতিত হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদের ভারতে সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য আইন তৈরি করবে ভারত। বেনাপোল সীমান্তলাগোয়া এ এলাকাটিতে এসে তিনি বাংলাদেশে হিন্দুনির্যাতনেরজন্য রাশি রাশি সহানুভূতি ঝেড়েছেন। সঙ্গে অভিযোগ ও হুমকিও ছাড়তে ভুলেননি।

অপরদিকে ঠিক একসপ্তাহ পর বলেছেন প্রবীণ তোগাড়িয়া। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাপতি। তার কথা আরো ধারালো। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ প্রবেশ ঠেকাতে দ্রুত মৃত্যুদণ্ডের আইনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া অবিলম্বে অনুপ্রবেশকারীদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থাও করতে হবে। যাতে করে ভারতকে হিন্দুদের জন্য একটি উন্নত, নিরাপদ এবং সম্মানিত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা যায়।তোগাড়িয়া আরো দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ ও পকিস্তান থেকে কোনো হিন্দু ভারতে প্রবেশ করলে তাদের শরণার্থী হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। আর যত দ্রুত সম্ভব ভারতে তাদের নাগরিকত্বও দিতে হবে।

একটি ব্যক্তব্যের দুটি পিঠ। একটিতে বলা হচ্ছে, হিন্দুদের শরণার্থী ঘোষণা করা হবে। নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অপরটিতে বলা হচ্ছে, অনুপ্রবেশকারীদের মৃত্যুদ- দিতে হবে। সেজন্য দরকারে আইন-কানুনও সংশোধন করতে হবে। অথচ দেশটি নিজেদেরকে দাবি করে -ধর্মনিরপেক্ষ। এমন ধর্মনিরপেক্ষ যে পাশের দেশের স্বজাতি-বিদ্বেষী সুশীলরা পর্যন্ত তাদের উদারতায়আটখানা হয়ে থাকে বারো মাস। সেই দেশ হিন্দুদের জানাচ্ছে স্বাগত। আর মুসলমানদের কল্লাকাটার আইন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রকাশ্যে। ওরা মুখের শব্দে হিন্দুদের সঙ্গে বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদেরও অন্তর্ভুক্ত করছে। মুসলমানদের আলাদা করে দেখানোর জন্য। পদ্ধতির চরম নোংরামি! অথচ বাস্তবতা তারাই কিন্তু উল্টো করে রেখেছে। খ্রিস্টানদের বিভিন্ন চার্চ ও গির্জায় হামলা ও হত্যা তাদের দেশে পুরনো কোনো ঘটনা নয়। বৌদ্ধরাও তাদের দেশে সুখে নেই। তারপরও মুখের একটা জমাখরচ তারা দিল। এজন্য যে মুসলিমবিদ্বেষে অন্য সংখ্যলঘুদের সঙ্গে নিয়ে একাট্টা একটা ছবি তাহলে দাঁড় করানো যায়। কিছু যুক্তি ও সহানুভুতির ছোঁয়া নেয়া যায় দূরের দেশ থেকেও। তারা যে বলেছে- অনুপ্রবেশকারীদের মৃত্যুদ- দেয়ার আইন করতে হবে- এ নিয়েও আছে ধূ¤্রজাল ও প্রশ্ন। কারণ, হিন্দু পরিষদ আর বিজেপির কাছে ভারতে বসবাসকারী সব মুসলিমই অনুপ্রবেশকারী। তারা শব্দটিকে প্রকৃত অনুপ্রবেশকারী অর্থে ব্যবহার করে না। সত্য হচ্ছে, পাশের মুসলিম দেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করার মতো কোনো উপলক্ষ কিংবা কারণও নেই। অর্থনীতি কিংবা জন-নিরাপত্তায় ভারত কি খুব এগিয়ে? বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মুসলমানরা ওখানে কোন রুটি-রুজির জন্য দলে দলে ভিড় করবে? মুসলমানরা সেখানে যান ভ্রমণে। আর তার পেছনেও থাকে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত বহু প্রেক্ষাপট। আসলে ভারতের হিন্দুবাদী নেতারা এসব বিষয় বিলক্ষণ জানেন। সেজন্যেই তাদের মুখের অনুপ্রবেশকারীকথাটির মানেই হলো- অ-হিন্দু ভারতীয়। হিন্দু ছাড়া অন্য সব ধর্মের অনুসারীকে তারা মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে ভারতছাড়া করতে চায়। তোগাড়িয়া তো স্পষ্ট করে বলেছেনই- ‘যাতে করে ভারতকে হিন্দুদের জন্য একটি উন্নত ও নিরাপদ এক সম্মানিত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা যায়।

বিজেপির লোকদের এসব কথা একদম নতুন নয়। যতদূর খোঁজ পাওয়া যায়, বহু আগে থেকেই এরকম কথাবার্তা তারা বলে এসেছেন। নির্বাচনের আগে-পরে তো স্বয়ং মহামতি মোদি সাহেবও সুর চড়া করেছেন এ সব বিষয় নিয়ে। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরেও এ-জাতীয় খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়েছে। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলেন, তারা উপরে উপরে এসব বলছেন। আর ভেতরে ভেতরে ৪৭ পরবর্তী সময়ের হিন্দু শরণার্থীদের আবার পাশের মুসলিম দেশগুলোতে পাঠানোর ক্ষেত্র তৈরি করছেন। অতীতে তো বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় বাংলাভাষী মুসলমানদের পুশইন করার ঘটনা তারা ঘটিয়েছেই। এবার হয়তো প্রতিবেশী দেশগুলোতে অনুকূল পরিবেশ পেয়ে উল্টো কিছুর ক্ষেত্র প্রস্তুতিই চালানো হচ্ছে। কারো কারো বিশ্লেষণ কিছুটা ভিন্ন। তারা বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সব হিন্দুর জন্য ভারতকে প্রকাশ্যে অভয়াশ্রমঘোষণা করার একটি অন্য অর্থও দাঁড়িয়ে যায়। সেটি হল, ওইসব দেশে (বাংলাদেশ-পাকিস্তান) যত সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতাই চালাক- সে যদি হিন্দু হয় বিপদে পড়লে অনায়াসে ভারতে আশ্রয় নিতে পারবে। বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানে হত্যা, গুম, খুন সব কিছু করে গেলেও ভারতের দরজা তার জন্য খোলা থাকবে। সুযোগ-সুবিধা, নাগরিকত্ব সব পাবে। এটা যে এখনও বন্ধ আছে- এমন নয়। কিন্তু এ-জাতীয় প্রকাশ্য ঘোষণার অর্থ হলো, এ সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে খোলামেলা এলান দিয়ে দেওয়া। যাতে প্রতিবেশী দেশে বসবাসরত হিন্দুরা এখন ব্যক্তিগত, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্রাইম করতে গিয়ে সব শংকা ঝেড়ে ফেলতে পারে। রাজনাথ ও তোগাড়িয়া কি তাহলে মহা উসকানিই দিলেন?

হতে পারে আরো কিছু বিষয়। এসব তর্জন-গর্জন আর আশ্বাসের অর্থ বিশ্লেষকরাই ভালো বলতে পারবেন। আমাদের মতো নিরীহরা কী আর বলবো! কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ করে আমরা একটু অবাক হলাম। বলা হতো, দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-ভাগের দাবি তুলে একশ্রেণির মুসলিম নেতারা ভুল করেছেন। দ্বি-জাতিতত্ত্বটাই নাকি ভুল। হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গেই থাকবে ভারতে। তাদের সব অধিকার ও প্রাপ্যতাও হবে এক। এখন তো দেখছি ভারত রাষ্ট্রের নেতা ও হিন্দু ধর্মের নেতারা আঙুল দিয়ে দেখালেন যে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ধারণা ঠিকই ছিল। মুসলমানদের গালি দিলেও দ্বি-জাতিতত্ত্বের ধারণাটিকে ক্ষুদ্রতর গণ্ডিতে ঠেলে নেয়ার কাজটি কিন্তু হিন্দু নেতারাই বেশি করছেন। বর্তমানেও, অতীতেও। দ্বি-জাতিতত্ত্বের সবচেয়ে চারণশালা হলো ভারত। সাম্প্রদায়িকতার বীভৎস বীজতলাও। বিষয়টি এভাবে বুঝতে বাধ্য না হলেই ভালো হতো। কিন্তু কী করবো? তারা তো চোখে আঙুল দিয়েই সব কিছু বার বার দেখান। বুঝতেও বাধ্য করেন। 

 

advertisement