Jumadal Ula 1437   ||   February 2016

আযানের কথা

মুস্তাফিজুর রহমান

আল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবার। আযানের সূচনা ধ্বনি। প্রতিদিন আমরা পাঁচবার এই আযান ধ্বনি শুনে থাকি। আযান ধ্বনিগুলোর অর্থ সবাই না বুঝলেও এ কথা সবাই বুঝে যে, এখন নামাযের সময় হয়ে গেছে। একটু পরেই জামাত শুরু হবে। তথাপি আযানের রয়েছে গূঢ় অর্থ ও মর্ম।

মর্ম ও তাৎপর্য : দুনিয়াতে অনেক কিছুই আছে বড়। রয়েছে বড়ত্বের অহমিকা ও দম্ভ। কিন্তু আল্লাহর বড়ত্ব সব কিছুকে ছাপিয়ে। দুনিয়াতে কোনো কিছুকে বা কাউকে বড়ত্ব তিনিই দান করেন। মহা মহীম সেই আল্লাহর মহিমা ও বড়ত্ব দিয়ে সূচনা হয় আযান-ধ্বনির। মানুষ যেন বিনয়াবনত হয় আল্লাহর বড়ত্বের কথা ভেবে।

এরপর রয়েছে তাওহীদের সাক্ষ্য। তাওহীদের বিশ্বাস মানুষকে করে দেয় সবচে দামী, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী।

এরপর আযানের ধ্বনিতে রয়েছে রিসালাতের সাক্ষ্য। রিসালাতের সাক্ষ্য ছাড়া তাওহীদের স্বাক্ষ্য অর্থহীন। উভয় সাক্ষ্য মিলে ঈমান পূর্ণ হয়। রিসালাতের সাক্ষ্য আমাদের এই বার্তাই দেয় যে, পৃথিবীর অন্য কোনো পথ ও মতে প্রকৃত সফলতা ও কামিয়াবী নেই। দৃশ্যত যতই তা যুক্তিযুক্ত ও হৃদয়গ্রাহী হোক না কেন। সুতরাং রাসূলের অনুসরণই আমাদের শিরোধার্য।

উপরন্তু এতে আরো রয়েছে নামায ও কল্যাণের দিকে আহ্বান। তাওহীদ ও রেসালাতের পরই নামাযের স্থান। হযরত উমর রা. বলেছেন, আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নামায। আযানের শব্দ বিন্যাসেও সেই ধারাক্রম রক্ষা করা হয়েছে।

কল্যাণ-গ্রহণ মানুষের স্বভাবজাত প্রেরণা। কিন্তু তাওহীদ, রিসালাত ও নামাযের কল্যাণের দিকে আহ্বান এই তাৎপর্যই বহন করে যে, জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণ আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশনার মধ্যেই নিহিত। শুধু নিজস্ব মেধা ও বোধ-বুদ্ধি এ ক্ষেত্রে বিচার্য নয়।

তারপর আযানের শব্দে পুনরায় এসেছে আল্লাহর বড়ত্বের উচ্চারণ। মানুষ যেন কখনোই অহংবোধে পতিত না হয় সেজন্যে আল্লাহর বড়ত্বের কথা বার বার। অহমিকা এতই জঘন্য যে, তা মানুষকে সত্য গ্রহণে বাধা প্রদান করে।

অবশেষে তাওহীদের বাণী পুনঃউচ্চারণের মধ্য দিয়ে আযান শেষ হয়। মানুষ যেন সর্বদাই তাওহীদের বিশ্বাসে অটল থাকে। তাওহীদের বিশ্বাস নিয়েই যেন তার জীবনের শুভ সমাপ্তি ঘটে।

গুরুত্ব : আযান ইসলামের একটি শিআর বা অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ নিদর্শন। শিআরের গুরুত্ব স্বীকৃত।

ইসলামের শুরুর দিকে মুমিনদের কীভাবে নামাযের জন্য একত্র করা হবেÑ এ বিষয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে পরামর্শ সভা করেছেন। বিভিন্ন সাহাবী বিভিন্ন রকম মত দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল নানা কারণে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় সে সব মত খ-ন করেছেন। অবশেষে জিবরীল আ.-এর মাধ্যমে স্বপ্নযোগে এক সাহাবী আযাানের শব্দগুলো জানতে পারলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনে তা সমর্থন করলেন। তো আযানের কালিমাগুলো সম্পূর্ণরূপে ঐশী নির্দেশনাপ্রসূত। এবং আল্লাহর রাসূল কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আযান কতটা গুরুত্ববহÑ আযানের শুরুতেই তা স্পষ্ট।

আযানের গুরুত্বের আরেকটা দিক এটাও যে, আযান শুধু শ্রবণের জন্য নয়। প্রত্যেক শ্রোতাকে তার জবাব দিতে হয়। মৌখিক জবাবের পাশাপাশি সবচেয়ে মর্মবহ জবাব হচ্ছে আযান শুনে মসজিদে গমন করা।

সর্বোপরি আযান হচ্ছে নামাযের আহ্বান। আর নামাযের গুরুত্ব যে সর্বাধিক তা বলাই বাহুল্য। হযরত উমরে ফারূক রা. থেকে বর্ণিত :

إِنَّ أَهَمُّ أُمُورِكُمْ عِنْدِي الصَّلَاةَ، مَنْ حَفِظَهَا وَحَافَظَ عَلَيْهَا حَفِظَ دِينَهُ، وَمَنْ ضَيَّعَهَا فَهُوَ لِسِوَاهَا أَضْيَعُ.

অর্থ : তোমাদের সব বিষয়ের  মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সালাত। যে তা রক্ষা করেছে অথবা বলেছেন যে, এ ব্যাপারে যতœবান হয়েছে সে তার দ্বীনকে রক্ষা করেছে। আর যে তা ধ্বংস করেছে সে অন্যান্য ব্যাপারে আরো বিধ্বংসী। Ñমুয়াত্তা মালেক, হাদীস ৬; সুনানে কুবরা, বায়হাকী হাদীস ২০৯৬

ফযীলত : আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ যদি আযান ও প্রথম কাতারের ছাওয়াবের কথা জানতো তাহলে লটারি করে হলেও তা অর্জনের চেষ্টা করত। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬১৫, ২৬৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৩৭

হযরত মুআবিয়া রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেয়ামতের দিন সুদীর্ঘ গ্রীবার অধিকারী হবে মুআযযিনগণ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৮৭

অন্য হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ছাওয়াবের প্রত্যাশায় সাত বছর আযান দিবে তার জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তি লেখা হবে। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ২০৪

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ইমাম যিম্মাদার, মুয়াযযিন আমানতদার। হে আল্লাহ! আপনি ইমামদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আর মুয়াযযিনদের ক্ষমা করুন। -সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৫৩১-১৫৩২; মুজামে কাবীর তবারানী, হাদীস ২০৩

এছাড়াও আযানের অনেক ফযীলত হাদীসে বিবৃত হয়েছে, যা আযানের গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়।

শিক্ষা : আল্লাহর বড়ত্ব স্বীকার করা, বর্ণনা করা। ঈমান-আক্বীদার হেফাযত করা। ঈমানের নবায়ন করা। নামাযের দিকে, কল্যাণের পথে দাওয়াত দেওয়া। তাওহীদের বিশ্বাসকে খালিছ করা এবং অব্যাহত রাখা।

শেষকথা, পৃথিবীতে বহু ধর্ম আছে। প্রত্যেক ধর্মের রয়েছে ইবাদত-উপাসনার নিজস্ব পদ্ধতি। কিন্তু নামাযের দিকে আহ্বানের এই পদ্ধতি -আযান- এক অনন্য অনুপম আদর্শ। তাৎপর্য-মণ্ডিত এক শিক্ষা ও ঐশীপ্রেরণাজাত এক নিদর্শন।

 

 

advertisement