সিলেটের বুযুর্গ আলেম হযরত মাওলানা মুশাহিদ রাহ.
একজন প্রথিতযশা মুহাদ্দিস ও বিজ্ঞ আলেমরূপে সিলেট বিভাগের সর্বাধিক পরিচিত ও স্বীকৃত আলেম ছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ মুশাহিদ রাহ.। (মৃত্যু ১৯৭০) তিনি সুদীর্ঘকাল ধরে সিলেটের বন্দর বাজার জামে মসজিদে তারাবীর নামাযের পর সেহরীর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ তাফসীর বর্ণনা ও ওয়ায-নসীহত করতেন। সিলেট শহর ও উপকণ্ঠের অনেক মসজিদের শত শত মুসল্লী গভীর রাত পর্যন্ত তাঁর উপভোগ্য ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শোনার জন্য বন্দর বাজার জামে মসজিদে সমবেত হতেন। মাওলানা মুরতাহিন বিল্লাহ ও আমি আমাদের ছাত্রজীবনে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত কলাপাড়ার জায়গীর বাড়ি থেকে দুই আড়াই মাইল পথ পায়ে হেঁটে বন্দরবাজার জামে মসজিদে প্রতিদিনই হাযির হতাম। এটি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে অব্যাহত থাকে। মাওলানা মুশাহিদ রাহ.-এর ইন্তেকালের পর অপেক্ষাকৃত নওজোয়ান আলেম সিলেট আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা অলিউর রহমান (শহীদ) কয়েক বছর সে দায়িত্ব পালন করেন। এভাবে বন্দরবাজার জামে মসজিদ গোটা রমযান মাস তিলাওয়াত-তাফসীর, হামদ-নাত ও গযলে মুখরিত থাকত। অনেকে কেবল এই তাফসীর মাহফিলে নিয়মিত হাযির থাকার উদ্দেশ্যে সিলেটের আগেকার দিনে বিখ্যাত মুবারক হোটেল ও জামে মসজিদ সংলগ্ন মুসলিম হোটেলে মাসব্যাপী অবস্থান করতেন। এককথায় বন্দর বাজার জামে মসজিদ সেকালে একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা পালন করে। সিলেটের গণমানসে তার বিরাট প্রভাব ছিল। যেমনটি ইতিপূর্বে হযরত মাদানীর উপস্থিতিতে নয়াসড়ক মসজিদের ছিল।
দ্বিতীয় জনপ্রিয় ওয়ায়েয ছিলেন মাওলানা আব্দুল লতীফ ফুলতলী রাহ.। হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরীর পুত্র ঢাকার চকবাজার মসজিদ প্রাঙ্গণে চিরনিদ্রায় শায়িত হযরত মাওলানা হাফিয আহমদ জৌনপুরীর খলীফা হযরত মাওলানা ইয়াকুব (উরফে হাতিম আলী)। উজ্জ্বল নূরানী চেহারামণ্ডিত সুকণ্ঠী একজন কারী হিসাবেও তাঁর খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা ছিল। নবী-জীবনী ও স্বরচিত উর্দু কবিতাসহ তাঁর কয়েকটি উর্দু গ্রন্থও ছিল। তিনি তাঁর দুইখণ্ডে সমাপ্ত উর্দু সীরাত গ্রন্থ منتخب السير স্বহস্তে আমাকে হাদিয়া স্বরূপ দিয়েছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত সীরাতুন্নবী স্মরণিকায় আমি এর উল্লেখও করেছি।
মাওলানা মুহাম্মাদ মুশাহিদ রাহ. ছিলেন ঘন কৃষ্ণ বর্ণের বড় নাক বিশিষ্ট অনেকটা হাবশী গড়নের অপেক্ষাকৃত বেঁটে আকৃতির। কিন্তু তাঁর জ্ঞান-গরিমা ও প্রাণখোলা আবেগসমৃদ্ধ বক্তব্যের জন্যে তিনি সিলেটবাসীর কাছে ‘কালোমানিক’রূপে সমাদৃত ছিলেন। তাঁর লিখিত দুটি উর্দু গ্রন্থ খুবই মশহুর। এর একটি হচ্ছে ১৯৪৮ সালে ভারতের রামপুর থেকে মুদ্রিত
فتح الكريم في سياسة النبي الأمين
যা ‘ইসলামের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার’ শিরোনামে বন্ধুবর অধ্যাপক আবু সাঈদ ওমর আলী মরহুম কর্তৃক অনূদিত হয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। তাঁর অপর বিখ্যাত গ্রন্থটি হচ্ছে الفرقان শিরোনামে লিখিত তাসাউফ সংক্রান্ত গ্রন্থ। একজন সিলেটী আলেমের লেখা এত উচ্চাঙ্গের দুটি কিতাব সেই পাকিস্তানী আমলের প্রথম দিকে বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে পুস্তক আকারে হিন্দুস্তান থেকে মুদ্রিত হয়ে এসে সিলেটবাসী আলেম উলামাকে তাক লাগিয়ে দেয়। জাতীয় অধ্যাপক দার্শনিক পণ্ডিত দেওয়ান মুহাম্মাদ আজরফ সাহেব প্রথমোক্ত পুস্তকটিকে ইসলামী অর্থনীতি ও রাজনীতির একটি মাইলফলক বলে গণ্য করতেন। আমি তাঁর নিজ মুখের এ প্রশংসা-বাক্যটি শুনেছি। আসলেও কিতাবখানি উচ্চাঙ্গের অনেক মৌলিক ইসলামী গ্রন্থাদির বরাতে লিখিত। লেখকের পাণ্ডিত্যের ছাপ পুস্তকখানির পাতায় পাতায় বিধৃত হয়েছে। দেওয়ান মোহাম্মাদ আজরাফ সাহেব তাই বলেছিলেন, মাওলানা হিফযুর রহমান সিয়ুহারভী রাহ. লিখিত اسلام كا معاشی نظام -এর পর গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের আলেম সমাজের লিখিত এটি দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
মাওলানা মুশাহিদ বাইয়মপুরী রাহ. নিজে আমাকে বলেছেন, দিল্লীর সর্ববৃহৎ পাঠাগারের এমন অনেক কিতাব তিনি পাঠ করেছেন, যেগুলোর পাতাও কাটা ছিল না। তিনি নিজেই প্রথম সেগুলোর পাতা কেটে কেটে সর্বপ্রথম পাঠক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। এমন অনেক কিতাবের কথাও তিনি আমাকে বলেন, যেগুলো সম্পর্কে স্বয়ং লাইব্রেরীয়ান তাঁকে বলেছেন, একমাত্র মুফতীয়ে আযম মুফতী কিফায়াতুল্লাহ ছাহেব ছাড়া আর কেউই এসব দুর্বোধ্য উচ্চাঙ্গের কিতাব স্পর্শ করেও দেখার সাহস পাননি, পড়া তো দূরের কথা। কথিত আছে, তিনি যখন ভারত-বিভাগপূর্ব কালে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে দেশে ফিরেন তখন তাঁর উস্তায শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ. বলেছিলেন,
اب علم سلہت کی طرف جا رہا ہے
অর্থাৎ এখন জ্ঞানবত্তা সিলেটের দিকে যাচ্ছে।
তাঁকে প্রদত্ত সনদে মাওলানা মাদানী রাহ. লিখিছিলেন- সিলেট জেলার অন্তর্গত কানাইঘাট নিবাসী মওলবী মুহাম্মাদ মুশাহিদ সাহেব দারুল উলূম দেওবন্দের হাদীসের সর্বোচ্চ জামাতে যেখানে হিন্দুস্তানের বাইরের এবং হিন্দুস্তানের প্রত্যেক জেলার বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন ১৮০জন ছাত্র ছিলেন তন্মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার লাভ করেছেন। জামাতের মধ্যে প্রথম হওয়ার জন্য তাকে বিভিন্ন রকমের পুরস্কার দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাকে অনেক মহৎ ও জন্মগত মহৎ গুণাবলী দান করেছেন। তার মেধা অত্যন্ত প্রখর ও উজ্জ্বল, চরিত্র উন্নত ও মহৎ। -সিলেটের একশত একজন, ফজলুর রহমান, পৃ. ৩২৫
এমন একজন নামীদামী আলেম সমাজের সর্বশ্রেণীর সমঝদার লোকের কাছে সমাদৃত হবেন এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক।
এখানে একটি অপ্রিয় সত্য কথা বলে রাখা ভালো। সিলেটের জৈন্তপুরে গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট এলাকা ছিল বৃহত্তর জৈন্তিয়া রাজ্যের মূল ভূখণ্ড। এটি খাসিয়া রাণী শাসিত রাজ্য ছিল প্রাচীনকাল থেকেই। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধপরবর্তী সময়ে পঞ্চপা-বের অন্যতম বীর অর্জুন জৈন্তরাণী প্রমীলার সাথে যুদ্ধ করতে এসে তার রূপ লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে যুদ্ধের পরিবর্তে তাকে বিয়ে করেছিলেন বলে মশহুর।
এই জৈন্তিয়া রাজ্যের পরিধি কখনো কখনো খুবই বিস্তৃত ছিল। সিলেটের খাদিমনগরের কাছে জৈন্তারাজ্য ও সিলেটের সীমানা বলে এখনো কিছু স্থান চিহ্নিত রয়েছে। একসময় এ রাজ্যটি হবিগঞ্জের লাখাই সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে প্রতীয়মান হয় স্বয়ং লাখাই নাট থেকেই। লাখাই মানে, এখানে খাই বা খাসিয়া রাজ্য নেই। তাই প্রাচীনকাল থেকেই বৃহত্তর সিলেটবাসীরা নারী রাজ্য বলে পরিচিত জৈন্তরাজ্যের অধিবাসীদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন এবং ওদেরকে অনেকটা গেঁয়ো ও বন্য প্রকৃতির নিম্নমানের লোক বলে জ্ঞান করতেন। জৈন্তাপুরবাসীদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখার সেই মানসিকতা থেকে আজও সিলেটবাসীরা পুরোপুরি মুক্ত নন। কিন্তু সেই জৈন্তারাজ্যের একান্তই কৃষ্ণবর্ণ গায়ের ত্বক ও এবড়ো থেবড়ো মুখাবয়বের অধিকারী মাওলানা মুহাম্মাদ মুশাহিদ শুধু বৃহত্তর সিলেটেই নয় বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশেই তাঁর জ্ঞানবত্তা ও মধুর চরিত্র বৈশিষ্ট্যের জন্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এমনকি ১৯৬২ সালে আইয়ুব খাঁর আমলে তিনি স্পীকার হুমায়ুন রশীদ মরহুমের বেগম সিরাজুন্নেসার মত বিদূষী ও সম্ভ্রান্ত ঘরের প্রার্থীকে পরাজিত করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন বিপুল ভোটে। এটা যে তাঁর বিপুল এবং অসাধারণ জনপ্রিয়তার ফলেই সম্ভব হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। এ ব্যাপারে আরেকটি দৃষ্টান্ত আমাদের সম্মুখে রয়েছেÑ যা আমরা পরে কোনো সময় আলোচনা করব।
আল্লামা মুশাহিদ ছাহেবের আমি প্রতিবেশী বা ছাত্র না হলেও আরো অনেকের মত আমি ছিলাম তাঁর সেই বন্দরবাজার জামে মসজিদের রমযানের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রশ্রোতা। আমি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলাম। কেননা, তাঁর গভীর রাতের গুরু-গম্ভীর ইলমী মজলিসে রীতিমত উপস্থিত আমার মত কমবয়েসী শ্রোতা তাঁর কমই ছিল। আমার চটুল কথাবার্তা ও সমঝদার বিমুগ্ধতা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এছাড়া আমার লেখালেখির প্রতিভাটাও সম্ভবত তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। তাই কাছে গেলেই স্নেহের বশে জাড়িয়ে ধরে সিলেটি ভাষায় বলতেন: ‘আমার ডাখাইত’। (আমার ডাকাত) আমার জন্যে তাঁর এ সম্বোধনটি ছিল অত্যন্ত গর্বের। কেননা তাঁর অতি পসন্দের লোক ছাড়া তিনি এরূপ সম্বোধন কাউকেই করতেন না।
তাঁর ১৯৬২ সালের সংসদ নির্বাচনকালে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, হুযুর! নির্বাচনে আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? তিনি বললেন, দুআ করবেন এবং যতদূর শক্তিতে কুলায় আমার পক্ষে প্রচার করবেন। সেবার নির্বাচন ছিল মৌলিক গণতন্ত্র নির্বাচন। ফলে ইউনিয়ন কাউন্সিলে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদ নির্বাচন, জনসাধারণের সাধারণ ভোটে নয়। আমি আমার এলাকার একজন কৃতী ছাত্ররূপে পরিচিত ছিলাম। তাই আমার এলাকার মেম্বার-চেয়ারম্যানদের কাছে সত্যি সত্যিই প্রচারে নেমেছিলাম। বিপুল জ্ঞানবত্তার অধিকারী, স্বয়ং উস্তাযদের কাছে উচ্চ প্রশংসিত এবং দেশবাসীর কাছে বিপুল প্রহণযোগ্যতার কারণে একদিকে যেমন তাঁর বিপুল আত্মবিশ্বাস ছিল তেমনি তাঁর এখলাস এবং বিনয়ও ছিল নযর কাড়ার মত।
তাঁরই একজন নিকট প্রতিবেশী গোয়াইনঘাটের লাফনাউট গ্রামের হাজী মুহাম্মাদ ইয়াকূব ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ একজন তাবলীগকর্মী। তিনি তাবলীগের বিশ্ব মাশওয়ারায় প্রতি বছর তাবলীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের সাথে মদীনা শরীফে পরামর্শসভায় মিলিত হতেন। মুন্সী গোছের এই নিবেদিত তাবলীগকর্মীর এখলাস এবং নিষ্ঠাও ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের। তিনি তাঁর গোয়াইনঘাটের স্ব-গ্রাম ‘লাফনাউটে’ একটি তাবলীগী মারকায গড়ে তুলেছিলেন। কাকরাইলের তাবলীগী মারকাযের তিনি ছিলেন অন্যতম মুরব্বী এবং মুরব্বী হিসেবে মাওলানা হরমযুল্লাহ রাহ.-এর প্রায় সমপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। আল্লামা মুশাহিদ রাহ. অনেক সময় তাঁর ওয়ায মাহফিলসমূহে তাবলীগের কোনো কোনো ব্যাপার নিয়ে সমালোচনা করতেন। এতে হাজ্বী ইয়াকুব সাহেব অত্যন্ত অসহায় বোধ করতেন এবং ভাবতেন, আমি সারা বছরের চেষ্টায় যে কয়জন লোককে তাবলীগের সাথে জুড়লাম, মাওলানার একটিমাত্র বক্তৃতায় তা প- হতে চলল! অথচ আল্লামা মুশাহিদের মুখের উপর কথা বলাও প্রায় অসম্ভব। অনেকটা বে-মানান ও অগ্রহণযোগ্য। হাজ্বী সাহেব নিজে আমাকে কথাটি এভাবেই বলেছেন। তিনি বলেন, ‘একবার আল্লামার এরূপ সমালোচনার সময় প্রকাশ্য সভায় আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। কঠোরভাবে মাওলানার প্রতিবাদ করলাম।’ তিনি উপেক্ষার সুরে বললেন, ‘ওহ হাজ্বী ইয়াকূব! তুমি ইসলামের বুঝোটা কী, যে প্রতিবাদ করার সাহস করছো’? হাজ্বী সাহেব বলেন, ‘আমি তখন তাঁকে বাহাছের জন্যে চ্যালেঞ্জ করলাম।’ মাওলানা মুশাহিদ হেসে বললেন, ‘তুমি করবে আমার সাথে বাহাছ? বাহাছ কিন্তু আরবী ভাষায় হবে, বাংলা বা সিলেটী ভাষায় নয়।’ হাজী সাহেব বলেন : আমি বললাম, ‘জী আরবীতেই হবে। আমি আরবী ভাষায়ই আপনার সাথে বাহাছ করব’। বাহাছটি আর হয়নি, এভাবেই কথার কথারূপে থেকে যায়। এভাবে হাজ্বী সাহেব তাবলীগ জামাতের ইমেজটা জনগণের মধ্যে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে সমর্থ হন। কেননা, আল্লামা মুশাহিদের সাথে আরবীতে বাহাছ করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ কোনো সহজ এমনকি কল্পনীয় ব্যাপারও ছিল না।
হাজ্বী সাহেব বলেন, তারপর ১৯৭০ সালের কুরবানীর ঈদের পূর্বরাতে আল্লামা মুশাহিদ নিজের জন্য কুরবানীর গরু কিনলেন। আর কী মনে করে আমাকে জরুরীভাবে তাঁর বাড়িতে তলব করলেন। আমি কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। আল্লামা মুশাহিদ (আঞ্চলিক পরিচিতিমতে ‘বাইয়মপুরী সাহেব’) আমাকে কেন তলব করলেন? আমি ভয়ে ভয়ে গিয়ে তাঁর বাড়িতে হাযির হলাম। তিনি বললেন, ‘হাজী ইয়াকূব! তোমার তাবলীগী কাজটি আসলে একটি হক কাজ! প্রকাশ্য জনসভায় এর সমালোচনা করে অন্যায়ভাবে তোমার মনে কষ্ট দিয়েছি, তুমি আমাকে মাফ কর!’ তখন আমি বললাম, বরং আমিই আপনার মত এতবড় বুযুর্গকে বাহাছের চ্যালেঞ্জ করে অন্যায় করেছি। আপনি আমাকে মাফ করুন।’
এই ছিল আল্লামা মুশাহিদ রাহ.-এর চরিত্র মাধুর্য ও উদারতা। ঐ রাতেই (১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি) তিনি পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন। হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে কানাইঘাটে তাঁর সেই মাদরাসা প্রাঙ্গণে বৃহৎ জানাযার জামাত অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তিনি বহু বছর হাদীসের দরস দিয়েছিলেন। শায়খে কৌড়িয়া ও মাওলানা ফুলতলীসহ গোটা সিলেট বিভাগের নেতৃস্থানীয় আলেমগণ সে জানাযায় উপস্থিত ছিলেন।
সারা জীবন যিনি ইলমে নববীর খেদমত করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সেই প্রিয় বান্দার মকবুলিয়াত ও মর্যাদা এভাবে প্রকাশ করলেন।
তাঁর ইন্তেকালের পর বন্দর জামে মসজিদে তাঁর শোকসভায় গোটা সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ আলেমগণের সাথে আমারও বক্তব্য দেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমি ছিলাম সে মজলিসের কনিষ্ঠতম বক্তা। আমি বন্দর বাজারের জামে মসজিদ রোডকে আল্লামা মুশাহিদ রোড নামকরণের প্রস্তাব করি। আল্লাহ তাআলা তাঁর এ প্রিয় বান্দাকে জান্নাতের উচ্চতম আসনে স্থান দান করুন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে ছোটভাই মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদিকে ভারতে পৌঁছে দিয়ে শিলং থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে আমি পায়ে হেঁটে গোয়াইনঘাট থেকে কানাইঘাটে তাঁর কবর যিয়ারত করতে যাই। তাঁর অগ্রজ মাওলানা মুজাম্মিল সাহেব রাহ. তখন জীবিত ছিলেন। তিনি আমাকে পরম স্নেহে আতিথ্য দান করেন। তারপর প্রায় চল্লিশ মাইল পায়ে হেঁটে সিলেটে নিজবাড়িতে ফিরেছিলাম।
আল্লামা মুশাহিদ রাহ.-এর রাজনৈতিক দর্শন
প্রকৃতিগত দিক থেকে আল্লামা মুশাহিদ রাহ. রাজনৈতিক জগতের লোক ছিলেন না। তিনি আদতে ছিলেন ইলমী জগতের লোক। কুরআন, হাদীস, তাফসীর ও ইলমী চর্চাতেই তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছে। তাঁর দেওবন্দের উস্তাযবর্গ বিশেষত শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রাহ.-এর ‘অবিভক্ত ভারতের পক্ষপাতী’ রাজনীতিরই তিনি একজন অনুসারী ছিলেন। আর সিলেট জেলার অধিকাংশ আলেম-উলামা যেহেতু ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’পন্থী এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন, তাই পাকিস্তানী আমলের প্রথমার্ধে তাঁদের সিলেটে রাজনীতির তেমন সুযোগও ছিল না। কেননা ‘জমিয়তী আলেম’ বা ‘কংগ্রেসপন্থী আলেম’ তখন সিলেটে রীতিমত একটি গালির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। কারণ, অধিকাংশ জনসাধারণ ১৯৪৬ সালে সিলেটের গণভোটকালে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তাই আল্লামা মুশাহিদ তাঁর মাদরাসা ও হাদীস শিক্ষাদান নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। অবশ্য তাঁর ওয়াযের জনপ্রিয়তা যথারীতি অক্ষুণœ ছিল। এছাড়া প্রচলিত গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিকে তিনি ইসলামী ভাবধারার পরিপন্থী মনে করতেন। তিনি তাঁর পূর্বোক্ত ‘ফাতহুল কারীম’ গ্রন্থে লেখেন- ‘ইনসাফের কথা হল, ইসলামী শাসন বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থা থেকে স্বতন্ত্র একটি পদ্ধতি- যাকে আলকুরআন ‘রাব্বানী শাসন’ বলে অভিহিত করেছে। এ দুটি ব্যবস্থার মৌলিক দুটি পার্থক্য হল, বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনে আইন প্রণয়ন, আইন রচনা, আইনের স্থিতিকরণ ও সীমাবদ্ধকরণ ও অন্যান্য ক্রিয়াকর্মের অধিকার ন্যস্ত থাকে জনগণের উপর। কিন্তু রাব্বানী শাসনে এই অধিকার জনগণ কেন, পৃথিবীর অন্য কারো উপর ন্যস্ত নয়। এখানে সিদ্ধান্তদাতা একমাত্র আল্লাহ তাআলা। দ্বিতীয়ত, রাব্বানী শাসনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হল আল্লাহভীরুতা। কিন্তু বর্তমান গণতন্ত্রে এর লেশমাত্র নেই। এখানে সকল বিষয়ের অধিকার নির্বিচারে জনগণের হাতেই ন্যস্ত। -ফাতহুল কারীম, পৃ. ১৪৪ (সংক্ষেপিত) এ মুল্যবান উদ্ধৃতিটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আমার সিলেট ও ঢাকা সরকারী আলিয়া মাদরাসাদ্বয়ের উস্তায ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উর্দু বিভাগ প্রধান নোয়াখালীর ডক্টর মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ মরহুম ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক ‘রাজনীতিতে বঙ্গীয় উলামার ভূমিকা’ গ্রন্থেও ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু ইসলামী শাসনের অনুপস্থিতির কারণে এখন নিজেদের বক্তব্য জনসাধারণের তথা জাতির সম্মুখে তুলে ধরতে হলে প্রচলিত রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ছাড়া বিকল্প নেই দেখে ১৯৬২ সালে তিনি আইয়ুব খাঁর ‘মৌলিক গণতান্ত্রিক’ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় পরিষদের ভাষণগুলোতে প্রথম দিকে তিনি সরকারের কঠোর সমালোচনাও করতেন। মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের উভয় অংশের আলেম সমাজ যে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তাঁর ভাষণেও এর প্রতিধ্বনি থাকতো। তিনি আমাদের ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলনের স্বপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং এ দাবী জাতীয় সংসদেও উত্থাপন করেন। পরবর্তীকালে তিনি আইয়ুব খাঁর কনভেনশন মুসলিমলীগে যোগদান করেন। এই সময় আমি তাঁর কাছে এর কারণ জিজ্ঞেস করি। তিনি আমার প্রশ্নের জবাবস্বরূপ বলেন, ‘বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আমার নিকট প্রতীয়মান হয়েছে যে, সমস্ত ইসলামী দলগুলো সম্মিলিতভাবে জোটবদ্ধ হলেও তার শক্তি দুই আনার বেশি হবে না। তাই মন্দের ভাল হিসেবেই আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, যতদূর পারা যায় এ দলের সাথে থেকেই নিজেদের দাবীর যৌক্তিকতা তাদের সম্মুখে তুলে ধরতে হবে।’
এ কথাটি তিনি সাধারণ্যে প্রকাশ করেননি। তাই জনগণ তাঁর এই ভূমিকাকে সুনজরে দেখেনি। ফলে পরবর্তী নির্বাচনে তিনি আর নির্বাচিত হতে পারেননি।
সে যাই হোক, আল্লামা মুশাহিদ রাহ. আমাদের ইলমী দুনিয়ার একজন শাহানশাহের আসনেই চিরদিন অধিষ্ঠিত থাকবেন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের উচ্চতম আসনে আসীন করুন!