Rabiul Auwal-Rabiul Akhir 1437   ||   January 2016

প্রতিবেশী : আবার অখণ্ডতার ডাক!

Khasru Khan

নাহ, সেই কথাটি আর গোপন রইল না। কথায়-শব্দে অস্পষ্ট ছিল। মুখ খুলে বলতে বাধা ছিল। ঠারে ঠুরে চলছিল। এদিক থেকেও-ওদিক থেকেও। এবার হাটে হাঁড়ি ভাংলেন। না শুধু হাঁড়িই ভাঙ্গেননি, হাঁড়ির ঝাঁপিই ভেঙ্গে দিলেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাফ সাফ বললেন, ‘বাংলাদেশ, পাকিস্তান আবার অখণ্ড ভারতে পরিণত হবে।গত ২৪ ডিসেম্বরে বিভিন্ন অনলাইন সংবাদমাধ্যমে বর্ণনাটি প্রকাশ হয়। তাতে দেখা যায়- তিনি বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন জনগণের শুভবোধেরমাধ্যমেই আবার অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠিত হবে।

বড় দিলখুলা মানুষ এই রাম মাধব। মনের ভেতরে প্যাঁচ রেখে চলা মোটেই পছন্দ করেন না। উগরে দিয়ে তিনি শান্তি পান। অথচ এই কথাটির আশেপাশে কত কথা অন্যরা আগে বলেছেন। লোকে শিরোনামটাই ধরতে পারেনি। বুঝতে তো পারেনি বিলকুল। প্রতিবেশী বড় দেশের প্রেসিডেন্ট কদিন আগে বলেছেন, দু দেশের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক চলছে। ওই দেশের পত্রপত্রিকায় সুসম্পর্কের ওপর মিষ্টি মিষ্টি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কদিন আগে আমাদের এক প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দুদেশ একই রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে।লোকে তার কথায় কান দিতে চায়নি। মনে করেছে, বেচারা আবেগে একটু বেশিই বলে ফেলেছে। মন্ত্রীত্বে নতুন তো, বুঝতে পারেনি! কিন্তু এই রাম মাধম সেসব কথার অনুচ্চারিত শিরোনামটাই উল্লেখ করে দিলেন। এবং কোনো রাখঢাক ছাড়া। দূরের অস্পষ্ট মেঘ ঘুর্ণিঝড় হয়ে মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে। তিনি সেই ঝড়ের কথাই বললেন।

তার কথায় কোনো আবেগ ছিল না। হঠাৎ মুখ ফসকে তিনি কোনো কথা বলে ফেলেননি। প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) আজো বিশ্বাস করে যে ৬০ বছর আগে ঐতিহাসিক কারণে যেসব অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তা জনগণের শুভেচ্ছায় আবার একত্রিত হবে। একজন আরএসএস সদস্য হিসেবে আমিও ওই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি।এরপর তিনি ওই মহানদৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের পদ্ধতিও ব্যাখ্যা করেন। আরএসএসের উদারতা বিশ্লেষণ করে তিনি আরো বলেন, ‘তার মানে এই নয় যে কোনো দেশকে যুক্ত করতে আমরা কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব। যুদ্ধ ছাড়া জনগণের সম্মতিতেই এটা হতে পারে।

সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, রাম মাধব আগে আরএসএসের জাতীয় নির্বাহী সদস্য এবং মুখপাত্র ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি বিজেপিতে যোগদান করেন এবং পার্টির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আরএসএস বিজেপির আদর্শিক শাখা হিসেবে পরিচিত। বিজেপি-ই এখন ভারত নামক রাষ্ট্রটির পরিচালনা করছে। এই বিজেপিতে যোগ দিয়েও তিনি চুপটি করে বসে থাকেননি। চুপটি করে বসে থাকার জন্য নিশ্চয়ই তিনি ঘোমটা খুলে রাজনৈতিক দলে যোগও দেননি। রাজনীতির প্রকাশ্য ময়দানে নেমে তার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেই যাচ্ছেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে এক বিবৃতিতে তিনি ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রবলে ঘোষণাও দিয়ে বসেছেন।

অখণ্ড ভারত এবং হিন্দুত্ব অভিন্ন বিষয়। এই হিন্দুত্বপূর্ণ ভারতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জনগণও গিয়ে মিশে যাবে। দুটি দেশ আবার তাদের অস্তিত্ব বিলীন করে  দিয়ে ভারত হয়ে যাবে। এরপর হিন্দু ভারতের সংস্কৃতিতেই তারা তুষ্ট ও ধন্য হবে। এই হচ্ছে রাম মাধবের সাদা বক্তব্যের খোলা নির্যাস। অন্যরাও এই কথাটি বলেন। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলায় সে কথার ভেতরটা ধরা যায় না। কিন্তু রাম মাধবের সব কথাই পরিষ্কার। ভারতবর্ষে হিন্দুত্বের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি কী চমৎকার বলেছেন-এটা এমন একটা ভণ্ড যেখানে বিশেষ ধরনের জীবনধারা, বিশেষ ধরনের সংস্কৃতি এবং সভ্যতার পরিচর্যা করা হয়। আমরা সেটাকেই হিন্দু বলছি- আপনার কোনো আপত্তি আছে কি? ভারতে একটিই সংস্কৃতি আছে। আমাদের সংস্কৃতি এক, জনগণ এক এবং এক জাতি।

কথা তো রাম মাধব সবই বলেছেন। কিছু বাদ রাখেননি। ভারতের বর্তমান শাসকদলের বড় নেতা তিনি। কিন্তু আমাদের এখানে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন চেতনার আড়ৎদাররা। কথায় কথায় দেশরক্ষার হুংকার তারা ঠিকই ছাড়েন। এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ওর সঙ্গে কটনীতি কেটে দেন। তাকে ডেকে এনে পারলে ফাঁসি দেন। এরা কেউ এখন রাম মাধবের কথার উত্তরে কিছু বলছেন না। স্বাধীন দেশটাকেই বিলীন করে দেওয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা! কিন্তু পথের মোড় ও টেবিলের পণ্ডিত-দেশরক্ষীরা মুখ ঢেকে বসে আছেন। শুধু তো এটুকুই নয়। সাম্প্রতিক খবর, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এই ডিসেম্বরে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী হত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিএসএফের এই তাৎপর্যপূর্ণ বন্দুক-বন্ধুত্বনিয়েও এই রক্ষীরা কিছু বলতে চান না। পদ্মশ্রী পদক আর আজীবন সম্মাননার হাতছানি এড়ানো মনে হয় কঠিন। এদের সব চেতনা, সব লালচোখ ভারতের সামনে ঠাণ্ডা!

পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলেন, উপমহাদেশকে আবার ৪৭ পূর্ব আমলে নিয়ে যাওয়ার দ্রুত একটা প্রস্তুতি দৃশ্যমান। আবার অখণ্ড ভারত! আবার হিন্দু জমিদার! আবার মুসলিম প্রজা-রায়ত! আবার গরু জবাইয়ে হত্যা! আবার দাড়ি-টুপির জন্য কষ্ট এবং কর! আবার কলোনি। আবার উপনিবেশ! সাম্রাজ্যবাদী আর আঞ্চলিক শক্তির গাটছাড়া। দিকে দিকে অস্থিরতার বানানো আলামত। আহা! যারা এখনও ভাবছেন অখণ্ড ভারত মানে হিন্দু-মুসলিমের সহৃদয় সহাবস্থান তারাও একটু এদিকে দেখুন। কত সরলতাদের ভাবনা! হিন্দুত্বে বিলীন হওয়ার সর্বগ্রাসী হাতছানি। সাম্প্রদায়িকতার দাঁতালো কৃপাণ মাথার উপর! এর সঙ্গেই একীভত হওয়ার আহ্বান। সতর্কতার কিছু আছে কি-না জানি না। 

 

advertisement