‘চান্দ্রমাস’ : একটি পর্যালোচনা- ৬ : শেষ কিছু নিবেদন
যেমনটি আমি বলে এসেছি, ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ এনামুল হকের এই বইয়ের পর্যালোচনাটি সংক্ষেপে লেখা সত্ত্বেও দীর্ঘ হয়ে গিয়েছে। সামনের আলোচনার শুধু শিরোনামগুলো দেখে নিতে অনুরোধ করছি-
১. ‘চান্দ্রমাস’ বইয়ে নতুন জিনিস কী?
২. বইয়ের মাঝে বিদ্যমান বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা।
৩. ২ : ১৮৯ ছাড়াও অন্যান্য বহু আয়াতের বিকৃতি।
৪. কিছু জলজ্যান্ত মিথ্যা।
৫. চাঁদ দেখা বিষয়ক হাদীসসমূহের বিকৃতি ও তার অবমাননা।
৬. হাস্যকর, বায়বীয় কথাবার্তার কিছু নমুনা (মাত্র পনেরটি উদাহরণ)।
৭. জ্যোতির্শাস্ত্রে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পারদর্শিতা।
৮. ‘বে-সনদ আলেমে’র দর্শন।
৯. ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের দৃষ্টিতে নিজের মর্যাদা।
১০. প্রকৌশলী জনাব শামছুল হক চৌধুরীর বই ‘চান্দ্রমাস বইয়ের বিভ্রান্তি’ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চয়ন।
১১. ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সমীপে সবিনয় কিছু নিবেদন।
এই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা যদিও এখনো প্রায় একশ’ পৃষ্ঠার বেশি (হাতে লেখা) জমা আছে, যা আলকাউসারে ছাপা হচ্ছে না, তথাপি বিগত জুমাদাল উলা, জুমাদাল উখরা, রজব ও যিলহজ্ব ১৪৩৬ হিজরী সংখ্যা, সেই সাথে গত মুহাররামুল হারাম ১৪৩৭ হিজরী সংখ্যায় প্রকাশিত মোট পাঁচটি কিস্তি আলহামদুলিল্লাহ পর্যালোচনাধীন বইয়ের হাকীকত বুঝতে যথেষ্ট। বিশেষত ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যদি এই পাঁচ কিস্তির আলোচনাগুলো সত্যসন্ধানী মন নিয়ে চিন্তা সহকারে পড়েন তাহলে ইনশাআল্লাহ তিনি তার মৌলিক ভ্রান্তিগুলো বুঝতে পারবেন এবং আশা করা যায়, তিনি সত্যের সন্ধান লাভে সমর্থ হবেন।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যে, ‘হিলাল’ এবং বৈজ্ঞানিক ‘নিউমুন’ দু’টোকে গুলিয়ে ফেলেছেন, গত সংখ্যায় সে সম্পর্কে পর্যালোচনা হয়েছে। শুধু এই একটি আলোচনাতেই তার জন্য চিন্তা-ভাবনার এবং শিক্ষাগ্রহণের বহু উপাদান বিদ্যমান রয়েছে, যদি তিনি শিক্ষাগ্রহণ করতে চান। আশ্চর্যের বিষয় হল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অমুসলিমদের খাতিরে ইসলামী ‘হিলাল’কে বৈজ্ঞানিক ‘নিউমুন’ বানাচ্ছেন। অথচ বহু অমুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরও এই সত্য জানা আছে যে, ইসলামী হিলাল আর বৈজ্ঞানিক ‘নিউমুন’ (এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুন) এক নয়। পীর মাওলানা যুলফিকার আহমাদ নকশ্বন্দী দামাত বারাকাতুহুম তার এক বক্তৃতায় এ বিষয়ে একটি চমৎকার কাহিনী শুনিয়েছেন, তিনি বলেন,
“... একদিন আমার স্মরণ হল, ওয়াশিংটনে একটি মহাকাশ যাদুঘর Space Museum রয়েছে। আপনি ঐ Space Museum এ গেলে বিস্ময়কর সব Scientific research (বৈজ্ঞানিক গবেষণা) দেখতে পাবেন। ওখানে আমি যখনই যেতাম, আমার দশ থেকে বারো ঘন্টা সময় ব্যয় হয়ে যেতো। কিন্তু কখনোই আমি তা পুরোপুরি দেখে শেষ করতে পারিনি। সবসময়ই কিছু অংশ দেখে ফিরে আসতাম।
ওখানে আমি একদিন জানতে পারলাম, এখানে এমন একটি বিভাগ (Section) রয়েছে, কর্তৃপক্ষ যেখানে একটি বিশেষ চ্যানেল খুলে রেখেছে। যাতে সর্বক্ষণ সম্প্রচার (Broadcast) করা হচ্ছে, ‘মহাকাশে কী ঘটছে’? What's happening in space?
তারা প্রতিনিয়ত এই সংবাদই দিয়ে থাকে। মহাশূন্যে যা কিছু হচ্ছে তার সংবাদ জানাতে হবে, এটাই তাদের কাজ। তখন আমার মনে হল, যেহেতু এরা মহাকাশের খবরাখবর প্রচার করে তাই চাঁদ সম্পর্কিত তথ্যও তাদের কাছে থাকবে। অতএব আমি এদের নম্বর টুকে নিলাম এবং বাসায় এসে আমি তাদের ফোন করলাম। বললাম, জ্বী আমি অমুক এলাকায় থাকি, আমার জানা দরকার, এখানে নতুন চাঁদ কবে দেখা যাবে? তারা উত্তর দিলো, মুসলিমরা যাকে নতুন চাঁদ বলে আমরা তাকে বলি ক্রিসেন্ট (Crescent) আর আমরা যাকে নতুন চাঁদ (New moon) বলি তা সম্পূর্ণ কালো এবং তা দেখাই যায় না। এটা (New moon) আমাদের একটি বৈজ্ঞানিক পরিভাষা (Scientific Term)। আর মুসলিমদের কাছে যেটা New moon সেটা হচ্ছে Crescent । যাকে বলা হয় হিলাল। এই হিলাল দৃষ্টিগোচর হওয়া সম্পর্কে আমরা বলে থাকি, সম্ভাবনা (Chances) রয়েছে, নিশ্চিত কিছু বলতে পারি না। আমি বললাম, কিন্তু আমাকে তো নিশ্চিত করেই বলতে হবে। তখন তারা বলল, যদি আপনাকে চূড়ান্ত কোন তথ্য পেতে হয় তাহলে আপনি আমাদের নৌ বাহিনীর আকাশ-পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র Naval observatory)-কে ফোন করুন। তারা আপনাকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারবে। কারণ তাদের কাছে সুপার কম্পিউটার রয়েছে। এ কথা শুনে আমি খুবই অবাক হলাম। কারণ চাঁদের সাথে নৌ বাহিনীর আকাশ পর্যবেক্ষণকেন্দ্র (Naval observatory) এর কী সম্পর্ক?! পরে বুঝতে পারলাম, নৌ বাহিনীতে যারা কাজ করে তাদেরকে সমুদ্রে (Ocean) সফর করতে হয়। আর সমুদ্রে যে সকল High Tide (জোয়ার ভাটা) হয় তার সম্পর্ক চাঁদের সাথে। চাঁদের যখন তের, চৌদ্দ এবং পনেরো তারিখ হয় তখন সমুদ্রে ঝড়ের সৃষ্টি হয়। যে কারণে সমুদ্রে চলাচলকারীরা এই দিনগুলোতে সমুদ্রভ্রমণ থেকে বিরত থাকে। কেননা High Tide এর সময় ডুবে যাবার আশঙ্কা প্রবল থাকে।
Naval observatory এর লোকদের দাবী, We trace each inch of the trajectory of moon.
আমি সেখানে ফোন করে তাদেরকে বললাম, আমি স্প্রিংফিল্ডে থাকি। আমার জানার বিষয়, চাঁদের ক্রিসেন্ট এখানে কবে দেখা যাবে? ওদিক থেকে এক মহিলা বললেন, আমি আপনাকে কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে জানাচ্ছি। এরপর তিনি আমাকে বললেন, সম্ভাব্য তথ্য (Chances) আছে। নিশ্চিত কোন খবর নেই।
এ পর্যায়ে আমি তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলাম : কেন, আমরা তো চাঁদে পা রেখেছি (যেহেতু সে সময় আমি ওখানে ছিলাম এবং ওখানকার একজন নাগরিক হিসেবেই কথা বলছিলাম) আর আপনি কিনা বলছেন, ‘আমরা চাঁদের বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না’?! তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনার কি বিজ্ঞান বিষয়ে পূর্ব জানাশোনা Scientific background আছে? আমি বললাম, হাঁ আছে। তিনি বললেন, আপনি কি আমার কথাবার্তা বুঝতে পারবেন? আমি বললাম, হাঁ বুঝতে পারব, আপনি বলুন। এবার তিনি খোলাখুলি কথা আরম্ভ করলেন। বললেন,
“আমরা যখন চাঁদের বক্ররেখা Trajectory অনুসন্ধান করি তখন আমরা তা চাক্ষুস দেখতে পাই না। এমন কোন দূরবীক্ষণ যন্ত্র নেই, যার সাহায্যে দেখে চাঁদের অবস্থান শনাক্ত করা যায়। বরং আমাদের কাছে একটি গাণিতিক ছক Mathematical Model) তৈরী করা আছে। ঐ ছকে হিসাব (Calculation) কষে আমরা জানাতে পারি, চাঁদ এখন কোথায়? একেবারে সঠিক তথ্যই আমরা পেয়ে যাই।”
আমি তখন বললাম, তাহলে হিসাব-নিকাশ (Calculation) করেই আমাকে বলুন। তিনি বললেন, ব্যাপার হচ্ছে মোট অঙ্ক ও সংখ্যা (Calculation) এর মাঝে ছয় হাজার চলক (Variables) আছে। এবং একটি চলক এর পরিবর্তনের কারণে ফাইনাল রেজাল্ট পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। সেজন্য আমি নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারবো না। তবে এতটুকু বলতে পারি যে, সম্ভাবনা (Chances) আছে, দেখার পর বোঝা যাবে।
আমি তৎক্ষণাত বললাম, আলহামদুল্লিাহ! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চৌদ্দশ’ বছর আগেই বলে দিয়েছেন, হে আমার উম্মত! যখন তোমরা রমযানের রোযা রাখবে তখন,
صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته
‘তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখো এবং তা দেখেই রোযা ছাড়ো (ঈদ উদ্যাপন করো)।’
আজ বিজ্ঞানের জগতও এ কথাই মানছে।” (খুতুবাতে ফকীর খ. ২৯, পৃ. ২৬৯-২৭২)
যাইহোক, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বইয়ের পর্যালোচনার যতটুকু অংশ এ পর্যন্ত ছাপা হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যদি সত্যান্বেষী হন তাহলে তার চিন্তা-ভাবনা এবং সংশোধনের জন্য এটুকুই যথেষ্ট, ইনশাআল্লাহ। পর্যালোচনার বাদবাকী অংশ আলকাউসারে ছাপাতে আপারগতা প্রকাশ করছি। তবে যেহেতু মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী জেদ্দার একটি সিদ্ধান্ত ইঞ্জিনিয়ার সাহেব না জেনে-বুঝে বারংবার উল্লেখ করছেন এবং তার মতো একই চিন্তা পোষণকারী আরো কিছু লেখকও এই সিদ্ধান্তটিকে এমনভাবে উল্লেখ করছেন, যেন এ থেকে তাদের উদ্দেশ্য আপনা আপনি হাছিল হয়ে যাচ্ছে, অথচ বাস্তবে তেমনটি নয়- সেজন্য ইচ্ছে করছে এ বিষয়ে কিছু কথা নগদ বলে দেই। আর প্রবন্ধের সর্বশেষ অধ্যায় (যার গুরুত্বর্পূ পরিচ্ছেদ ও শিরোনামসমূহের বিবরণ এসেছে শাবান-রমযান ১৪৩৫ হিজরী সংখ্যায়) এবং তার পরিশিষ্ট, সেটা ইনশাআল্লাহ দেড়-দুই বছর পরে লেখা হবে। এই বিরতির একটি উদ্দেশ্য এই যে, যা কিছু পাঠকের সামনে এসেছে, সে ব্যাপারে যদি কারো কোনো পরামর্শ বা মতামত থাকে তাহলে সেটা আলকাউসারের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ পেশ করা। তাদের সেসব পরামর্শ বা মতামত জেনে আমি উপকৃত হতে চাই।
এমনিভাবে যেসব সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের বই-পুস্তক নিয়ে শাবান-রমযান ১৪৩৫ হিজরী সংখ্যা থেকে চলতি সংখ্যা পর্যন্ত পর্যালোচনা পেশ করা হয়েছে- হতে পারে তাদের পক্ষ থেকেও কোনো পরামর্শ বা মতামত আমাদের কাছে আসবে। যা থেকে আমি উপকৃত হতে চাই। আল্লাহ প্রত্যেককে জাযায়ে খায়ের নছীব করুন।
জেদ্দা ফেকাহ একাডেমির সিদ্ধান্ত : কিছু মানুষের ভুল ধারণা এবং প্রকৃত বাস্তবতা
সফর ১৪০৭ হিজরী (মোতাবেক অক্টোবর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ)-তে ওমানে অনুষ্ঠিত সভায় মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী জেদ্দা (বর্তমান নাম মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী আদ-দুয়ালি) দু’টি রেজ্যুলেশন পাস করে। যার আরবী ভাষ্য এই :
أولا: إذا ثبتت الرؤية في بلد وجب على المسلمين الالتزام بها، ولا عبرة لاختلاف المطالع لعموم الخطاب بالأمر بالصوم والإفطار.
ثانياً: يجب الاعتماد على الرؤية، ويستعان بالحساب الفلكي والمراصد مراعاة للأحاديث النبوية والحقائق العلمية.
তরজমা :
১. যখন কোনো শহরে (নতুন চাঁদ) ‘দেখা’ সাব্যস্ত হয়ে যাবে তখন মুসলমানদের জন্য তা মেনে নেওয়া আবশ্যক হবে। উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়। কেননা রোযা ও ঈদ পালনের নির্দেশের ক্ষেত্রে সম্বোধন সকলের প্রতি।
২. দেখার উপর নির্ভর করা জরুরি। (দেখা সম্ভব কি সম্ভব নয় তা নির্ণয়ে) জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাব কিংবা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। যাতে হাদীসে নববী এবং বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা দু’য়ের প্রতিই লক্ষ্য রাখা যায়। (মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী সংখ্যা ৩, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১০৮৫)
মাজমাউল ফিকহের এই রেজ্যুলেশনে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, ইসলামী চান্দ্রমাস প্রমাণের ভিত্তি চাঁদ দেখার উপর। জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবের সাহায্যে গণনা করে মাসের শুরু নির্ধারণ করা জায়েয নেই। তবে হিসাব থেকে এতটুকু সাহায্য নেওয়া যাবে যে, কোন্ রাতে, কোন্ জায়গায়, কতক্ষণের জন্য নতুন চাঁদ দেখতে পাওয়া সম্ভব, আর কোথায় সম্ভব নয়।
অতএব যারা চাঁদ দেখার বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে শরীয়তের এ সুস্পষ্ট, সর্বজনস্বীকৃত ও অবিচ্ছিন্ন বহু সূত্রপরপম্পরায় চলে আসা বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করে- তাদের এখান থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।
মাজমাউল ফিকহের এই রেজ্যুলেশনের প্রথম দফায় একটি মতবিরোধপূর্ণ ফিকহী মাসআলায় একাধিক মতামতের মধ্যে একটিকে অবলম্বন করা হয়েছে। অথার্ৎ চান্দ্রমাসসমূহের সূচনা এবং এতদসংশ্লিষ্ট বিধানের ক্ষেত্রে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য কি ধর্তব্য নয়- এটি একটি মতভেদপূর্ণ মাসআলা। মাজমাউল ফিকহ এ ক্ষেত্রে ধর্তব্য না হওয়ার মাযহাব এখতিয়ার করেছে। এটা হচ্ছে তাদের দিক থেকে একটি মতকে অগ্রাধিকার দান। এতে করে এটা আবশ্যক হয়ে যায় না যে, তাদের গৃহীত ঐ সিদ্ধান্তের পর এই মাসআলা মুজমা আলাইহি বা সর্বজনমান্য হয়ে গিয়েছে, এখন আর এই মাসআলায় কোনো দেশের আলেম-উলামা ও শাসকশ্রেণীর জন্য অপর মাযহাব অনুযায়ী আমল করার কোনোরকম বৈধতা নেই! বিষয়টি কখনো এমন নয়। এমনিভাবে এই রেজ্যুলেশনের উদ্দেশ্য এটাও হতে পারে না যে, যে কেউ নিজ দেশের আলেম-উলামা ও শাসকশ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী এই মোতাবিক আমল করতে শুরু করে দেবে। বরং এ অনুযায়ী আমল করা চাঁদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে যিনি দায়িত্বশীল তারই কাজ।
যদি মতভেদপূর্ণ মাসআলায় কোনো ফেকাহ একাডেমির পক্ষ থেকে কোনো একটি মাযহাব অবলম্বন করায় অপরাপর মাযহাব পরিত্যাক্ত হয়ে যেত তাহলে তো রাবেতা আলমে ইসলামীর আল মাজমাউল ফিকহি মক্কা মুকাররমার ফেব্রুয়ারী ১৯৮১ তারিখের গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং সৌদী আরবের হাইয়াতু কিবারিল উলামার (সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ) শা‘বান ১৩৯২ হি. সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের পর আমলের জন্য কেবল এই মাযহাবটিই চূড়ান্ত হয়ে যেত যে, মাসের সূচনা নির্ধারনের ব্যাপারে উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য করা বা না করা যেহেতু একটি মতবিরোধপূর্ণ ও মুজতাহাদ ফীহ মাসআলা, তাই একে প্রত্যেক দেশের আলেমসমাজ ও শাসকশ্রেণীর এখতিয়ারে রাখা হবে- তারা আমলের জন্য যে মত অবলম্বন করবেন ওখানের অধিবাসীদের জন্য সে মোতাবেক আমল করা অপরিহার্য হবে (কারারাতুল মাজমাইল ফিকহিল ইসলামী, মক্কা আলমুকাররামা পৃ. ৮৪-৮৯; আবহাসু হাইআতি কিবারিল উলামা ৩/৩২-৩৪) যদি কোনো ফেকাহ একাডেমির ফায়সালা ইজমার সমতুল্য হত তাহলে উল্লেখিত দুই একাডেমির ফায়সালার পর মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর জন্য দ্বিতীয় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই বৈধ হত না।
আর এটাও জানা কথা যে, মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী যদিও O.I.C (আল মু’তামারুল ইসলামী বর্তমান নাম মুনাযযমা আত-তায়াউন আল ইসলামী)-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, কিন্তু তাই বলে মাজমাআর প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত ও.আই.সির পক্ষ থেকে প্রত্যয়নকৃত হওয়া জরুরি নয়। তাই তাকে সরাসরি ও.আই.সির ফায়সালা বলা যাবে না। এই বাস্তবতা সত্ত্বেও কিছু লোক সমস্ত মানুষকে বোকা বানিয়ে এই ফায়সালাকে সরাসরি ও.আই.সির ফায়সালা এবং একটি সর্ববাদীসম্মত বিধান আকারে পেশ করছে।
সবচে’ বড় কথা, মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী উক্ত রেজ্যুলেশনে একটি মতবিরোধপূর্ণ ফিকহি মাসআলায় নিজের পছন্দের কথা ঘোষণা করেছে মাত্র। একে আমলী রূপদানের জন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি- তার কোন রূপরেখা উপস্থাপন করেনি এবং এ বিষয়েও আলোচনা করেনি যে, হেলাল দেখাই যেহেতু চাঁদ প্রমাণিত হবার ভিত্তি, সেহেতু দেখাকে ভিত্তি ধরে সমগ্র বিশ্বে প্রথম দেখার ভিত্তিতে রোযা ও ঈদ করা আসলেই সম্ভব কি সম্ভব নয়?
এটা ছিল তাদের সংক্ষিপ্ত ফায়সালা। একে বাস্তবায়িত করবার জন্য তাদের পক্ষ থেকে কোনো বিস্তারিত রূপরেখা আসেনি। উচিত ছিল, তা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা এবং খোদ এই রেজ্যুলেশন অনুমোদনকারী উলামা ও তাদের দেশের আমল কী, সেটাও দেখা। এই রেজ্যুলেশনের পর তারা নিজ দেশের উলামা ও শাসকদের সঙ্গেই রোযা ও ঈদ করছেন, নাকি তাদের থেকে আলাদা হয়ে।
দুঃখের বিষয়, আমাদের অনেক অতি উৎসাহী ভাই এসকল বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে এই ফায়সালাকে পুঁজি করে রোযা ও ঈদ পালনে স্বয়ং নিজেরাও বিচ্ছিন্নতার পথে হাঁটতে শুরু করেছেন, অন্যদেরকেও বিচ্ছিন্নতার দিকে ডাকছেন। উল্টো তারাই কিনা আবার আলেম-উলামা ও শাসকগোষ্ঠীকে ধর্মের ব্যাপারে শিথিলতা ও ফরয তরকের অপবাদ দিয়ে যাচ্ছেন!!
কথা পরিষ্কার। তা সত্ত্বেও আমরা মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর মহাপরিচালক ও উপ-প্রধানকে এ বিষয়ে পত্র লিখেছি। উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন জবানীতে এ কথাই বলেছেন যে, ঐ ভাইদের কর্মপন্থা ভুল। মহাপরিচালকের চিঠি আরবীতে লেখা। প্রবন্ধটি যখন বই আকারে ছাপা হবে তখন তা পেশ করা হবে, ইনশাআল্লাহ। এখন মাজমার উপ-প্রধান শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমের পত্রটি তুলে ধরা হচ্ছে।
হযরতকে মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর রেজ্যুলেশন-ভাষ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়েছিল,
“এর উদ্দেশ্য তো এটাই যে, শরীয়তসম্মত পন্থায় হিলাল প্রমাণ ও হিলালের ফায়সালা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা হলে সে মোতাবিক আমল করা হবে। কিন্তু এখানে কেউ কেউ বলে বেড়াচ্ছে যে, ও.আই.সির সিদ্ধান্তের পর এখন আর কারো তা অগ্রাহ্য করার অধিকার নেই। এবং সৌদি কিংবা অন্য কোনো দেশে দেখা প্রমাণিত হওয়ার পরও আমরা যে নিজেদের দেখার অপেক্ষায় রোযা ও ঈদ করা থেকে বিরত থাকি- এতে নাকি আমরা গোনাহগার হচ্ছি।
হযরত ওয়ালা মাজমাউল ফিকহের উপ-প্রধান হিসেবে আপনার কাছে বিশেষভাবে এই প্রশ্নটি উপস্থাপন করা হচ্ছে যে, সত্যিই কি মাজমাউল ফিকহের উক্ত সিদ্ধান্তের এটাই উদ্দেশ্য, যা এরা বলছে? তদ্রূপ মাজমাউল ফিকহের কোনো ফিকহি সিদ্ধান্ত অনুমোদনের অর্থ কি সেটা স্বয়ং সংস্থা (ও.আই.সি)-এরও ফায়সালা? সংস্থার তরফ থেকে কি মাজমার এই ফিকহি সিদ্ধান্ত মোতাবিক এ ব্যাপারে কোনো ফায়সালা করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? ”
হযরত উত্তর লিখেছেন:
قرار کا مطلب تو وجوب ہی ہے، لیکن مجمع الفقہ کی قرار مؤتمر کی طرف سے موثق یا واجب العمل نہیں، مسئلہ چونکہ مجتہد فیہا ہے اس لئے قرار کا حاصل یہ ہے کہ مسلمان ممالک اس پر متفق ہو جائیں تو اچھا ہے، لیکن جب تک یہ نہ ہو ملکوں کے لئے تمام راستے کھلے ہیں۔
والسلام محمد تقی
৮/৯/১৪৩৪ হিজরী
তরজমা : সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য তো এটাই যে, এক জায়গার দেখা সবার জন্যই অবশ্য-পালনীয়। কিন্তু মাজমাউল ফিকহের সকল সিদ্ধান্ত মু’তামার (ও.আই.সি)-এর পক্ষ থেকে প্রত্যয়নকৃত বা অপরিহার্য পালনীয় নয়। মাসআলাটি যেহেতু ইজতিহাদনির্ভর এবং মতবিরোধপূর্ণ তাই এই সিদ্ধান্তের সারকথা হলো, মুসলিম দেশসমূহ যদি এতে একমত হয়ে যায় তো ভালো। কিন্তু যতক্ষণ এটা হচ্ছে না ততক্ষণ রাষ্ট্রগুলোর জন্য সবরকম রাস্তাই খোলা আছে।
ওয়াসসালাম
মুহাম্মাদ তাকী
৮/৯/১৪৩৪ হিজরী
মাজমাউল ফিকহিল ইসলামীর উপ-প্রধান পরিষ্কার বলেছেন, সমস্ত মুসলিম দেশ যদি এ সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করে তাহলে ভালো। অর্থাৎ শরীয়তের দৃষ্টিতে এই ঐকমত্য অপরিহার্য নয়। তবে হয়ে গেলে ভালো। আর যে পর্যন্ত তাদের ঐকমত্য হচ্ছে না সে পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলোর জন্য সবরকম রাস্তাই খোলা আছে।
অর্থাৎ সেখানকার ওলামা ও শাসকবর্গ পরামর্শের মাধ্যমে চাই নিজেদের দেখা মোতাবিক আমল করুক, চাই শরীয়ত সম্মতভাবে প্রমাণিত হবার পর অন্য কোন দেশের দেখার ফায়সালা মোতাবিক আমল করুক- তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু বিচ্ছিন্নতার পথ অবলম্বন করা কোনো অবস্থাতেই যুক্তিযুক্ত নয়, যেমনটি স্বয়ং হযরতের কিতাব ইন‘আমুল বারী ৫ খণ্ডের ৪৯৭ পৃষ্ঠার উদ্ধৃতিতে ১৪৩৫ হি. রজব সংখ্যায় লেখা হয়েছে।
আশা করি সত্যসন্ধানীদের জন্য এতটুকু বিশ্লেষণই যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলা সুস্থ বিবেক এবং সঠিক উপলদ্ধি দান করুন। আমীন।
পাঠকদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার আগে রাবেতা আলমে ইসলামীর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আল মাজমাউল ফিকহী আলইসলামী মক্কা মুকাররমা কর্তৃক ১৯-২১ রবিউল আউয়াল ১৪৩৩ হিজরী (মোতাবিক ১১-১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১২ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর অনুবাদ পাঠকবৃন্দের সামনে পেশ করা সঙ্গত মনে করেছি। এই সভার বিষয়বস্তুই ছিল, চান্দ্রমাসসমূহের সূচনা ও সমাপ্তি প্রসঙ্গে উলামায়ে শরীয়ত এবং জ্যোতির্শাস্ত্রবিদগণ যুগের পরিস্থিতি ও দাবীকে সামনে রেখে সম্মিলিতভাবে চিন্তাভাবনা করে কোনো সমাধানে পৌঁছবেন।
চান্দ্রমাস প্রমাণ ইস্যুতে উলামায়ে শরীয়ত ও জ্যোতির্শাস্ত্রবিদদের বিশ্ব সম্মেলন
এই মহতী সম্মেলনের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর আরবী ভাষ্য
>البيان الختامي للمؤتمر العالمي لإثبات الشهور القمرية بين علماء الشريعة والحساب الفلكي<
শিরোনামে বিভিন্ন সাইটে পাওয়া যাবে। এর উর্দূ তরজমা মাসিক আল বালাগে ছেপেছে। যা দ্বীন ইসলাম ডটকমে দেখে নিতে পারেন। উর্দূ অনুবাদের ভ‚মিকা ও পরিশিষ্ট স্বরূপ আমার উস্তায হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমের লিখনী থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও এসেছে, যা অবশ্যই পড়া উচিত।
এখানে আমরা ঐ সিদ্ধান্তবলীর বাংলা তরজমা পেশ করছি-
সিদ্ধান্তনামায় অবতরণিকা হিসেবে হিলাল ভিত্তিক চান্দ্রমাসসমূহের ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরে বেশ কিছু আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। এবং চাঁদ দেখা ও চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে ইসলামী বিশ্বে যে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে সেদিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ‘সেজন্য এই মাসআলা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা অতীব জরুরি। যেখানে শরঈ বিধানের প্রতি লক্ষ্য রাখার পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও তার গণনা এবং দূরবীক্ষণ যন্ত্র, আল্লাহ তাআলা যার অসামান্য উন্নতি দান করেছেন- এরও সাহায্য নেওয়া হবে। যাতে করে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিবেচনার মাধ্যমে মাসআলার একটি কার্যকর সমাধানে উপনীত হওয়া যায়।’
রাবেতা আলমে ইসলামীর অধীন আল মাজমাউল ফিকহি আল ইসলামী মুসলমানদের সমস্যা সমাধানে দায়িত্ব পালনের তাগিদে এবং আলোচ্য বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার তীব্র প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে চান্দ্রমাসসমূহ প্রমাণ ইস্যুতে উলামায়ে শরীয়ত এবং জ্যোতির্শাস্ত্র বিশারদদের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে একটি আর্ন্তজাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। যা ১৯-২১ রবিউল আউয়াল ১৪৩৩ হিজরী মোতাবিক ১১-১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে অনুষ্ঠিত হয়। সৌদি আরবের ভিতরের ও বাইরের বিভিন্ন শরীয়াবোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাকেন্দ্রের নির্বাচিত বিশেষজ্ঞ আলেম ও জ্যোতির্শাস্ত্রবিদ এতে অংশগ্রহণ করেন। খাদেমুল হারামাইন শরীফাইন বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আযীয (আল্লাহ তাকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় পৃথিবীর পবিত্রতম স্থান মক্কা মুকাররমার কাবা শরীফ প্রাঙ্গনে যা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সম্মেলনে যোগদানকারী সদস্যবৃন্দ সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধের বিষয়বস্তু জেনে, তার সারসংক্ষেপ শুনে এবং তাতে যে সকল প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে তার পক্ষে বিপক্ষে মতামত ও পর্যালোচনা শেষে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে জোর দেন :
১. চান্দ্রমাসের সূচনা ও শেষ নির্ধারণের মাপকাঠি নতুন চাঁদ দেখা। তা খালি চোখেই হোক কিংবা দূরবীক্ষণযন্ত্র ও অন্যান্য জ্যোতির্শাস্ত্রীয় সরঞ্জামের সাহায্যে হোক। আর হিলাল যদি দেখা না যায় তাহলে ত্রিশ দিন পূর্ণ করা হবে। কারণ, হযরত আবু হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘(চাঁদ) দেখে রোযা রাখো এবং তা দেখেই ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করো। (তবে) যদি চাঁদ তোমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায় তাহলে শা‘বানের গণনায় ত্রিশ পূর্ণ করো।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৯)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মাস হয় উনত্রিশ রাতে। অতএব তোমরা রোযা রেখো না যতক্ষণ না (হেলাল) দেখতে পাও। আর যদি মেঘের জন্য হেলাল দেখা না যায় তাহলে ত্রিশ দিন হিসাব করো।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৭)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযিআল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা রোযা রেখো না যতক্ষণ না হিলাল দেখতে পাও। এবং ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করো না যতক্ষণ না তা দেখতে পাও। তবে যদি মেঘের কারণে হিলাল তোমাদের দৃষ্টিগোচর না হয় তাহলে মাস ত্রিশ ধরো।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৬)
এসব হাদীস এবং সাথে আরো বহু হাদীস প্রমাণ করে যে চান্দ্রমাসের সূচনা ও সমাপ্তির ক্ষেত্রে মাপকাঠি হলো হেলাল ‘দেখা’।
২. প্রত্যেক মাসে হিলাল অনুসন্ধান করা ফরযে কিফায়া। কেননা অনেক ফরয পালন এর উপর নির্ভরশীল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল ও তাকরীর (সম্মতি) থেকে যার সমর্থন পাওয়া যায়। তাই তো আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা‘বান মাসের বিষয় (তার হেলাল কবে দেখা গেছে এবং কতদিন পার হয়েছে) অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দিতেন। এরপর রমযানের চাঁদ দেখে তিনি রোযা রাখতেন। আর যদি মেঘের কারণে হেলাল দেখা না যেত তাহলে ত্রিশ গণনা করে অতপর রোযা রাখতেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩২৫)
ইবনে হিব্বান ও ইবনে খুযায়মার বর্ণনায় : শা‘বানের হিলালের হিসাব রাখার ক্ষেত্রে অন্য মাসের চেয়ে বেশি যত্নবান হতেন। আর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযিআল্লাহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন (একবার) লোকজন হিলাল (অনুসন্ধান ও তা) দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। আমি তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালাম, আমি তা দেখেছি। এ কথা শুনে তিনি নিজেও রোযা রাখলেন, অন্যদেরকেও রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৩৪২)
৩. সাক্ষ্যদাতার মাঝে সাক্ষ্য গৃহীত হবার প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূর্ণমাত্রায় পাওয়া যেতে হবে এবং সাক্ষ্যগ্রহণের প্রতিবন্ধক কোনো বিষয় না থাকতে হবে। সাক্ষীর তীক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। এবং হিলাল দেখার মুহূর্তে তার দেখার ধরন সম্পর্কেও নিশ্চিত করে জানতে হবে। যেন তার সাক্ষ্যর মধ্যে কোনরূপ সংশয়-সন্দেহ না থাকে।
৪. জ্যোতির্শাস্ত্রীয় গণনা একটি স্বতন্ত্র বিদ্যা। যার নিজস্ব মূলনীতি ও নিয়ম-কানুন রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর সিদ্ধান্ত ও সমাধান গ্রহণ করা সমীচীন। যেমন চন্দ্র ও সূর্যের সম্মিলনের সময়কাল, চাঁদ সূর্যগোলকের অদৃশ্য হবার আগে অদৃশ্য হল, না পরে এবং সূর্যের সাথে সম্মিলন পরবর্তী রাতে দিগন্তে চাঁদের উচ্চতা হবে কতটুকু, ইত্যাদি। এ কারণেই হিলাল দেখার সাক্ষ্য গৃহীত হবার জন্য জ্যোতির্বিদ্যার স্বীকৃত ও অকাট্য বাস্তবতা যা নির্ভরযোগ্য জ্যোতির্শাস্ত্রসংস্থাসমূহ কর্তৃক জানা যায়- সে অনুসারে চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়া অসম্ভব না হতে হবে। যেমন, (চাঁদ ও সূর্যের) ঠিক সম্মিলনের মুহূর্তে কিংবা সূর্যের অস্তগামী হওয়ার আগে চাঁদের অস্তমিত হওয়ার অবস্থায় (হেলাল দেখা যাওয়া সম্ভব নয়)।
৫. মুসলিমরা সংখ্যালঘু এমন দেশে কতক অঞ্চলে হিলাল দেখতে পাওয়া দেশের বাদবাকী অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য যথেষ্ট হবে। তাদের রোযা ও ঈদ পালনে ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থে।
৬. যেসব দেশে মুসলিম সংখ্যালঘুর বসবাস, সেখানে কোনো কারণে হিলাল দেখা সম্ভব না হলে তাদের কর্তব্য হবে, নিকটতম মুসলিম দেশের দেখা অনুসারে আমল করা কিংবা পার্শ্ববর্তী এমন কোনো দেশের দেখাকে গ্রহণ করা, যেখানে মুসলিম জনবসতি রয়েছে এবং চাঁদ প্রমাণিত হবার ঘোষণা এসেছে সেখানকার ইসলামিক সেন্টার বা মুসলমানদের নেতৃত্বদানকারী এজাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে।
৭. যে সকল চান্দ্রমাসের সঙ্গে ইবাদত পালনের সম্পর্ক রয়েছে তার শুরু নির্ধারণ করা একটি শরীয়ত নির্দেশিত কাজ। যে কারণে তা উলামায়ে শরীয়তের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, যাদেরকে নিযুক্ত করেছে কোনো স্বাধীন কর্তৃত্বশীল কর্তৃপক্ষ আর জ্যোতির্শাস্ত্রবিদ ও জ্যোতির্শাস্ত্রীয় সংস্থাসমূহের দায়িত্ব, চাঁদের জন্ম, হিলালের অবস্থান এবং পৃথিবীর গোলার্ধের যে কোনো স্থানে তার দেখতে পাওয়ার পর্যায় ও ধরন- এ সংক্রান্ত বিষয়ে সূ² পরিসংখ্যান ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহ করা। যা কিনা নিখুঁত ও নির্ভুল সিদ্ধান্তদানের ক্ষেত্রে শরয়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করবে।
৮. মানুষের কল্যাণ সাধন ও তাদের দৈনন্দিন আদান-প্রদানকে সহজ করণের স্বার্থে উন্নত জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাব ও আধুনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য গ্রহণসহ বিজ্ঞানের ইতিবাচক ব্যবহারে শরীয়ত বাধা প্রদান করে না। কেননা বিজ্ঞান ও তার আবিষ্কৃত বাস্তবতার সাথে ইসলামের অবস্থান সাংঘর্ষিক নয়।
৯. শরয়ী কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যদি মাসের শুরু নির্ধারিত হয়ে যায় এবং মুসলিম রাষ্ট্রের ওলিউল আমর (শাসক বা তৎকর্তৃক নিযুক্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দায়িত্বশীল) তা গ্রহণ করে নেন, তাহলে মাসের শুরু প্রমাণিত ঘোষণা হবার পর সে বিষয়ে আলোচনা সমালোচনা কিংবা কোনরূপ সংশয়ের সৃষ্টি করা বৈধ হবে না। কেননা এটি একটি ইজতিহাদী মাসআলা, শাসকের ফায়সালার মাধ্যমে যার বিরোধ-নিষ্পত্তি হয়ে যায়।
১০. মুসলিম সরকারসমূহকে এ মর্মে উৎসাহিত করা যাচ্ছে যে, তারা দেখার উপকরণাদির প্রতি এবং হিলাল অনুসন্ধানের জন্য বিশেষ কমিটি গঠনে মনোযোগী হবেন।
এ প্রসঙ্গে কনফারেন্স সেসব ইসলামী রাষ্ট্রের তৎপরতার প্রশংসা করছে, যারা মহাকাশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দূরবীক্ষণ যন্ত্র স্থাপনে মনোনিবেশ করেছে। যার শীর্ষে রয়েছে সৌদি আরবের প্রয়াস। ‘বাদশাহ আব্দুল আযীয বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শহর’ নির্মাণের মধ্য দিয়ে যা প্রতিফলিত।
১১. কনফারেন্স রাবেতায়ে আলমে ইসলামীকে সুপারিশ করছে, উলামায়ে শরীয়ত ও জ্যোতির্শাস্ত্রবিদদের সমন্বয়ে একটি ইলমী বোর্ড গঠনের। যার কাজ হবে, উভয় ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী ও গবেষণাধর্মী যত কাজ হয়েছে, যত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, এবং বৈঠক ও সভা সম্মেলনে আরো যে সব প্রবন্ধ উপস্থাপিত হয়েছে, এমনিভাবে বিভিন্ন ফেকাহ একাডেমি বা শীর্ষস্থানীয় আলিমদের বোর্ড অথবা ইসলামী গবেষণাকেন্দ্রসমূহ থেকে যা কিছু প্রকাশিত হয়েছে- সব নিয়ে গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করা। উলামা ও জ্যোতির্বিদদের সম্মিলিত ঐ ইলমী বোর্ডের চেষ্টা থাকবে, চান্দ্রমাসসমূহের সূচনার ক্ষেত্রে ঐক্য সৃষ্টির উপায় অনুসন্ধান করা। এ উদ্দেশ্যে ইসলামের পূণ্যভ‚মি ও মুসলিমদের প্রাণকেন্দ্র মক্কা মুকাররমাকে জ্যোতির্শাস্ত্রীয় দূরবীক্ষণের জন্য এবং হিজরী তারিখের অভিন্ন ক্যালেন্ডার প্রকাশের জন্য মক্কাকে সেন্টার রূপে গ্রহণ করা। উপরন্তু এই বোর্ড ইসলামী বিশ্বের সকল শরীয়া বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও জ্যোতির্শাস্ত্রীয় গবেষণা কেন্দ্রের মধ্যে সংযোগ ও সংহতি তৈরী করবে। আর এই বোর্ডের কেন্দ্রস্থল হবে, ইসলামের হৃৎপিণ্ডসম পূণ্যভূমি মক্কা মুকাররমায় অবস্থিত ‘রাবেতায়ে আলমে ইসলামী’।
এই বোর্ড ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের ফেকাহ একডেমি ও ফতোয়া বোর্ড কিংবা এদের অনুমোদিত বিশেষজ্ঞ উলামায়ে শরীয়ত এবং জ্যোতির্শাস্ত্রবিদদের সমন্বয়ে গঠিত হবে। যারা নিজেদের গবেষণার ফলাফল এবং এই সম্মেলনের গৃহীত সিন্ধান্তাবলী রাবেতার আলমাজমাউল ফিকহীতে পেশ করবে।
وصلى الله وسلم على نبينا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين.
রাবেতা আলমে ইসলামীর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত বিশ্বসম্মেলনে পুরো বিশ্বের অনেক উলামায়ে শরীয়ত এবং জ্যোতির্শাস্ত্র বিশারদ অংশ নিয়েছিলেন।
মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী জেদ্দার যে সদস্যগণ ১৯৮৬-এ আম্মানে অনুষ্ঠিত সভায় ছিলেন তাদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন- তাদের অনেকেই এ মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। পাঠকবৃন্দ এই বিশাল মহতী সম্মেলনের গৃহীত সিদ্ধান্তাবলী পাঠ করেছেন। সেখানে আপনারা দেখেছেন উলামায়ে শরীয়ত এবং জ্যোতির্শাস্ত্র বিশারদ এই উভয় দলই বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে সামনে নিয়ে এই ফায়সালা করেছেন যে, রোযা ও ঈদসহ অন্যান্য ইসলামী মৌসুমের ভিত্তি চাঁদ দেখার উপর, গণনা-নির্ভর জ্ঞানের উপর নয়। তবে হাঁ, খালি চোখে দেখা জরুরি নয়। দূর্বীক্ষণযন্ত্রের সাহয্যেও যদি দেখা হয় তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে সেটাও ‘দেখা’ বলে বিবেচিত হবে।
উপরন্তু উলামায়ে কেরাম এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ মিলিতভাবে এই সিদ্ধান্তও অনুমোদন করেছেন যে, চাঁদ দেখার ফায়সালা জনগণ বা ব্যক্তিবিশেষ করবে না; বরং তা ন্যস্ত থাকবে ‘উলুল আমর’ (যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষ) কর্তৃক নিযুক্ত উলামায়ে কেরামের উপর। আর জ্যোতির্শাস্ত্রবিদগণ শাস্ত্রীয় গণনার মাধ্যমে ‘দেখা’ প্রসঙ্গে ও ‘দেখার’ সাক্ষ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করবেন।
পরিশেষে এই রেজ্যুলেশনে বলা হয়েছে, কনফারেন্স রাবেতা আলমে ইসলামীকে সুপারিশ করেছে মক্কা মুকাররমায় উলামা ও বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে একটি পৃথক বোর্ড গঠনের। যা চান্দ্রমাসসমূহে ঐক্য বজায় রাখার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেবে এবং এ উদ্দেশ্যে জরুরি শরয়ী নীতিমালা ও বাস্তবায়ন-রূপরেখা প্রণয়ন করবে।
অতএব এখন সচেতন ও সমঝদার লোকের কাজ হল, দুআ করা এবং এ ব্যাপারে রাবেতাকে সাহায্য করা। আর যতক্ষণ পর্যন্ত এর কোনো সর্বসম্মত কর্মসূচী প্রণীত হয়ে কাজ আরম্ভ না হচ্ছে ততক্ষণ নিজ দেশের উলামা ও শাসকবর্গের সাথেই সিয়াম ও ঈদ পালন করা এবং বিচ্ছিন্নতা ও বিশৃঙ্খলা থেকে বেঁচে থাকা।[1]
তাওফীক আল্লাহরই হাতে। আমরা তাঁরই কাছে তাওফীক প্রার্থনা করি।
هذا وصلى الله تعالى وبارك وسلم على سيدنا ومولانا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.
বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
দারুত তাসনীফ,
মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা
১৬/০১/১৪৩৭ হিজরী
৩০/১০/২০১৫ খ্রিস্টাব্দ
[1] কর্মসূচী প্রণীত হওয়া মাত্রই পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, হিলাল দেখাটাই যেহেতু ভিত্তি, তাই বাস্তবে ‘সারা বিশ্বে একই সাথে করা’ সম্ভব হবে না, তবে বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশে সম্ভব হবে। যদি শর্তসমূহের প্রতি লক্ষ্য রেখে তরীকা মোতাবিক এই পরিসরে একই দিনে করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তো তাতে ইনশাআল্লাহ কোনো সমস্যা নেই। (আবদুল মালেক)