Shaban-Ramadan 1437   ||   June-July 2015

শাশ্বত : দুগল্পের দুই জগত

Abu Tashrif

দুজন মায়ের দুটি চিত্র। দুটি গল্প। একই দিনে ছাপা হয়েছে। দুটি সংবাদপত্রে। ১০ মের নয়াদিগন্তের ১০-এর পাতায় ছাপা হয়েছে একটি গল্প। গল্পের শিরোনাম : মাকে খুঁটির সাথে বেঁধে পিটিয়েছে সন্তান। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে জন্মদাত্রী মাকে ঘরের খুঁটির সাথে বেঁধে মারধর করার রিপোর্টটি এসেছে বরিশালের আগৈলঝাড়া থেকে। জানা গেছে, উপজেলার আন্ধারমানিক গ্রামের অবনী জয়ধরের ছেলে কোদালধোয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক অপূর্বলাল জয়ধর মাঝে মধ্যে তার মা লেবুরানীকে (৬০) মারধর করত। লেবুরানীর স্বামী অবনী জয়ধর জীবিত থাকলেও তিনি ছেলের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন। গত মঙ্গলবার তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ঘরের ভেতরের খুঁটির সাথে বেঁধে মারধর করায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন লেবুরানী। পরে নাতি দীপ্ত ঘরে গিয়ে রশি কেটে দেয়। চিকিৎসার পর লেবুরানীর জ্ঞান ফিরে আসে।

এ গল্পটি একজন দুঃখী মায়ের। খবরটি একজন পাষণ্ড পুত্রের। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পুত্র। শিক্ষার কী অপূর্ব উপহারই না তিনি মাকে দিচ্ছেন! দেখলে, জানলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। সমাজে কত রকম হিংস্রতার ঘটনাই ঘটছে। কত নির্মমতাই তো সহনীয় হয়ে যাচ্ছে। তা-ই বলে খুঁটিতে বেঁধে আপন মাকে প্রহার! মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলা!! কীভাবে সম্ভব! আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এ-রকম অসম্ভব খবর এখন প্রায়ই ছাপা হচ্ছে। সমাজ কি তাহলে ভয়ংকর কোনো অভিশপ্ত খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে? হতাশাবাচক প্রশ্নটির উত্তর হয়ত খুবই দুরূহ। কিন্তু একইসঙ্গে এটিও একটি প্রশ্ন যে, মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক কি সব ক্ষেত্রেই এরকম হৃদয়কাঁপানো পর্যায়ে নেমে গেছে? কোথাও কি কোনো হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া আশাব্যঞ্জকতা নেই? প্রশ্নটির উত্তর জানতে আমরা আরেকজন মায়ের গল্পের দিকে যেতে পারি।

১০ মের প্রথম আলোর ৩-এর পাতায় এসেছে। মা আর পুত্রেরই গল্প। শিরোনাম : এ যুগের বায়েজিদ বোস্তামি! রিপোর্টটি এসেছে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থেকে। ওই খবরের প্রথম প্যারাটি এরকম : শতবর্ষী ঊষা রানী মজুমদার বার্ধক্যজনিত কারণে চলাফেরা করতে পারেন না। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার সড়কটি যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হওয়ায় আট কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। গত সাত বছর ধরে এই মাকে বাঁশের ডালায় তুলে মাথায় করে চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার কাজটি করছেন ছেলে বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার।

শতবর্ষী এক সুখী মায়ের গল্প এটি। অসুস্থ মা রোগ শয্যায় শায়িত। তবুও পুত্রসুখে তিনি সুখী। কারণ, মায়ের সেবায় নিবেদিত একটি পুত্রের তিনি জননী। শেষ বয়সে তার সেবা ও চিকিৎসায় ওই পুত্র নিজের সব সামর্থ্য উজাড় করে দিচ্ছেন। না, তার ছেলেটি খুব শিক্ষিত নয়। সামান্য দিনমজুর। সেই দিনমজুর ছেলেই প্রতিদিন সকালে মাকে খাইয়ে কাজে যায়। দুপুরে ফিরে এসে মাকে স্নান করিয়ে খাবার খাইয়ে নিজে খাবার খায়। মায়ের সেবায় নিমগ্নতার কারণে ছেলেটি এখনো বিয়ে-সংসারও করেনি। হাঁ খবরটি মাতৃভক্ত এক সুখী পুত্রেরও। জানলে, পড়লে হৃদয় ভিজে আসে। শাশ্বত মানবিক সম্পর্কের কী হৃদয়ছোঁয়া উপমা! মাতৃভক্তিতে বীরত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এই বীরেন্দ্রের প্রতি আমাদের অভিনন্দন! আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন বীরেন্দ্র তার মাকে মাথায় নিয়ে। দীর্ঘ প্রায় সাত বছর ধরে। তার মনোভাব বলে, যতদিন তার মা জীবিত থাকবেন, তিনি এভাবে পথপাড়ি দিয়েই যাবেন। এমন ত্যাগী ও দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মানুষের জন্য আমাদের মনে আরো কিছু শুভ-প্রত্যাশার কথা জাগ্রত হতেই পারে। আমরা তাই আল্লাহর দরবারে দুআ করি, বীরেন্দ্র যেন জীবনের সবচেয়ে সরল ও শাশ্বত শান্তির পথটিতে বিচরণেরও তাওফীক লাভ করেন।

সাদা ও কালো। জীবনের দুরকম প্রবণতাই মানুষকে ধাবিত করতে পারে। শাশ্বত সুন্দর সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রেও দেখা যায় মানুষের আচরণ সব সময় কাক্সিক্ষত পর্যায়ে থাকে না। কখনো অনেক নীচে নেমে যায়। কখনো উজ্জ্বলতায় অনেক উপরেও উঠে আসে। নামার গল্পগুলো সমাজসংসারকে নিশ্চিতভাবেই দূষিত করে। পক্ষান্তরে উপরে যাওয়ার গল্পগুলো সমাজকে সুখী করে, অনুপ্রাণিত করে, সুন্দরের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

মা পেটানো শিক্ষক অপূর্বলালের অন্ধকার গল্পের পাশেই দিনমজুর মাতৃভক্ত বীরেন্দ্রনাথের উজ্জ্বল গল্পটি আমাদেরকে স্বস্তি দিল। ইতিবাচক সে গল্পটিতেই আমরা শেখার ও অনুসরণের অনেক কিছু পেলাম। মায়ের জন্য সর্বাত্মক সেবা তো তার আছেই। তার সঙ্গে আছে ঘর-সংসার না করে মায়ের জন্য নিজেকে পুরোপুরি নিমগ্ন রাখার মতো বে-হিসাবী শ্রদ্ধাও। পার্থিব বিচার ও প্রতিবেশ তুলনার সমাজে এই ত্যাগী দৃষ্টান্তের সুফল অনেক। এই যন্ত্র ও দ্বন্দ্বের জড় দুনিয়ায় এ যেন প্রাণের একটি স্ফুলিঙ্গ। একই সঙ্গে এ কথাও স্বরণযোগ্য যে, এ সমাজে এরকম প্রাণবান বহু মা-পুত্রের গল্প এখনও সজীব। আলহামদু লিল্লাহ। কিন্তু সেসব প্রতিটি গল্পই গণমাধ্যমের সাক্ষাৎ পায় না। এবং কখনো কখনো ইচ্ছা করেও সেসবের জানান দেওয়া হয় না। কিন্তু আমরা আড়ালে ও সামনে থাকা এইসব উজ্জ্বল গল্পের মানুষদের দিকেই তাকিয়ে থাকতে চাই। 

 

advertisement