Shaban-Ramadan 1437   ||   June-July 2015

গণমাধ্যম : মামার মারে ভাগ্নের অভিমান!

Khasru Khan

মিছিলটি ছিল ছাত্র ইউনিয়নের। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠন। বর্তমান সরকারের প্রায় সব সেকুলারবাদী কর্মকাণ্ডের উদ্যোগী সমর্থক। সংখ্যায়, শক্তিতে আর লিয়াজোতে পিছিয়ে থাকায় মন্ত্রিত্বের চেয়ারটা তারা বাগাতে পারেননি। এই যা দূরত্ব। তা না হলে শাহবাগ মঞ্চ, মৌলবাদ-বিরোধিতা এবং সংবিধান থেকে আল্লাহর নাম উচ্ছেদ-অভিযানে এরা বরং সরকারের চেয়ে এক কাঠি সরেস। ইসলাম আর মুসলমানিত্ব নিয়ে এদের গায়ে যেন বারমাসের চুলকানি লেগেই থাকে। সেই কামিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠনেরই একটি মিছিলে পুলিশের ভমিকা নিয়ে প্রভাবশালী গণমাধ্যমের চিহ্নিত অংশটিতে জ্বালা আর মাতম শুরু হয়ে গেছে। পুলিশের গাড়ীতে টব ছুঁড়ে মারার জবাবে তাদের এক নারী কর্মীর প্রতি পুলিশ সামান্য পুলিশসুলভ আচরণ উপহার দিয়েছিল। আর এতেই যেন সর্বনাশ হয়ে গেছে। না, সাম্প্রতিক সময়ে বহুল চর্চিত কোনো সাউন্ডগ্রেনেড, রাবার বুলেট কিংবা টিয়ারশেল নিক্ষেপ করার ধারে কাছেও যায়নি পুলিশ। এমনকি ঢালাও লাঠিচার্জও করেনি। সর্বোচ্চ দুতিনজন কর্মীকে মারধর করেছে। এতেই বাংলাদেশের সমস্ত মানবাধিকার, নারী-অধিকার হঠাৎ করে ভলুণ্ঠিত হয়ে গেছে। পুলিশ হয়েছে অত্যন্ত নিকৃষ্ট প্রাণীতে পরিণত। ভণ্ড-বাম ও একপক্ষীয় প্রভাবশালী গণমাধ্যমের দৃষ্টিকটু বুক চাপড়ানিতে এমনটিই মনে হয়েছে। তাদের আচরণে আরো মনে হয়েছে, গত ছয় বছরে পুলিশ যেন এত নীচে আর কখনো নামেনি। মনে হয়েছে, কমিউনিস্ট পার্টি করা লোকেরাই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক আদর-আপ্যায়ন ভোগ করার একমাত্র পাত্র; সুপার সিটিজেন। অথচ এসব ধিকৃত গণমাধ্যমের উসকানি ও প্রশ্রয়ের কারণেই যে পুলিশের মধ্যে নির্যাতনের প্রবণতা দিন দিন বেড়েছে- সে কথাটিই তারা চেপে যাচ্ছে।

পয়লা বৈশাখে আয়োজিত হৈচৈয়ের মধ্যে একশ্রেণীর চিহ্নিত ধর্ষণপ্রবণ চেতনাসম্পন্ন তরুণ কর্তৃক পরিকল্পিত নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ওই মিছিলটি বের করেছিল ছাত্র ইউনিয়ন। সঙ্গে ছিল আরো কিছু বাম সংগঠন। এ মিছিল ও প্রতিবাদের বিষয়ের সঙ্গে নিঃসন্দেহে রয়েছে আমাদের সহমত। বাম ছাত্রসংগঠন বলেই তাদের একটি ইতিবাচক কাজের বিরোধিতার পক্ষে আমরা নই। একই সঙ্গে যেভাবে যতটুকু মাত্রার নির্যাতনই পুলিশ তাদের উপর করে থাকুক- আমরা তারও নিন্দা জানাই। মনে করি, ওই নির্যাতনের মধ্য দিয়ে আইনের অপপ্রয়োগ এবং সাংবিধানিক অধিকারের ভলুণ্ঠন ঘটেছে। কিন্তু আমরা অবাক হই এ ঘটনায় কর্তৃত্ববাদী একপেশে গণমাধ্যমের হঠাৎ চমকে উঠা দেখে। দৃশ্যত এ ঘটনায় তারা পুলিশী নিপীড়নের (বাস্তবে সেটা সেদিন অতি সামান্য পরিমাণে হয়ে থাকলেও) বিরুদ্ধে নিজেদের এত বেশি সজাগ ও অনুভতিপ্রবণ অবস্থান তুলে ধরেছে যে, মনে হতেই পারে এই গণমাধ্যম পুলিশী নির্যাতনের বিষয়ে বরাবর খুবই সজাগ ও অতন্দ্র ছিল। সারা দেশের মানুষ পুলিশি আচরণের খতিয়ান সব জানে, তার পরও ওই গণমাধ্যমগুলো এ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে যে, এ-দেশে হেফাযতের আন্দোলনের সময়সহ নানা ধর্মীয় ও জাতীয় ইস্যুতে পুলিশ কোনো বর্বরতাই করেনি। এ ঘটনায় বরং দুষ্ট গণমাধ্যম ও তাদের পোষ্য সুশীলদের চিৎকারে এ সত্যটি উল্টে দেওয়ার চেষ্টাই করা হয়েছে যে, নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন শুধু নয়, গুলি ও প্রাণনাশই হচ্ছে বর্তমানে পুলিশি পদক্ষেপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। গণমাধ্যমগুলো ছাত্র ইউনিয়নের আহত নারী কর্মীর জন্য কাঁদতে কাঁদতে অনেক কথাই বলেছে। তাদের কিছু কথা: বিচারহীনতা নতুন অপরাধের জন্ম দেবে, পুলিশের আচরণের দায় সরকার এড়াতে পারে না, সীমা ছাড়াচ্ছে পুলিশ, ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হোক, এ সরকার হাফ-রাজাকার এবং এরকম আরো বহু কথা ও ধ্বনি। কোনো কোনো ইংরেজি গণমাধ্যমের শিরোনাম তো ছিল: মা দিবসে নারীর প্রতি পুলিশের উপহার। এ-জাতীয় রিপোর্ট, ছবি, কলাম, সম্পাদকীয়, মতামত, ফলোআপে ভরে গেছে গণমাধ্যমের পাতা ও পর্দা। অথচ কয়েক বছর যাবত এরাই প্রতিবাদী জনতার মিছিলে পুলিশি হামলার শিরোনাম করেছে নির্যাতিতদের প্রতি কিছুটা টুইস্ট (ব্যঙ্গ) করে। যেমন: মিছিলকারীদের বেধড়ক পিটিয়েছে পুলিশ, পুলিশ দাঁড়াতেই দেয়নি, পুলিশের হামলায় হেফাযতের কর্মীরা পালিয়েছে, পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, ইত্যাদি।

মূলত মতাদর্শিক অন্ধ গণমাধ্যমের উস্কানি ও আস্কারায় নিরীহ পুলিশ নির্মম নির্যাতনের মধ্যেই নিজেদের আত্মমর্যাদা খুঁজে পেয়েছে। এখন তারাই বুঝে না-বুঝে স্বগোত্রীয়দের উপর হামলে পড়ার মধ্যেও মজা পাচ্ছে। এ বিষবৃক্ষ তো তৈরি করেছে বদ গণমাধ্যম আর উলঙ্গ সুশীলচক্রই। এখন আর তাদের কেঁদে কেটে কী লাভ! মাত্র তো শুরু। পুলিশী দণ্ড আর বুটের গুঁতো যে কত ভাবে এখন তাদের নাজেহাল করতে পারে- এটি কেবল অসহায় চোখে দেখার পালা। এবার তারা দুঃখ পেয়েছেন। বড় খেদ ও অভিমানেও ভুগেছেন। এ সরকারের পুলিশ তাদের (বামপন্থী) ছেলেমেয়েদের কেন ছুঁতে যাবে? পুলিশ কি জানে না- সরকারের সঙ্গে বামেদের সম্পর্ক হচ্ছে- আমাদের আর মামাদের। এই পক্ষে আর ওই পক্ষে আমরা আর মামারাই থাকবো। অন্য কোনো দলমতকে কোনো দিকেই টিকতে দেব না। কিন্তু হিংসা ও মতাদর্শিক হিংস্রতার আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া এবং নষ্ট করে দেওয়া ও পচিয়ে দেওয়া শৃঙ্খলা এখন আর এই মামা-ভাগ্নেদের কাউকেই সুস্থ থাকতে দেবে বলে মনে হয় না। এই কমু-সেকু গণমাধ্যমবাদীরা নিজেদের মতাদর্শের লোকেদের অতি উঁচু অভিজাত নাগরিক রূপে দাঁড় করাতে গিয়েই তাদের সামনের দিনগুলো হতাশায় ঢেকে দিয়েছে। এবার মামাদের নিপীড়নবাদী বাহিনীর বুটের তলাতেই তারা তাদের ছেলেমেয়ে, ভাই-বেরাদারদের চেহারা প্রায়ই দেখতে পাবেন -শংকাটা সেরকমই। এজন্যই তাদের এত অভিমান। এজন্যই তাদের এত হতাশা। 

 

advertisement