ছোট্ট সাঈফার স্বপ্ন
মানুষ সবসময়ই নিজের চেয়ে উঁচু শ্রেণীর দিকে তাকায়। নিজের চেয়ে যারা ধনী তাদের দিকে তাকায়। তাদের মত হতে চায়। তাদের জীবনাচরণ অনুসরণ করতে চায়। ফলে তার চাহিদা ও অভাব আরো বেড়ে যায়। মনের কষ্ট বেড়ে যায়। যে কোনো মূল্যে সে তাদের মত হতে চায়। ফলে সে নিজ অবস্থার উপরে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে ভুলে যায়। ন্যায় অন্যায়ের কথা ভুলে যায়। আমাদের মাঝে অনেকেই এমন আছে। তারা নিজেকে খুব অসহায় মনে করে, ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু আমাদের সকলেরই উচিত উঁচু দালানে বসবাসকারী ব্যক্তিদের দিকে না তাকিয়ে আমার চেয়ে যে নিচের অবস্থায় আছে তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া। আর এটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ছোট্ট খুকী সাঈফা। সে লেখা-পড়ায় ভাল। তার চেয়েও বেশি ভাল, কথা-বার্তা ও আচার আচরণে। সাঈফা যেমন মিষ্টি, তেমন ভদ্র। সে যেমন ছোট্ট তেমন তার স্বপ্নগুলোও ছোট ছোট। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো সাঈফার হৃদয়ের গণ্ডি কখনোই পেরুতে পারে না। তার মনের আশা আলোর মুখ দেখে না।
সে তার খালাতো বোন ফায়যাদের বাসায় মাঝে মাঝেই যায়। তার আব্বু বড় ব্যবসায়ী। ঢাকায় তাদের বিশাল বাড়ি আছে। বাড়ির সামনে ফুলবাগান। ফায়যার আলাদা পড়ার রুম। এগুলো দেখে সাঈফার মন চায়, তার একটা পড়ার ঘর হবে আর সে তার ঘরটাকে মনের মত করে সাজাবে। বাড়ির সামনে একটি ফুল বাগান করবে। সেখানে সে হাসনাহেনা, রজনীগন্ধা আরো কতশত ফুলের গাছ লাগাবে।
কিন্তু আজো সাঈফার আশা পূর্ণতা পায়নি। কারণ সাঈফাদের তো বাড়িই নেই। তিন রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে তারা। সাঈফার আরো কিছু ইচ্ছে আছে। যেমন, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপে বেড়ানো। একদিন সাঈফা তার আব্বুকে বলতে শুনেছে, সাঈফাকে তো খুব নামী-দামী স্কুলে ভর্তি করে আমি তার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। এতে সাঈফার ছোট্ট মনে কষ্ট অনুভূত হয়।
সাঈফার এ ধরনের কষ্টকে আরোও বাড়িয়ে দেয় তার স্কুল-বান্ধবী বড় লোকের একমাত্র দুলালী লিজা। সে প্রায়ই সাঈফাকে কাপড় পরিধান, টিফিনসহ নানা বিষয়ে লজ্জা দিতে কুন্ঠাবোধ করে না। আর লিজার কথায় সাঈফা লজ্জায় এতটুকু হয়ে যায়। কয়েকদিন পর সাঈফার আব্বু বললেন, মামনি চল তোমাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসি। সাঈফার মনটা হঠাৎ খুশীতে ভরে ওঠে। সে অনেকদিন পর বেড়াতে যাবে। কিন্তু সাঈফার আব্বু ওকে যেখানে বেড়াতে নিয়ে গেলেন, দেখে সাঈফা হতবাক হয়ে গেল। এ আমাকে কোথায় নিয়ে এলেন আব্বু! সাঈফা ভেবেছিল আব্বু তাকে শিশুপার্ক অথবা চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু এ কোন্ আজবখানা। মানুষ তো নয় সব যেন কঙ্কাল। পেটফোলা ছেলে-মেয়েগুলোর হাত পা একেবারে লিকলিকে। চারদিক নোংরা পরিবেশ। সাঈফার যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। ছেলে-মেয়েগুলো সাঈফাকে অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। যেন সাঈফা অন্য জগতের মেয়ে।
আব্বু বেশি কিছু বললেন না। শুধু বললেন, এটা বস্তি। এরকম বস্তি আরো আছে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে। এরা তোমারই মত ছেলে মেয়ে ও তোমার আব্বু-আম্মুর মত নারী-পুরুষই তাদের বাবা-মা। সাঈফার মত মেয়েদের এর চেয়ে বেশি কিছু বলার দরকার হয় না। বস্তির ছেলে-মেয়েদের কষ্ট দেখার পর সাঈফার মনে আর কষ্ট রইল না। সে মনে মনে বলল, হে আল্লাহ্! এতদিন আমি বুঝিনি। বুঝতে পারিনি। আমি মনে করেছি, আমার ছোট ছোট স্বপ্ন ও আশাগুলো পূরণ না হওয়ায় আমার মতো দুঃখী মানুষ এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। অথচ আজ দেখলাম, আমার মতো হাজারো ছেলে-মেয়ে কত কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। হে মেহেরবান আল্লাহ্! আজ আমি বুঝেছি যে, আমাকে তুমি অনেক সুখে রেখেছ। অনেক শান্তিতে রেখেছ। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। তার মনে পড়ে, সে আব্বুর মুখে শুনেছে, নবীজী বলেছেন, “তোমরা তোমাদের চেয়ে নিচের লোকদের প্রতি তাকাও, তোমাদের চেয়ে উঁচু শ্রেণীর লোকদের দিকে তাকিয়ো না। তাহলে তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিআমতকে তোমাদের কাছে তুচ্ছ মনে হবে না। (তোমাকে আল্লাহ যে নিআমত দিয়েছেন, তার উপর না-শোকরি আসবে না।) Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৬৩
সাইফা এবার বুঝলো, তাকে আল্লাহ অনেক ভালো রেখেছেন। অনেক সুখে রেখেছেন। সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। বলল, আলহামদু লিল্লাহ! সাথে সাথে বস্তির মানুষদের দেখে সাঈফার অবুঝ হৃদয়ে দরিদ্র মানুষের প্রতি একটা ভালবাসা জন্ম নিল। সে তাদের জন্য কিছু করতে চায়। আল্লাহ্ যেন আমাদেরও সাঈফার মত সঠিক বুঝ দান করেন। নিজ নিজ অবস্থার উপর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার এবং নিজের সাধ্যের মধ্যে গরীব মানুষের জন্য কিছু করার তাওফিক দান করেন। আমীন!