Muharram 1437   ||   November 2015

নিউইয়র্কে আরেকটি জুমার স্মৃতি

মুহাম্মদ জাহিরুল আলম

[সম্মানিত লেখকের নিউইয়র্কের এ-রকমই জুমার নামায ধরতে পারার অলৌকিকতামণ্ডিত একটি স্মৃতিকথা গত ফেব্রæয়ারি ২০১১ ঈ. সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। এবারের লেখাটিও তার জুমার নামায বিষয়ক আরেকটি স্মৃতি। তবে বৈশিষ্ট্য এক হলেও দুটি ঘটনার ফলাফল ছিল ভিন্ন। সময়ের হিসাব থেমে যাওয়া ও এগিয়ে যাওয়ার এই দুটি ঘটনা থেকে পাঠকগণ আশা করি শিক্ষণীয় কিছু গ্রহণ করতে পারবেন। Ñসম্পাদক]

আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো আরো বড় রহস্য। আরো অনেক বড় অলৌকিকতা। এক প্রশ্নের উত্তর পেতে না পেতেই জমা হলো আর এক প্রশ্ন । প্রশ্নের পর প্রশ্ন । নয়তো প্রথমে প্রশ্ন ও তারপরে তার উত্তর। অনেকটা সনেট  বা চতুর্দশপদী কবিতার মত। প্রথম আট লাইনে যে প্রশ্নের উদ্ভব শেষোক্ত ছয় লাইনে তারই উত্তর। আমার প্রথম প্রশ্নটি ছিলো প্রথম আট লাইনের বিষয় আর শেষোক্ত ছয় লাইন হলো তারই সম্ভাব্য উত্তর।

    এক সপ্তাহ কেটে গেছে। কেটে গেছে আকাশের মেঘ। পরিচ্ছন্ন পরিষ্কার রৌদ্রালোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে কল্পনায়ও ভাবা যায় না যে এই আকাশটাই কী ধরনের চেহারা ধারণ করেছিলো ঠিক এক সপ্তাহ পূর্বে। এই আকাশটাকে কেন্দ্র করেই নিউ ইয়র্ক টাইমস আট কলাম জুড়ে একটি হেড লাইন করেছিলো। দি বিøজার্ড অব নিউ ইয়র্ক। নিউ ইয়র্ক রাষ্ট্রটা থেমে গিয়েছিলো । হয়তোবা ঘড়ির কাটাও। নয়তো আমি কেন মিস করলাম না জুমাতুল বিদার জুমার সালাত? এ রহস্য তো আমার কাছে আজও অনুদঘাটিত। এক অজানা অলৌকিক রহস্য ঘিরে রেখেছে আমার জীবনের একটা ক্ষুদ্র খণ্ডাংশ। দীর্ঘ সময়েও উন্মোচন করতে পারিনি এই ঘোর রহস্যের জাল। গেল রমযানুল মুবারকের শেষ জুমা। অতিবাহিত হল ঈদুল ফিতর। এক সপ্তাহ পর এলো আবার একটি জুমা। জুমাতুল বিদার উত্তাপ উত্তেজনা না থাকলেও জুমাবারের বিশেষ আকর্ষণ তো থাকবেই। ঈদ চলে গেছে কিন্তু ঈদের আমেজ তো রয়েছে । সকল সাধারণ মানুষের জীবনেই লেগেছে স্বাভাবিকতার ছোঁয়া। সিয়াম সাধনার পবিত্রতম মুহূর্তগুলো এখন বিগত। একটা অনাবিল মাধূর্যমণ্ডিত সময় অতিক্রান্ত হয়ে এসেছে একটা বৈচিত্র বর্জিত গতানুগতিক স্বাভাবিক সময়। নেই নেক আমল সংগ্রহের একটি অতি আকুল আকুতি। নেই ইফতার সেহরি তারাবি সালাতের জন্য অতিরিক্ত আগ্রহ বা ব্যস্ততা। অর্থাৎ মহাসমুদ্রের বিশাল জলরাশির মহা জলোচ্ছাসের পর একটা নীরব স্থবিরতা। সব কিছু যেন থেমে গেছে। কোনোকিছু বদলে না গিয়েও যেন সবকিছুই বদলে গেছে। এ পরিবর্তন পরম করুণাময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার তরফ থেকেই হয়ে থাকে প্রতি বৎসরই। এ পরিবর্তন সবাই দেখতে পায় না। সকলে বোঝেও না। যারা বোঝার তারা বোঝে আর যারা দেখার কেবল তারাই দেখে। যারা এর উপর চিন্তা করে তারা তো ঘটনা আদ্যেপান্ত পড়তেও পারে। এমন বিচিত্র এর রূপ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সৃষ্টির বিচিত্রতার তো আর কোনো আদি অন্ত নেই। যেদিকে দৃষ্টি দেবেন সেদিকেই বিচিত্রতা। চির বিচিত্রতায় আবদ্ধ করে রেখেছেন পরম করুণাময় তাঁর বিচিত্র ধরণীকে এক বিশাল বিচিত্রময়তায়। এ এক রাত্রি-দিনের ব্যবধানের মত একটা বিশাল পরিবর্তন। রোযার পূর্বের সময়, রোযার সময় আর রোযার পরের সময় যে এক রকম নয় তা অবশ্যই সকলেরই বোধগম্য। সবাই বোঝে, কারো কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই। বিষয়টি অনুভবেরও। চোখ দিয়ে দেখা যায়, মন দিয়ে যায় বোঝা।

আমি প্রতি সপ্তাহের মতই পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হলাম জুমার সালাতে অংশ নেওয়ার জন্য। গত সপ্তাহের দূর্দমনীয় অভিজ্ঞতার কারণে এবার রওনা হলাম আরো ঘণ্টা খানেক সময় অতিরিক্ত হাতে নিয়ে। সালাত মিস করার বিন্দুমাত্র কোনো আশংকা যেন না থাকে মনে বা মনের বাইরেও। অনেকটা রাজকীয় মনোভাব নিয়েই বের হওয়া। রাজকীয় বললাম এই জন্য যে, কোনোভাবেই যে মিস হবে না সে সম্পর্কে একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়া। মসজিদও ঐ একই টার্কিস মসজিদ। যাত্রা পথও পূর্বের ন্যায় একই। ট্রেন এবং বদল ট্রেনের বিষয়ও একই। অর্থাৎ কোনো ঘাত প্রতিঘাত বাধা বিপত্তি বা প্রতিবন্ধকতার অবকাশই রইলো না কোথাও। যাব, নামায পরবো আর ফিরে আসবো। প্রয়োজনের চেয়েও অনেক অতিরিক্ত সময় হাতে। রৌদ্রকরোজ্জ্বল আকাশে সূর্য খাঁ খাঁ করছে। সূর্যের প্রচণ্ড দাবদাহ ক্লান্ত করছে পথচারিকে। অতিরিক্ত কিরণ বিকিরণের মাধ্যমে রাস্তার পথচলা যাত্রীদের ক্ষণে ক্ষণেই ঘর্মাক্ত করে তুলছে। অবশ্য বলা বাহুল্য, ইউরোপ আমেরিকায় লোকজন আমাদের দেশের মত একই পদ্ধতিতে রাস্তায় পথ চলে না। ৯৫% জনই পাতাল রেল, বাস অথবা ব্যক্তিগত প্রাইভেট কারে চলাফেরা করে। রাস্তায় বেশির ভাগ কেবল স্থানীয়দেরই পায়ে চলা পথে চলাফেরা করতে দেখা যায়। আবার কেউ কেউ হয়তো কোনো দূরাঞ্চল থেকে বাসে বা পাতাল ট্রেন থেকে নেমে উপরে উঠে স্থানীয়ভাবে কোন ঠিকানা অনুসন্ধান করছে। এ দেশের প্রায় প্রতিজন লোকেরই ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার রয়েছে। এ দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে গাড়ীর সংখ্যা অনেক বেশি। সুতরাং আমাদের দেশে বসে, না দেখে ঐ সকল দেশের জীবনযাত্রা সম্পর্কে সঠিক মন্তব্য করা প্রায় একেবারেই অসম্ভব।

যাক প্রসঙ্গান্তরে না গিয়ে মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। আমার চিরন্তন বদঅভ্যাস হলো কথা বলতে গিয়ে বা লিখতে গিয়ে অতি সহজেই প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়া। সহজেই কথার খেই হারিয়ে ফেলি। কথার চেয়ে অকথা বেশি। জুমার সালাত আদায় করতে আমাকে যাত্রা করতে হবে নিউইয়র্কের ব্রæকলিন-এর ভিকটোরিয়া হাসপাতাল থেকে পায়ে হেটে আনুমানিক ছয় বøক। তারপর পাতাল রেল। আর ট্রেন ধরে বেশ কয়েকটি স্টেশন। তারপর ট্রান্সফার নেবো এন ট্রেনে। সেখান থেকে কয়েক মিনিট পায়ে হেটে পৌঁছে যাবো সুশোভিত টার্কিশ মসজিদটিতে। যথাযথ সময়ে রওনা হয়ে পাতাল রেল স্টেশনে পৌঁছে দেখি ট্রেন আমার ঠিক পূর্বেই এসে থেমে আছে। সেকেন্ডেরও বিলম্ব নেই। ট্রেন যথারীতি ট্রেন বদলের স্টেশনে পৌঁছুলে দেখি পরবর্তী এন ট্রেনও দাঁড়িয়ে আছে পূর্ব থেকেই। কোথাও সেকেন্ডেরও বিলম্বের কোনো কারণ ঘটেনি। ট্রেনটা যেন আমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। এ যাত্রার সব কিছুই এত দ্রæত ও তাড়াতাড়ি ঘটে যাচ্ছে একটার পর একটা, আমার তো অবাক হবার মাত্রা হাড়িয়ে যাবার কথা। আনমনে ভাবনায় ফিরে যাই পূর্ববর্তী জুমার স্মৃতিতে। ট্রেনে পা রাখার সাথে সাথেই তা চলতে শুরু করলো। যথারীতি পথ অতিক্রম করে ট্রেন তার গন্তব্যে পৌঁছে। আমার মনোরাজ্যে কেবল গত সপ্তাহের দৃশ্য একের পর এক মেলে চলছে। অথচ গত সপ্তাহের সব ঘটনার উল্টো সব ঘটনা একটার পর একটা এ সপ্তাহে ঘটতে শুরু করেছে। কিন্তু আমার অবাক হবার ঘটনা এখানেই শেষ নয়। আগের অবাক করা সব ঘটনাকে তুচ্ছ করে আরো বড় করে অবাক করার ঘটনা অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য। এবারে ট্রেন এসে থামলো আমার অবতরণ-গন্তব্যে। এত তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছেছে দেখে ভাবলাম নিশ্চই আজ ঘণ্টারও বেশি সময় পূর্বে পৌঁছে গেছি গন্তব্যে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে সালাত বা খোৎবা আরম্ভ হতে। মহা আনন্দে বীর দর্পে যখন মসজিদের সদর দরজা অতিক্রম করে প্রবেশ করছি তখনই ঘটলো জীবনের চরমতম বিস্ময়কর দৃশ্যের অবতারণা। অর্থাৎ মুসল্লীগণ নামাজ শেষ করে বাহির পথ দিয়ে মসজিদ থেকে দলে দলে বেড়িয়ে আসছে। আমার নিকট তখন পৃথিবীতে এর চেয়ে অসম্ভব কাজ আর কিছু নেই। মানুষের চিন্তা ভাবনারও শেষ আছে কিন্তু এই ঘটনায় আমি আমার ভাবনারও খেই হারিয়ে ফেলেছি।

ফিরতি পথের মুসল্লিদের জিজ্ঞেস করলে খুবই শান্ত স্বাভাবিক উত্তরে জানালো যে, নামায শেষে এখন গৃহে ফিরে যাচ্ছি। আমি অবাক বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে সেই স্থানেই বসে পড়লাম। ভাবনা চিন্তার অবকাশ কোথায়? মুসল্লিগণতো আমারই সম্মুখ দিয়ে সব মসজিদ থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। এবারে আরো একটু পরিষ্কার ও বিস্তারিত জানার জন্য মুসল্লি ভাইদের নানান রকম প্রশ্ন করতে থাকলে কেউ বললেন নামায একই সময় অর্থাৎ ঠিক একটায়ই শুরু হয়েছে। কেউ বললেন, নামায সব সময় যে সময়ে শুরু হয় ঠিক সে সময়েই শুরু হয়েছে। কেউবা বিরক্তিভরা কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করলেনÑ এ মসজিদে কি যোহর বা জুমার সময় কখনও পাল্টাতে দেখেছেন? কেউবা বললেন, গত সপ্তাহে যখন শুরু হয়েছিলো, আজও ঠিক তখনই শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে সর্বশেষ কথা হলো যোহর এবং জুমার সালাত এই মসজিদটিতে ঐ একই সময়ে অর্থাৎ বেলা দুপুর একটায় হল আরম্ভকাল। ঘড়ির কাঁটা যখন একটার কোঠায়, ইমাম সাহেব তখন মিম্বরে। এ হিসাবের ব্যতিক্রম নেই। শুক্রবার হলো ইউরোপ আমেরিকার কার্যদিবস; ওয়ার্কিং ডে। সর্বত্রই যথাযথ সময়ে কাজ শুরু এবং যথা সময়ে শেষ হয়। এ সকল দেশে সবকিছুই চলে ঘড়ির কাঁটা ধরে। হাজার হাজার লোক যারা নামাযে সালাম ফিরিয়েই দৌড়াচ্ছে যার যার কার্যক্ষেত্রে। যার যার পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রামে। কথায় বলে, সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সেই সময়ই আমাকে যে তেলেসমাতি দেখালো আমি হতবাক হয়ে থেমে গেলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নিজ থেকেই ভাবতে থাকলাম এ অবিশ্বাস্য অসম্ভবকে কে সম্ভব করল আমার জীবনে? একবার সময়কে থামিয়ে দিলো আরেকবার সময়কে করলো তরান্বিত। একবার পেয়ে গেলাম বহু আকাক্সিক্ষত জুমাতুল বিদা আরেকবার মিস করলাম জুমার সালাত? ইহকালে এই প্রশ্নের উত্তর কি কেউ আমাকে জানাতে পারবেন? হয়তো পারবেন। কিংবা পারবেন না। আমি এই স্মৃতি নিয়ে অপেক্ষা করব রোয কিয়ামত অবধি। হয়ত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তা জানাবেন কোনো না কোনোভাবে। আজও অবকাশে বসে বসে ভাবি জুমাতুল বিদার যে নামায আমার  কোনোভাবেই পাবার কথা ছিলো না তা এত সহজভাবে পাওয়া এবং তার পরের জুমা যা কোনোভাবেই হারাবার ছিলো না তা এত সহজভাবে হারাবার অভ্যন্তরে যে নিগূঢ় রহস্য ও অলৌকিকতা তা নির্ধারন করা না গেলেও প্রিয় নবিজীর একটি ঈমান বিষয়ক হাদীস সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য। নবিজী বলেছেন, "জীবনে তোমরা যা পেয়েছো তা তোমাদের কখনও কোনোভাবেই হারাবার ছিলো না, আবার তোমরা যা হারিয়েছো তা কখনও কোনোভাবেই তোমাদের পাবারও ছিলো না।" Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬৯৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৭৭ 

 

প্রিয় নবীজীর এই ঈমান বিষয়ক হাদীসটি কি এর অতি সহজ এবং সঠিক উত্তর নয়? 

 

advertisement