দরসে হাদীস : বান্দার প্রতি আল্লাহর খিতাব
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ষষ্ঠ খিতাব
يَا عِبَادِي، إِنَّكُمْ لَنْ تَبْلُغُوا ضَرِّي فَتَضُرُّونِي، وَلَنْ تَبْلُغُوا نَفْعِي فَتَنْفَعُونِي .
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা না আমার অপকার সাধনের পর্যায়েই কখনো পৌঁছুবে যে, আমার কোনো অপকার করবে। আর না উপকার সাধনের পর্যায়ে পৌঁছুবে যে, কোনো উপকার করবে।’
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হলেন সেই সুমহান অমুখাপেক্ষী সত্তা, যিনি সর্বপ্রকারের লাভ-ক্ষতি, উপকার-অপকারের ঊর্ধ্বে। আর বান্দার অবস্থা এই যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপকার বা অপকার সাধনের প্রশ্নই তার ক্ষেত্রে অবান্তর।
‘অবস্থান’ ও ‘সম্বন্ধ’ বোঝা
জ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, অবস্থান ও সম্বন্ধ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান। কে না জানে যে, ঐ জ্ঞানই প্রশংসনীয়, যা সঠিক ও বাস্তব। ভুল বা অবাস্তব জ্ঞান প্রকৃত অর্থে জ্ঞান নয়। সেটা অজ্ঞানতা। বাস্তবতার সঠিক উপলব্ধি ঐ কাম্য ও প্রশংসনীয় জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। এরই একটি দিক ‘অবস্থান’ ও ‘সম্বন্ধ’ বোঝা। অর্থাৎ নিজের অবস্থান সম্পর্কে বাস্তব ধারণা এবং অন্যের সাথে সম্বন্ধের স্বরূপ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি। এটি একটি প্রশস্ত বিষয়। এখানে যে অংশটি প্রাসঙ্গিক তা হচ্ছে, মানবের কর্তব্য, নিজের সত্তা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা পোষণ আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে তার সম্বন্ধের নির্ভুল উপলব্ধি।
এই জ্ঞান ও উপলব্ধি মানবের চিন্তা ও কর্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। সে তখন উপলব্ধি করে যে, আল্লাহ হলেন খালিক ও ¯্রষ্টা। আর সে এক মাখলুক ও সৃষ্টি। আল্লাহ হলেন বে-নিয়ায ও অমুখাপেক্ষী। আর সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর মুখাপেক্ষী। এটাই হচ্ছে আল্লাহকে জানা এবং নিজেকে চেনার এক বিশেষ দিক। হারিস ইবনে হাইয়্যান রাহ. বলেছেনÑ
من عرف نفسه وعرف ربه عرف قطعا أنه لا وجود له من ذاته، إنما وجود ذاته ودوام وجوده وكمال وجوده من الله وإلى الله وبالله.
অর্থাৎ যে নিজেকে চিনেছে এবং আপন রবের পরিচয় লাভ করেছে তার এ প্রত্যয় জন্মেছে যে, সে আপন অস্তিত্বে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; বরং তার অস্তিত্ব, তার বেঁচে থাকা ও তার সকল গুণ একমাত্র আল্লাহরই দান। Ñইহইয়াউ উলুমিদ্দীন ৪/৩১৮
এই উপলব্ধিরই ফল আল্লাহর ভয়। তাই সালাফ আল্লাহর ভয়কে ‘ইলম’ বলেছেন আর এর বিপরীত ‘উজ্ব’ বা আত্মগর্বকে ‘জাহ্ল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিখ্যাত তাবেয়ী মাসরূক ইবনুল আজদা রাহ. বলেনÑ
كفى بالمرء علما أن يخشى الله وكفى بالمرء جهلا أن يعجب بعلمه.
অর্থাৎ, জ্ঞানের প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর ভয় আর অজ্ঞতার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে নিজ আমলের কারণে আত্মগর্বী হওয়া। Ñআদ দারেমী ৩৮৩; জামেউ বায়ানিল ইলম ১/১৪৩
ইমাম গাযালী রাহ. বলেনÑ
أخوف الناس لربه أعرفهم بنفسه وبربه، ولذلك قال - صلى الله عليه وسلم: أنا أخوفكم لله ،وكذلك قال الله - تعالى : إنما يخشى الله من عباده العلماء.
আপন রবকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে ঐ ব্যক্তি যে নিজের সম্পর্কে এবং আপন রবের সম্পর্কে বেশি জানে। আর একারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করি।’ তেমনি কুরআন মাজীদের ইরশাদÑ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই আল্লাহকে ভয় করে...’ Ñইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৪/১৬৪
এর প্রকাশ ঘটে বিনয়, ন¤্রতা, আল্লাহর যিকির, হামদ-ছানা এবং দুআ ও কান্নাকাটির মধ্য দিয়ে।
ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ায রাহ. বলেনÑ
يخرج العارف من الدنيا ولم يقض وطره من شيئين: بكائه على نفسه، وثنائه على ربه.
আরিফ দুটি বিষয়ে অতৃপ্তি নিয়েই দুনিয়া থেকে যায়; নিজের উপর ক্রন্দন আর আপন রবের প্রশংসা। আর এটি এক শ্রেষ্ঠ উক্তি। কারণ এই হালত প্রমাণ করে যে, ব্যক্তি নিজেকে চেনে (নিজের দুর্বলতা ও অক্ষমতা বোঝে) আর তাঁর রবকে এবং রবের প্রতাপ ও মহিমা জানে। ফলে সে নিজের বিষয়ে লাজ্জিত আর রবের প্রশংসায় মুখরিত। Ñবাসাইরু যাবিদ তাময়ীয ৪/৫৪
তো মানবের কর্তব্য, নিজেকে নির্ভুলভাবে চেনা। নিজের সীমা-সরহদ সঠিকভাবে জানা। আর তার সাথে আল্লাহ তাআলার যে নিসবত, খালিক ও মাখলুকের নিসবত, রব ও মারবূবের নিসবত, মাবুদ ও আবিদের নিসবত, সে সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি অর্জন করা।
খালিক অমুখাপেক্ষী আর মাখলুক মুখাপেক্ষী
গোটা সৃষ্টিজগত আল্লাহর মাখলুক ও সৃষ্টি। আর আল্লাহ তাআলা খালিক ও সৃষ্টিকর্তা। গোটা সৃষ্টিজগত প্রতিপালিত আর আল্লাহ তাআলা পালনকর্তা। গোটা সৃষ্টিজগত আল্লাহর দাস, আর আল্লাহ তাআলা মালিক ও প্রভু। গোটা সৃষ্টিজগত আল্লাহর মুখাপেক্ষী আর আল্লাহ তাআলা বে-নিয়ায ও অমুখাপেক্ষী।
সুতরাং বান্দার অবস্থানই এই নয় যে, সে আল্লাহর কোনো উপকার-অপকার করতে পারে। আল্লাহ তো মহামহিম সত্তা, যিনি সকল লাভ-ক্ষতির উর্ধ্বে। কুরআন মাজীদের ইরশাদÑ
হে মানুষ! তোমরা তো আল্লাহর মুখাপেক্ষী; কিন্তু আল্লাহ, তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসার্হ্য। Ñসূরা ফাতির (৩৫) : ১৫
আল্লাহই একমাত্র সত্তা, যিনি সব দিক থেকে অভাবমুক্ত এবং সব দিক থেকে প্রশংসিত। তাঁর অভাবমুক্ততার এক দিক যা সূরায়ে ইসরার শেষ আয়াতে উল্লেখিত হয়েছেÑ
وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُن لَّهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ وَلَمْ يَكُن لَّهُ وَلِيٌّ مِّنَ الذُّلِّ ۖ وَكَبِّرْهُ تَكْبِيرًا.
বল, প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি। তাঁর রাজত্বে কোনো অংশী নেই। এবং তিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যার কারণে তার কোনো সাহায্যকারীর প্রয়োজন হতে পারে। আর সসম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর। Ñসুরা ইসরা (১৭) : ১১১
আল্লাহর সিফাত ও গুণাবলী সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার সম্বন্ধ সঠিকভাবে ‘নির্ণয়ে ব্যর্থ হওয়ার কারণে যুগে যুগে কত জাতি বিপথগামী হয়েছে! কোনো জাতি আল্লাহর কোনো বান্দাকে তাঁর ‘পুত্র’ সাব্যস্ত করেছে! কোনো জাতি ফিরেশতাদেরকে তাঁর ‘কন্যা’ ঘোষণা করেছে। কোনো জাতি নানা কাল্পনিক দেব-দেবী বা আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর ‘রাজত্বে’ শরীক সাব্যস্ত করেছে। কোনো জাতি তাঁর প্রতি নানাবিধ মানবীয় দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা যুক্ত করেছে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন জায়গায় এই সকল বিভ্রান্তি স্পষ্ট ভাষায় খণ্ডন করা হয়েছে। এই সকল বিভ্রান্তির মূলে রয়েছে আল্লাহ তাআলার সিফাত সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা। এবং আল্লাহ ও বান্দার সম্বন্ধের বিষয়ে ভুল ধারণা ও অজ্ঞতা।
তো হাদীসে কুদসীর এই খিতাব স্পষ্ট বলছে, বান্দার শানই এই নয় যে, সে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কোনোরূপ উপকার বা অপকার করতে পারে। সুতরাং যে সকল বিশ্বাস, চিন্তা, উচ্চারণ বা আচরণ এই শিক্ষার পরিপন্থী তা বান্দাকে খুব সচেতনভাবে ত্যাগ করতে হবে।
ইবাদত ও ইতাআতে বান্দার নিজের উপকার
আল্লাহর অমুখাপেক্ষিতার এক দিক এই যে, বান্দার উপাসনা ও আনুগত্যের কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই। এ তো একান্তই বান্দার প্রয়োজন এবং এতে বান্দারই ফায়েদা। বান্দার ইবাদত-ইতাআতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও মহত্বে কোনো প্রকার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না; বরং এর দ্বারা বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে এবং দুনিয়া-আখেরাতের সফলতা হাসিল করে।
সামনের দুই খিতাবে এ বিষয়টি স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয়েছে।
সপ্তম ও অষ্টম খিতাব
يا عبادي لو أن أولكم وآخركم وإنكسم وجنكم كانوا على أتقى قلب رجل واحد منكم ما زاد ذلك في ملكي شيئا.
يا عبادي لو أن أولكم وآخركم وإنسكم وجنكم كانوا على أفجر قلب رجل واحد منكم ما نقص ذلك في ملكي شيئاً.
হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রথম ও শেষ জন, তোমরা মানব ও জিন সকলেই যদি হও তোমাদের সবচেয়ে খোদাভীরু কলবের ব্যক্তিটির মত তাহলে তা আমার রাজত্ব কিছুমাত্রও বৃদ্ধি করবে না।
হে আমার বান্দাগণ! তোমাদের প্রথম ও শেষজন, তোমরা মানব ও জিন সকলেই যদি হও তোমাদের সবচেয়ে অবাধ্য হৃদয়ের লোকটার মত তাহলে তা আমার রাজত্ব কিছুমাত্রও হ্রাস করবে না।
গোটা মানব ও জিন জাতির মধ্যে সবচেয়ে খোদাভীরু হৃদয়ের অধিকারী হলেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সবাই যদি তাঁর মতো আরিফ ও মুত্তাকী হয়ে যায় এতে আল্লাহর রাজত্বে কোনো কিছু বাড়বে না। গোটা মানব ও জিন জাতির মধ্যে সবচেয়ে অবাধ্য হৃদয়ের লোকটা হচ্ছে ইবলীস। সবাই যদি ইবলীসের মতো অবাধ্য-নাফরমান হয়ে যায় তাহলে আল্লাহর কুদরত, ক্ষমতা, রাজত্ব কিছুমাত্র হ্রাস পাবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা সম্পূর্ণ বে-নিয়ায। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর ক্ষমতা ও রাজত্ব কারো সমর্থনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। তাঁর রাজত্ব ও ক্ষমতায় কারো কোনো অংশীদারত্ব নেই। দেখুন, দুনিয়াতে যারা রাজা-বাদশা, নেতা-নেত্রী তারা সবাই অন্যের মুখাপেক্ষী। অন্যের শক্তি ও সমর্থনে তাদের ক্ষমতা। অন্যের কর্ম ও আনুগত্যে তাদের রাজত্ব। তাই সমর্থন ও আনুগত্য থাকলে ক্ষমতা থাকে, আনুগত্য ও সমর্থন না থাকলে ক্ষমতাও থাকে না। এটা মানব-রাজত্বের বৈশিষ্ট্য। কারণ সে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়; সে অন্যের মুখাপেক্ষী। একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই হলেন সবদিক থেকে অমুখাপেক্ষী।
وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ
‘তিনিই তো অভাবমুক্ত, প্রশংসার্হ্য।’
কেউ প্রশংসা করুক বা না করুক তিনি তার সত্তা ও গুণাবলীর কারণেই প্রশংসিত। কেউ ইবাদত করুক বা না করুক তিনিই সত্য মাবুদ। তিনি ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই।
কেউ ‘ইতাআত’ করুক বা না করুক, তিনিই সত্য প্রভু। তিনি ছাড়া চ‚ড়ান্ত আনুগত্যের উপযুক্ত আর কেউ নেই।
তবে তাঁর করুণা ও মেহেরবানী যে, নিজ বান্দাদের তিনি তাঁর ইবাদত ও ইতাআতের পথ দেখিয়েছেন এবং অনেককে তাওফীক দান করেছেন। সুতরাং ঈমান ও ইতাআতের তাওফীক হলে বান্দার কর্তব্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ ও কৃতার্থ হওয়া।
দ্বীন গ্রহণে ও দ্বীনের নুসরতে বান্দার নিজের উপকার
সূরায়ে হুজুরাতের এ সত্য কত স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছেÑ
یَمُنُّوْنَ عَلَیْكَ اَنْ اَسْلَمُوْا ؕ قُلْ لَّا تَمُنُّوْا عَلَیَّ اِسْلَامَكُمْ ۚ بَلِ اللّٰهُ یَمُنُّ عَلَیْكُمْ اَنْ هَدٰىكُمْ لِلْاِیْمَانِ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ
তারা (বেদুইনরা) ইসলাম গ্রহণ করে তোমাকে ধন্য করেছে বলে মনে করে। তাদেরকে বলে দাও, তোমাদের ইসলাম দ্বারা আমাকে ধন্য করেছ বলে মনে করো না; বরং তোমরা যদি বাস্তবিকই (নিজেদের দাবিতে) সত্যবাদী হও তবে (জেনে রেখো) আল্লাহই তোমাদের ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। Ñসূরা হুজুরাত (৪৯) : ১৭
চিন্তা ও দৃষ্টির কী অপূর্ব পরিশুদ্ধি! লক্ষ্যণীয় এই যে, এ আয়াতে শুধু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কথা বলা হয়নি; বরং স্পষ্ট ভাষায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের কথা বলা হয়েছে যে, ইসলাম গ্রহণ করে তোমরা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে ধন্য করেছ এমনটা মনে করো না। এটা এক আসমানী তরবিয়ত। কিছু বেদুঈন যারা তখনও দ্বীনের পূর্ণ প্রজ্ঞা অর্র্জন করেননি তাদের মনে এ ধরনের চিন্তার উদ্রেক ঘটেছিল। এখনও এই শ্রেণির লোকের মধ্যে এই ধরনের চিন্তা থাকতে পারে। তাদের মনে হয়েছিল, তাদের ইসলাম গ্রহণের দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম-এর উপকার হল! তাঁর অনুসারী বৃদ্ধি পেল! তিনি শক্তি পেলেন! তিনি ধন্য হলেন বৈকি! (নাউযুবিল্লাহ)
এ হচ্ছে চিন্তার অস্বচ্ছতা। এর চিকিৎসা কুরআন মাজীদের বহু জায়গায় করা হয়েছে, যার সারকথা হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নুসরত তো করেন আল্লাহ তাআলা। তবে যারা সৌভাগ্যবান তাদের তিনি এই নুসরাতের কাজে যুক্ত করে ‘দ্বীনের নুসরতকারী’র মর্যাদা দান করেন। সূরা তাওবায় আল্লাহ তাআলার ইরশাদÑ
اِلَّا تَنْصُرُوْهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللّٰهُ اِذْ اَخْرَجَهُ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا ثَانِیَ اثْنَیْنِ اِذْ هُمَا فِی الْغَارِ اِذْ یَقُوْلُ لِصَاحِبِهٖ لَا تَحْزَنْ اِنَّ اللّٰهَ مَعَنَا
তোমরা যদি তার (অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের) সাহায্য না কর তবে (তাতে তার কোনো ক্ষতি নেই। কেননা) আল্লাহই তো সেই সময়ও তার সাহায্য করেছিলেন যখন কাফেররা তাকে (মক্কা থেকে) বের করে দিয়েছিল এবং তখন সে ছিল দুইজনের দ্বিতীয়জন, যখন তারা উভয়ে গুহার মধ্যে ছিল, তখন সে তার সঙ্গীকে বলেছিল, চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। ... Ñসূরা তাওবা (৯) : ৪০
এই কুরআনী তারবিয়তের ফলে সাহাবায়ে কেরামের চিন্তা ও দৃষ্টি যে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধি লাভ করেছিল তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সাহাবায়ে কেরামের তারবিয়াত করেছেন। যার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানে পেশ করছি।
সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের কিতাবগুলোতে হুনাইনের যুদ্ধের ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। ঐ যুদ্ধে গনীমতের যে সম্পদ অর্জিত হয়েছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মক্কার ‘মুআল্লাফাতুল কুলূব’দের (অর্থাৎ ফতহে মক্কা বা কাছাকাছি সময়ে নতুন ইসলাম গ্রহণকারী, যাদেরকে ইসলামের উপর অবিচল রাখা ও ফতহে মক্কার দ্বারা তাদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল তার উপর একটি শীতল প্রলেপ দেয়া তাঁর ইচ্ছা ছিল) মাঝে বণ্টন করে দেন। মদীনার আনসারীদের এ সম্পদ থেকে কিছুই দেননি। এতে আনসারীদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হল এবং কেউ কেউ নানা কথাও বলে ফেললেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানানো হলে তিনি আনসারীদের এক জায়গায় একত্র করে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে যারা ‘ফকীহ’ (অর্থাৎ দ্বীনের প্রজ্ঞা যাদের আছে) তারা তো কিছু বলেননি তবে অন্যরা বলেছে।’ বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবীগণ কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতেন না। বাস্তব অবস্থা অকপটে তুলে ধরতেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনÑ
يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ أَلَمْ أَجِدْكُمْ ضُلاَّلاً فَهَدَاكُمُ اللَّهُ بِي،وَكُنْتُمْ مُتَفَرِّقِينَ فَأَلَّفَكُمُ اللَّهُ بِي، وَعَالَةً فَأَغْنَاكُمُ اللَّهُ بِي.
হে আনসারী সম্প্রদায়! তোমরা কি পথহারা ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের পথ দেখালেন? তোমরা কি বিবাদ-বিভক্তিতে জর্জরিত ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার দ্বারা তোমাদের ঐক্যবদ্ধ করলেন? তোমরা কি নিঃস্ব ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের নিঃস্বতা দূর করলেন?’ আল্লাহর রাসূল যখন এ কথাগুলো বলছিলেন তখন প্রতি প্রশ্নের উত্তরে আনসারী সাহাবীগণের জবাব ছিলÑ
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই (আমাদের প্রতি) অধিক অনুগ্রহকারী।’
(সুবহানাল্লাহ! লক্ষ্য করুন, এখানে আল্লাহর রাসূল সবার আগে হেদায়েতের নিআমত এরপর ঐক্যবদ্ধতার নিআমত এরপর সচ্ছলতার নিআমত উল্লেখ করেছেন) এরপর আল্লাহর রাসূল বললেনÑ
مَا يَمْنَعُكُمْ أَنْ تُجِيبُوا رَسُولَ اللَّهِ - صلى الله عليه وسلم-
‘তোমরাও তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রত্ত্যুত্তরে কিছু বলতে পার। তা বলছ না কেন?’
তোমরা তো বলতে পারÑ যদি বল তবে তা সত্যই হবে এবং তোমাদের সত্যবাদীই বলা হবেÑ যে, আপনি তো আমাদের কাছে ঐ সময় এসেছেন যখন অন্যরা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলেছে। তখন আমরা আপনাকে সত্যবাদী বলেছি।
আপনি ঐ সময় এসেছেন যখন আপনার কোনো সাহায্যকারী ছিল না। তখন আমরা আপনার নুসরত করেছি। আপনি এমন অবস্থায় এসেছেন যে, আপনাকে আশ্রয়হীন করা হয়েছে। ঐ সময় আমরা আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি।
আপনি এমন অবস্থায় এসেছেন যে, আপনি ছিলেন রিক্তহস্ত, ঐ সময় আমরা আপনার সহমর্মী হয়েছি।’
সুবহানাল্লাহ! কীভাবে মানব-মনের এক একটি কাঁটা বের করে আনছেন এবং হৃদয়কে কণ্টকমুক্ত করছেন!
আল্লাহর রাসূলের এই কথাগুলোর জবাবে আনসারীদের জবাব কী ছিল? তাঁদের জবাব ছিলÑ
بل المن علينا لله ولرسوله
বরং আমরাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কৃতার্থ। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪৩৩০ (ফতহুল বারী)
অর্থাৎ সাময়িক বিস্মৃতির পর তারা আবার প্রকৃত অবস্থায়, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় ফিরে এসেছেন। তাঁদের চেয়ে এ উপলব্ধি আর কাদের বেশি হতে পারে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত নুসরতকারী স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। আর যাদের তিনি এ নুসরতের কাজে ব্যবহার করেছেন এ তো তাদের পরম সৌভাগ্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তো কোনোরূপ মাধ্যম ছাড়াও তার দ্বীনের নুসরত করতে পারেন আবার যাদেরকে মাধ্যম বানিয়েছেন তারা ছাড়া অন্যদেরও মাধ্যম বানাতে পারেন। সুতরাং তাদের অনুসরণীয় ও অবিস্মরণীয় জবাবÑ
بل المن علينا لله ولرسوله
‘বরং আমরাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কৃতার্থ।’ এই হচ্ছে দ্বীনের সমঝ, নুসরতে দ্বীন সম্পর্ক সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এতক্ষণ তো ছিল তরবিয়াতের অস্ত্রোপচারপর্ব। এরপর ক্ষতস্থান সিলাই ও ব্যান্ডেজ-পর্ব। তা হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ কথাগুলো। সহীহ বুখারীর বর্ণনায় তা এভাবে আছেÑ
أَتَرْضَوْنَ أَنْ يَذْهَبَ النَّاسُ بِالشَّاةِ وَالْبَعِيرِ، وَتَذْهَبُونَ بِالنَّبِيِّ - صلى الله عليه وسلم - إِلَى رِحَالِكُمْ، لَوْلاَ الْهِجْرَةُ لَكُنْتُ امْرَأً مِنَ الأَنْصَارِ، وَلَوْ سَلَكَ النَّاسُ وَادِيًا وَشِعْبًا لَسَلَكْتُ وَادِيَ الأَنْصَارِ وَشِعْبَهَا، الأَنْصَارُ شِعَارٌ وَالنَّاسُ دِثَارٌ، إِنَّكُمْ سَتَلْقَوْنَ بَعْدِي أَثَرَةً فَاصْبِرُوا حَتَّى تَلْقَوْنِي عَلَى الْحَوْضِ.
তোমরা কি রাজি আছো যে, লোকেরা উট ও ছাগল নিয়ে ঘরে ফিরবে আর তোমরা ঘরে ফিরবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে? যদি হিজরতের প্রসঙ্গ না হত তাহলে আমি আনসারীদেরই একজন হতাম। (কিন্তু যেহেতু হিজরত অনেক বড় মর্যাদার বিষয় এজন্য আনসারী পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছি না। স্মর্তব্য, আনসারীগণ ছিলেন আল্লাহর রাসূলের মাতুল বংশীয়, তাছাড়া আরবে সম্বন্ধের নানা রীতি প্রচলিত ছিল) আর সকল মানুষ যদি এক গিরিপথ ও উপত্যকায় চলে আমি চলব আনসারীদের উপত্যকা ও গিরিপথে। (অর্থাৎ আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি তাদের সমর্পণ ও দুনিয়ার বিষয়ে নির্মোহতার পথই পছন্দনীয় পথ) আর আনসার হল আমার ভিতরের পোষাক (একান্ত কাছেরজন) আর অন্যরা বাইরের পোষাক। শোনো! আমার পর তোমরা বঞ্চনার শিকার হবে তখন সবর করো, পরিশেষে আমার সাথে তোমাদের সাক্ষাত হবে ‘হাউযে’র পাড়ে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪৩৩০
এই বাক্যগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা অন্য কোনো অবসরে আলোচনা করা যাবে।
তো, কুরআন-সুন্নাহর আলোকিত তারবিয়াতের মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরাম দ্বীনের সহীহ ‘ফিকহ’ অর্জন করেছিলেন যার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক চিন্তার স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতা।
তো ইবাদত, ইতাআত ও নুসরতে দ্বীনের যত কাজ রয়েছে এতে যুক্ত হতে পারা বান্দার সৌভাগ্য। এতে আল্লাহর প্রতি বান্দার কোনো অনুগ্রহ সাব্যস্ত হয় না।
কবি কত সুন্দর বলেছেনÑ
منت منہ کہ خدمت سلطاں ہمی کنی + منت شناس ازو کہ بخدمت بداشتت
মনে করো না সুলতানের ‘সেবা’ করে তাকে ধন্য করেছ। বরং কৃতার্থ হও যে, তিনি তোমাকে ‘সেবা’র সুযোগ দান করেছেন।
যাই হোক, হাদীসে কুদসীর উপরোক্ত দুই খিতাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অমুখাপেক্ষিতার বিবরণ এসেছে। তাঁর অভাবমুক্ততার আরেক দিক পরের খিতাবে উল্লেখিত হয়েছে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)