দরসে হাদীস : বান্দার প্রতি আল্লাহর খিতাব
عَنْ أَبِي ذَرٍّ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فِيمَا رَوَى عَنِ اللهِ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَّهُ قَالَ: يَا عِبَادِي إِنِّي حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي، وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا، فَلَا تَظَالَمُوا.
আজ একটি হাদীসে কুদসী পাঠ করেছি। এই হাদীসে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যে সম্বোধন তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্ণনার মাধ্যমে আমরা লাভ করেছি, সে সম্পর্কে কিছু কথা আরয করার ইচ্ছা রাখি। আল্লাহ পাক তা সঠিকভাবে বলার, বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন
হাদীসটি ইমাম মুসলিম রাহ. তাঁর সহীহ মুসলিমে ‘কিতাবুল বিররি ওয়াস সিলাহ’ (সদাচার ও সম্পর্ক রক্ষা শীর্ষক) অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী রাহ. ‘সুনান’ গ্রন্থেও তা উল্লেখ করেছেন।
এটি একটি হাদীসে কুদসী। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ পাক থেকে তাঁর যে সুস্পষ্ট বাণী বর্ণনা করেছেন এগুলোকেই পরিভাষায় ‘হাদীসে কুদসী’ বলা হয়। যদিও তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কথা, কিন্তু যেহেতু তা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন, তাই তা হাদীসের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ পাকের কালাম, যা নামাযে তিলাওয়াত করা হয়, নামাযে যার শব্দগুলোই পাঠ করতে হয়, তরজমা পঠের সুযোগ নেই, যা তিলাওয়াত করাই একটি বিশেষ ইবাদত, অর্থ না বুঝলেও যে ইবাদতের ছাওয়াব পাওয়া যায়- এই কালাম হল, আলকুরআনুল কারীম, যা মুসহাফে লিপিবদ্ধ ও সুসংরক্ষিত এবং যে মুসহাফ অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করা বৈধ নয়।
তো কুরআন কারীমও আল্লাহ পাকের কালাম, আল্লাহ পাকের বাণী ও বিধান, হাদীসে কুদসীও আল্লাহ পাকের কালাম, বাণী ও সম্বোধন, কিন্তু এ দুয়ের মাঝে পার্থক্য আছে। কুরআন কারীম আলাদা, হাদীসে কুদসী আলাদা। কুরআন কারীমের এমন কিছু বিধান ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা একান্তই কুরআন কারীমের। শরীয়তের অন্যান্য নসের এই বিধান ও বৈশিষ্ট্য নেই। শরীয়তের অন্যান্য নসের মতো হাদীসে কুদসীও একটি নস।
যারা আরবী বোঝেন এবং আল্লাহর কালামের জালাল ও প্রতাপ উপলব্ধির মত সংবেদন অন্তরে ধারণ করেন তাঁরা এই হাদীসে কুদসীগুলো পাঠ করলে শিহরিত হয়ে ওঠেন।
বিখ্যাত তাবেয়ী আবু ইদ্রিস আলখাওলানী রাহ., যিনি হযরত আবু যর আলগিফারী রা. থেকে এই হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি যখন হাদীসটি বর্ণনা করতেন তখন হাঁটুর উপর দাঁড়িয়ে প্রভুর এই ফরমান বর্ণনা করতেন। এই হাদীসের জালাল ও প্রতাপ এভাবে তাঁকে অভিভ‚ত করেছিল। এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. বলেছেন, ‘শামের অধিবাসীগণ যে সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে অভিজাত ও সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ হাদীস হচ্ছে এই হাদীস।
কালামের সূচনা
এখানে আল্লাহ পাকের কালাম শুরু হয়েছে يا عبادي সম্বোধনের মাধ্যমে। মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে যে, আসমান-যমীনের যিনি স্রষ্টা, জগত-মহাজগতের যিনি সৃষ্টিকর্তা, তিনি তাদের সম্বোধন করছেন يا عبادي (হে আমার বান্দাগণ!) বলে।
আমাদের এক বড় মনীষী কাযী ইয়ায রাহ.। মুহাদ্দিস, মুফাসসির ছিলেন। তাঁর দু’টি পঙতি বর্ণনা করা হয়-
وَمِمَّا زَادَنِي شَرَفًا وَفَخْرًا + وَكِدْتُ بِأَخْمُصِي أَطَأُ الثُّرَيَّا
دُخُولِي تَحْتَ قَوْلِكَ يَا عِبَادِيَ + وَأَنْ أَرْسَلْتَ أَحْمَدَ لِي نَبِيَّا
‘আমার গর্ব ও গৌরব কে পরিমাণ করতে পারে? আমি তো ছুরাইয়া তারকাও ভেদ করে উঠে যেতে চাই। কারণ, হে প্রভু! তুমি যে আমায় সম্বোধন করেছ ‘ইয়া ইবাদী’ বলে, আর আহমদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) বানিয়েছ আমার নবী।’
এরচেয়ে বড় গৌরবের বিষয় আর কী হতে পারে? একজন ক্ষুদ্র মানবের জন্য এর চেয়ে বড় সৌভাগ্য তো আর কিছুই হতে পারে না। এই যে আনন্দ এটা ঈমানী আনন্দ। এই আনন্দ যার নসীব হয়েছে তার তো অমূল্য সম্পদ নসীব হয়েছে।
এই হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ পাকের দশটি সম্বোধন রয়েছে। দশবার তিনি বান্দাদের সম্বোধন করেছেন ‘ইয়া ইবাদী’ বলে আর দশটি কথা তিনি বলেছেন বান্দাদের লক্ষ করে।
প্রথম সম্বোধন
حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِي.
হে আমার বান্দাগণ! ‘আমি নিজের উপর যুলুম হারাম করে নিয়েছি’।
আল্লাহ পাক হলেন ঐ মহাপরাক্রমশালী সত্তা যাকে জিজ্ঞাসা করার কেউ নেই। কারো কাছে তাঁর জবাবদিহিতা নেই।
لا يُسْئَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْئَلُونَ.
তিনি তো সর্বশক্তিমান- স্রষ্টা ও প্রভু, সব তাঁর সৃষ্টি ও দাস। কে আছে তাঁকে জিজ্ঞাসা করার? কিন্তু তিনি বলেন, আমি নিজের উপর যুলুমকে হারাম করে নিয়েছি। সুতরাং আমি কারো উপর যুলুম করি না। ফরমানের সূচনাই আল্লাহ পাক করেছেন নিজের এই সিফাতের বর্ণনার মাধ্যমে যে, আমি নিজেই নিজের উপর যুলুমকে হারাম করে নিয়েছি। সুতরাং আল্লাহ তাআলা অন্যায়-অবিচার থেকে পবিত্র। এতে বান্দার জন্য এই নির্দেশনাও আছে যে, আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে বান্দার জন্য যে বিধান ও পথনির্দেশ আসে তা বান্দার জন্য পূর্ণ কল্যাণকর। বান্দার দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণকর। সকল শ্রেণির মানুষের জন্য কল্যাণকর। আল্লাহ পাক তো সকল স্বার্থ-চিন্তার ঊর্ধ্বে, সব রকম অবিচার থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
মানুষ তার চারপাশের জন্য বিভিন্ন নিয়ম-কানুন তৈরি করে। যারা প্রস্তুত করে তারা যেহেতু সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়, স্বার্থ-চিন্তা ও ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়, তাই এই নিয়ম ও বিধানে মানবীয় দুর্বলতার ছায়া ও প্রতিফলন থাকে। কিন্তু আল্লাহ পাক হলেন ঐ সত্তা যিনি সকল স্বার্থ-চিন্তার ঊর্ধ্বে। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন। সুতরাং তার পক্ষ থেকে যে বিধান ও নির্দেশ আসে সেটিই ত্রুটিমুক্ত, ভারসাম্যপূর্ণ।
وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا.
‘তোমাদের মাঝেও যুলুমকে হারাম করেছি’।
আমরা যদি কুরআন-সুন্নাহর নুসূস অধ্যয়ন করি তাহলে যুলুমের দুটি প্রকার দেখতে পাই। যুলুম কুরআন ও সুন্নাহর নুসূসে দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এক. নিজের প্রতি যুলুম। দুই. অন্যের প্রতি যুলুম।
আমাদের সীমাবদ্ধ চিন্তায় আমরা শুধু অন্যের প্রতি যুলুমকেই যুলুম মনে করি। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহর নুসূস আমাদের দৃষ্টিকে পরিচ্ছন্ন করে এবং প্রসারিত করে। কুরআন-সুন্নাহ বলে, যুলুম দুই প্রকার। এক হল নিজের প্রতি যুলুম। আরেক হল অন্যের প্রতি যুলুম। অন্যের প্রতি যুলুমও পরিণামে নিজের প্রতিই যুলুম। চিন্তা করলে দেখা যাবে, এটিই বাস্তবতা। প্রকৃতপক্ষে মানুষ তার অন্যায় ও গর্হিত কর্মের দ্বারা নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। কুরআন মাজীদের আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
وَما ظَلَمْناهُمْ وَلكِنْ كانُوا أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ.
আমি তাদের প্রতি কোনো যুলুম করিনি; কিন্তু তারাই নিজেদের প্রতি যুলুম করত। -সূরা নহল (১৬) : ১১৮
আখেরাতে যখন ফায়সালা হবে, জাহান্নামীদের জন্য জাহান্নামের ফায়সালা হয়ে যাবে তখন আল্লাহ পাক বলবেন, আমি তাদের উপর যুলুম করিনি; বরং তারাই নিজেদের উপর যুলুম করেছে। আপন কর্মের ফল তারা আজ ভোগ করছে। কুরআন মাজীদের আরো বহু আয়াতে এই বিষয়টি এসেছে।
একটি সহীহ হাদীসে এসেছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَيُمْلِي لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُ، قَالَ: ثُمَّ قَرَأَ : وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ القُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ.
‘আল্লাহ পাক যালিমকে অবকাশ দিতে থাকেন। ঢিল দিতে থাকেন। কিন্তু এরপর যখন পাকড়াও করেন তখন আর ছাড়েন না। এরপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন- (তরজমা) এমনই হয় তোমার রবের পাকড়াও, যখন তিনি জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন, ওদের যুলুমে লিপ্ত অবস্থায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৮৬
এই হাদীসে যালিম মানে কী? এখানে ‘যালিম’ উভয় অর্থকেই শামিল করছে। অন্যের প্রতি যে যুলুম করে সেও শামিল। আর যে ব্যক্তিগত পাপাচারে লিপ্ত থাকে, সে-ও শামিল।
তো কুরআন ও সুন্নাহর নুসূস আমাদের জানাচ্ছে, কাকে বলে যুলুম আর কাকে বলে যালেম। সব রকমের পাপাচার যুলুম, নিজের উপর যুলুম। অন্যের হক্ব নষ্ট করাও যুলুম। পরিণামের বিচারে এটাও নিজের উপর যুলুম। এই স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি যার আছে সে তো নিজের স্বার্থেই পাপাচার ও অবিচার থেকে বেঁচে থাকবে। এই বিশ্বাস যত দৃঢ় হবে কর্ম ও আচরণ ততই প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে। পক্ষান্তরে পাপাচার যদি হয় ‘ভোগ’ ও ‘উপভোগ’, অন্যের হক্ব নষ্ট করা যদি হয় ‘কর্তৃত্ব’ ও ‘কৃতিত্ব’ তাহলে তো পাপাচার, অবিচার চলতেই থাকবে। এই হচ্ছে দুই দৃষ্টিভঙ্গি, কর্ম ও আচরণ সম্পর্কে দুই মূল্যায়ন। এখন আমাদের চিন্তা করা উচিত কোন্ মূল্যায়ন বাস্তবসম্মত এবং কোন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তি ও সমাজের জন্য কল্যাণকর।
মূল কথায় ফিরে আসি। এই হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, তিনি নিজের উপর যুলুম হারাম করে নিয়েছেন এবং মানুষের উপরও একে অপরের প্রতি যুলুমকে হারাম করেছেন।
সহীহ মুসলিমে একটি হাদীস আছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করেছেন-
أَتَدْرُونَ مَا الْمُفْلِسُ؟
তোমরা কি জানো তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিঃস্ব কে?
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ!
الْمُفْلِسُ فِينَا مَنْ لَا دِرْهَمَ لَهُ وَلَا مَتَاعَ.
আমাদের মধ্যে নিঃস্ব ব্যক্তি সে, যার অর্থ-সম্পদ নেই।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বললেন-
إِنَّ الْمُفْلِسَ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلَاةٍ، وَصِيَامٍ، وَزَكَاةٍ، وَيَأْتِي قَدْ شَتَمَ هَذَا، وَقَذَفَ هَذَا، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا، وَضَرَبَ هَذَا، فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُقْضَى مَا عَلَيْهِ، أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ فَطُرِحَتْ عَلَيْهِ، ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ.
‘আমার উম্মতের নিঃস্ব ঐ লোক, যে কিয়ামতের দিন সালাত-সিয়াম-যাকাত নিয়ে আগমন করবে কিন্তু কাউকে সে গালি দিয়েছিল, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল, কারো রক্ত ঝরিয়েছিল। তো একে তার নেক আমল দিয়ে দেওয়া হবে, ওকেও তার নেক আমল দিয়ে দেওয়া হবে। যখন নেক আমলগুলো শেষ হবে তখন ঐসকল লোকের গুনাহ এই ব্যক্তির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হবে, এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (এ হচ্ছে আমার উম্মতের সবচেয়ে মিসকীন, সবচেয়ে রিক্তহস্ত।) -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮১
আরেকটি সহীহ হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম জানিয়েছেন, যখন জান্নাত-জাহান্নামের ফায়সালা হবে, জান্নাতীগণ জান্নাতে যাবে আর জাহান্নামীরা জাহান্নামে যাবে এর আগে একটা ব্যাপার ঘটবে। সেই ব্যাপার হল, কোনো জান্নাতী এই অবস্থায় জান্নাতে যেতে পারবে না যে, কোনো একজন জাহান্নামীর তার কাছে কোনো পাওনা আছে। এমন নয় যে, ঐ লোক তো জাহান্নামী, তার প্রতি যদি কোনো জান্নাতী কিছু যুলুম করেও থাকে তা ধরা হবে না, বিবেচনায় আনা হবে না। না, ধরা হবে এবং নিষ্পত্তি করা হবে। একজন জাহান্নামীরও পাওনা থাকা অবস্থায় কোনো জান্নাতী জান্নাতে যেতে পারবে না। আল্লাহ পাক তাদের বিবাদ মিটাবেন। এরপর জান্নাতী জান্নাতে যেতে পারবে।
আল্লাহ পাক এই হাদীসে কুদসীতে খুব জালাল ও প্রতাপের সাথে ইরশাদ করেছেন- আমি তোমাদের মাঝে যুলুমকে হারাম করেছি। সুতরাং সাবধান! কেউ কারো প্রতি যুলুম করো না।
দ্বিতীয় খিতাব
يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ ضَالٌّ إِلَّا مَنْ هَدَيْتُهُ، فَاسْتَهْدُونِي أَهْدِكُمْ.
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা সকলেই পথ-না-জানা। আমি যাকে পথ দেখাই সে-ই শুধু পথ পায়। সুতরাং আমার কাছে পথের দিশা প্রার্থনা কর। আমি তোমাদের পথের দিশা দিব।’
আল্লাহ পাক মানুষকে সত্য গ্রহণের যোগ্যতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষ যখন সত্যের সন্ধান পায় তখন স্বভাবগতভাবেই সত্যের প্রতি প্রলুব্ধ হয়, কিন্তু শয়তানের ধোকায়, প্রবৃত্তির তাড়নায় এবং চারপাশের জগতের হাতছানিতে সে সত্য থেকে বিচ্যুত হয়, তখন মিথ্যা ও অন্যায়ের পথে চলা তার জন্য সহজ হয়ে যায়।
সত্যের পথে চলতে হলে প্রথমে মানুষকে সত্যের সন্ধান পেতে হয়। এরপর মিথ্যার হাতছানি থেকেও আত্মরক্ষা করতে হয়। আর এ দুইয়ের প্রত্যেকটিই শুধু হতে পারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তাওফীকের মাধ্যমে। সুতরাং আল্লাহ পাকের ইরশাদ-
كُلُّكُمْ ضَالٌّ إِلَّا مَنْ هَدَيْتُهُ.
‘তোমাদের সকলেই পথ-নাজানা। আমি যাকে পথ দেখাই শুধু সে-ই পথ পায়। আমি যাকে সুপথে পরিচালিত করি শুধু সে-ই সঠিক পথের পথিক হয়।’
সুতরাং তোমরা আমার কাছে হেদায়েত চাও। আমি তোমাদের হেদায়েত দান করবো। এটা হল আল্লাহ পাকের ওয়াদা। যে বান্দা আল্লাহর কাছে হেদায়েত চায় আল্লাহ পাক অবশ্যই ঐ বান্দাকে হেদায়েত দান করেন। এটা দুনিয়ার জীবনে বান্দার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
তৃতীয় খিতাব
يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ جَائِعٌ، إِلَّا مَنْ أَطْعَمْتُهُ، فَاسْتَطْعِمُونِي أُطْعِمْكُمْ.
‘হে আমার বান্দারা! তোমরা সকলেই অন্নহীন, শুধু সে-ই অন্ন পায় যাকে আমি অন্ন দান করি। সুতরাং আমার কাছে অন্ন চাও, আমি তোমাদের অন্ন দান করব।’
আল্লাহ তাআলাই রাযযাক। তিনিই একমাত্র রিযিকদাতা। মানুষ শুধু আল্লাহর রিযিক অন্বেষণ করতে পারে। সূরায়ে ওয়াকিয়ায় এ সত্য তিনি কত সুন্দর করেই না বলেছেন-
أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَحْرُثُونَ، أَأَنْتُمْ تَزْرَعُونَهُ أَمْ نَحْنُ الزَّارِعُونََ.
‘তোমরা যে চাষাবাদ কর বল তো এই চাষবাস থেকে ফল-ফসল তোমরা উৎপন্ন কর, না আমি উৎপন্ন করি?’ -সূরা ওয়াকিআ (৫৬) : ৬৩-৬৪
أَفَرَأَيْتُمُ الْماءَ الَّذِي تَشْرَبُونَ، أَأَنْتُمْ أَنْزَلْتُمُوهُ مِنَ الْمُزْنِ أَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُونَ.
‘বল তো তোমরা যে পানি পান কর, মেঘমালা থেকে তা কি তোমরা বর্ষণ কর না আমি বর্ষণ করি?’ -সূরা ওয়াকিআ (৫৬) : ৬৮-৬৯
তাহলে অন্ন দানকারী কে? আল্লাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের অন্ন দান করেন। আমরা আল্লাহরই কাছে অন্ন চাই।
চতুর্থ খিতাব
يَا عِبَادِي كُلُّكُمْ عَارٍ، إِلَّا مَنْ كَسَوْتُهُ، فَاسْتَكْسُونِي أَكْسُكُمْ.
‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা সকলেই বস্ত্রহীন। আমি যাকে বস্ত্র দেই, শুধু সেই বস্ত্র পায়। সুতরাং আমার কাছে বস্ত্র চাও, আমি তোমাদের বস্ত্র দান করব।’
এককথায় বান্দার যত প্রয়োজন তা পূরণ করেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। কিন্তু আল্লাহ যে পূরণ করেন সেটা আমাদের চিন্তায় থাকে না। প্রাত্যহিকতার কারণে এবং আমাদের কিছু কর্ম-প্রয়াস যুক্ত থাকার কারণে আল্লাহর স্মরণ আমাদের চিন্তা থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায়। আমরা মনে করি এ-ই তো নিয়ম। দেখুন, প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠে, সন্ধ্যায় অস্ত যায়। প্রাত্যহিকতার কারণে এ অতি সাধারণ ব্যাপার। আমাদের চিন্তা ও মস্তিষ্ক রাত-দিনের গমনাগমনে সচকিত হয় না। অথচ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত সৌর জগতের কত বড় ঘটনা! এই ঘটনা যিনি প্রতিনিয়ত ঘটান তিনি কত বড় শক্তিমান!
শস্যের বীজ জমিতে বপন করা হলে গাছ জন্মায়, তা থেকে শস্য পাওয়া যায়। প্রাত্যহিকতার কারণে এ অতি সাধারণ ঘটনা। সুতরাং আমাদের চিন্তা ও মস্তিষ্ক এতে সচকিত হয় না। সে নিয়মটিই শুধু জানে। নিয়মের নিয়ন্তা পর্যন্ত পৌঁছার তাড়না বোধ করে না। অথচ একটি বৃক্ষের অঙ্কুরোদ্গম প্রকৃতির কত বড় ঘটনা। যিনি তা নিপুণভাবে ঘটান তিনি কত নিপুণতার অধিকারী!
সকালে একজন মানুষ কর্মস্থলে যায়, সন্ধ্যায় ঘরে ফেরে। এভাবে সে তার জীবিকা উপার্জন করে। প্রাত্যহিকতার কারণে মনে হয় এ-ই নিয়ম। এভাবেই জীবিকা আসে। তার চিন্তা ও মস্তিষ্ক এর অধিক কিছু চিন্তার প্রেরণা বোধ করে না। অথচ প্রাণীজগতে জীবিকা কত বড় ঘটনা! যিনি তা সৃষ্টি করেছেন ও বণ্টন করেছেন তিনি কত মহান, কত শক্তিমান!
তো মানুষ প্রাত্যহিকতার কারণে এবং আপন চিন্তাশক্তির অক্ষমতার কারণে চারপাশের বাস্তবতা সম্পর্কেও গাফিল থাকে, তাই আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাকে সচেতন করেছেন এবং জানিয়েছেন, তার যা কিছু প্রয়োজন তা তিনিই পূরণ করেন। সুতরাং বান্দার প্রথম কর্তব্য, আপন প্রভুর অনুগ্রহ সম্পর্কে সচেতন হওয়া।
সহীহ মুসলিমে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ পাক বান্দার এই আমলটিকে খুব পছন্দ করেন যে, সে খাবার গ্রহণ করে এবং ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলে। সে পানি পান করে এবং ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলে।
এত ছোট্ট আমল, খাবার খেল এরপর বলল, ‘আলহামদু লিল্লাহ’। পানি পান করল এরপর বলল, ‘আলহামদু লিল্লাহ’, এতেই আল্লাহ তাআলা রাজিখুশি! আপাতদৃষ্টিতে আমলটা ছোট, কিন্তু বাস্তবে অনেক বড়। যে আলহামদু লিল্লাহ বলে এই ছোট্ট কথাটিতে তার এই বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটে যে, আমার একজন প্রভু আছেন, যিনি আমার অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করেন। তিনিই আমার জন্য এই সকল নিআমতের ব্যবস্থা করেছেন। আমি তার শোকরগোযারি করছি। চিন্তা করুন, কত বড় কথা! কত বড় সত্যের উপলব্ধি ও স্বীকৃতি! যদি বিষয়টি হৃদয় দ্বারা উপলব্ধি করে থাকেন, তাহলে নিজেই বিবেচনা করুন, এই সত্যের সাথে যার পরিচয় ঘটেনি সে কত বড় বাস্তবতা থেকে বঞ্চিত! আরো চিন্তা করুন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে কত সহজে কত বড় সৌভাগ্য অর্জন করেছি! আলহামদু লিল্লাহ! ছুম্মা আলহামদু লিল্লাহ। এই একটিমাত্র বাক্যের দ্বারা, যদি তা অন্তর থেকে উৎসারিত হয়, ঈমানের সাথে হয়, কৃতজ্ঞতার সাথে হয়, হতে পারে আল্লাহ পাক কাউকে মাফ করে দেবেন, কারো বেড়া পার করে দেবেন।
হাদীস শরীফে আছে, বান্দা কখনো কখনো একটি কথা বলে, ولم يلق لها بالا ‘সে এটাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথাই মনে করে না।’ কিন্তু আল্লাহ পাক তার এ কথার কারণে তার জন্য জান্নাতের ফায়সালা করে দেন। আবার এমনও হয় যে, বান্দা একটি কথা বলে, ولم يلق لها بالا ‘সে এটাকে কোনো কথাই মনে করে না।’ কিন্তু আল্লাহর কাছে তা এত অপছন্দের, এত ক্রোধের হয় যে, এর কারণে তার জাহান্নামের ফায়সালা হয়ে যায়। সুতরাং যবানকে সংযত রাখা জরুরি। আমরা আমাদের চারপাশের একটি শ্রেণীর মাঝে এই প্রবণতা দেখি। আল্লাহ সম্পর্কে, রাসূল সম্পর্কে, কুরআন সম্পর্কে, সুন্নাহ সম্পর্কে, দ্বীন সম্পর্কে, সৃষ্টিজগতে আল্লাহর নানা কুদরতের নিদর্শন সম্পর্কে নানা কথা বলে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে ফেলে। যা মুখে আসে বলে ফেলে। মনে রাখতে হবে সব বিষয় হাস্য-রসের বিষয় নয়। সব ধরনের হাস্য-রস গ্রহণযোগ্য নয়। হাস্য-রসেরও কিছু সীমা-সরহদ আছে। জীবন ও জগতের কিছু বিষয় থাকে যেগুলো নিয়ে হাস্য-রস চলে না। তো আল্লাহ, রাসূল, কুরআন, সুন্নাহ, দ্বীন ও শরীয়ত এই সকল বিষয়ে একজন মুসলিমকে ধীর-স্থির, সংযত-গম্ভীর হতে হয়।
পঞ্চম খিতাব
يَا عِبَادِي إِنَّكُمْ تُخْطِئُونَ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ، وَأَنَا أَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا، فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ.
হে আমার বান্দাগণ! তোমরা তো রাতদিন ভুল কর। আর আমি সকল অপরাধ ক্ষমা করি। সুতরাং আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৭
এই খিতাবে আল্লাহ পাক বান্দার দুর্বলতা উল্লেখ করেছেন এবং আপন দয়া ও মহত্ব বর্ণনা করেছেন। বান্দার দুর্বলতা এই যে, তার ভুল হয়, সে অন্যায় করে, আর আমাদের যিনি রব তাঁর বৈশিষ্ট্য হল, তিনি ক্ষমা করেন। সবাইকে ক্ষমা করেন। সব গুনাহ ক্ষমা করেন।
সব গুনাহ ক্ষমা করেন
তিনি সব গুনাহ ক্ষমা করেন- এ কথার অর্থ সঠিকভাবে বোঝা দরকার। এর অর্থ হচ্ছে, বান্দা যে গুনাহই করুক সব গুনাহই আল্লাহ পাকের রহমতের বিচারে ক্ষমাযোগ্য, যদি বান্দা ক্ষমার পথ অবলম্বন করে। এর অর্থ কখনো এই নয় যে, বান্দা গুনাহ করতে থাকবে আর নির্ভয়, নির্লিপ্ত থাকবে যে, আমার গুনাহ এমনিতেই মাফ হয়ে যাবে। আল্লাহ পাক ক্ষমা করেই দেবেন। সুতরাং গুনাহ করলেও কোনো অসুবিধা নেই। এ ধরনের মানসিকতা আসলে আল্লাহর দয়া ও রহমতের আশাবাদ নয়, আল্লাহর শাস্তি ও আযাব সম্পর্কে নির্লিপ্ততা। এটা অপরাধ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
نَبِّئْ عِبادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ،وَأَنَّ عَذابِي هُوَ الْعَذابُ الْأَلِيمُ.
আমার বান্দাদেরকে বলে দিন যে, আমি তো পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু এবং আমার শাস্তি- সে অতি মর্মন্তুদ শাস্তি! -সূরা হিজর (১৫) : ৪৯-৫০
আমাদের রবের এক পরিচয় যেমন এই যে, তিনি অতিক্ষমাশীল, তেমনি তাঁর আরেক পরিচয়, তিনি কঠিন শাস্তিদাতা। তো গুনাহ সম্পর্কে নির্ভয় ও নির্লিপ্ত হওয়ার অর্থ আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে নির্লিপ্ত হওয়া।
আল্লাহর রহমতের প্রকৃত আশাবাদী কারা
আল্লাহর রহমতের প্রকৃত আশাবাদী তারা যাদের কর্ম তাদের প্রত্যাশার সত্যায়ন করে। কর্ম ও প্রচেষ্টাহীন প্রত্যাশা কুরআন-হাদীসের দৃষ্টিতে নির্বুদ্ধিতা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের বিখ্যাত হাদীস-
الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ، وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا، وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ.
বুদ্ধিমান সে যে নিজের নফসের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কর্ম করে। আর (নির্বোধ) অক্ষম সে যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুগামী করে এবং আল্লাহর প্রতি (অলীক) প্রত্যাশা পোষণ করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪২৬০
সুতরাং আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা তখনই সত্য হয়, যখন আল্লাহ প্রদত্ত ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে প্রবৃত্তির অনুগামিতা ত্যাগ করা হয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কর্ম করা হয়। কুরআন মাজীদে এ বিষয়টি কত পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَةَ اللَّهِ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ.
যারা ঈমান আনে এবং যারা হিজরত করে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে। আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, পরমদয়ালু। -সূরা বাকারা (২) : ২১৮
إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتابَ اللَّهِ وَأَقامُوا الصَّلاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْناهُمْ سِرًّا وَعَلانِيَةً يَرْجُونَ تِجارَةً لَنْ تَبُورَ، لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّهُ غَفُورٌ شَكُورٌ.
যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, সালাত কায়েম করে, আমি তাদের যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই প্রত্যাশা করে এমন ব্যবসার যার ক্ষয় নেই। এই জন্য যে, আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দিবেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদের আরো বেশি দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী। -সুরা ফাতির (৩৫) : ২৯-৩০
কর্মহীন প্রত্যাশা অজ্ঞতা ও অজ্ঞতা-প্রসূত
ইহুদী-সম্প্রদায়ের মাঝে ধর্মীয় দিক থেকে যেসকল বিভ্রান্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, তন্মধ্যে একটি ছিল অলীক প্রত্যাশা। ঐ সম্প্রদায়ের বে-ইলম শ্রেণীর মাঝে এ মানসিকতার বিস্তার ঘটেছিল। কুরআন মাজীদে ওদের এই বিভ্রান্তি চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে-
وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لا يَعْلَمُونَ الْكِتابَ إِلاَّ أَمانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَظُنُّونَ.
তাদের মধ্যে এমন কতক নিরক্ষর লোক আছে, যাদের মিথ্যা আশা ব্যতীত কিতাব সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান নেই। তারা শুধু অমূলক ধারণা পোষণ করে। -সূরা বাকারা (২) : ৭৮
ইমাম আবুল আলিয়া, রবী‘ ও কাতাদা রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন,
إِلا أَمَانِيَّ، يَتَمَنَّوْنَ عَلَى اللَّهِ مَا لَيْسَ لَهُمْ.
অর্থাৎ ওরা আল্লাহর প্রতি এমন সব প্রাপ্তির প্রত্যাশা করে যা তাদের জন্য নেই। -তাফসীরে ইবনে কাছীর ১/১৭৫
এরপরের আয়াতগুলোতে ইহুদী জাতির আরো কিছু অলীক ও অমূলক ধারণা বর্ণনা করা হয়েছে এবং পরিষ্কার ভাষায় খণ্ডণ করা হয়েছে। সারকথা এই যে, প্রত্যাশা ভালো, অমূলক প্রত্যাশা ভালো নয়। ইসলাম অমূলক প্রত্যাশাকে উৎসাহিত করে না। কেননা এটা মিথ্যারই একটি প্রকার।
মুসলমানদের কোনো কোনো গোমরাহ ফের্কার মাঝেও অনেক আগে থেকেই এ ধরনের বিশ্বাস ছিল, এখনো থাকতে পারে যে, ‘গুনাহ করলে কোনো ক্ষতি নেই। ঈমান আনা হয়েছে তো এখন গুনাহ কোনো ক্ষতি করবে না।’ এটা একটা ভ্রান্ত কথা। গুনাহ অবশ্যই মানুষের ক্ষতি করে। মানুষের ঈমানকে দুর্বল করে। মানুষ যদি গুনাহে লিপ্ত থাকে, কবীরা গুনাহ করতে থাকে, তাহলে মানুষের এমন অবস্থাও হতে পারে যে, তার ঈমান বিনষ্ট হয়ে যাবে। গুনাহ মানুষের দুনিয়া এবং আখেরাতের জন্য ক্ষতিকর। দুনিয়াতেও তার শাস্তির আশঙ্কা আছে। আখেরাতেও শাস্তির আশঙ্কা আছে।
কিন্তু কোনো গুনাহই এমন নয়, যা আল্লাহ পাকের দয়া ও রহমতের বিচারে ক্ষমার অযোগ্য। আমরা অনেক ক্ষেত্রে বলি ‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ’ ‘এমন অপরাধ ক্ষমা করা যায় না’ কিন্তু আল্লাহ পাকের রহম-করম, ক্ষমা ও করুণা, বড়ত্ব ও মহত্ব এত বেশি যে, কোনো গুনাহই, কোনো অপরাধই তার রহম করমের বিচারে ‘ক্ষমার অযোগ্য’ নয়।
শিরক ক্ষমা করা হবে না- একথার অর্থ
কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন-
إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذلِكَ لِمَنْ يَشاءُ.
‘আল্লাহ তার সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করবেন না। এছাড়া সকল গুনাহই যার সম্পর্কে ইচ্ছা করবেন ক্ষমা করে দেবেন। -সূরা নিসা (৪) : ৪৮
তো আল্লাহ পাক শিরককে ক্ষমা করবেন না- একথার অর্থ কী? একজন মানুষ শিরক করেছে, কুফর করেছে, এখন সে তওবা করেছে, আল্লাহ পাকের দিকে ফিরে এসেছে, শিরক পরিত্যাগ করে তাওহীদ অবলম্বন করেছে, কুফুর পরিত্যাগ করে ঈমান অবলম্বন করেছে এবং এরপর মৃত্যু পর্যন্ত ঈমানের হালতে, আমলে ছালেহের সাথে তার জীবন অতিবাহিত করেছে, আল্লাহ পাক কি তাকে ক্ষমা করবেন না? অবশ্যই ক্ষমা করবেন। ঈমানের দ্বারা কুফুরের হালতের গুনাহগুলো আল্লাহ পাক মাফ করে দেন।
তো কুরআন মাজীদের এই যে, ঘোষণা- ‘আল্লাহ পাক তার সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না’ এর অর্থ হল, যদি শিরকের অবস্থায় তার মৃত্যু হয়ে যায় তখন আর তার ক্ষমার ও মুক্তির কোনো উপায় থাকে না। আল্লাহ পাক কখনো তাকে ক্ষমা করবেন না। পক্ষান্তরে ঈমানের হালতে মৃত্যু হয়েছে, তাওহীদের উপর মৃত্যু হয়েছে, কিছু গুনাহও হয়েছে এমন লোকদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেবেন।
সারকথা এই দাঁড়াল যে, সব গুনাহই ক্ষমাযোগ্য। আল্লাহ পাকের রহমতের কাছে কোনো গুনাহই এমন নয় যা ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু বান্দার কর্তব্য হল, ক্ষমার পথ অবলম্বন করা। আল্লাহ পাক (আলোচ্য হাদীসে কুদসীতে) এর পরের বাক্যে বলেছেন,
فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ.
‘তোমরা আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দেব।’
গুনাহ যদি এমনি এমনি মাফ হয়ে যায়, তাওবা করতে হয় না, ইস্তেগফার করতে হয় না, নেক আমল করতে হয় না, আল্লাহ পাকের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হয় না, ঈমান আছে তো সকল গুনাহ এমনিই মাফ, কোনো গুনাহই কোনো ক্ষতি করবে না, তাহলে আল্লাহ পাক ইস্তেগফারের আদেশ করলেন কেন? বুঝা গেল, গুনাহ ক্ষমাযোগ্য, যদি মানুষ ক্ষমার পথ অবলম্বন করে। فَاسْتَغْفِرُونِي أَغْفِرْ لَكُمْ. আমার কাছে ক্ষমা চাও। আমি তোমাদের ক্ষমা করে দেবো।
ইসলাম আশাবাদের ধর্ম, ইসলাম হতাশার ধর্ম নেয়। ইসলাম বলে না, পাপ মানুষের সত্তার ভিতরে ঢুকে পড়েছে। মানুষের সত্তাই পাপী। পাপমুক্ত হওয়ার ক্ষমতা ব্যক্তিমানুষের নেই। এর জন্য ঐশী কোনো ব্যবস্থার প্রয়োজন! এই ধরনের প্রান্তিকতা ইসলামে নেই।
প্রত্যেক মানুষ আল্লাহ পাকের কাছে ইস্তেগফারের মাধ্যমে, তাওবার মাধ্যমে, আমলে ছালেহের মাধ্যমে গুনাহ থেকে পবিত্র হতে পারে, আল্লাহ পাকের নৈকট্য অর্জন করতে পারে। ইসলামের শিক্ষা সহজ, সরল, স্বাভাবিক।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক মানুষকে এই পয়গাম দেওয়ার আদেশ করেছেন-
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ.
অর্থাৎ ‘আমার এই পয়গাম মানুষের কাছে পৌঁছে দিন- হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো গাফুরুর রাহীম। -সূরা যুমার (৪৯) : ৫৩
কিন্তু এর জন্য বান্দাকে ক্ষমা লাভের পথ অবলম্বন করতে হবে। যদি সে নিজেকে পবিত্র করতে চায় তাহলে মৃত্যু পর্যন্ত ক্ষমার দুয়ার তার জন্য খোলা। আল্লাহ পাক মৃত্যু পর্যন্ত এই পথ খোলা রেখেছেন।
এইজন্য একজন মুমিন কখনো হতাশ হতে পারে না। আমি এত পাপ করেছি, এত অন্যায় করেছি, এত অবিচার করেছি, আমার তো মুক্তির কোনো উপায় নেই, আমার তো ভালো হওয়ার সুযোগ নেই- এরকম মনে করা হতাশা। এটা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া।
আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কবীরা গুনাহ
আল্লাহ রহমতের আশাবাদী হওয়া মুমিনের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কবীরা গুনাহ। আমরা তো শুধু কবীরা গুনাহ মনে করি চুরি, ব্যাভিচার, ইত্যাদিকে। অবশ্যই এগুলো কবীরা গুনাহ। তবে কবীরা গুনাহ আরো আছে। এর মধ্যে একটি হল, ‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া।’ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার বিভিন্ন পর্যায় আছে। বিভিন্ন প্রকাশ আছে। একটি প্রকাশ হল, আমার তো আর উপায় নেই। আমার তো ভালো হওয়ার সুযোগ নেই। আমি তো একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছি। এ রকম নিরাশ হয়ে যাওয়া কবীরা গুনাহ। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। আমি যদি নিজের দিকে তাকাই তাহলে আমি অক্ষম, দুর্বল। কিন্তু যদি আল্লাহর রহমতের দিকে যদি তাকাই তাহলে তো তা এক মহাসমুদ্র। আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অবকাশ রয়েছে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ দান করবেন।
হযরত ইয়াকুব আ.-এর উপদেশ
হযরত ইয়াকুব আ. সন্তানদের উপদেশ দিয়েছিলেন-
وَلا تَيْأَسُوا مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لا يَيْأَسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكافِرُونَ.
হে আমার সন্তানগণ! তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহর রহমত থেকে তো শুধু তারাই নিরাশ হয় যারা কাফির। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৮৭
কবি বলেন-
‘তাঁর সাথে যোগ নাই যার সে-ই করে নিতি অভিযোগ
তাঁর দেওয়া অমৃত ত্যাগ করে বিষ করে তারা ভোগ।’
বিদ্রোহী কবি আরো বলেছেন-
‘তাঁরই নাম লয়ে বলি বিশ্বের অবিশ্বাসীরা শোনো,
তাঁর সাথে ভাব হয় যার তার অভাব থাকে না কোনো।’
(চলবে ইনশাআল্লাহ)