‘চান্দ্রমাস’ : একটি পর্যালোচনা-৪
হিলালের বিকৃতি এবং একসাথে বহু বিভ্রান্তি
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের এই দাবীর স্বরূপ তো প্রত্যক্ষ করেছেন যে, আয়াত ২ : ১৮৯-এর তরজমা ও তাফসীর (মাআযাল্লাহ) মুতারজিম ও মুফাস্সিরগণ বোঝেননি কিংবা পেশ করতে পারেননি; কেবল ইঞ্জিনিয়ার সাহেবই তা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন এবং পেশ করতে সমর্থ হয়েছেন!
পাঠকগণ দেখেছেন, এটা তার নিছক দাবী, বাস্তবতার সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই। এবং এই বিষয়টিও পাঠকবর্গ লক্ষ্য করেছেন, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যে সংস্কারের স্বপ্ন দেখছিলেন, তথা আয়াত ২ : ১৮৯-এর তরজমা কিনা তিনিই শুধরে দিয়েছেন এ শুধু তার আত্মতৃপ্তি। তার এই স্বপ্ন পৃথিবীর সবচে’ ব্যর্থ ও অবাস্তব স্বপ্নগুলোর একটি। হাকীকত হল, তরজমার যেটুকু তিনি সঠিক লিখেছেন তা পূর্ববর্তীদের লেখাতেও আছে। আর যা কিছু ভুল কথা লিখেছেন সেটা তার নিজের আবিষ্কৃত। তো নতুন ভুলের সূচনা করার নাম যদি হয় সংস্কার তাহলে নিঃসন্দেহে, তিনি একটি সংস্কার কর্মই আঞ্জাম দিয়েছেন বটে। এ নিয়ে যদি তিনি আনন্দিত হতে চান তবে সেটা তার মর্জি। (দেখুন, আলকাউসার, যুমাদাল উলা ও যুমাদাল উখরা সংখ্যা ১৪৩৬ হিজরী)
এমনিভাবে আলকাউসার রজব ১৪৩৬ হিজরী সংখ্যায় পাঠকবর্গ এও পড়েছেন যে, অন্যায়ভাবে আল-বেরুনীর নাম ব্যবহার করে যেই দাবী করা হয়েছিল যে, আরবী চান্দ্রমাস অমাবস্যা থেকে শুরু হয়, তা কতটা অবাস্তব। আল-বেরুনী তার অনেক কিতাবে অনেকবার বলেছেন, ইসলামী চান্দ্রমাস অমাবস্যা শেষ হওয়ার পর দর্শনযোগ্য ‘হিলাল’ (Crescent moon) থেকে শুরু হয়। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, এটাই কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা এবং মুসলমানগণ এ হিসেবেই আমল করেন।
এখন যে কথাটি পেশ করা উদ্দেশ্য, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তরজমা করতে ভুল করেছেন কিংবা জেনে-বুঝে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন শুধু তাই নয়; বরং তিনি আয়াতের উদ্দেশ্য এবং অনুসৃত তাফসীরকেই পাল্টে ফেলেছেন। আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তাআলা হিলালকে মীকাত বানিয়েছেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ‘হিলালের’ অর্থই বদলে দিয়েছেন। যাতে আয়াতের অর্থ এবং তার সাথে সর্ম্পকিত বিধানসমূহ পরিবর্তনে আলাদা কসরত করতে না হয়। তো ‘হিলাল’-এর অর্থ পরিবর্তন- এটা এমন এক ভয়াবহ গোমরাহী, যা তার নিজের মধ্যে একসাথে বহু বিকৃতি এবং বহুসংখ্যক বিভ্রান্তিকে ধারণ করে আছে।
‘হিলাল’-এর অর্থ হল অমাবস্যা শেষ হওয়ার পর উজ্জ্বল ধনুকের আকৃতিতে প্রকাশ পাওয়া চাঁদ। যা দেখে ইসলামী মাস আরম্ভ হয় । কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব একে বিকৃত করে ‘হিলাল’-এর অর্থ বানিয়েছেন ‘অমাবস্যা’ বা ‘অমাবস্যার চাঁদ’। এ হচ্ছে সকালকে সন্ধ্যা এবং দিনকে রাত বানানোর মতো ব্যাপার।
চাঁদের ক্রমাগত তিথি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক মাসে চাঁদ বিভিন্ন অবস্থা ও পর্যায় অতিক্রম করতে থাকে। চাঁদের যেই পৃষ্ঠ পৃথিবীর দিকে ফেরানো থাকে, তার আলোকিত অংশ বাড়তে-কমতে থাকে। এই হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে চাঁদের আকারের যে পরিবর্তন হয় তাকে ইংরেজীতে বলা হয় Phases of the moon আর বাংলায় চাঁদের কলা। চাঁদের কলাসমূহের কয়েকটি এই:
১) الهلال বহুবচন أهلة । অর্থাৎ দর্শনযোগ্য চিকন চাঁদ বা বাঁকা চাঁদ।
অমাবস্যা শেষ হওয়ার পর চাঁদ যখন পৃথিবী থেকে দর্শনযোগ্য হয়। তখন সূর্য অস্ত যাওয়ার পর পশ্চিমাকাশে চাঁদের যেই চিকন অংশ উজ্জ্বল ধনুকাকৃতিতে দেখা যায় তাকে ‘হিলাল’ বলা হয়। ইংরেজীতে এর নাম Crescent moon|
২) التربيع الأول First Quarter বাংলায় অর্ধচন্দ্র।
৩) المحدودب المتزايد Waxing Gibbous বাংলায় অর্ধাধিক।
৪) البدر Full moon বাংলায় পূর্ণিমা।
৫) المحدودب المتناقص Waning Gibbous
৬) التربيع الأخير Last Quarter
৭) الهلال الزائل Waning crescent
৮) المحاق Interlunar period বাংলায় অমাবস্যা। [1]
কুরআন ‘হিলাল’কে (১ নং কলা) মিকাত বানিয়েছে অর্থাৎ ইসলামী মাস গণনা হিলালের মাধ্যমে শুরু করার শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বলেন, ইসলামী মাস ‘হিলাল’ থেকে নয়, অমাবস্যা (৮ নং কলা) থেকে শুরু হবে। যে কেউ-ই বুঝতে সক্ষম যে, এ কথা কুরআন-বিরুদ্ধ। কুরআন তো ‘হিলাল’কে মিকাত বানিয়েছে, ‘মিহাক’ বা অমাবস্যাকে নয়। এ জন্যই ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কৌশলে হিলালের অর্থই পরিবর্তন করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘হিলালে’র অর্থ দর্শনযোগ্য চিকন চাঁদ নয়, এর অর্থ হল অমাবস্যা!!
চাঁদের অর্থ বিকৃতি সাধনে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এই ছুতা পেয়ে গেলেন যে, কুরআন ও হাদীসের অনেক ইংরেজী অনুবাদে ‘হিলালে’র অর্থ ‘নিউমুন’ বলা হয়েছে। আর তিনি কোন ইংরেজী থেকে বাংলা অভিধানে ‘নিউমুনে’র অর্থ পেয়ে গেলেন অমাবস্যা। ব্যস, দু’টিকে মিলিয়ে তিনি এই আজগবি দাবী করে বসলেন, ‘হিলালে’র অর্থ হল অমাবস্যা।
অথচ ইংরেজীতে ‘নিউমুনে’র সাধারণ ব্যবহার হল দর্শনযোগ্য চিকন চাঁদ বা Crescent moon -এর অর্থে। এটাই ‘নিউমুনে’র আভিধানিক অর্থ। এটাই তার পুরাতন ও মূল অর্থ। তবে এস্ট্রোনমির পরিভাষায় চাঁদের সংযোগ অবস্থা বা Conjunction কে ‘নিউমুন’ বলা হয় । অমাবস্যার সময় চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবী যখন একই রেখায় অবস্থান করে এবং চাঁদ উভয়ের মাঝে থাকে, তখন চাঁদের আলোকিত অংশ সূর্যের দিকে থাকে এবং অন্ধকার অংশ পৃথিবীর দিকে থাকে। চাঁদের এই সংযোগ অবস্থাকে আরবীতে বলে ইকতিরান বা ইজতিমা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা চান্দ্রমাসের শুরু যেহেতু ইকতিরান বা সংযোগ অবস্থাকে সাব্যস্ত করেন, তাই একে তারা ‘নিউমুন’ বলেন। বুঝা গেল, এটা এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুন যা আভিধানিক ও প্রচলিত নিউমুন থেকে ভিন্ন। [2]
নিউমুন -এর মূল ও অনুসৃত অর্থ, যা শত শত বছর ধরে চলে আসছে, তা হচ্ছে এই শব্দের আভিধানিক অর্থ। তবে যেহেতু আজকাল মানুষের মধ্যে নিউমুন শব্দটি এস্ট্রোনমিক্যাল নিউমুন অর্থে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত হতে শুরু হয়েছে। এজন্য এখন ‘হিলাল’ -এর তরজমায় ‘নিউমুনে’র চেয়ে ‘ক্রিসেন্টমুন’ শব্দটি বলাই অধিক শ্রেয়।
যাহোক, ইংরেজী কুরআন তরজমাগুলোতে সাধারণত ‘আল আহিল্লাহ’ الْأَهِلَّةِ এর অর্থ ‘নিউমুনস’ লেখা হয়েছে। যার উদ্দেশ্য হলো আভিধানিক এবং প্রচলিত অর্থ। তথা ‘ক্রিসেন্টমুন’। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক দ্ব্যর্থবোধক শব্দের সুযোগ নিয়ে মানুষকে এ ধোকা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, কুরআনে আল্লাহ তাআলা অমাবস্যার মুহূর্তে শুরু হওয়া নতুন চাঁদ থেকে চান্দ্রমাসের সূচনা করতে আদেশ করেছেন, যা শুধুই হিসাবের মাধ্যমে জানা সম্ভব।
এই অপকর্মকাণ্ডের জন্য তিনি কোন ধরনের ভূমিকা কিংবা কোনোরকম কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। উপরন্তু তিনি বাংলা ‘নতুন চাঁদ’ ও ‘নবচন্দ্র’ শব্দদু’টিকে তার বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় সরাসরি অমাবস্যার অর্থে ব্যবহার করেছেন। কখনো বা আরো বেশি দুঃসাহস দেখিয়ে বলেছেন, কুরআন চান্দ্রমাস শুরু করতে বলেছে অমাবস্যা থেকে!! আর কখনো একটু-আধটু ভয় জেগেছে, তাই ‘নতুন চাঁদ’ ও ‘ নবচন্দ্রকে’ নিজের উদ্ভাবিত অমাবস্যার অর্থে ব্যবহার করে বলেছেন, কুরআন নতুন চাঁদ থেকে চান্দ্রমাস শুরু করতে বলেছে!! তার মনের মধ্যে রয়েছে অমাবস্যার অর্থ। অথচ পাঠকবর্গ ভাবছেন, প্রথম রাতের চাঁদ!!
সারা পৃথিবীতে রোযা ও ঈদ একই দিনে করানোর সার্থে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তো এমনিতেই বহু বিকৃতি ও মিথ্যাকথনের আশ্রয় নিয়েছেন। তার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে একই সাথে যে তিনটি বিকৃতি সাধন করেছেন, সেগুলো এই:
১. হিলাল
চাঁদের প্রসঙ্গে এর একমাত্র অর্থ, ক্রিসেন্টমুন। উদ্দেশ্য, অমাবস্যা শেষ হওয়ার পর পশ্চিমাকাশে দর্শনযোগ্য চিকন চাঁদ। একে বিকৃত করে তিনি বানিয়েছেন অমাবস্যার চাঁদ!!
২. নিউমুন
আয়াত ২ : ১৮৯-এর তরজমায় ইংরেজী অনুবাদকগণ এই শব্দকে আভিধানিক এবং প্রচলিত অর্থে ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ ক্রিসেন্টমুন, চান রাতের চাঁদ। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব একে এস্ট্রোনমিক্যাল ‘নিউমুনে’ পরিণত করেছেন!!
৩. নতুন চাঁদ, নবচন্দ্র
বাংলা ভাষায় এই দুই শব্দের অর্থ একটাই। তথা অমাবস্যা-পরবর্তী প্রথম রাতের চাঁদ। কিন্তু একেও তিনি অমাবস্যা বানিয়ে ফেলেছেন!!
বিকৃতির উপর ভর করে তিনি খুবই নির্লজ্জভাবে আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর কালাম সম্বন্ধে পুরো বইয়ে বারবার এই মিথ্যা বলে গিয়েছেন যে, কুরআন হিসাবের মাধ্যমে, অমাবস্যার মাঝে শুরু হওয়া নতুন চাঁদ থেকে চান্দ্রমাস আরম্ভ করতে বলেছে! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।
এবার এই ভয়ঙ্কর বিকৃতির শিকার তার কিছু বক্তব্য, (লা হাওলা পাঠ করে) দেখুন:
১. বইয়ের পর্ব ৪৪ এ ‘বাংলাদেশের চান্দ্রমাস গণনা ভুল হয়’ শিরোনামের অধীনে চান্দ্রমাসের হিসাবের একটি নকশা দিয়েছেন। ওখানে অমাবস্যার সময়ের প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছেন যে, প্রকৃত চান্দ্রমাসের প্রথম তারিখ এটিই।
এরপর অমাবস্যার পরবর্তী দিনকে সৌদী আরবের প্রথম তারিখ এবং তারপরবর্তী দিনকে বাংলাদেশের প্রথম তারিখ দেখিয়েছেন। এরপর নোট লিখেছেন,
“অমাবস্যার মাঝখানে শুরু হওয়া নতুন চাঁদ ২ লক্ষ ৩৯ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত পৃথিবী থেকে ১২ ঘণ্টা পরে ছাড়া খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়, বিধায় আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী (২ : ১৮৯) হিসাবের মাধ্যমে নতুন চাঁদ দিয়ে মাস শুরু করতে হবে। তাহলেই কেবল মাসের ১৪/১৫ তারিখে পূর্ণিমা পাওয়া যাবে এবং ২৯/৩০ তারিখে অমাবস্যা হবে।” (চান্দ্রমাস, পৃ. ৭১, নবম সংস্করণ)
আরেক জায়গায় লিখেছেন,
নতুন চাঁদের বয়স ১২ ঘণ্টার বেশি না হলে কখনো খালি চোখে দেখা যাবে না। তাই আল্লাহর হুকুম মোতাবেক হিসাবের মাধ্যমেই নবজাতক চন্দ্র দিয়ে চান্দ্রমাস শুরু করতে হবে। (চান্দ্রমাস, পৃ. ৬৩)
২. পর্ব নম্বর ৫৮ তে ‘খালি চোখে চাঁদ দেখে চান্দ্রমাস আরম্ভ করতে হবে না কেন? শিরোনামে লিখেছেন,
“১৭। খালি চোখে দেখা আরবদের নতুন চাঁদ আর তৃতীয় বৎসরের অতিরিক্ত মাস গণনা, এর কোনটাই আল্লাহ গ্রহণ করেননি।
১৮। তাই অমাবস্যার মাঝখানে শুরু হওয়া অদেখা ১২ টা নতুন চাঁদ দিয়ে আল্লাহ ১২ টা চান্দ্রমাস আরম্ভ করতে বলেছেন (২ : ১৮৯) এবং তৃতীয় বৎসরের অতিরিক্ত মাস হিসাব করতে নিষেধ করেছেন (৯ : ৩৬, ৩৭)।
১৯। তাই ১২ টা নতুন চাঁদ দিয়ে হিসাবের মাধ্যমে ১২ টা চান্দ্রমাস আরম্ভ করতে হবে; খালি চোখে দেখে মাস শুরু করা যাবে না।” (চান্দ্রমাস, পৃ. ৯৭, পর্ব ৫৮)
আরবরা ফিতরি (স্বভাবগত) তরীকা মোতাবিক চান্দ্রমাস আরম্ভ করতো চাঁদ দেখে। তাদের এই তরীকা সঠিক ছিলো। ইসলাম তা গ্রহণ করেছে। রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে মোতাবিক আমল করেছেন এবং উম্মতকে আমল করতে আদেশ করেছেন। এই বিষয়ে সহীহ এবং মুতাওয়াতির (অবিচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায় বর্ণিত) হাদীসসমূহ আমরা পড়েছি।
হজ্বের সম্পর্ক যিলহজ্ব মাসের সঙ্গে। যা কিনা হিলালের উপর নির্ভরশীল চান্দ্রমাস। সে জন্য হজ্বের মৌসুম যথারীতি পরিবর্তন হতে থাকে। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের মস্তিষ্কে এই কুফুরি চিন্তা সওয়ার হয়েছিলো যে, তারা হজ্বের মৌসুমকে ফিক্সড (নির্ধারিত) করে দিবে। অতএব তারা ইহুদীদের কাছ থেকে نسىء :বিলম্বিতকরণ / মলমাস গণনার ধারা শিখে নেয়। যার একটি তরীকা ছিল এই যে, প্রতি তিন চান্দ্রবৎসর অন্তর অন্তর একটি মাস যোগ করে দেয়া হতো। এর ফলে হজ্বের মৌসুম তো ফিক্সড / সুর্নিধারিত হয়ে যেতো, কিন্তু স্বভাবতই এর দ্বারা হজ্বের প্রকৃত তারিখ পাল্টে যেতো। সূরা তাওবায় ৯ : ৩৬-৩৭ মাস বিলম্বিত করণকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে ইসলামী পর্বগুলোতে এর কোন অস্তিত্ব বা কোনোরূপ প্রভাব নেই। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব (আল্লাহ তাআলা তাকে সুস্থ বিবেক এবং সিরাতে মুস্তাকীমের হেদায়েত নছীব করেন) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামকে আরবের মুশরিকদের কাতারে এনে দাঁড় করিয়েছেন এবং বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তো আরবের মুশরিকদের তরীকা (হিলাল দেখে মাস আরম্ভ) গ্রহণ করেননি অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর উম্মত তথা সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে’ তাবেয়ীন- এঁরা কিনা ঐ তরীকাই অবলম্বন করলেন। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং যেই তরীকা বাতিল করে হিসাবের সাহায্যে অমাবস্যার মাঝে শুরু হওয়া অদেখা চাঁদ থেকে মাস শুরু করতে হুকুম করেছেন; এঁরা আল্লাহর নিদের্শিত সেই পদ্ধতি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহ কর্তৃক পরিত্যক্ত পন্থাই গ্রহণ করেছেন!!
এই হল আমাদের টি এন্ড টি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সেই সংস্কার, যা নিয়ে তিনি গর্বিত। এবং যেই কীর্তির জন্য তিনি জাফরী সাহেব এবং আল-মারূফ সাহেবের স্তুতি বাক্যও পেয়ে যান (?!) ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন!
জানি না, মানুষ কোন কিছু না পড়ে তার উপর প্রশংসাবাণী কীভাবে লেখে?! [3]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াত ২ : ১৮৯-এর ব্যাখ্যা তো করেছেন ‘চাঁদ দেখা’ দিয়ে। আর তাঁর কৃত ব্যাখ্যা স্বয়ং আল্লাহ তাআলার শেখানো বয়ান (১৯ : ৭৫)। অথচ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব শুধু ‘দেখা’ কে ‘হিসাব’ দিয়ে পরিবর্তন করে দিচ্ছেন তাই নয়; বরং ‘হিলালকেই’ ‘মিহাকে’ (অমবস্যায়) পর্যবসিত করেছেন (?!) আয়াত ২ : ১৮৯-এর এই ভয়ানক বিকৃতি পর্যন্তই তিনি থেমে থাকেননি; বরং আরো বিভিন্ন আঙ্গিকে তিনি এই আয়াতের বিকৃতি সাধন করেছেন। সম্ভব হলে সামনে এ বিষয়েও কিছু কথা পেশ করা হবে।
আরো শুনুন তিনি কী বলেছেন,
৩. ‘আরব দেশে রাসূল (সা.) এর জন্মের পূর্ব হতেই খালি চোখে দেখা নতুন চাঁদ দিয়ে চান্দ্রমাস আরম্ভ করা হতো। রাসূল (সা.) সেটাকে অনুসরণ করেছেন মাত্র। কিন্তু কোন হাদীস দিয়ে সেটাকে সমর্থন দিয়ে যাননি। কারণ কোরআন তা বলে না। অতএব, হিসাবের মাধ্যমে অমাবস্যার মাঝে শুরু হওয়া নতুন চাঁদ দিয়েই চান্দ্রমাস আরম্ভ করতে হবে। তাহলেই কেবল ‘একক প্রকৃত বিশ্বহিজরী ক্যালেন্ডার’ পাওয়া যাবে।’ (চান্দ্রমাস পৃ. ২০৬, প্রশ্ন : ৬০-এর উত্তর প্রসঙ্গে আলোচনায়, নবম সংস্করণ)
চিন্তা করুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল তো হাদীসই। যদি তিনি একটি তরীকা মোতাবিক আমল করে থাকেন তবে এটাই সেই তরীকার সমর্থন। আর যখন তিনি কোনো একটি তরীকা অনুযায়ী আমল করেছেন তখন এটা অসম্ভব যে সেই তরীকা কুরআনের পরিপন্থী হবে। যেহেতু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব স্বীকার করছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুন চাঁদ দেখে চান্দ্রমাস শুরু করতেন সেহেতু তার একথা বলার অধিকার নেই যে, (তিনি এটা তাঁর হাদীস দ্বারা সমর্থন করেননি। কেননা রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল অবশ্য-অনুসরণীয় হাদীস। তাঁর হাদীস কেবল তার বাণী-কথনের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। এমনিভাবে তার একথা বলারও অধিকার নেই যে,) ‘কুরআন এরকম বলে না। কুরআন অমাবস্যা থেকে চান্দ্রমাস আরম্ভ করতে বলে’। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজ তো কুরআনের শিক্ষা এবং কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করা এবং করানো। কুরআন পরিপন্থী আমল করা কিংবা কুরআনের খেলাফ কোনো তরীকা অনুসরণ নয়।
যাই হোক, এই মুহূর্তে আসলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বক্তব্য নিয়ে পর্যালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। আমি দেখাতে চাচ্ছিলাম যে, তিনি পরিষ্কার ভাষায় দাবী করেছেন যে, কুরআন অমাবস্যার চাঁদ থেকে মাস আরম্ভ করতে বলেছে। হিলাল দেখার পরে নয়। তার এই দাবীর মধ্যে একই সাথে অসংখ্য বিভ্রান্তি লুকিয়ে আছে:
প্রথম বিভ্রান্তি: হিলালের বিকৃতি
প্রথম বিভ্রান্তি এই যে, ‘হিলাল’ যা হলো কুরআন ও সুন্নাহর একটি বিশেষ শব্দ। যার সাথে বহুসংখ্যক বিধান যুক্ত- তিনি এটাকেই বদলে দিয়েছেন। যদ্দরুণ একই সাথে কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহ তিনের সাথে সংশ্লিষ্ট ভাষ্য ও বক্তব্যসমূহ বিকৃতির অপরাধে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন। যে এই বিকৃতি মেনে নেবে, সে এক নিঃশ্বাসে এই সমস্ত শরয়ী বিধানকে বদলে ফেলবে, যা হিলালের সাথে সম্পৃক্ত। এসকল বিধানকে তখন হিলালের পরিবর্তে মিহাক (অমাবস্যা) -এর সাথে যুক্ত করে দেবে।
দ্বিতীয় বিভ্রান্তি: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান।
তৃতীয় বিভ্রান্তি: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কুরআন না বোঝার কিংবা কুরআনের বিরুদ্ধাচরণের অপবাদ।
চতুর্থ বিভ্রান্তি: হাদীস ও সুন্নাহ -এর বিরুদ্ধাচরণ
পঞ্চম বিভ্রান্তি: সাহাবায়ে কেরামসহ পুরো উম্মতের ‘ইজমা’ এবং সাবিলুল মু’মিনীন তথা মু’মিনদের সর্বস্বীকৃত পন্থার বিরুদ্ধাচরণ।
ষষ্ঠ বিভ্রান্তি: কুরআনে উপর এই অপবাদ আরোপ যে, কুরআন জ্যোতির্শাস্ত্রীয় গণনার মাধ্যমে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জানতে বলেছে এবং এ উদ্দেশ্যে ২ : ১৮৯, ১০ : ৫, ১৭ : ১২, ৫৫ : ৫, মোট চারটি আয়াতের অর্থগত বিকৃতি সাধন!!
বিকৃতির রাস্তা কীভাবে বের করলেন?
এই ভয়ানক বিকৃতি করবার জন্য ইঞ্জিনিয়ার সাহেব চতুরতার সাথে বেশ কয়েকটি রাস্তা আবিষ্কার করেছেন। যেমন তিনি দেখলেন যে, কুরআনের ইংরেজী তরজমাসমূহে সাধারণভাবে الأهلة (আল আহিল্লাহ)-এর তরজমা করা হয়েছে, ‘নিউমুনস’। আর নিউমুন এর অর্থ হল, নতুন চাঁদ। এবার ধরুন বাংলা একাডেমীর অভিধান (ইংরেজী-বাংলা) তিনি দেখেছেন। সেখানে তিনি পেয়ে গেলেন, নিউমুন: অমাবস্যা।
ব্যস, এ থেকেই তিনি বুঝে ফেললেন, তার কেল্লা ফতে। এবং এখন তার জন্য বৈধ হয়ে গেলো এই দাবী করে বসা যে, কুরআন অমাবস্যার মাঝে শুরু হওয়া নতুন চাঁদ থেকে মাস আরম্ভ করতে বলেছে। কেননা, একে তো هلال (হিলাল)-এর অর্থ হল নিউমুন। আর নিউমুন অর্থ অমাবস্যা। দ্বিতীয়ত বাংলা কুরআন তরজমা ও হাদীসের তরজমার কিতাবগুলোতে ‘হিলাল’-এর অর্থ লেখা হয়েছে, ‘নতুন চাঁদ’। আর তার বক্তব্য অনুযায়ী, চাঁদ দর্শনযোগ্য হওয়ার পর্যায়ে আসতে আসতে পুরানো হয়ে যায়। অথচ কুরআন তো মাস আরম্ভ করতে বলেছে নতুন চাঁদ দিয়ে। অতএব অমাবস্যার সময়কার অদেখা চাঁদ থেকেই মাস শুরু করতে হবে। কারণ নতুন চাঁদ তো সেটাই!
শরীয়তের সর্ববাদীসম্মত বিধানের বিপরীতে এ ধরনের ওয়াসওয়াসা যদি বাস্তবেই কারো মনে এসে থাকে তাহলে তার উচিত ছিলো আউযুবিল্লাহ এবং লা হাওলা পড়ে মন থেকে তা ঝেড়ে ফেলা। এবং এ কথা বিশ্বাস করা, কুরআন যে নতুন চাঁদ দিয়ে মাস আরম্ভ করতে বলেছে এটা আমার চেয়ে ঐ সকল মুতারজিমীনই ভালো বুঝবেন যাদের তরজমার উপর ভিত্তি করে আমি কথা বলছি। সুতরাং এ ক্ষেত্রে তাদের আমলটা কী? আর যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, অতঃপর সাহাবায়ে কেরামসহ গোটা উম্মত এখন পর্যন্ত চাঁদ দেখেই চান্দ্রমাস শুরু করেছেন ও করছেন; এতএব বোঝা গেল, দেখতে পাওয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষার কারণে চাঁদ পুরানো হয়ে যায় না। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজের ওয়াসওয়াসার প্রতিকারের পরিবর্তে খোদ ওয়াসওয়াসাকেই এলহাম মনে করছেন এবং সেটাকে উম্মতের সামনে পেশ করছেন আমলের উদ্দেশ্যে!!
এই জনাবেরা যদি বুঝতেন, কুরআন মজীদের শব্দ ‘নিউমুন’ও নয়, ‘নতুন চাঁদ’ও নয়। কুরআনের শব্দ হলো ‘হিলাল’! সুতরাং আপনাকে এখানে দেখতে হবে هلال -এর অর্থ কী।
হিলাল শব্দের ধাতুউৎপন্ন অর্থের মাঝে দু’টি জিনিস পরিলক্ষিত হয়: ক) প্রকাশ। খ) আওয়াজ।
(ه ل ل) এই ধাতুমূল থেকে নিষ্পন্ন সমস্ত শব্দ ও তার প্রয়োগ-ক্ষেত্রের উল্লেখ আরবী বৃহৎ অভিধানগুলোতে বিশদাকারে বিদ্যমান। সেগুলো খোলামাত্রই এই দুইটা জিনিস সামনে এসে যায়।
আরবরা যেহেতু প্রথম থেকেই অমাবস্যার পর দৃশ্যমান ক্রিসেন্টমুন (ধনুকাকৃতির চাঁদ) দেখে মাস আরম্ভ করতো, সেহেতু তারা তা পরস্পরে দেখা ও দেখানোর ব্যাপারে গুরুত্ব দিতো। যে কারণে আওয়াজ উচুঁ হতো। ‘ঐ যে চাঁদ, আরেকটু উপরে, একটু ডানে...’। এখনও আমরা চাঁদ দেখতে কালে এরকম আওয়াজ হয়।
তৃতীয় যে জিনিসটি ‘হিলালে’র অর্থের সাথে অঙ্গাঅঙ্গি মিশে আছে তা হল তার ধনুকের অবয়ব বা বক্রাকৃতি, ক্রিসেন্ট। যেহেতু অমাবস্যা-পরবর্তী চাঁদ যখন আলো ছড়াতে শুরু করে তখন তা ধনুকের আকৃতিই প্রতিবিম্বিত করে তাই আরবীতে ( ) এই চিহ্নের নাম দেওয়া হয়েছে, ‘হিলালাইন’ অর্থাৎ দুই হিলাল। এবং এরই ভিত্তিতে ‘হিলাল’-কে বিভিন্ন জায়গায় আলামত বা প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো মুসলিম দেশের পতাকায় ‘হিলাল’-এর যে চিহ্ন আঁকা রয়েছে সেটা উজ্জ্বল ধনুকেরই আকৃতি, অন্ধকার চাঁদের ছবি নয়।
মোটকথা ‘হিলাল’-এর ধাতু নিদের্শিত মূল অর্থ এবং তার প্রয়োগক্ষেত্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করাই এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট যে, অমাবস্যার চাঁদকে হিলাল বলার কোনোরকম অবকাশ নেই। এতে না ‘প্রকাশ’ আছে আর না তা দেখার মতো অবস্থা আছে যে, দেখতে ও দেখাতে গিয়ে আওয়াজ হবে। আর না এতে আছে ক্রিসেন্ট রূপ।
সারকথা এই যে, কোনো একটি শব্দের অর্থ যত উপায়ে নির্ধারণ করা সম্ভব সব উপায়ে ও সকল দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হলে কেবল মাত্র এই জ্বলজ্যান্ত বাস্তবতাই পরিদৃষ্ট হয় যে, অমাবস্যার পর্যায় অতিক্রান্ত হওয়ার পর চাঁদের যে উজ্জ্বল ধনুকাকার দর্শনযোগ্য হয় এবং মানুষ ২৯-এর দিবাগত রাতে যা দেখার চেষ্টা করে থাকে, কখনো দেখতে পায় কখনো বা পরবর্তী রাতে দেখে- আরবীতে এরই নাম ‘হিলাল’। যেহেতু মুসলমানদের এবং তারও আগে আরবদের কাছে নতুন চান্দ্রমাস এই হিলাল দিয়েই আরম্ভ হতো এজন্য হিলালের অর্থই হয়ে গিয়েছে উদূর্তে ‘নয়া চাঁদ’, ফারসীতে ‘মাহে নও’ বাংলায় ‘নতুন চাঁদ’ বা ‘নবচন্দ্র’ এবং ইংরেজীতে ‘নিউমুন’। (অথার্ৎ هلال কে এসকল ভাষায় নতুন চাঁদ বলার কারণ, তা দিয়ে নতুন মাস আরম্ভ হচ্ছে, এই হিসেবে। এ কারণে নয় যে তা বয়সে সদ্যজাত। দ্বিতীয় অর্থটাই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের আবিষ্কার এবং তার উপরই তার সংস্কারকর্মের ভিত্তি। উল্লিখিত ভাষাসমূহে হিলালকে নতুন চাঁদ বলার এই প্রেক্ষাপটটি যদি তিনি বুঝতেন এবং গ্রহণ করতেন তাহলে অমাবস্যার মাঝে শুরু হওয়া চাঁদের সদ্যোজাত অদেখা আকারটিকে নতুন চাঁদ বলার জন্য গোঁ ধরতেন না এবং হিলালকে তা দিয়ে ব্যাখ্যার জন্য উঠে পড়ে লাগতেন না)।
না হয় এই শব্দগুলোর (নয়া চাঁদ, মাহে নও, নতুন চাঁদ, নিউমুন) সরাসরি আরবী প্রতিশব্দ তো হলো القمر الجديد (আল-কামারুল জাদীদ), هلال (হিলাল) নয়।
তো বিভিন্ন ভাষায় ‘হিলাল’-এর এই অর্থ (নতুন চাঁদ) প্রচলনের বাস্তবতা ও তার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় না নিয়ে এই অর্থ (নতুন চাঁদ) টিকেই هلال (হিলাল)-এর বিকৃতি সাধনের জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। যদি তিনি এই বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট থেকে চক্ষু বন্ধও করেন তথাপি এ থেকে কীভাবে চোখ বন্ধ করে থাকবেন যে, কুরআন ও হাদীসের শব্দ হলো أهلة (আহিল্লাহ) এবং هلال (হিলাল)। قمر جديد (কামারুন জাদীদ) বা أقمار جديدة (আকমারুন জাদীদাহ) নয় যে আপনি ব্যস جديد (নতুন) শব্দ দিয়েই আয়াতের নববী অর্থ (নবী যে অর্থ বুঝেছেন) এবং হিলালের অনুসৃত অর্থ বদলে দেওয়ার চক্করে পড়ে যাবেন। কুরআনের শব্দ তো হলো هلال (হিলাল)। আপনাকে এর যা অর্থ সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। যদি তাফসীরে কুরআনের সমস্ত নির্ভরযোগ্য উৎস থেকেও আপনি দৃষ্টি সরিয়ে নেন, কেবল هلال (হিলাল)-এর অর্থ নিয়েই চিন্তা করেন তাহলেও ইনশাআল্লাহ, এই বিকৃতি থেকে আপনার বাঁচবার তাওফিক হয়ে যাবে।
আল্লাহর বান্দা চিন্তা করে না, رؤية الهلال (চাঁদ দেখা) এই যে আরবী কথাটা এবংصوموا لرؤية الهلال وافطروا لرؤيته(হিলাল দেখে রোযা ও ঈদ করা) হাদীস, সুন্নাহ এবং ইসলামী শরীয়তের এই যে ধারাবাহিক অনুসৃত ভাষা- এখানেই তো এ বিষয়টি পরিষ্কার রয়েছে যে, ‘হিলাল’ অমাবস্যার সময়কালীন চাঁদ নয়; রবং অমাবস্যার পর্যায় অতিক্রম করার পর দর্শনযোগ্য চাঁদ। অমাবস্যার চাঁদ তো অন্ধকারাচ্ছন্ন, সেটা দেখা, বা না দেখার প্রশ্ন আসে না। এবং সেটা দেখার সাক্ষ্য দেওয়ারও কোনো প্রশ্ন ওঠে না। অতএব ‘হিলাল’ দৃষ্টিগোচর হওয়া বা না হওয়ার মধ্যেই এ ব্যাপারটি রয়েছে যে, হিলাল হচ্ছে অমাবস্যাপরবর্তী দৃশ্যমান চাঁদ। অমাবস্যার ভিতরের চাঁদ নয়। হিলালের এই অনুসৃত এবং সর্ববাদীসম্মত অর্থের স্বপক্ষে আরবী ভাষার অভিধান (আরবী - আরবী, আরবী - অনারবী, অনারবী - আরবী), কুরআন, হাদীস এবং ফিকহের শব্দাভিধান, সেই সাথে তাফসীরগ্রন্থ এবং হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ এবং অন্যান্য দ্বীনী কিতাবাদির শত শত সূত্রে প্রাচীন ও আধুনিক শত শত নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতি বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু এত সুস্পষ্ট একটি জিনিসের জন্য উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি দিয়ে যাওয়া ভালো মনে হয় না। তারপরও নমুনাস্বরূপ বিশ-পঁচিশটি কিতাবের হাওয়ালা উল্লেখ করছি।
১. ‘কিতাবুল আইন’
আল-খলীল ইবনে আহমাদ আল-ফারাহীদী (১০০ হিজরী- ১৭০ হিজরী) খ. ৪, পৃ. ৩২০-৩২১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত, লেবানন।
ইমাম খলীল বলেন, الهلال غرة القمر حين يهله الناس في غرة الشهر অথার্ৎ হিলাল হচ্ছে চাঁদের শুভ্রঅংশ, মাসের প্রারম্ভে মানুষ যা দেখে। ইমাম খলীলের এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানার জন্য দেখা যেতে পারে তাজুল আরুস মিন জাওয়াহিরিল কামুস (খ. ১৩, পৃ. ২২২, মাদ্দা غ ر ر)
সামনে আমি শুধু উদ্ধৃতি উল্লেখ করবো। ভাষ্য উদ্ধৃত করবো না। কারণ ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় আরবী ভাষার প্রত্যেক ইমামে লোগাত (ভাষা বিশেষজ্ঞ) এই অভিন্ন কথাটিই বলেছেন। কেউ আরেকটু বিস্তারিত বলেছেন। আরবী ভাষায় ‘হিলাল’-এর ক্ষেত্রে ‘প্রকাশ’-এর অর্থ এতই ব্যাপক প্রচলিত যে, أهل الهلال এবং استهل الهلال -এর অর্থই হল অমুক হিলাল দেখেছে। এমনিভাবে هل الهلال এর অর্থ, হিলাল আত্মপ্রকাশ করেছে।
সামনে যেসব গ্রন্থের নাম আসছে সেখানে এ দু’টি এবং এ ছাড়াও বহু ব্যবহার উল্লেখ করে এ কথাই বলা হয়েছে যে, ‘হিলাল’ হচ্ছে মাসের শুরুতে দর্শনযোগ্য চাঁদ। এবং এই সমস্ত অভিধানে, এমনিভাবে অন্যান্য সকল অভিধানে অমাবস্যার জন্য আলাদা শব্দ লেখা হয়েছে। যেমন, মিহাক, সিরার ইত্যাদি। অতএব পুনরুক্তি থেকে বাঁচার জন্য শুধু কিতাবগুলোর নাম উল্লেখ করে দেয়া হচ্ছে। যার ইচ্ছা দেখতে পারেন।
২. ‘কিতাবুল আলফায’
ইবনুস সিককীত ইয়াকূব ইবনে ইছহাক (১৮৬ হিজরী- ২৪৪ হিজরী) পৃ. ২৮৭-২৮৯ বাবু আসমায়িল কামারি ওয়া ছিফাতিহী।
৩. ‘আদাবুল কাতিব’
আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনে মুসলিম ইবনে কুতাইবা (২১৩ হিজরী- ২৭৬ হিজরী) পৃ. ৬৯-৭১, (বাবু মা‘রিফাতি মা ফিস্ সামাই ওয়ান্ নুজূমি ওয়াল আযমান ওয়ার রিয়াহ)। দারুল ফিক্র বৈরুত, ১৩৮২ হি. মোতাবিক ১৯৬৩ খৃ.।
৪. ‘মাআনিল কুরআনি ওয়া ই‘রাবুহু’
আবু ইসহাক আয্-যাজজায ইবরাহীম ইবনুস-সারি। (২৪১ হিজরী - ৩১১ হিজরী), খ. ১, পৃ. ২৫৮।
এ অভিধানগুলোসহ অন্যান্য বহু সংখ্যক অভিধানে এটাও লিখেছে যে, চান রাত বা প্রথম রাতের চাঁদের নাম হল হিলাল। কিংবা প্রথম রাতের উদিত চাঁদের নাম হিলাল। দ্বিতীয়ার চাঁদকেও হিলাল বলা হয়। এক ব্যবহারে, তৃতীয়ার চাঁদকেও বলা হয়েছে- হিলাল...।
এইসব বক্তব্যের দাবীও এটিই যে, হিলাল হচ্ছে অমাবস্যা শেষ হবার পর প্রকাশ পাওয়া চাঁদ। কেননা অমাবস্যার চাঁদ দৃশ্যমান হয় না তদুপরি অমাবস্যা চলাকালে Conjunction থেকে কিংবা Conjunction -এর অব্যবহিত পর থেকেই যেই জ্যোতির্শাস্ত্রীয় নিউমুন -এর সূচনা হয়- তার কোন সুনিদির্ষ্ট সময় নেই। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যে কোনো সময় তার সূচনা হতে পারে। ভোর চারটায়, পাঁচটায়, সকাল দশটায়, দুপুর বারোটায়; বিকেল তিনটায়, অথবা রাত দুইটায়... একেক মাসে একেক সময় তার সূচনা হয়। সেজন্য “হিলাল হচ্ছে প্রথম রাতের চাঁদ”। এই বক্তব্যের মাঝে এ কথাও বিদ্যমান রয়েছে যে, অমাবস্যা বা জ্যোতির্শাস্ত্রীয় নিউমুনের নাম ‘হিলাল’ নয়। এটা তো দিন-রাতের যে কোন সময় আরম্ভ হতে পারে। পক্ষান্তরে হিলাল -এর সময় সুনির্দিষ্ট। অমাবস্যার শেষে সূর্যাস্তের পর পশ্চিমাকাশে তা দৃষ্টিগোচর হয়। [4]
৫. ‘জামহারাতুল্লুগাহ’:
আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ইবনে দুরায়দ আল-আযদি (২২৩ হিজরী- ৩২১ হিজরী), খ.১ পৃ.১২১, ১৬০, ১৬৯, ৩৭২; খ.২, পৃ. ৭৯২; খ. ৩, পৃ. ১৩০৯। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা, ডক্টর রমযী মুনীর বা‘লাবাক্কী, দারুল ইলম, লিলমালায়ীন, বৈরুত, প্রকাশকাল: ১৯৮৭ খৃ.
৬. ‘আয্-যাহির ফি মা‘আনী কালিমাতিন নাস’
আবু বকর আল-আনবারী মুহাম্মাদ ইবনে কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে বাশ্শার (২৭১ হিজরী- ৩২৮ হিজরী) খ.১, পৃ. ৪৬৮
৭. ‘তাহযীবুল্লুগাহ’
আবু মনসূর আল-আযহারী মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ ইবনুল আযহার আল-হারাবী (২৮২ হিজরী- ৩৭০ হিজরী) খ. ৫, পৃ. ২৩৯-২৪৩, দারু ইহয়াউত্ তুরাছিল আরাবী, বৈরুত, লেবানন, প্রকাশকাল: ১৪২১ হি.
৮.‘আস-সিহাহ’
আবু নসর আল-জাওহারী ইসমাঈল ইবনে হাম্মাদ (৩৯৩ হিজরী) খ. ৫, পৃ. ১৮৫১, তাহকীক : আহমদ আব্দুল গফুর আত্তার, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৩৯৯ হি. (পুণ:মুদ্রণ ১৪০২ হি.) সায়্যেদ হাসান আব্বাসের স্যেজন্যে।
৯. ‘আল মুহকাম ওয়াল-মুহীতুল আযম’
ইবনে সীদাহ আবুল হাসান আলী ইবনে ইসমাঈল (৩৯৮ হিজরী- ৪৫৮ হিজরী) খ. ৪, পৃ. ১০০-১০৩, পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা আব্দুল হামীদ, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, লেবানন, প্রথম প্রকাশ: ১৪২১ হি.
১০. ‘আল-মুখাসসিস’
ইবনে সীদাহ (প্রাগুক্ত), খ. ২ পৃ. ৩৭৬-৩৮০ (ছিফাতুল কামারি ওয়া আসমাউহু) এবং খ. ৫ পৃ. ২১১ (বাবুত-তারিখ), দারু ইহয়াউত্ তুরাছিল আরাবী, বৈরুত, লেবানন, প্রকাশকাল: ১৪১৭ হি.।
আল- মুখাসসিসের এই সব আলোচনার জন্য আল-মুখাসসিসের উন্নত ও মানসম্মত পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত গ্রন্থ ‘আল ইফসাহ ফি ফিকহিল লুগাহ’ পৃ. ৪৫৯-৪৬১ দেখা যেতে পারে। যা আব্দুল ফাত্তাহ আছ-ছঈদী (১৩১০ হিজরী -১৩৯১ হিজরী) এবং হুসাইন ইউসুফ মূসার প্রস্তুতকৃত। এর একটি ফটো সংস্করণ দারুল কুতুবিল ইলমিয়া বৈরুত থেকে ১৪০৭ হিজরীতে ছেপেছে।
১১. ‘মুফরাদাতু আলফাযিল কুরআন’
আর-রাগেব আল আস্পাহানী আল-হুসাইন ইবনে মুহাম্মাদ ইবনুল মুফায্যাল (৫০২ হিজরী) পৃ. ৮৪৩ (ه ل ل), দারুল কলম দামেস্ক, এবং আদ-দারুশ শামিয়্যা, বৈরুত, প্রকাশকাল, ১৪১২ হিজরী
১২. ‘আসাসুল বালাগাহ’
মাহমূদ ইবনে উমর জারুল্লাহ আয্যামাখশারী (৪৬৭ হিজরী- ৫৩৮ হিজরী) পৃ. ৫৮৩, ৫২২, ২৯৩।
১৩. ‘আল ফায়েক্ব ফী গারীবিল হাদীস’
জারুল্লাহ আয্যামাখশারী (পূর্বোক্ত) খ. ৪, পৃ. ১১০-১১১, দারুল ফিক্র, বৈরুত, প্রকাশকাল: ১৪১৪ হিজরী।
১৪. ‘মাশারিকুল আনওয়ার আলা সিহাহিল আছার’
আবুল ফযল কাযী ইয়ায ইবনে মূসা আসসাবতী (৪৮৬ হিজরী- ৫৪৪ হিজরী) খ. ২, পৃ. ৩৩৭ (حرف الهاء مع اللام), দারুল ফিক্র, বৈরুত, প্রকাশকাল: ১৪১৮ হিজরী।
১৫. ‘আন নিহায়া ফী গারীবিল হাদীসি ওয়াল আছর’
মাজদুদ্দীন ইবনুল আছীর আল-জাযারী আবুস সাআদাত আল মুবারাক (৫৪৪ হিজরী- ৬০৬ হিজরী) খ. ২, পৃ. ৯১০-৯১১, দারুল মারেফা, বৈরুত, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৪২৭ হিজরী।
১৬. ‘আত-তাফসীরুল কাবীর’
ফখরুদ্দীন আর-রাযী মুহাম্মাদ ইবনে উমর (৫৪৪ হিজরী-৬০৬ হিজরী) খ. ৫, পৃ. ১০২-১০৬, আয়াত ২ : ১৮৯-এর তাফসীরের অধীনে। দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৪২৫ হিজরী।
১৭. ‘আল-ঊবাবুয-যাখির ওয়াল লুবাবুল ফাখির’
রযিউদ্দীন আছ-ছগানী আল-হাসান ইবনে মুহাম্মাদ আল-লাহোরী (৫৭৭ হিজরী-৬৫০ হিজরী) এতে লিখেছে: الشكس - بالفتح- قبل الهلال بيوم أو بيومين وهوالمحاق অর্থাৎ شكس (শাকাস)-এর অর্থ হল মিহাক; অমাবস্যা, হিলালের এক দুই দিন পূর্বে, (হরফুস্-সীন, পৃ. ২২২)
দারুশ-শুউনিল আম্মাহ আস-সাকাফিয়্যাতুল আম্মাহ, বাগদাদ, ইরাক থেকে এই বিশাল গ্রন্থটি ছেপেছে। এই ভাষ্যটুকু হরফুস-সীন খণ্ডে এসেছে। যা ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ হাসান আলে ইয়াসীনের তাহকীকে ছেপেছে। এখানে আরবী ভাষার বিখ্যাত পণ্ডিত ইমাম রযিউদ্দীন ছগানী বলেছেন যে, অমাবস্যা হয় ‘হিলাল’ -এর পূর্বে (হিলাল তার পরে), অমাবস্যার মধ্যে নয়।
১৮. ‘লিসানুল আরব’
ইবনে মনযূর আল-ইফরিকী জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে মুকাররাম (৬৩০ হিজরী-৭১১ হিজরী) খ.১৫, পৃ. ৮৩-৮৫, দারে ছাদের, বৈরুত।
১৯. ‘আদ-দুররুল মাছূন ফী উলূমিল কিতাবিল মাকনূন’
শিহাবুদ্দীন আস-সামীন আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে ইউসুফ (৭৫৬ হিজরী) খ.১, পৃ. ৪৭৮-৪৭৯, (আয়াত: ২ : ১৮৯-এর অধীনে), ভূমিকা: ডক্টর আহমাদ মুহাম্মাদ, উসুলুদ্দীন ফ্যাকাল্টি, জামেয়া আল-আযহার। দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত, প্রথমপ্রকাশ: ১৪১৪ হিজরী।
২০. ‘আল মিছবাহুল মুনীর ফী গারীবিশ শারহিল কাবীর’
আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ আল ফাহয়ূমী আবুল আব্বাস (মৃত্যু ৭৭০ হিজরী -এর দিকে) পৃ. ৪০১, দারুল হাদীস, কায়রো, ১৪২৯ হিজরী।
২১. ‘আল কামুসুল মুহীত ওয়াল কাবুসুল ওয়াসীত’
মাজদুদ্দীন আল-ফায়রুযাবাদী মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকূব (৭২৯ হিজরী- ৮১৭ হিজরী) খ. ৪, পৃ. ৭০, পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা ও টীকা: শায়খ নাছর আল হোরীনী। এর সঙ্গে ‘আলকামুস’ -এর বিশাল ভাষ্যগ্রন্থ ‘তাজুল আরুস মিন জাওয়াহিরিল কামুস’ও দেখুন। যা ভাষা বিশারদ, মুহাদ্দিস ও ফকীহ মুরতাযা (মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ হুসাইনী) যাবিদী (১১৪৫ হিজরী- ১২০৫ হিজরী) সংকলিত, কুয়েতের আলমাজলিসুল ওয়াতানী যা অনেকগুলি বিরাট ভলিউমে প্রকাশ করেছে। ‘হিলাল’ -এর উল্লেখ এই সংস্করণে ৩১ তম খণ্ডে (পৃ. ১৪৪-১৫৬) এবং ‘মিহাক’ (অমাবস্যা)-এর উল্লেখ খ. ২৬ পৃ. ৩৭৮ এবং ‘সারার’ (‘মিহাক’ -এর আরেকটি প্রতিশব্দ)-এর উল্লেখ খ. ১২, পৃ. ১৬-১৭
২২. ‘বাছাইরু যাউয়িত তাময়ীয ফি লাতাইফিল কিতাবিল আযীয’
মাজদুদ্দীন আল-ফায়রুযাবাদী (প্রাগুক্ত) খ. ৫, পৃ. ৩৩১-৩৩২, আল-মাকতাবাতুল ইলমিয়্যা, বৈরুত। এই গ্রন্থে ‘হিলাল’ -এর হাকীকত এবং এর নামকরণের সাথে সম্পর্কিত ঐ তিনটি বিষয় (প্রকাশ, আওয়াজ, ধনুকাকৃতি) একসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
২৩. ‘গারাইবুল কুরআন ওয়া রাগাইবুল ফুরকান’
নিযামুদ্দীন আল-হাসান ইবনে মুহাম্মাদ নিশাপুরী, (মৃত্যু ৮৫০ হিজরীর পর) খ.১, পৃ. ৫২৫, মাকতাবা দারুল বায, মক্কা মুকাররমা, ১৪১৬ হিজরী, তার ভাষ্যটি এই:
وتسمى القطعة المرئية الصغيرة أول ما يبدو إلى ليلتين هلالا، ويجمع على أهلة، لأنه يتعدد اعتبارا.
অর্থাৎ (অমাবস্যার পরে) চাঁদ প্রথম প্রথম যখন প্রকাশ পায় তখন তার যে ছোট্ট অংশটি নযরে পড়ে তার নাম হিলাল। প্রথম দুই রাতে একে ‘হিলাল’ই বলা হয়।
২৪. ‘আল-লুবাব ফী উলূমিল কিতাব’
আবু হাফস উমর ইবনে আলী সিরাজ উদ্দীন দামেশকী (রচনাকাল: ৮৮০ হিজরী) (আয়াত ২ : ১৮৯ -এর অধীনে)
ব্যস, এই মুহূর্তে শত শত উদ্ধৃতির মধ্য থেকে নমুনাস্বরূপ কেবল এই চব্বিশটি উদ্ধৃতিই উল্লেখ করলাম। অতিরিক্ত একটি উদ্ধৃতি শুধু উল্লেখ করি: খ্রিস্টান গবেষক পণ্ডিত লুয়াইস মালুফ (১২৮৪ হিজরী- ১৩৬৬ হিজরী মোতাবেক ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দ- ১৯৪৬ খিস্টাব্দ)-এর কৃত আল-মুনজিদ ফিল লুগাহ, যার প্রথম সংস্করণ ১৯০৮ খিস্টাব্দে ছেপেছে এবং এখন পর্যন্ত এর অনেক সংস্করণ বেরিয়েছে; এতে ‘হিলাল’-এর আলোচনা শেষ করা হয়েছে এ কথা দিয়ে:
والهلال عند أهل الهيئة: ما يرى من القمر أول ليلة.
অর্থাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে হিলাল হচ্ছে চাঁদের সেই অংশ যা প্রথম রাতে দৃষ্টিগোচর হয়। (আল-মুনজিদ ফিল লুগাহ, পৃ. ৮৭০, কলাম, ত্ব ৩৫)
বোঝা গেল, আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও ‘হিলাল’কে অমাবস্যার পর প্রকাশ পাওয়া দর্শনযোগ্য চাঁদ -এর অর্থেই ব্যবহার করেন। ইংরেজী জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যেভাবে ‘নিউমুন’কে এর আভিধানিক অর্থের বাইরে অন্য একটি অর্থের জন্য পরিভাষার রূপ দিয়েছেন, আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ এ ধরনের কাজ করেননি। রবং তাদের শাস্ত্রীয় পরিভাষাতেও হিলাল হচ্ছে অমাবস্যা-পরবর্তী সাধারণ দৃষ্টিতে দৃশ্যমান উদিত চাঁদ।
মুহতারাম ইঞ্জিনিয়ার সাহেব! একটি সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ এবং অনুসৃত ও সর্বজনগ্রাহ্য ও সর্ববাদীসম্মত বিষয়ে এতগুলো রেফারেন্স শুধু আপনার স্বার্থেই দেওয়া হল। সাধারণ পাঠকগণ হয়ত নারায হচ্ছেন যে, প্রবন্ধকার কী তামাশা শুরু করেছেন। জানা এবং স্পষ্ট একটি বিষয়ে এত হাওয়ালা উল্লেখ করার কী প্রয়োজন ছিল? তারপরও আপনার জন্য আমি এরূপটি করলাম। আশা করি, সত্যানুসন্ধানের চেতনা নিয়ে যদি চিন্ত-ভাবনা করেন তাহলে আল্লাহ তাআলা আপনাকে সত্য উপলব্ধি করার এবং হককে কবুল করার তাওফীক দান করবেন। (হিলালের বিকৃতি বিষয়ের বাকী আলোচনা আগামী সংখ্যায়)
[চলবে ইনশাআল্লাহ]
[1] দেখুন, الموسوعة العربية العالمية (Global Arabic Encyclopedia) খণ্ড ১৮, পৃষ্ঠা ৩২৬-৩২৭, দ্বিতীয় সংস্কারণ, প্রবন্ধ القمر
আরো দেখুন, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ১৪১-১৪২, প্রফেসর এ. এম. এম. আবদুর রহমান (অব.) বি. এস-সি (অনার্স, লন্ডন), এ. আর. সি এস. (লন্ডন) এম. এস-সি (ঢাকা) প্রাক্তন প্রফেসর, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। তিতাস পাবলিকেশন্স, ৩৮ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
[2] “When the moon is between the sun and the earth its sunlit side_the far side_ is turned away from the earth, Astronomers call this darkened phase of the moon a new moon.” The World book Encyclopedia, Vol- 13, P. 646h, World book- child craft international, Inc, © 1982 USA. & © 2005, Vol- 13, P. 784 .
[3]এমনও হতে পারে যে, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ঐ অভিমতদাতাদের সামনে বইয়ের সেই কপিই কেবল পেশ করেছেন, যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিলো ৬৬। যাতে বিকৃতি ও অসংলগ্ন কথাবার্তা অনেক কম ছিলো। কিন্তু পরবর্তী প্রতিটি সংস্করণে তিনি ঐ অভিমতগুলো ব্যবহার করেছেন!
[4] ইবনুল হুমামের ভাষায়: والمفهوم المتبادر منه الرؤية عند عشية آخر كل شهر، عند الصحابة التابعين ومن بعدهم (ফাতহুল কদীর, খ. ২ পৃ. ৩১৩, পরিচ্ছদ: চাঁদ দেখা প্রসঙ্গ।)