মসজিদে হারামের দুর্ঘটনা : আল্লাহ! আমাদের ক্ষমা করুন
গত ১১ সেপ্টেম্বর মসজিদে হারামে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে এ দুর্ঘটনায় ১০৭ জন নিহত ও ২৩৮ জন আহত হয়েছেন। যারা মারা গেছেন আল্লাহ তাদের শাহাদাতের মাকাম দান করুন এবং মাগফিরাত নসীব করুন। আর যারা আহত হয়েছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁদের পূর্ণ সুস্থতা দান করুন। সকলের পরিবার-পরিজনকে সবরে জামীলের তাওফীক নসীব করুন। আর আমাদের সকলকে এই ঘটনা থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণের তাওফীক দান করুন।
এই ঘটনা এবং এ ধরনের ঘটনা নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক তবে এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, এগুলো আমাদের জন্য অনেক বড় হুঁশিয়ারী। হায়! আমরা যদি তা উপলব্ধি করতে পারতাম।
মসজিদে হারামে ঘটে যাওয়া এ ঘটনার এক মূল্যায়ন হচ্ছে, যারা হতাহত হয়েছেন তাদের দিক থেকে। আরেক মূল্যায়ন, আমরা যারা আপাত দৃষ্টিতে এ থেকে মুক্ত রয়েছি তাদের দিক থেকে।
যারা হতাহত হয়েছেন তাদের বিষয়ে আমরা আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের প্রত্যাশা করি। কারণ কুরআন মাজীদের ইরশাদ-
(তরজমা) “... এবং কেউ আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যে নিজ গৃহ থেকে মুহাজির হয়ে বের হলে এবং তার মৃত্যু ঘটলে তার পুরস্কারের ভার আল্লাহর উপর। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” -সূরা নিসা (৪) :১০০
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি আরাফার ময়দানে উকুফরত ছিলেন। হঠাৎ সওয়ারী থেকে পড়ে তার ঘাড় ভেঙ্গে গেল। (এতে তিনি মৃত্যু বরণ করলেন) তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
اغسلوه بماء وسدر، وكفنوه في ثوبين، ولا تمسوه طيبا، ولا تخمروا رأسه، ولا تحنطوه، فإن الله يبعثه يوم القيامة ملبيا.
“তাকে পানি ও বড়ই পাতা দিয়ে গোসল দাও এবং দুই কাপড়ে কাফন দাও। ওকে সুগন্ধী দিও না, মাথা ঢেকো না। কারণ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় ওঠাবেন।” -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৫০
আর আমাদের জন্য এ ঘটনার প্রথম শিক্ষা হচ্ছে, মৃত্যুর স্মরণ। যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় যে কারো মৃত্যু হতে পারে। সুতরাং মৃত্যুকে দূরে মনে করে গাফিল থাকার অবকাশ নেই। কুরআন মাজীদের ইরশাদ-
أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ مُشَيَّدَةٍ
“তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই। এমনকি সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করলেও।” -সূরা নিসা (৪) :৭৮
দ্বিতীয় শিক্ষা, তাওবা-ইস্তিগফার ও আল্লাহর দিকে রুজু করা। কুরআন মাজীদের ইরশাদ-
وَمَا أَرْسَلْنَا فِي قَرْيَةٍ مِنْ نَبِيٍّ إِلَّا أَخَذْنَا أَهْلَهَا بِالْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ لَعَلَّهُمْ يَضَّرَّعُونَ
“আমি যে-কোনও জনপদে নবী পাঠিয়েছি, তার অধিবাসীদের অবশ্যই অর্থ-সংকট ও দুঃখ-কষ্টে আক্রান্ত করেছি, যাতে তারা বিনয় অবলম্বন করে” -সূরা আরাফ (৭) : ৯৪
এসকল ঘটনায় সতর্ক না হওয়া এবং আল্লাহর দিকে রুজু না করা হচ্ছে ঐ নিন্দিত বৈশিষ্ট্য, কুরআন মাজীদে যাকে ‘হৃদয়ের কাঠিন্য’ ও ‘শয়তানের মন্ত্রণা-প্রসূত’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে-
فَلَوْلَا إِذْ جَاءَهُمْ بَأْسُنَا تَضَرَّعُوا وَلَكِنْ قَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“অতপর যখন তাদের কাছে আমার পক্ষ হতে সংকট এল তখন তারা কেন নম্রতা ও রোনাযারী অবলম্বন করল না। বরং তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেল এবং তারা যা করছিল শয়তান তাদের বোঝাল যে, সেটাই উত্তম কাজ।” -সূরা আনআম (৬) : ৪৩
এই ঘটনার পর একশ্রেণির ‘অসুস্থ’ মানুষের পক্ষ হতে যেসকল বিভ্রান্তিকর কথা আসছে, তা এই নিন্দিত প্রবণতার মধ্যেই পড়ে। যেমন, মসজিদে হারাম তো নিরাপদ জায়গা, এখানে এ দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল? যখন প্রয়োজন তাওবা-ইস্তিগফার এবং আপন কর্ম ও বিশ্বাসের মুহাসাবা ঐ সময় এজাতীয় তর্কে জড়িয়ে পড়া শয়তানের ওয়াসওয়াসা ছাড়া আর কিছুই না। এভাবে সময়ের মূল করণীয় থেকে শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
অথচ কুরআন-সুন্নাহর সাধারণ ধারণাও যার রয়েছে তার পক্ষেও এই সময় এধরনের অসার প্রশ্ন অতি পীড়াদায়ক হওয়ার কথা। অবশ্যই কা‘বা ও মসজিদে হারাম নিরাপদ স্থান। কিন্তু এর অর্থ মোটেও এই নয় যে, কোনো রকমের ব্যতিক্রমি ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাও ওখানে ঘটবে না। এমন কথা তো কুরআন-সুন্নাহর কোথাও বলা হয়নি। বহুবার কা‘বা ও মসজিদে হারাম বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছে, পানির ঢলে, অগ্নিকাণ্ডে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন সময় নাফরমান লোকেরা এই স্থানের নিরাপত্তার বিধান লঙ্ঘন করে এখানে রক্তপাত ঘটিয়েছে। আর এ ধরনের ঘটনা ইসলাম-পূর্ব যুগেও ঘটেছে, ইসলাম-পরবর্তী যুগেও ঘটেছে, কিন্তু কুরআন নাযিলের যুগের কোনো কাফেরও কুরআনের এই ঘোষণাকে ঐসকল ঘটনার সাথে সাংঘর্ষিক মনে করেনি। অথচ সাংঘর্ষিক যদি হত তাহলে খুব সহজেই তারা একে কুরআনের বিরুদ্ধে, আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে দলীল হিসেবে ব্যবহার করত।
এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা অন্য ফুরসতে করা যাবে, আপাতত আমাদের নিবেদন শুধু এইটুকু যে, এই হৃদয়বিদারক ঘটনার সময় এজাতীয় কূটতর্কের অবতারণা- হয় জাহালত-অজ্ঞতা, না হয় ইলহাদ ও মুনাফিকি। এই সময় আল্লাহর দিকে রুজু না করে এজাতীয় অসার তর্কে লিপ্ত হওয়াও এক প্রকারের আযাব। যারা হতাহত হয়েছেন তাদের সম্পর্কে তো আমরা মাগফিরাতের প্রত্যাশা করি। কিন্তু যারা এই ঘটনাকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর উপায় বানায় তাদের ব্যাপারে কঠিন শাস্তির আশঙ্কা করি। আল্লাহ তাদের হেদায়েত দান করুন।
তৃতীয় শিক্ষা এই যে, মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় কেন্দ্রে এই দুর্ঘটনা উম্মাহর জন্য অনেক বড় হুঁশিয়ারি। মুসলিমমাত্রই এই দুর্ঘনার দ্বারা আক্রান্ত। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য, এই ঘটনার বার্তা উপলব্ধি করা এবং কুরআন-সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারী হওয়া, বিশেষত হজ্ব-ওমরার সফরকে ছোট-বড় সব রকমের নাফরমানী থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা।
এছাড়া এ ঘটনায় অনেক ইতিবাচক বিষয়ও রয়েছে। এত বড় দুর্ঘটনার পরও যেভাবে জুমায়, জামাতে মসজিদে হারাম কানায় কানায় পূর্ণ ছিল তা এক অপূর্ব বিষয়। এভাবেই যুগে যুগে বহু রক্তক্ষয়ী দুর্ঘটনার পরও কা‘বা ও মসজিদে হারাম অভিমুখে মুমিনের মিছিল এক লমহার জন্যও বন্ধ হয়নি। নিঃসন্দেহে এ এক নযীরবিহীন বিষয়।
দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে, মক্কা-মদীনার খিদমতে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের আন্তরিকতা। এর দ্বারা হয়তো স্বজন-আপনজনের ক্ষত একেবারে শুকিয়ে যাবে না, কিন্তু একটি শীতল প্রলেপ তো অবশ্যই পড়বে। দুর্ঘটনা বিভিন্ন জায়গায় ঘটছে, বিভিন্নভাবে ঘটছে, কিন্তু এই সেবা ও আন্তরিকতার নযীরও এই সময়ে খুব বেশি দেখা যায় না।
শেষ কথা এই যে, আল্লাহ আমাদের অভিভাবক, তাঁরই ইচ্ছায় সব ঘটে। তিনি আমাদের বিভিন্নভাবে সতর্ক করেন, যেন আমরা মৃত্যুর আগেই তাঁর দিকে রুজু করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন।