তুরস্কে, তুর্কিস্তানের সন্ধানে-১২
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
***
বিমানে তোমার পাশের আসনে যিনি বসেন তার সঙ্গে যদি তোমার ভালো-মন্দ কোন অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় সেটা উল্লেখ করা সফরনামার প্রচলিত রীতির মধ্যেই পড়ে। বিশেষ করে বাংলা ও উর্দূভাষার বিখ্যাত সফরনামাগুলোতে এর প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। আল্লামা আলী নাদাবী রহ, তাঁর তুরস্কের সংক্ষিপ্ত সফরনামায় ট্রেনের সহযাত্রীদের কথা বেশ দরদের সঙ্গে লিখেছেন। আরো আগে আল্লামা সৈয়দ সোলায়মান নাদাবী রহ, তাঁর ইউরোপযাত্রায় পানির জাহাযের সফরসঙ্গীদের কথা লিখেছেন এবং তাতে রয়েছে শিক্ষার যথেষ্ট উপাদান। হাঁ, এটাই হলো মূল কথা; পাঠকের জন্য যদি থাকে শিক্ষার বিষয় তাহলে অবশ্যই তা সফরনামার অন্তর্গত হতে পারে, হওয়া সঙ্গত।
তো আমি যদি ইস্তাম্বুল থেকে নয়াদিল্লীর পথে বিমানযাত্রায় যাকে আমার পাশের আসনে সহযাত্রীরূপে পেয়েছিলাম তার কথা উল্লেখ করি, আশা করি তা সফরনামার স্বীকৃত ধারা থেকে বিচ্যুতি বলে গণ্য হবে না। এমন স্বাস্থ্যবান একটি ভ‚মিকা এজন্য তৈরী করতে হলো যে, আমার প্রিয় মাওলানা আব্দুল মালেক আমাকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন, আর তাঁর কথার মধ্যে কিছু যে যুক্তি নেই তাও নয়। তাই মাঝেমধ্যে আমারও আফসোস হয় যে, আমার লেখার যারা প্রধান পাঠক সম্ভবত তাদের সাহিত্যরুচির সঙ্গে নিজেকে আমি পুরোপুরি খাপখাইয়ে চলতে পারি না। যাক, যা বলার ইচ্ছা করেছি সেটা বরং বলেই ফেলি। আমার পাশের আসনে যিনি বসলেন দু’টি সন্তানসহ, একটি ছেলে একটি মেয়ে, তিনি ভারতের মধ্যপ্রদেশের মধ্যবয়সের এক মহিলা। যথেষ্ট ভদ্র এবং মনে হলো সম্ভ্রান্ত। উর্দূ বা হিন্দি, বলেন ভাঙ্গা ভাঙ্গা, তার চেয়ে ইংরেজিটা যথেষ্ট ভালো। তিনি থাকেন তার কর্মস্থল কানাডায়, স্বামী থাকেন ইস্তাম্বুলে নিজের কর্মক্ষেত্রে। এ ধরনের ঘটনা আগে শুনেছি, আজ দেখলাম, পরে অবশ্য এরূপ একটি পরিবারের সঙ্গে আমরা পারিবারিকভাবেই পরিচিত হয়েছি। বড় অদ্ভুত তাদের কষ্টের জীবন। এমন জীবন তারা স্বেচ্ছায় কেন গ্রহণ করেন, আল্লাহই ভালো জানেন। আমরা মাদরাসার ‘পিছিয়ে থাকা’ মানুষগুলো আল্লাহর রহমতে এখনো জীবনের অনেক জটিলতা থেকে মুক্ত আছি, তবে দুঃখের কথা, এ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে শোকরের অনুভ‚তি কম।
আগের কথায় ফিরে আসি, ভদ্রমহিলা কানাডা থেকে ইস্তাম্বুলে এসে কয়েকদিন ছিলেন স্বামীর সঙ্গে। মাঝেমধ্যেই আসেন, ভদ্রলোকও কানাডায় যান, তবে খুব কম। ‘তবে খুব কম’ কথাটা যে সুরে ও স্বরে ভদ্রমহিলা উচ্চারণ করলেন তাতে কষ্টের অনুভ‚তি ছিলো বলেই আমার মনে হলো। যাক, তিনি এখন চলেছেন দেশে ‘সুস্রাল’ ও ‘মাইকে’[1] ভাগাভাগি করে সময়যাপনের জন্য। সেখান থেকে চলে যাবেন কানাডায়, যেখানে তিনি কাজ করেন কম্পিউটার প্রকৌশলীরূপে।
তিনি বসলেন, আর আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। কারণ তিনি নিজে বসেছেন আমার পাশের আসনে, আর বাচ্চাদু’টিকে বসিয়েছেন ওপাশে। ওরা ততক্ষণে লেপটপ খুলে ডুবে গেছে গেমস-এর জগতে। এটা তো শুধু আকাশ্লযাত্রার বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিশ্ব বলুন, কিংবা মুসলিমবিশ্ব, আধুনিক সমাজের খুব কম পরিবারই তা থেকে মুক্ত। আমাদের শিশুপ্রজন্ম, এমনকি যুবপ্রজন্ম আজ কোথায় চলেছে সে সম্পর্কে কারো কোন চিন্তাই যেন নেই। আসলে চিন্তা থাকলেও এ সর্বগ্রাসী পরিস্থিতির মুখে করারও কিছু নেই। সবকিছুর পিছনে কাজ করছে ইহুদি দেমাগ এবং তাদের জাতিগত অর্থলোলুপতা।
যাক, আমি বাচ্চাদু’টিকে প্রসঙ্গ করে বললাম, ‘কিতনে পেয়ারে ব্যচ্চে হ্যাঁয় আপকে, ইধ্যর বিঠাইয়ে না, য্যরা পেয়ার করোঁ। তিনি ‘যরূর, যরূর’ বলে বাচ্চা দু’টিকে এ পাশে বসালেন, আমারও অস্বস্তি দূর হলো। তবে বিব্রত হলাম একটু পরে যখন তিনি কিছুটা ক্ষণœ স্বরে বললেন, দেখিয়ে মুন্সিজী, আপনে এ্যয়সা কিউঁ কিয়া ম্যঁয় সমঝ স্যকতী হূঁ। আমাদের ধর্মে না হয় ছুত অচ্ছুতের মু‘আমালা আছে, কিন্তু নারীদের প্রতি আপনাদের ধর্মে এমন অনুদারতা কেন?
এরূপ ভারিক্কি প্রশ্নে প্রথমটায় আমি তো ভড়কেই গেলাম। পরে একটু হালকা স্বরে বললাম, ‘কাফি হূঁশিয়ার ল্যগতী হ্যাঁয় আপ।’ কিন্তু এর দায়ভার তো আমার নয়, ‘ভগওয়ান কা হ্যয়, যব মুলাকাত হোগী উনসে পূছ লিজিয়েগা।’
এরপর সংক্ষেপে যে আলোচনা হলো, তাতে তিনি স্বীকার করলেন যে, বাস্তবেই নারীপুরুষের সুস্থ জীবনের জন্য পর্দার প্রয়োজন রয়েছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিশ্বব্যাপী আগ্রাসনের মুখে এখনো মুসলিম সমাজ কিছুটা সুরক্ষার মধ্যে রয়েছে, শুধু পর্দার কল্যাণে।
অথচ এই ভদ্রমহিলা প্রথমেই আমাকে কাবু করতে চেয়েছিলেন একথা বলে যে, পর্দা নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে কানাডায় মুসলিম সমাজ এখন কত বেকায়দায় পড়েছে!
মাঝখানে ভদ্রমহিলা যে কথাটি বললেন তাতে অবশ্য আমার লজ্জার কোন শেষ ছিলো না। কানাডায় তার সহকর্মী এক ইন্ডিয়ান মুসলিমকে তিনি কিছু ধার দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা পরিশোধ তো করেনই নি, বরং একে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে বেশ তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে।
আমার মনে পড়ে গেলো, কোরআনের আয়াত, যাতে বলা হয়েছে, তোমরা ওয়াদা রক্ষা করো, ওয়াদা ভঙ্গ করো না।
বলতে চেষ্টা করলাম, আপনি মুসলিমকে না দেখে ইসলামকে দেখুন। যদি আপনার মনে হয়, এটাই ছহী দ্বীন, তাহলে গ্রহণ করুন এবং আদর্শ মুসলিম হওয়ার চেষ্টা করুন।
এর মধ্যে ভদ্রমহিলার ঘুম পেয়ে গেলো, আমিও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ধর্ম সম্পর্কে কোন অমুসলিমের সঙ্গে এটাই আমার জীবনের একমাত্র আলোচনা। তাতে বেশ উপলব্ধি হলো যে, আজকের মুসলিম সমাজের বাস্তবতায় কত কঠিন এ আলোচনা!
***
বিমান চলছে রাতের আকাশে অন্ধকার ভেদ করে, হয়ত আলোর উদ্দেশ্যে। বিমানের বাইরে যেমন অন্ধকার, ভিতরেও তেমনি অন্ধকার। একটু আগে রাতের খাবার হয়েছে, এখন সব আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। অবশ্য আমি নিজের আলোটা জ্বালিয়ে নিতে পারি। কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছে না; পাশের যাত্রীর ঘুমের তাতে কিছু না কিছু ব্যাঘাত হয়। পুরো বিমানে, মনে হলো আমি ছাড়া কেউ জেগে নেই। জানি না, এখন আমরা তুরস্কের আকাশে, না অন্য দেশের। ইস্তাম্বুল ছেড়ে এসেছি, কিন্তু আসলেই কি ছেড়ে আসতে পেরেছি!! এমন করে মনে পড়ছে কেন তাহলে ইস্তাম্বুল?! মাত্র তো দু’দিনের সামান্য কিছু স্মৃতি! কিন্তু মনে হচ্ছে কত দিন যেন ছিলাম ইস্তাম্বুলের বুকে, প্রিয় ইস্তাম্বুলের উষ্ণ সান্নিধ্যে!! যেন কত দিনের কত মধুর স্মৃতি লালন করছি বুকের মধ্যে!! হঠাৎ মনে হলো, আমার বুকের মধ্যে এখন ইস্তাম্বুলের জন্য যেমন হাহাকার, তেমনি ইস্তাম্বুলের বুকের মধ্যেও রয়েছে এক অন্তহীন হাহাকার!! মুসলিম উম্মাহর কী বিশাল ও গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী ছিলো সুপ্রাচীন এই শহর ইস্তাম্বুল!! আর আজ আধুনিকতার বিপুল আলো ও চাকচিক্যের মধ্যেও মনে হয় কত নিঃস্ব!! সব হারিয়ে যেন এক কাঙ্গাল!! সুলতানদের প্রতিটি প্রাসাদ এবং তাঁদের তৈরী প্রতিটি মসজিদ যেন অতীতের একটি করে দীর্ঘশ্বাস!! যখন ইস্তাম্বুলে ছিলাম, এমন মনে হয়নি। গৌরবের অনুভব ছিলো এবং ছিলো বেদনার অনুভ‚তি, কিন্তু হাহাকার ছিলো না। এখন রাতের আকাশে বিমানের এই যাত্রাপথে অন্ধকারের মধ্যে বসে বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা হাহাকার! আর তাতেই যেন অনুভব করতে পারছি আমার প্রিয় ইস্তাম্বুলেরও বুকের হাহাকার!!
***
মধ্যরাতের কিছু পর আল্লাহর রহমতে বিমান নিরাপদে নয়াদিল্লী বিমানবন্দরে অবতরণ করলো। ঢাকা থেকে আসার পথে আকাশ থেকে দিল্লী দেখেছি দিনের আলোতে; এবার দেখলাম রাতের আলোতে। সত্য কথা হলো, শহরটাকে তেমন আলোঝলমল মনে হলো না। আকাশ থেকে দেখা রাতের আলোঝলমল শহরকে যেমন স্বপ্নময় মনে হয়, তেমন মনে হলো না। কিছুটা যেন বিষাদগ্রস্ত!! হয়ত আমার চোখের দৃষ্টিতে ছিলো মনের চিন্তার ছাপ, কিংবা হয়ত এটা নির্মম সত্য যে, মানুষের রক্তে এবং পাশবিকতার উল্লাসে কলঙ্কিত হয় যে শহর, যে দেশ, শত আলোর ঝলকানিতেও মোছা যায় না তার বিষণœতার ছাপ। ইস্তাম্বুলের মাটি ছেড়ে বিমান যখন আকাশে উঠেছে তখন দেখেছি রাতের ইস্তাম্বুল, যাকে বলে আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া, তেমনি মনে হয়েছে আকাশ থেকে দেখা রাতের ইস্তাম্বুলকে। যেন আলোর সাজে সাজানো এক দুলহান! এখানেই পার্থক্য দু’টি শহরের। ইস্তাম্বুলে রক্ত ঝরে না, দিল্লীতে রক্ত ঝরে!!
বিমানের দরজা খোলা হলো, ভেবেছিলাম, রাতের দিল্লী শহরের হিমেল বাতাস আমাদের স্বাগত জানাবে। কিন্তু না, এবারও ব্রিজের মাধ্যমেই টার্মিনালভবনে আসতে হলো। তারাভরা আকাশের সান্নিধ্য এবং হিমেল বাতাসের স্পর্শ আর পাওয়া গেলো না।
একটি বিমানের যাত্রী তো কম নয়, কিন্তু সুপরিসর পথের কারণে মনে হয় অল্প ক’জন। তবে প্রথমবার যেমন অপরিচিত লেগেছে এখন তেমন লাগলো না। হাঁটতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হলো। মাঝামাঝি এসে আভ্যন্তরীণ যাত্রীরা নীচে নেমে যেতে লাগলো।
হযরত মাওলানা আরশাদ মাদানী, হযরত মাওলানা সালিম কাসিমী ও অন্যাদের নেমে যেতে দেখলাম। যেমনই হোক, দাঙ্গাগোলযোগ যাই হোক, যত রক্তগঙ্গাই প্রবাহিত হোক, এটা তাঁদের স্বদেশ। যেখানে যাবেন এখানেই আবার ফিরে আসবেন। মীরাটে রক্ত ঝরবে, গুজরাটে গণহত্যা সঙ্ঘটিত হবে[2] তার মধ্যেও মুসলমান বেঁচে থাকবে হিন্দুস্তানে এবং কাশ্মীরে। হযরত সাঈদ আ‘যামী ছাহেব এলেন সবার পরে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন, ছহী সালামাতের সঙ্গে যেন দেশে পৌঁছতে পারি, দু‘আ করলেন, আর বললেন, সুলতান যাওক ছাহেবকে আমার সালাম বলবেন।
যতক্ষণ দেখা যায় দেখে থাকলাম। মনের ভিতরটা কেমন যেন হু হু করে উঠলো। মনে হলো, এমন প্রিয় মানুষগুলো যেন চিরকালের জন্য হারিয়ে গেলো। নিজেকে তখন কেমন যেন সঙ্গহীন মনে হলো। তবে যাকে বলে নিঃসঙ্গ, তা মনে হলো না। ট্রানজিট যাত্রীও সংখ্যায় কম ছিলো না, তাদের মধ্যে আবার মুসলমানও আছেন কিছু। গন্তব্য অবশ্য একেকজনের একেক দিকে, পৃথিবীটা ছোট হয়েও অনেক বড়, আবার বড় হয়েও অনেক ছোট। নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হলো না, কারণ জেগে থাকা একজন যাত্রী সালাম দিলেন, তার নিদ্রাকাতর মুখের একটুকরো হাসি, মনে হলো জান্নাত থেকে পাওয়া উপহার। তাতেই মনে হলো, নাহ, আমার পাশে আছে আমার আপন কেউ!!
***
ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়, কিন্তু এখন ঘুমিয়ে পড়া ফজরের নামাযের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই জেগে থাকার চেষ্টা করলাম। যাদের ভিতরটা জাগ্রত তারা জেগে থাকার জন্য যিকির করেন, তাসবীহ পড়েন, তিলওয়াত করেন। মুশকিল এই যে, আমাদের জন্য এগুলো হচ্ছে ঘুমের দাওয়াই। আমাদের জেগে থাকতে হলে কিছু দেখতে হয়, কিংবা কিছু পড়তে হয়। কিছুক্ষণ ট্রানজিট যাত্রীদের ঘুম দেখলাম, কারো কারো ঘুম শুনলাম। তাতে নাসিকাধ্বনি যেমন ছিলো, তেমনি ছিলো নাসিকাগর্জন; অবশ্যই দু’টোতেই জনে জনে মাত্রার তারতম্য ছিলো। দিল্লীবিমানবন্দরে সেদিন শেষরাতে বেশ ভালো একটা ‘সঙ্গীতজলসা’ই উপভোগ করা গেলো। তবে কতক্ষণ আর ভালো লাগে! মিয়াঁ তানসেনের সুরসঙ্গীত তো আর নয়! একসময় বিরক্ত হয়ে ‘বুক কর্নার’ থেকে পত্রিকা নিয়ে এলাম। দিল্লীতে উর্দূ দৈনিক একটা দু’টো নিশ্চয় প্রকাশিত হয়, কিন্তু এখানে সম্ভবত সেগুলোর প্রবেশাধিকার নেই। আছে শুধু ইংরেজি, আর হিন্দি। না, আমাকে অবাক করে দিয়ে একটি পত্রিকা চেহারা বের করলো, সংস্কৃত ভাষায়। হিন্দু ভারত যথেষ্টই এগিয়েছে বলতে হয়। সংস্কৃত ভাষায় খবর পড়তে শুনেছি আকাশবাণীতে, পত্রিকা দেখলাম এই প্রথম। ভালোই হলো, নতুন একটা অভিজ্ঞতার কথা লেখা যাবে। একবার মনে হলো, পত্রিকাটা নিয়ে নিই, কিন্তু লেখাটা চোখে পড়লো, হিন্দিতে, ‘দ্যয়া কীজিয়ে, প্যড়হ্ ক্যর আপনে ভাইকে লিয়ে র্যখ দীজিয়ে’। হয়ত কয়েক বছর পর, কথাটা সংস্কৃত ভাষায়ও লেখা থাকবে। আচ্ছা সবাই যদি আমার ভাই হয় তাহলে আমার বুকে ছুরি চালায় কারা?! জাফর হাশেমীকে আগুনে পুড়িয়ে মারে কারা?!
একটা হিন্দি পত্রিকা নিলাম, নামটা এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। ভাবছিলাম, ‘ভারত স্যমাচর’, কিন্তু ইন্টারনেটে খোঁজ নিয়ে নামটা পাওয়া গেলো না, এখন মনে হচ্ছে, নামটা ছিলো, ... যাক, নামে আর কী আসে যায়, খবরটাই হলো আসল। খুব বেশি তালাশ করতে হলো না, দু’টো খবর পেয়ে গেলাম। একটা শেষের পাতায়, একটা ভিতরের পাতায়। প্রথমটা হলো, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর জোয়ানদের গুলিতে তিনজন কাশ্মীরী আতংকবাদী নিহত’। দ্বিতীয়টা হলো, জনৈক শিবসেনার বিবৃতি, ‘মহান ভারতের বুকে নিরাপদে বাস করতে হলে মুসলমানদেরকে অবশ্যই হিন্দু সংস্কৃতি গ্রহণ করতে হবে। যমযমের পরিবর্তে গঙ্গাজল পান করতে হবে।’
মনে মনে বললাম, গঙ্গার জল তো অনেক দিন থেকেই দাবী করছি, দিচ্ছো না তো!
***
ফজরের সময় হলো, আযান শোনার সৈাভাগ্য হলো না, ঘড়ির আযানও না। যেমনই হোক, বাংলাদেশকে মনে হলো, আহা, কত ভালো দেশ! দিল্লীর সঙ্গে ঢাকার সময়ের ব্যবধান কত? একটু আগে নিশ্চয় পুরো ঢাকা জেগে উঠেছে আযানের সুমধুর ধ্বনিতে!
আমরা জামাতের জন্য প্রস্তুত হলাম এবং ভালো লাগলো, দু’জন মুসাফির ভাই আমাদের সঙ্গে জামাতে শরীক হলেন। কোন্ দেশে বাড়ী, কোন্ ভাষায় কথা বলেন, কিছুই জানা গেলো না। কিন্তু মনে হলো, কত যেন আপন! সালামের পর মুছাফাহা করলেন হাসিমুখে। ভাষার সাহায্য নিলেন না, উপায়ও নেই। শুধু মুখের হাসিটুকুর মাধ্যমে অন্তরের ভালোবাসাটুকু যেন আমাদের উপহার দিলেন। প্রতিউত্তরে আমাদের কাছেও মুখের হাসি ছাড়া আর কিছু ছিলো না। ভুল বললাম, সঙ্গে ছিলো মুছাফাহার দু’আ। বললামÑ
يغفر الله لنا ولكم
***
মুসাফির, সঙ্গে আছে ঘোড়া, বেচারা তাহলে ঘোমাবে কীভাবে, ঘোড়াটা যদি চুরি হয়ে যায়! লোকটা সম্ভবত পাঠান ছিলো। তাই পাঠানগোছেরই একটা বুদ্ধি বের করলো। ঘোড়াটা বিক্রি করে নিশ্চিন্ত একটা ঘুম দিলো। ঘুম থেকে উঠে আবার একটা কিনে নিলেই হলো। সেই থেকে উর্দূতে কথাটা চালু হয়েছে, ‘ঘোড়া বেচক্যর সো জানা’; ঘোড়া বেচে ঘুম দেয়া। আমাদের সঙ্গে ঘোড়া ছিলো না; তারপরো তিনজনে মিলে একটা ‘ঘোড়াবেচা’ ঘুম দিলাম। চোখ মেললাম একেবারে এগারটার দিকে, আমীর সাহেবের ডাকে। চোখ খুলে দেখি, কোমল চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটি! হিন্দু-বাবুর হাতে চড় খাওয়া সেদিনের সেই ‘অচ্ছুত’ মেয়েটি!! কালো মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠলো। সামান্য সদাচারের কী আশ্চর্য সুফল! কালকে নাকি আমাদের খোঁজ করেছে, না পেয়ে ভেবেছে, আর হয়ত দেখা হলো না। আজ আমাদেরকে ঘুমের মধ্যে দেখে বহুত খুশি হয়েছে। একটু পরে পরে এসে দেখে যাচ্ছে, আর ‘অপেক্সা’ করছে, কখন আমরা জাগবো! আমরাও খুশী হলাম এবং তাকে খুশী করলাম। বিশাল ভারত সত্যি আজ ব্যাকুলভাবে ‘অপেক্ষা’ করছে। কবে আসবে সেই মুসলমান?!
***
যোহরের নামায পড়ে প্রস্তুত হলাম। জেট এয়ারের কাউন্টারে যোগাযোগ করলাম। এতগুলো টাকার টিকেট, বিনিময়ে একটা কৃত্রিম হাসিও কি আমাদের প্রাপ্য ছিলো না! কিন্তু ‘তালেবানি’ লেবাসের যাকাত এখানেও আদায় করতে হলো। তবে এতেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো যে, তাচ্ছিল্য ছাড়া আর কোন বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়নি। মনের মধ্যে কিন্তু একটা আশঙ্কার কাঁটা খচখচ করে বিঁধছিলো। যাক আল্লাহ মেহেরবান।
একটু এগিয়ে চেকিংয়ের সম্মুখীন হলাম। এটা অবশ্য স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক যেটা সেটা হলো, এবার দাদাবাবুরা পায়ের জুতা পর্যন্ত খুলিয়ে ছাড়লেন। দেহতল্লাসীটা এমনভাবে করলেন যে ....। লক্ষ্য করলাম, আমাদের সামনের, বা পিছনের অন্য যাত্রীর সঙ্গে এমন দৃষ্টিকটু আচরণ করা হচ্ছে কি না; নাহ, এটা শুধু আমাদেরই কপালে ছিলো। চেকিংয়ের ধকলটা শেষ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ডান দিকে দীর্ঘ পথ পার হলাম। ডিউটি ফ্রি এলাকাটা বেশ জমজমাট। মনে হলো, ‘নেই’ এমন কোন জিনিস নেই। আমীর সাহেব নিজের জন্য যেমন কিছু নিলেন, তেমনি আমার জন্যও চকোলেট নিলেন। সামান্য কিছু চকোলেট, কিন্তু চমকদার কাগজের তৈরী ব্যাগটা হলো ইয়া বড় এবং খুবসূরাত! চকোলেট পেয়ে নাতি খুশী, আর তার চেয়ে বেশী খুশী ওর মা ব্যাগটা পেয়ে।
শুধু দিল্লী বিমানবন্দরে আসা-যাওয়ার পথে যা দেখলাম তাতেই আমার বুঝ হয়ে গেলো যে, দাদাবাবুরা সত্যি বেনিয়ার জাত। বাণিজ্য করতে জানে বটে! ঢাকা বিমানবন্দরে কখনো মনে হয়নি, ‘বাঙ্গালী’ ব্যবসা জানে।
সফরনামা কত সংক্ষেপে লেখা যায়, এবার তার ছোট্ট একটা মহড়া দিতে ইচ্ছে করছে; ‘বিকেল তিনটার দিকে আল্লাহর রহমতে নিরাপদে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম এবং মাগরিবের পর ছহী সালামতে মাদরাসায় এসে পৌঁছলাম।’
বিদায় হে প্রিয় পাঠক! আমি তোমার জন্য আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ রহমত কামনা করি, তুমিও আমার জন্য যা ভালো মনে করো, দু‘আ করো। এটা আমার অনুরোধ নয়, মিনতি! আমাকে এবং আমার সমস্ত পাঠককে প্রতিটি কল্যাণের জন্য তুমি কবুল করো হে আল্লাহ!
[1] সুস্রাল, শশুরালয়, মাইকে, পিত্রালয়। উর্দূ ও হিন্দি দু’টোতেই ব্যবহৃত।
[2] এ সফরনামা যখন লিখছি, তখন গুজরাটে মুসলিম গণহত্যার প্রধান অপরাধী নরেন্দ্র দামাদোর মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসন ‘অলঙ্কৃত’ করে বসে আছেন! মুসলিম রক্তের হোলিখেলার সর্বোত্তম পুরস্কারই পেয়েছেন মোদি সাহেব, ভারতের ‘উদার’ গণতন্ত্রের কাছে। তার চেয়ে বড় কথা, গুজরাটের গণহত্যার অপরাধে, যে মুখ্যমন্ত্রী মোদির জন্য আমেরিকার ভিসা নিষিদ্ধ ছিলো, সেই মোদি এখন আমেরিকার পরম প্রিয়জন। ‘মুসলিম রক্তের ধারক’ বারাক হোসেন ওবামা সম্প্রতি ভারত সফরে এসে একসময় তারই দেশকর্তৃক ঘোষিত সন্ত্রাসীকে আলিঙ্গন করে গিয়েছেন। রাজনীতি এবং ক‚টনীতি সত্যি বড় আজব চিড়িয়া! এখানে সত্য-মিথ্যা এবং ন্যায়-অন্যায় নির্ধারিত হয় বিবেক দ্বারা নয়, স্বার্থ দ্বারা, প্রয়োজন দ্বারা।