Shawal 1436   ||   August 2015

প্রতিবেশী : আনুগত্যের জোয়ার

Waris Rabbani

ভারত থেকে মোদি সাহেব এসেছিলেন গত জুন মাসে। তার আগমনে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিল আনন্দে। ভারতপন্থী আর ভারতবিরোধী সব একাকার হয়ে গিয়েছিল বন্দনায়। ভাবখানা ছিল এমন যে মোদি সাহেবের হাঁটুর কাছে বসে একটু ঝাড়ফুক নিতে পারলে মসনদের কপাল প্রশস্ত হয়ে যাবে। মোদি সাহেবের মুচকি মুচকি হাসির ছবি তখন পত্রিকায় দেখেছি। তিনি কি লজ্জা লজ্জা পাচ্ছিলেন? আমরা জানতে পারিনি, গুজরাটের কসাইখ্যাত, মুসলিম রক্তপাতের মহান এই নায়ক আমাদের ক্ষমতাভিক্ষুকদের দৃষ্টিকটু তোষামোদে আসলেই বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন কি না?

তিনি নারাজ হলে কিংবা বিব্রত হলে তো বড় মুশকিল ছিল। মস্ত বড় মেহমান। মহান ভারতের কর্ণধার। সাত রাজত্বের রাজা। তাকে যদি ঠিকমতো খুশি না করা যায় তাহলে আমাদের দেশ চলবে কীভাবে! তার বদান্যতার শরীর। মুখ ফুটে কোনো কষ্টের কথা বলে যাননি। আমরা বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। যদিও তার দরজাবন্ধ বৈঠকগুলোর ফিসফাস নিয়ে বাইরে অনেক ফোঁসফাস হয়েছে। আমাদের মতো চৌদ্দপুরুষের নিরীহ জনতা তাতেও এটা বুঝতে পেরেছি যে, মোদিবাবু বড়ই লাজুক মানুষ।

মোদি সাহেবের এই মহান ভদ্রতার উত্তর আমরাও সাধ্যমতো দিয়েছি। তার আগমনে ভেতরে ভেতরে তো আমরা আনন্দে আটখানাই ছিলাম। মুখে সবকথা বলতে পারিনি। কিন্তু সেসব না-বলা কথা বলার জন্য কয়েকজনকে যেন আমরা দায়িত্ব দিয়েই রেখেছিলাম। তারা সে দায়িত্ব উঁচু কণ্ঠেই পালন করেছেন। না, তাদেরকে আপনি কিছুতেই দোষ দিতে পারেন না। বুক ফাটে তো মুখ ফুটে নার অপবাদ দিলে তাদের প্রতি বড় বে-ইনসাফিই হবে।

আমাদের একজন করিৎকর্মা সংখ্যালঘু নেতা আছেন। নানান কর্মে তিনি নিজেকে চিনিয়ে রেখেছেন। গত ৪জুন শুক্রবার তিনি রাজধানীর কাকরাইলে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, বাংলাদেশের মাটিতে ভারত-বিরোধীদের ঠাঁই নেই। সেদিন তিনি আরো বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৭১ সালের সম্পর্ক কায়েমের দিকে যেতে চাইছে। এ সম্পর্ক  উভয় দেশের স্বার্থের, সম্মানের। ওই বক্তব্যে ভারতের সরকার ও জনগণকে সাধুবাদ জানিয়ে ভেতরের গদগদ-আনুগত্যের মহান অভিব্যক্তি তিনি তুলে ধরেছেন। তার মাঝে কোনো লুকোছাপা ছিল না। এই সাহসী নেতা অবশ্য অতীতেও কখনই লাজ-শরম নিয়ে ভীত হননি। তিনি রাষ্ট্রধর্ম, বিসমিল্লাহ কিংবা হেফাযতের ইসলামী অগ্রযাত্রা নিয়ে মুখ ভেংচিয়ে কথাবলায় কখনই দ্বিধা-সংকোচে ভোগেননি। বড় সোজাসাপ্টা মানুষ!

আমরা এই সোজাসাপ্টা নিরীহ মানুষটাকে নিয়ে খুবই আগ্রহ পোষণ করি। আমাদের ধারণা ছিল, প্রতিবেশী মহান দেশটির প্রতি আনুগত্যের ক্ষেত্রে তার চেয়ে পরিষ্কার কথাবার্তা ও কাজকর্মে আর কেউ যেতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের এই ধারণা এর দুদিন পরই ভেঙে গেল। তার চেয়েও এক কাঠি সরেস আরেকজনকে পাওয়া গেল। আসলে জাতির পক্ষ থেকে দায়িত্ব বলে কথা। মহান ভারত আর তার কর্ণধার মহাত্মন মোদির চরণতলে কিছু নির্ভেজাল দাসত্বের কথা নিবেদন করার মতো যোগ্য লোক তো আমাদের দরকার। সে দরকারি কাজটিই তিনি করেছেন বুক ফুলিয়ে।

গত ৬ জুন ভারতের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিষয়ক এক চুক্তিস্বাক্ষর অনুষ্ঠানে একজন নেতা বলেছেন, গত ৪০ বছরে যে দ্বিধাদ্বেদ্বর মধ্যে একটা সীমারেখা ছিল, আমি মনে করি ধীরে ধীরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এখন তা উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। আমরা এখন সবাই একই রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছি। ভারত মাতার একজন অনুগত হিসেবে তিনি এর চেয়ে আর কম কীভাবে বলেন! কী বীরত্ব! কী সাহস তার!! একই রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাওয়ার মতো এতবড় বিপ্লবী কথা বঙ্গবন্ধুও বলতে পারেননি। কেউ কেউ বলেন, সিকিমের লেন্দুপ দর্জিরাও ভারতের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মাঠে-ময়দানে এই সুরে কথা বলতে ভয় পেতেন। কিন্তু বড় একটি গোষ্ঠীর ছায়ায় বেড়ে উঠা নেতা তিনি। তাই তার এই রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বক্তব্যে কোথাও একটি পাতাও নড়েনি।

সবই কি মোদি সাহেবের কারিশমা? আমরা জানি না। এ বক্তব্য নিয়ে এ দেশের পান থেকে চুন খসা মিডিয়া কিছু বললো না। আদালতেও কোনো প্রশ্ন উঠল না। সুশীল-বাবু বুদ্ধিজীবীরা কিছু বললো না। স্বাধীনতার অতন্দ্র সেনানায়ক শাহবাগী বীরগণ কিছু বললো না। অবাক হয়ে গেলাম! না, আমি বলছি না- এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছু বলুন, বরং তার মতো কিংবদন্তিতুল্য বীরের প্রতি সম্মান তো জানানো দরকার ছিল এ   কবার। একই রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনার যে একক বিষ্ফোরণ তিনি ঘটালেন- এর একটা মূল্য আছে না! কে দেবে সেই মূল্য- অপেক্ষায় আছি! মোদি সাহেব ঠোঁটের নিচে হাসি ঝুলিয়ে চলে গেছেন বলে অন্য সবার অবদান আমাদের ভুলে যেতে হবে? একদম ঠিক না।  

 

advertisement