Rabiul Akhir 1429   ||   April 2008

জী ব ন : ছোট কেয়ামতের ‘আপন ভুবন’

Abu Tashrif

সেদিন মানুষ পালিয়ে যাবে তার ভাইয়ের কাছ থেকে, তার মায়ের কাছ থেকে, তার বাবার কাছ থেকে, তার সঙ্গিনীর কাছ থেকে এবং তার সন্তানের কাছ থেকে...। পবিত্র কুরআনের এই তাৎপর্যপূর্ণ বাণীতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কেয়ামত দিবসের চিত্র। সেদিন যে কেউ কারো পাশে দাঁড়াতে চাইবে না, সবাই আপন আপন চিন্তায় বিভোর থাকবে-এরই এক কঠোর চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে এ আয়াতে।

যদিও এ চিত্রটি মহা কেয়ামত দিবসের, কিন্তু দুনিয়াতে সংঘটিত ছোট কেয়ামতের (বড় দুর্যোগ ও বিপদ-আপদ) সময়েও মানুষের জীবনে এ কঠোর তিক্ততা সত্য হয়ে ধরা দেয়। বন্ধন ও মায়াময় পার্থিব জীবনে কেয়ামত দিবসের আপনচিন্তায় বিভোর হয়ে আপনজনদের ভুলে যাওয়ার কুরআনিক উপমাটি অনেকের কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য মনে হয়ে থাকে অনেক সময়। দুর্বল সংশয়ী মনে কৌতূহল জাগে- মানুষ কি এভাবে নিজের লোকদের ছেড়ে পালাবে আসলে! কেয়ামতের দিনে কি মানুষ এতটাই অপরিচিত ও আপনভোলা ও নিজের নিজের হয়ে যাবে! এ-ও কি সম্ভব! সেই কেয়ামত দিবসের কথা এটি। অথচ ছোট কেয়ামতেই মানুষের এ রকম রূপ ধরা পড়ে যায়। নিজের বাঁচার আকুতির সামনে তুচ্ছ হয়ে যায় নাড়ীর বন্ধন। যখন-তখন। মুহূর্তের মধ্যেই। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বুড়িগঙ্গায় বেদনাদায়ক লঞ্চ দুর্ঘটনার সময় এরকম একটি ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছে।

 

সদরঘাট থেকে ছেড়ে লঞ্চটি যখন বুড়িগঙ্গা সেতুর কাছে পৌঁছে তখনই একটি মাটিকাটা ট্রলারের ধাক্কায় লঞ্চটি টাল খেয়ে তলিয়ে যায়। এ কারণে প্রায় অর্ধশত মানুষের সলিল সমাধি ঘটে। সে দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে বেশি সংখ্যকই ছিলেন নারী ও শিশু। কোনো কোনো মানুষের গোটা পরিবারই পানিতে ডুবে মারা যায়। সর্বহারা সেসব মানুষের বুকফাটা আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে যায়। এ দুর্ঘটনায় কোনো মতে জীবনে বাঁচা এক নারী ছিলেন রীতা বেগম। তার সম্পর্কে ২৯ ফেব্রুয়ারির একটি দৈনিক রিপোর্ট করেছে- লঞ্চের যাত্রী রীতা বেগম সাঁতরে কোনো মতে জীবন বাঁচিয়েছেন। গতকাল বিকেলে সমকালের কাছে আহাজারি করতে করতে জানালেন, কোলে থাকা ১০ মাসের শিশুপুত্র রেদোয়ানকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। সে বেঁচে আছে কি না তা তিনি জানেন না। তবে তার সঙ্গে থাকা শাশুড়ি জয়নব বিবির লাশ তিনি খুঁজে পেয়েছেন। তাদের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের বালিগাঁও। সেখানেই তারা যাচ্ছিলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পাওয়া গেল, রীতা বেগমের ১০ মাসের শিশুপুত্র রেদোয়ান বেঁচে আছে। লঞ্চের অপর যাত্রী আবুল হোসেন সাঁতরে তীরে ওঠার সময় শিশুটিকে উদ্ধার করেন।

 এ রিপোর্টে রীতা বেগম নামের এক মায়ের যে ঘটনাটি উঠে এসেছে তা আসলে জীবনের ডাকে, বাঁচার আকুতিতে ব্যাকুল আর তীব্র অসহায় এক মায়ের আচরণ। এ কোনো হঠাৎ নিষ্ঠুর মায়ের গল্প নয়। মা হিসেবে তার হৃদয়েও হয়তো জগতসমান মমতা ছিল। কিন্তু অসহায়ত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেই সন্তানকে ফেলে দিয়ে নিজে সাঁতার শুরু করেছিলেন।

আল্লাহর ইচ্ছায় সে সন্তান পানিতে ডুবে মরেনি। প্রাপ্তবয়স্ক সাঁতার জানা মানুষের কেউ কেউ যেখানে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন সেখানে অবুঝ ও জীবন থেকে নিক্ষিপ্ত এ শিশুটির জীবন বাঁচানোর ব্যবস্থা আল্লাহ করে দিয়েছেন। আরেক ডুবন্ত যাত্রীর সাঁতরে উঠার সময় তার মনে ঢেলে দিয়েছেন শিশুটিকে রক্ষার আবেগ। আবুল হোসেনের হাতে শিশু রেদোয়ানের জীবন এভাবে পাড়ে উঠিয়ে আনলেন তিনিই। খোদায়ী কারিশমার এ এক অনন্য নিদর্শন। অথৈ পানিতে ফেলে দেওয়া সন্তান এভাবে আবারো খুঁজে পেল এক সাগর অনুশোচনায় দগ্ধ তার মায়ের কোল।

আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছেন বলেই শিশুটিকে আবারো ফিরে পেয়েছেন মা। কিন্তু এ ঘটনায় এ কঠোর সত্য ফুটে উঠলো যে, আপনা জান বাঁচানোর তীব্র অসহায় আকুতির সময় মানুষের সামনে কঠোর ও নির্মম এক জগতের দৃশ্য রচিত হয়। সেটা এই মায়াময় দুনিয়াতেই হয়। ছোট অতি ছোট কেয়ামতের সময়েই হয়। তাই আসল কেয়ামতের সময় এমন ঘটনা ঘটা প্রচন্ড প্রাসঙ্গিক। ঘটবেই। পবিত্র কুরআন তো তাই বলেছে। এজন্য দুনিয়ার মায়ার ভুবনেই সবার পরকালীন আপন ভুবনটি নিরাপদ করার চেষ্টায় কাল বিলম্ব না করা উচিত। 

 

advertisement