Jumadal Ula 1429   ||   May 2008

সং ক ট :অভাবের দিনে নিরন্নের পাশে দাঁড়ানো দায়িত্ব

Khasru Khan

দুর্ভিক্ষ কি সরব নাকি নীরব কোন্ভাবে চলছে এ নিয়ে উঁচু মহলে একটি তর্ক চলছে। তর্কের খবর পত্রিকার পাতাতেও আসছে। এক উপদেষ্টা তো রীতিমতো প্রশ্ন রেখেছেন, খাদ্যাভাবে একজন-দুজন নাকি শত শত লোকের মৃত্যু হলে তাকে দুর্ভিক্ষ বলা যাবে? দুর্ভিক্ষের সংজ্ঞা নিয়ে এই যখন তর্কের ধরন তখন নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অভাব, ক্ষুধা ও কুল-কিনারাহীন দারিদ্রে্যর ঝড়। এ ঝড়ে বহু মানুষ পঙ্গুর মতো কুঁজো হয়ে গেছেন। কেউ কেউ ঝরেই পড়েছেন দুনিয়ার বাগান থেকে।

 

গত ৬ এপ্রিল দৈনিক ইনকিলাবের শেষ পৃষ্ঠায় খবর বেরিয়েছে এক পিতার আত্মহত্যার। ঘটনার বিবরণে দেখা যাচ্ছে, শিশুপুত্রের ক্ষুধার কান্না সহ্য করতে না পেরে রিকশাচালক পিতা এয়াকুব মিয়া ভোরে আত্মহত্যা করেছেন। ৬ সদস্যের পরিবারের খাবারের জোগান দিতে না পেরে চৌদ্দগ্রামের ললীশ্বর গ্রামের ওই রিকশাচালক দুঃখ ও যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। আগের দিন রাতে ৪ বছরের শিশু ক্ষুধার জ্বালায় চিৎকার করে কাঁদছিল। কিন্তু রিকশাচালক পিতা তার ক্ষুধা নিবারণে কোনো বিহিত করতে পারেননি।

 

তার অক্ষমতা ও হতাশা তখন চরম রূপ ধারণ করে। পরদিন ভোরে পার্শবর্তী ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে একটি জাম গাছের ডালে গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় ঝুলন্ত এয়াকুবকে উদ্ধার করা হয়। ততক্ষণে তিনি মৃত। এ ঘটনা এবং ঘটনাটির এই শেষ দৃশ্য বহু মানুষের চোখের পানি ঝরিয়েছে। মরহুম এয়াকুব মিয়ার স্ত্রী কাজল বেগমের আহাজারিতে কারো চোখের পানি বাঁধ মানেনি।

খাদ্যের সংকট ও বহুগুণ মূল্যবৃদ্ধি আজ দেশের বহু দরিদ্র মানুষকে এরকম হতাশার চোরাকাদার কাছাকাছি নিয়ে পৌঁছিয়েছে। এপ্রিল মাস জুড়েই বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় নিরন্ন, অর্ধহারে অভ্যস্ত, বাধ্য হয়ে অভুক্ত থাকার সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে ও হচ্ছে। প্রতিবেদনগুলো পড়লেই বোঝা যায় খাদ্যাভাবে দুঃখী মানুষদের এসব চিত্র দূরের কোনো চিত্র নয়, একদম সমাজের ভেতরে মিশে থাকা নগর-শহর-গ্রামের লাখো মানুষের এক মেঘাচ্ছন্ন চিত্র এসব। গত কয়েকদিনে এধরনের আরো কয়েকটি আত্নহত্যার খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। দরিদ্র, হতদরিদ্র মানুষ কতটা বিপন্ন হলে জীবনের সমাপ্তি টানার মতো প্রান্তিক পথে পা বাড়াতে পারেন -সমাজের সক্ষম,সচ্ছল মানুষেরা সেটি নিয়ে যদি একটু ভাবতেন ভালো হত।

 খাদ্যের সংকট, খাদ্যের অতিমূল্যবৃদ্ধির পিছনে আন্তর্জাতিক বাজারের উর্ধ্বগতি,সুব্যবস্থার অভাব কিংবা ফসল কম হওয়াসহ যেসব বাহ্যিক কার্যকারণের কথাই সামনে আসুক, একথা মিথ্যা নয় যে, এরপরও এদেশে লাখ লাখ পরিবারের খাবারটেবিলে উপচে পড়া খাবারের আয়োজন থাকে। অপচয় হয়। ওএমএসের চালের লাইনের পাশ দিয়ে মুহুর্মুহু ছুটে যায় ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা দামের পাজেরো ,নোয়াহ, করল্লা। সুখী বিত্তবান মানুষের উল্লাস ও হৈ চৈয়ে চাপা পড়ে যায় দুঃখী অভাবী মানুষের ফ্যাকাশে মুখের চাপা স্বর, একটু সাহায্যের আবেদন-আহবান। একটি সুস্থ সমাজের তো এটি লক্ষণ হতে পারে না। এই স্বার্থপর নির্বিকারত্ব নিয়ে দুনিয়াতেই বা আমরা কিভাবে ভালো থাকব?

অভাবী-নিরন্ন মানুষের মুখে, অভাবী পরিবারগুলোর শিশু ও বৃদ্ধদের মুখে, ঘরে অবস্থানকারী লজ্জাশীল নারীদের মুখে খাবারের দুটি গ্রাস তুলে দেওয়ার জন্য যে বৃহত্তর রাষ্ট্রীয়-সামাজিক দায়িত্বের বন্ধনে ঈমান আমাদের বেঁধে রেখেছে সে বন্ধন ছিঁড়ে ফেলে দিলে আমাদের আর কী থাকে? চরম হতাশায় আত্নহত্যা বা আত্মবিনাশের অন্য কোনো পথে যাওয়ার আগেই চলুন কোটি মানুষের অভাবের দুঃখ ঘোচাতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগে খাদ্যের দুটি দানা নিয়ে আমরাও নানাভাবে অভাবী মানুষের পাশে পাশে দাঁড়াই। নৈতিক ও ঈমানী দায়িত্বের পাশাপাশি মানবিকতার এই আবেদন অস্বীকার করা যায় না। 

 

advertisement