Jumadal Ula 1429   ||   May 2008

আমরা তৃপ্ত তারা ক্ষুধার্ত

মুহাম্মাদ জাহিদুল ইসলাম

দেশে এখন গরীব-দুঃখীদের দুর্দিন। হাজার হাজার মানুষ অর্ধাহারে, অনাহারে কোনো রকম দিন কাটাচ্ছে। অনেকে ভিটা-বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে ফেলছে। ক্ষুধার দুর্বিষহ যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে একই পরিবারের ছয়জন একসাথে আত্মহত্যা করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। অভাবের তাড়নায় নিরুপায় হয়ে গভীর রাতে নিজের তিন সন্তানকে জীবিত কবর দেওয়ার চেষ্টা করার সংবাদও তো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের কথা হল আমাদের অনেকেই বিষয়টা আঁচ করতে পারছেন না বা করছেন না। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, দুর্ভিক্ষের কথা স্বীকার করতেই চাচ্ছেন না কেউ কেউ। না খেয়ে কিছু মানুষ মারা গেলে না কি দুর্ভিক্ষ হয় না!! দুর্ভিক্ষ হতে হলে অনাহারে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে হয়!! দু-চারজন মারা গেলে দুর্ভিক্ষ হবেই বা কেন? যারা মারা যায় ওরা তো উচুঁশ্রেণীর কেউ না। এরা তো সেই দরিদ্র পরিবারের প্রাণী। ওরা মারা গেলে দেশের আর কী আসে যায়। কেউ   কেউ আড়তে গিয়ে বস্তা বস্তা চাল দেখে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েছেন যে, দেশে চালের কোনো সংকট নেই!

 

অন্য একজন মার্কেটে দামী দামী জিনিসপত্র ও বিলাস সামগ্রী বিক্রি হতে দেখে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, দেশে কেনো অভাব নেই!

 

তারা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো বলছেন বা এর পিছনে কোনো রহস্য লুকায়িত আছে কি না তা উদঘাটনের অভিপ্রায় আমার নেই। তবে দেশে চাল নেই, চাল পাওয়া যাচ্ছে না- এমন কথা এ পর্যন্ত কেউ বলেনি। চাল আগে ছিল এখনো আছে। পার্থক্য শুধু আগে যে চাল ১৫/২০ টাকায় পাওয়া যেত এখন সেগুলো ৩৫/৪০ টাকা দিয়ে ক্রয় করতে হচ্ছে। কেউ পারছে কেউ পারছে না। যারা পারছে না তারা সকলে না খেয়ে আছে তা বলছি না। কেউ একবেলা, কেউ আধবেলা, কেউ আধ পেট খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। আবার চাল ক্রয়ের জন্য কেউ ভিটাবাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছে।

তেমনিভাবে মার্কেটের দামী দামী পণ্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে একথাও অসত্য নয়। তবে এগুলো যারা ক্রয় করছে তারা দেশের সকল কিংবা অধিকাংশ জনগণ নয়। তারা দেশের একটি শ্রেণী মাত্র। যাদের জন্য চালের দাম ১০০ টাকা হলেও কোনো সমস্যা নেই। এ শ্রেণীর লোকদের সংখ্যা অনেক হলেও অন্যদের তুলনায় খুবই কম। দেশে তো কোটি টাকার গাড়ি চড়ার লোকদের সংখ্যাও অনেক। অথচ পেটে ক্ষুধা নিয়ে, প্রখর রোদের মাঝে মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়ে উত্তপ্ত পথ পাড়ি দেওয়া কঙ্কালসার লোকদের সংখ্যাও কম নয়। যে দেশে ফাইভস্টার হোটেল, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, কমিউিনিটি সেন্টার ইত্যাদিতে দামী দামী সুস্বাদু খাবার অর্ধভোজান্তে ফেলে দেওয়ার লোকদের সংখ্যা প্রচুর সে দেশেই একবেলা ডাল-ভাত খেতে পারছে না এমন অসহায়ের পরিমাণও খুব নগণ্য নয়।

ইসলাম এমন দৃশ্য কখনো পছন্দ করেনি। সব সময়ই এমন অবস্থার কঠোর নিন্দা করে আসছে। তবে ধনী-গরীবের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকবে না, সবাই সমান হবে ইসলাম এমন কথা বলেনি বরং জীবিকার ক্ষেত্রে মানুষের পার্থক্যের এ চিরন্তন বিধান দ্ব্যর্থহীনভাবে মেনে নিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আমিই তাদের মাঝে তাদের জীবিকা বণ্টন করেছি এবং এক্ষেত্রে একজনকে অন্যজনের উপর প্রাধান্য দিয়েছি। -সূরা যুখরুফ ৩২

ইসলামের নির্দেশনা হল একটা ইনসাফ-ভিত্তিক সহানুভূতিশীল সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে কমপক্ষে সমাজের প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের ন্যূনতম ব্যবস্থা থাকবে। একজন না খেয়ে থাকলে অন্যজন তার খাবারের ব্যবস্থা করবে। কেউ বিপদে পড়লে অন্যরা সাহায্য করবে। 

 

দুর্ভিক্ষের মুহূর্তে ইসলামের নির্দেশনা

এ ধরনের চরম অভাব-অনটনের সময় ইসলামের নীতিতে পরিচালিত সরকারের দায়িত্ব হল কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা। প্রয়োজনে অন্নহীনদের জন্য অন্ন, বস্ত্রহীনদের জন্য বস্ত্র ও গৃহহীনদের জন্য গৃহের ব্যবস্থা করা। যাদের যেমন সামর্থ আছে সে অনুপাতে কমমূল্যে এগুলো সরবরাহ করা। যাদের কোনো সামর্থ নেই তাদেরকে এ সমস্ত সুবিধা বিনামূল্যে প্রদান করা।

সরকার ছাড়া আর যাদের উপর এ দায়িত্ব বর্তায় তারা হল সমাজের সকল সামর্থবান ব্যক্তি।

 

প্রথম নিকটবর্তী সমাজ তথা পাড়াপ্রতিবেশী। তারা এ দায়িত্ব পালন না করলে বা অক্ষম হলে পরবর্তী নিকটবর্তী সমাজের উপর দায়িত্ব আসবে। এমনিভাবে পর্যায়ক্রমে সমাজগুলোর উপর এ দায়িত্ব বর্তাবে। ধনীরা যাকাত-সদকার পাশাপাশি দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী এতীম-অসহায় ও বিধবাদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। যাদের অর্থ নেই তারা শ্রম দিয়ে সংকট দূর করার চেষ্টা করবে। যারা এককভাবে কিছু করার সামর্থ রাখে না তারা সম্মিলিতভাবে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

 

এ দেশে দরিদ্রের সংখ্যা অনেক হলেও সম্পদশালীদের সংখ্যাও কম নয়। তারা যদি নিজেদের অপচয় কিছুটা কমিয়ে, অনর্থক বিলাসিতার পরিধি কিছুটা সীমিত করে এ অর্থটা দেশের অনাহারে ক্লিষ্ট গরীব-দুঃখীদেরকে দিয়ে দেয়, তাহলে অনায়েশে এরা খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে। অথচ বিত্তবানের বিলাসিতায় তেমন কোনো ঘাটতি দেখা দিবে না। কমপক্ষে ফরয যাকাত-সদকাটাও যদি আদায় করে দেয় তাহলেও দরিদ্রের ক্ষুধা অনেকটা কমে যাবে। বিনিময়ে সম্পদশালীরা কঠিন শাস্তির হাত থেকে বেঁচে যাবে এবং লাভ করবে অগণিত নেকী ও আল্লাহর সন্তুষ্টি।

ইসলাম এমন একটা ইনসাফ-ভিত্তিক সহানুভূতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জোর তাগিদ দিয়েছে। কুরআন ও হাদীসে বিভিন্ন ভঙ্গিতে এর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

 

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, সৎকর্ম শুধু পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করার নাম নয়; বরং বড় সৎকর্ম হল, আল্লাহ তাআলা, পরকাল, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব ও সমস্ত নবী-রাসূলগণের উপর ঈমান আনয়ন করা। আর আল্লাহর   মুহাববতে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির, ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য সম্পদ ব্যয় করা। -সূরা বাকারা ১৭৭

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, সে ধর্মের ঘাটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি কি জানেন সে ঘাটি কী? তা হচ্ছে, দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান, এতীম আত্মীয়কে কিংবা ধুলি-ধুসরিত মিসকীনকে। -সূরা বালাদ ১১-১৬

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কসম ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, আল্লাহর কসম ঐ ব্যক্তি মুমিন হতে পারে না; যে তৃপ্তির সাথে পেট ভরে ভক্ষণ করে অথচ প্রতিবেশী ক্ষুধার কষ্ট ভোগ করে। -তবারানী, কাবীর হাদীস ৭৫১

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আবু যার! যখন তুমি ঝোল-তরকারী রান্না কর তখন কিছুটা পানি বাড়িয়ে দাও। অতঃপর সেখান থেকে কিছু অংশ তোমার প্রতিবেশীদের ঘরে পাঠিয়ে দাও। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬২৫

অন্য এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, এতীম ও বিধবাদেরকে রক্ষণাবেক্ষণকারীরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মতো। -সহীহ বুখারী হাদীস ৫৩৫৩, সহীহ মুসলিম হাদীস ২৯৮২

এ সমস্ত নির্দেশনার সাথে সাথে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, দেখ দান করে মনে কর না যে, আমরা তাদের উপর অনুগ্রহ করছি; বরং এটা তোমাদের সম্পদে তাদের পাওনা অধিকার, যা আদায় করে দেওয়া তোমাদের কর্তব্য। সুতরাং করুণা নয়, দায়িত্ব পালন মাত্র।

এ ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের অধিকার রয়েছে। -সূরা যারিয়াত ১৯

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ফল (ফসল) কর্তনের সময় তার হক দিয়ে দাও। -সূরা আনআম ১৪১

এই আয়াতে যাদের জমি নেই বা চাষাবাদ করার ব্যবস্থা নেই ফল-ফসল কাটার সময় তাদেরকে একটা অংশ দিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সম্পদের মধ্যে যাকাত ছাড়া আরো হক রয়েছে। -তিরমিযী হাদীস, ৬৫৯

শুধু হক আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে তাই নয়, বরং এ হক আদায় না করলে আখেরাতে জবাবদিহি করতে হবে এবং কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে সে বিষয়ে কঠিন হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা আল্লাহর রাস্তায় খরচ না করে ধন-সম্পদ পুঞ্জিভূত করে রাখে তাদেরকে কঠোর শাস্তির কথা শুনিয়ে দিন। সূরা তাওবা ৩৪

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, যারা আল্লাহর অনুগ্রহে পাওয়া সম্পদের ক্ষেত্রে কৃপণতা করে তারা যেন এই কৃপণতাকে নিজেদের জন্য মঙ্গলজনক মনে না করে। বরং এটা তাদের জন্য নিতান্তই ক্ষতিকর। কিয়ামতের দিনে এ সমস্ত সম্পদকে বেড়ী বানিয়ে তাদের গলায় পরিয়ে দেওয়া হবে। -সূরা আলে ইমরান ১৮০

হাদীসে কুদসীতে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, তুমি আমার শুশ্রূষা করনি। সে বলবে, হে প্রভু! আপনি বিশ্বজগতের অধিপতি, আমি কিভাবে আপনার শুশ্রূষা করবো। আল্লাহ বলবেন কেন, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল তুমি তার শুশ্রূষা করনি। তুমি তার শুশ্রূষা করলে সেখানে আমাকে পেতে। আবার বলবেন, হে আদম সন্তান আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে খাবার দাওনি। সে বলবে, হে প্রভু! আপনি সমস্ত জগতের প্রতিপালক।

আমি কিভাবে আপনাকে খাওয়াবো। আল্লাহ বলবেন, কেন? আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল। তুমি তাকে খাবার দাওনি। তুমি যদি তাকে খাবার দিতে তাহলে আজ তার প্রতিদান পেতে।

 

তৃতীয়বার বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে পানি দাওনি। সে বলবে, প্রভু!  আপনি বিশ্বজগতের নিয়ন্তা, আমি কিভাবে আপনাকে পানি পান করাব। তখন আল্লাহ বলবেন, কেন? আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তাকে পানি দাওনি। সেদিন তাকে পানি দিলে তার প্রতিদান পেয়ে যেতে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৬৯

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলোতে দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে, ফযীলতের কথা শুনিয়ে ও ভীতি প্রদর্শন করে সমাজকে দরিদ্র ও অসহায়ের প্রতি সহানভূতিশীল হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে সমাজ বিলাসিতায় বিভোর হয়ে তাদের কথা ভুলে না যায়।

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণের আমল : 

অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এক্ষেত্রেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন। অসহায়ের সহায় হওয়া, সম্বলহীনের সম্বলের ব্যবস্থা করা, বিপদ ও দুর্যোগে পতিত ব্যক্তির সাহায্য-সহযোগিতা করা, এগুলো ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত ও সাধারণ অভ্যাস। যারা তার সাহচর্যে ধন্য হয়েছিলেন তারাও ছিলেন এই গুণের অধিকারী।

যখন নবী করীম সা. হেরা-গুহায় জিবরাইলের আলিঙ্গন ও নবুওয়াত প্রাপ্তির পর নব দায়িত্বের চিন্তায় পেরেশান হয়ে গৃহে ফিরে এলেন তখন আম্মাজান খাদীজা রা. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ করে বললেন, আল্লাহর কসম! কখনো তিনি আপনাকে বিব্রত করবেন না। কেননা আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, সত্য বলেন, অসহায়ের ভার বহন করেন, নিঃস্বদের জীবিকার ব্যবস্থা করেন। মেহমানের সেবা করেন বিপদ ও দুর্যোগের সময় সাহায্য করেন। -সহীহ বুখারী হাদীস ৩, ৬৯৮২

তেমনিভাবে আবু বকর রা. সম্পর্কে একই ধরনের উক্তি করেছিলেন ইবনে দাগিনা উপনামের এক কাফের সরদার যখন আবু বকর রা. মক্কার কুরাইশদের নির্যাতনে অস্থির হয়ে হাবশায় হিজরত করছিলেন তখন বারকুল গিমাদ নামক স্থানে ইবনে দাগিনার সাথে সাক্ষাত হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আবু বকর কোথায় যাও? আবু বকর রা. বললেন, আমার সম্প্রদায় আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। তাই ইচ্ছা করেছি যমীনে যাযাবর হয়ে থাকবো এবং প্রভুর ইবাদত করবো। ইবনে দাগিনা বলল, তুমি দেশ ছেড়ে চলে যাবে বা তোমাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে তা হতে পারে না। কেননা, তুমি তো আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ, মেহমানের সেবা করা, নিঃস্বের জীবিকার ব্যবস্থা কর, অসহায়ের ভার বহন কর ও বিপদ ও দুর্যোগে সাহায্য কর। -সহীহ বুখারী হাদীস ২২৯৭, ৩৯০৫

এ ধরনের হাজারও দৃষ্টান্ত আজও হাদীস ও ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। হাদীস ও ইতিহাসের সেই স্বর্ণপাতাগুলো থেকে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি :

ক. এক বছর লোকেরা দুর্ভিক্ষে পতিত হয়েছিল। তখন গ্রাম থেকে অভাবী লোকেরা মদীনায় ছুটে আসত। সে সময়গুলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষে নির্দেশ দিতেন প্রত্যেকেই সামর্থ অনুযায়ী লোক নিয়ে নাও। তখন কেউ একজন, কেউ দুজন, কেউ তিনজন করে লোক নিয়ে যেতেন। বাকী যারা থাকত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। -তবারানী, হায়াতুত সাহাবা ২ : ৫১

যাদের সামর্থ্য আছে শুধু তারাই নিতেন তা নয়; বরং যারা ঘরে একজনের খাবার আছে এমন অনেক সাহাবীও মেহমান নিয়ে যেতেন এবং ঘরের সব খাবার মেহমানকে দিয়ে নিজেরা এমন ভান করতেন, যেন গৃহাভ্যন্তরে তারা খানা খাচ্ছেন। -সহীহ বুখারী ৪৮৮৯

খ. হযরত হারিছ ইবনে হিশাম রা. ও ইকরিমা ইবনে আবু জাহাল রা. এর ঘটনা তো সর্বজন বিদিত। ইয়ারমুকের যুদ্ধের সময় মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে পিপাসায় কাতর হয়ে পানির পেয়ালা মুখে দিবেন এমন সময় অন্যের পিপাসার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নিজে পান না করে অন্যকে দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এক নযীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তাঁরা দুজনই একে একে এই আচরণ করলেন এবং পানি পান ছাড়াই দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। -মুসতাদরাক হাকেম, হাদীস ৫১০৩

 

তাদের ত্যাগের এ আচরণগুলো পবিত্র কুরআনে সংক্ষেপে এভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, তারা ক্ষুধার্ত হলেও অন্যদেরকে নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দান করে। -সূরা হাশর ৯

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। আর বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি। তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান কিংবা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। -সূরা দাহর ৮-৯

গ. উতবা ইবনে ফারহাক রা. বলেছেন, একদা আমি খুরমা ও ঘী দিয়ে তৈরি কিছু হালুয়ার প্যাকেট নিয়ে উমার রা.-এর কাছে উপস্থিত হলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন এটা কী? বললাম কিছু হালুয়া। আপনার জন্য এনেছি। সারাদিন মানুষের কাজে ব্যস্ত থেকে যখন ক্লান্ত হয়ে যাবেন তখন এখান থেকে কিছু খেয়ে নিলে ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। তখন উমার রা. একটা প্যাকেট খুলে জিজ্ঞেস করলেন প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কি একটি করে প্যাকেটের ব্যবস্থা করেছ? বললাম, আমীরুল মুমিনীন কায়স গোত্রের সব সম্পদ ব্যয় করলেও তা যথেষ্ট হবে না। তখন তিনি বললেন, তাহলে আমার এটার কোনো প্রয়োজন নেই।

 

তারপর শুকনো রুটি ও শক্ত গোশতের একটা পাত্র আনিয়ে তিনি খুব তৃপ্তির সাথে খেতে লাগলেন। আমি চুঁটের গোশত মনে করে একটা শুভ্র টুকরা তুলে নিলাম। অথচ সেটা ছিল রগের টুকরা। অনেক চিবিয়েও সেটাকে কাবু করতে না পেরে উমারের চোখ ফাঁকি দিয়ে পেয়ালার নিচে রেখে দিলাম। অতঃপর একটা নাবীযের পেয়ালা এনে বললেন পান কর। নাবীয তো না, যেন সিরকা। অনেক ধস্তাধস্তি করে তা গলার নিচে পৌঁছাতে পারলাম না। তখন তিনি আমার হাত থেকে পেয়ালাটা নিয়ে তৃপ্তির সাথে পান করলেন। তারপর বললেন, উতবা শোন, আমাদের এখানে প্রতিদিন কয়েকটা উট জবাই করা হয়। সেগুলোর চর্বিযুক্ত ভালো ভালো গোশতগুলো দেওয়া হয় দূর দূরান্ত থেকে আগত মুসলমানদেরকে। আর গলার শক্তগুলো থাকে উমারের পরিবারের জন্য। -হানাদ, হায়াতুস সাহাবা ২ : ১১৫

আর নিজ মাথায় করে এতীম ও বিধবাদের দুয়ারে জীবিকা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে উমার-এর কৃতিত্ব তো সুপ্রসিদ্ধ।

 

ধনী ভাইদের উদ্দেশ্যে

সব শেষে একটি আরয- ভায়েরা! দয়া করে একটি বিষয়ে চিন্তা করে দেখুন। আপদের এ সম্পদের পাহাড় কিন্তু এমনি এমনিই গড়ে উঠেনি। এর পেছনে গরীব-অসহায়দের অনেক অবদান রয়েছে। আপনাদের গাড়ি-বাড়ি কল-কারখানা সব কিছুর পেছনেই তাদের অক্লান্ত শ্রম রয়েছে। আপনারা নিজ হাতে একটা চাকাও কি লাগিয়েছেন? একটা ইটও কি কখনো উঠিয়েছেন? একটা মেশিনও কি কখনো চালিয়েছেন? আপনাদের এ সমস্ত কাজে তারাই বিরামহীনভাবে করে যাচ্ছে। আপনাদের এত ধন-সম্পদ এ গরীব শ্রেণী থাকার কারণেই হয়েছে। রক্ত পানি করে সভ্যতার ঘানি ঘুরিয়ে যারা সভ্যতার এমন উৎকর্ষ সাধন করেছে তাদের পেটে আজ ভাত নেই। তারা ক্ষুধার্ত, আমরা তৃপ্ত! এক লোকমা খাবারের জন্য তারা হাত পেতে রয়েছে। তাদের এ হাতগুলো কি খালি ফিরিয়ে দেওয়া হবে?

 

ঈমানী দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতা যদি আমাদের বিবেককে তাড়া না করে, তাহলে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য হলেও গরীবদের সহযোগিতায় আমাদের এগিয়ে আসা এবং তাদের জন্য অন্ন বস্ত্রের ব্যবস্থা করা উচিত। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন। #

 

advertisement