Jumadal Akhirah 1429   ||   June 2008

কোমলতা সৌন্দর্য আনে

 

গত ইংরেজি মাসটি ছিল মে মাস। এ মাসে যে বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হয় তা হল শ্রমিকের অধিকার। এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। শ্রমজীবী মানুষের উপর যন্ত্রসভ্যতার শোষণ-নির্যাতনের ইতিহাস এবং অধিকার আদায়ে শ্রমিক শ্রেণীর দীর্ঘ সংগ্রাম-আন্দোলনের আলেখ্য অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় উপস্থাপিত হয়। সমাজের উচ্চ পর্যায় থেকে আসে বক্তৃতা, বিবৃতি ও বাণী। এগুলোই মে মাসের কার্যক্রম। মে মাস গত হয়েছে, তারও আগে বিগত হয়েছে পয়লা মে। প্রচলিত ধারা অনুযায়ী শ্রম ও শ্রমিক বিষয়ে আলোচনার মওসুম আর নেই! কিন্তু এ নিবন্ধে যেহেতু এবিষয়েই কিছু লিখতে চাচ্ছি তাই এ বিনামওসুমী আলোচনার কারণটা আগে বলে নিই।

গত ৮ মে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংক্ষেপে তার বিবরণ হচ্ছে- লিপি নামে ৭ বছরের একটি মেয়ে ময়মনসিংহের ফুলপুরে এক বাসায় কাজ করত। গত ৭ মে তাকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। শিশুটির উপর চরম নির্যাতন করা হয়েছে। তার শরীরে এমন কোনো স্থান নেই যেখানে গরম লোহার ছ্যাকা দেওয়া হয়নি।

এ কাজকে কী বলা হবে? মধ্যযুগীয় বর্বরতা? কিন্তু এটা যে ঘটেছে একেবারে সভ্যযুগে, সভ্য মানুষ দ্বারা!

এ কন্যা শিশুটির উপর এমন অমানবিক নির্যাতনে যিনি অভিযুক্ত হয়েছেন তিনি একজন নারী। তিনি হালুয়াঘাট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন! সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ৮ মে ২০০৮

সত্যি কথা এই যে, নাম-পরিচয়ে মুসলিম হলেও ইসলামী আদর্শ ও সভ্যতা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গিয়েছি। ফলে মানবতা ও মনুষ্যত্বও আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। একজন মুসলিমের পক্ষে এমন হিংস্র আচরণ কোনো ভাবেই সম্ভব হতে পারে না। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমের পরিচয় এভাবে দিয়েছেন- মুসলিম সে যার হাত ও মুখ থেকে অন্য সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে। অন্য হাদীসে এসেছে- মুমিন সে যার পক্ষ থেকে সকল মানুষ নিরাপদ থাকে।

জুলুম ও অত্যাচার থেকে বিরত থাকা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বে আরাফার ময়দানের বিদায়ী খুৎবায় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সাবধান। তোমাদের প্রত্যেকের রক্ত, প্রত্যেকের সম্পদ অন্যের জন্য এমনই সংরক্ষিত যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর।

বলাবাহুল্য, সেই দিনটি ছিল আরাফার দিন। মাসটি ছিল জিলহজ্ব ও স্থানটি ছিল আরাফার মুবারক ময়দান। এই স্থান-কালের মাহাত্ম ও মর্যাদা ছিল আরবজাতির চেতনার অংশ। যুগ যুগ ধরে তারা চেতনার গভীরে একে লালন করত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমের রক্ত ও সম্পদের মর্যাদাকেও মুসলিম-চেতনার অংশ বানিয়ে দিয়েছিলেন। এটাই হচ্ছে মুসলমানিত্ব। মুসলিমের শাশ্বত পরিচয়।

ইসলামের এই যে মূলনীতি তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে শ্রমজীবী ও অধীন মানুষেরা। তারাও এ মূলনীতির আওতাভুক্ত। তাদেরও রক্ত ও সম্পদ একই রকম মর্যাদাপূর্ণ ও সংরক্ষিত। কিন্তু যেহেতু তারা অধীন, তাদের হক্ব বিনষ্ট করা হতে পারে, কেউ তাদের প্রতি জুলুম-অত্যাচার করতে পারে এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের প্রসঙ্গে বিশেষভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং এ বিষয়ে তাঁর         সাহাবীদের বিশেষ তরবিয়ত করেছেন।

হযরত আবু মাসউদ রা. বলেন, একদিন আমি গোলামকে প্রহার করছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, হে আবু মাসউদ, তুমি এর উপর যতটুকু ক্ষমতাশালী, আল্লাহ তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী তোমার উপর।

আমি চমকে ওঠে পিছনে তাকিয়ে দেখি, স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি অনুতপ্ত হয়ে বললাম ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি একে আযাদ করে দিলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি যদি তা না করতে তবে আগুন তোমায় ঝলসে দিত।

এক কবি বলেছেন এবং যথার্থই বলেছেন- বেতরছ আয আহে মাযলুমাঁ কে হাংগামে দুআ করদান

ইজাবত আয দারে হক বাহরে         ইস্তেকবাল মী আয়াদ।

অর্থাৎ অত্যাচারিতের আহ কে ভয় করো, কেননা সে যখন ফরিয়াদের জন্য হাত ওঠায় তখন আল্লাহর দরবার থেকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তা গ্রহণ করা হয়।

অনেক সময় আমাদের বুঝে আসে না, জীবনে আমার এত কষ্ট কেন? কেন এত বিপদ-আপদ? এই প্রশ্ন যখন আসে তখন একবার আমাদের কর্মের ফিরিস্তির দিকেও নজর ফেরানো উচিত বৈ কি।

নবীযুগের আরেকটি ঘটনা। এক সাহাবী এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন,ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা কতবার খাদেমকে ক্ষমা করব? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো উত্তর দিলেন না। সাহাবী আবার ওই প্রশ্ন করলেন। নবীজী এবারও উত্তর দিলেন না। তৃতীয়বার প্রশ্নের পর বললেন, প্রতিদিন সত্তর বার ক্ষমা করবে।

এই হাদীসের তাৎপর্য কী? কেন নবীজী অধীন লোকদের শুধু বারবার ক্ষমাই করতে বলছেন। খুব সহজেই যে বিষয়টি আমাদের বুঝে আসে তা এই যে, অধীনদেরকে শাস্তি দিতে গেলে মাত্রাজ্ঞান ঠিক রাখা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। আর যেহেতু সে অধীন, তাই শাস্তি দেওয়ার প্রেরণাটাই জেগে ওঠে সবার আগে। এই পাশবিক প্রেরণাকে দুর্বল ও নিয়ন্ত্রিত করার উত্তম উপায় আর কী হতে পারে বারবার ক্ষমা করে দেওয়ার অনুশীলন ছাড়া।

কাজের মেয়েটি গ্লাস ভেঙ্গে ফেলেছে? ক্ষমা করে দিন। ডালের বাটি উল্টে ফেলেছে? ক্ষমা করে দিন। বিছানায় পেশাব করে দিয়েছে? ক্ষমা করে দিন।   না বলে  কিছু খেয়ে ফেলেছে? ক্ষমা করে দিন। এমনকি মুখে মুখে তর্ক করেছে? তবুও ক্ষমা করে দিন। দিনে কতবার ক্ষমা করবেন? সত্তর বার। বারবার। এতে ক্ষমাগ্রহণকারীর উপকার যতটুকু, তার চেয়ে অনেক বেশি উপকার স্বয়ং ক্ষমাকারীর।

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাদাকা দ্বারা  সম্পদ হ্রাস পায় না। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে নিজেকে ছোট করে আল্লাহ তাকে বড় করে দেন। আর ক্ষমার মাধ্যমে আল্লাহ শুধু বান্দার মর্যাদাই বৃদ্ধি করেন।

সবশেষে একটি তাৎপর্যপূর্ণ  ঘটনা উল্লেখ করে আলোচনা শেষ করছি। 

 একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসে ছিলেন। এক ইয়াহুদী এসে সালামের মতো করে বলল - আসসামু আলাইকা! অর্থাৎ তোমার মরণ হোক! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সালামের জওয়াবের মতো করে বললেন-ওয়া আলাইকা অর্থাৎ তোমার উপর হোক! নবীর সঙ্গে শয়তানী করতে গিয়ে ইয়াহুদী নিজের কত বড় সর্বনাশ ডেকে আনল! যাই হোক, নবীজী প্রশান্ত বদনে বসে আছেন। আম্মাজান আয়েশা রা.ও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ইয়াহুদীর কথাটা লক্ষ করে ক্রুদ্ধ হয়ে গেলেন এবং তাকে ভৎর্সনা করতে লাগলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, আয়েশা,  শান্ত হও। তুমি কি লক্ষ করনি, আমি তাকে কী জওয়াব দিয়েছি?  সব বিষয়ে কোমলতা অবলম্বন করবে। কেননা যাতে কোমলতা আছে তা সৌন্দর্যমন্ডিত। আর যেখান থেকে কোমলতা সরিয়ে নেওয়া হয় তা কুৎসিত ও দোষযুক্ত।

উম্মুল মুমিনীনকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে উপদেশ দিয়েছেন তা তার সন্তানদের জন্যও অনুসরণীয়।

বর্তমান সভ্যতা আমাদের শিখিয়েছে ধনী, বিত্তশালী আর ক্লায়েন্ট ও কলিগদের সঙ্গে হাসিমুখে কোমল আচরণ করতে। কিন্তু ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন জীবনের সকল ক্ষেত্রে, সবার সঙ্গে কোমলতা অবলম্বন করতে। যেখানে কোনো স্বার্থ আছে সেখানেও, যেখানে স্বার্থ নেই সেখানেও। যেখানে কোমল আচরণ না করলে ক্ষতির আশঙ্কা সেখানেও, যেখানে কোনো ক্ষতির আশংকা নেই সেখানেও। তাই খন্ডিত সৌন্দর্য নয়, পূর্ণ সৌন্দর্যে যেন আমরা আলোকিত হই। আমাদের পরিচয় যেন হয় মমতা, কোমলতা ও ক্ষমাশীলতা।

 

 

advertisement